তিনি
গল্পকার নন, তিনি কবি। লিখেছেন কবিতার পর কবিতা। ‘বন্দীর বন্দনাতে’: ‘প্রবৃত্তির
অবিচ্ছেদ্যর কারাগারে চিরন্তন বন্দী করি রচেছো আমায়’, ‘প্রেমিক’ কবিতায়: ‘মোরে প্রেম দিতে চাও? প্রেমে মোর ভুলাইবে মন’? , ‘কঙ্কাবতী’ কবিতায়:
‘তোমার নামের শব্দ আমার কানে আর প্রাণে গানের মতো’ কিংবা, ‘আজ
মাঝরাতে ঠাণ্ডা বাতাস ছুটবে যখন, ঘুম ফেলে দিয়ে
তুমি চ’লে এসো এখানে, কেমন?’ কিংবা, আবার যখন লিখেন ‘এসো, ভুলে যাও তোমার সব
ভাবনা, তোমার টাকার ভাবনা, স্বাস্থ্যর ভাবনা, এর পর কী হবে,’ আবার লিখলেন
‘আটচল্লিশের শীতের জন্যঃ ১’ এর মতো কবিতা। স্থির থাকেননি, আবার লিখলেন ‘রাত্রি‘ কবিতায় ‘রাত্রি, প্রেয়সী আমার,
প্রসন্ন হও, নিদ্রা দিয়ো না’–এর মতো
কবিতা। লিখে উঠলেন কবিতার পর কবিতা। যে সকল কবিতা কোনো ভাব-বিশ্লেষণ নয়, বরং তাতে
প্রকাশ পায় অপার সৌন্দর্য। কবিতার
পাশাপাশি লিখলেন অসংখ্য প্রবন্ধ। ‘লেখার স্কুল’ , ‘কল্লোল ও দিনেশ রঞ্জনদাশ’, ‘জীবনানন্দ
দাশ’, তিনি লিখেছিলেন সুধীদ্রনাথের কবিতা নিয়েও। প্রবন্ধের পাশাপাশি আবার লিখলেন
বেশকিছু নাটক। ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’, ‘কালসন্ধা’, ‘অনাম্নী অঙ্গনা’, ‘প্রথম পার্থ’,
‘সংক্রান্তি’, প্রায়শ্চিত’ এ ছাড়াও থাকলো ‘অনুরাধা’ নামে আরও একটি নাটক। সাহিত্যর
সকল শাখায় উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ , আলোচনা, সমালোচনা
সব-ই লিখেছেন আপন মনে। ছোট গল্পেও হাত রাখলেন সমান ভাবে। বুদ্ধদেব বসু, ষোল-সতের
বছর বয়স থেকে ছোটো গল্প লিখতে শুরু করেন। সে সব গল্প সাময়িক পত্রে দু- একটি ক’রে
ছাপতে থাকেন। সেই সময়েই ‘কল্লোল’-এ প্রকাশিত হলো ‘রজনী হ’লো উতলা’ গল্পটি
(জ্যৈষ্ঠ,১৩৩৩)। গল্পের বিশেষ পটভূমিতে মৌলিক উপাদান থেকেও, উপজীব্য হ’য়ে দেখা দেয়
আত্মকথন প্রবাহতা। তাঁর রচিত গল্পতে একটি জিনিস স্পষ্ট হ’য়ে দেখা দেয়, তা হ’লো
গল্পের শরীর জুড়ে আত্মকথন। এই আত্মকথনই অনেক গল্পের প্রধান উপাদান হ’য়ে উঠে।
ত্রিশ-চল্লিশের দশকই বুদ্ধদেব বসুর গল্প রচনার উত্তম সময় বলে মনে করা হয়। চল্লিশের
মাঝামাঝিতে তাঁর গল্প রচনার স্রোত অনেকটা থেমে আসে। ১৯৫৫-এ প্রকাশিত তাঁর
‘স্বনির্বাচিত’ সংকলনটির ভূমিকায় তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁর গল্পগুলির রচনাকাল
(১৯৪৪-৪৬)-এর মধ্যে। বুদ্ধদেব বসুর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থটি দেখা দেয় অনেকগুলির
পুরনো লেখার সংকলনরূপে। পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে আবার দেখা দেয় নতুন গল্পের
সংকলন। ১৯৬১-তে ‘হৃদয়ের জাগরণ’ এবং ১৯৭২-এ প্রকাশিত হয় ‘প্রেমপত্র’ নামে
গল্পগ্রন্থগুলি। এর থেকে অনুমান করা যায়; তাঁর অধিকাংশ গল্প লেখা হ’য়ে গেছে ১৯৪৫-এর
সময়ের মধ্যে। ১৯৪৫- এ কলকাতার বেতার কর্তৃপক্ষ ‘আমার গল্প লেখা’ নামে একটি
বক্তৃতামালা প্রচার করেন। সমকালের অনেক লেখকের নিজের গল্প রচনা সম্পর্কে নানা কথা
তিনি সেখানে জানিয়েছিলেন। বুদ্ধদেব বসুর লেখায় নিজের চরিত্র নির্মাণের সবটাই তিনি
প্রকাশ করে দিয়েছেন। নিজেকে গোপন করার ইচ্ছা তাঁর কখনো ছিল না। নিজের গল্প সম্পর্কে
বুদ্ধদেব বসু আরো বলেন, ‘খুব সম্ভাব আমি স্বাভাবিক গল্পলেখক নই। আমার উদ্ভাবনী
শক্তি দুর্বল; ঘটনার চাইতে বর্ণনার দিকে আমার ঝোঁক, নাটকীয়তার চাইতে, স্বগতোক্তির
দিকে, উত্তেজনার চাইতে মনস্তত্ত্বের দিকে।’
বুদ্ধদেব বসুর গল্পের বিষয়বস্তুর মধ্যে প্রেমই প্রধান হ’য়ে দেখা দেয়। তাঁর
প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ অভিনয়, অভিনয় নয় ও অন্যান্য গল্প (১৯৩০)-এ প্রকাশিত হয়। ১৯৩২-এ
প্রকাশিত বুদ্ধদেব বসুর ‘এরা ওরা এবং আরো অনেকে’র গ্রন্থে সব গল্পগুলোই প্রেম
উপজীব্য হ’য়ে দেখা দেয়।
বুদ্ধদেব বসু লিখে উঠলেন গল্পের পর গল্প।
এক একটি গল্প যেন এক অজানা কাহিনীর স্তম্ভ। ‘জ্বর’, ‘প্রশ্ন’, ’বিরূপাক্ষ দেবের
কাহিনী’, ’তুলসী গন্ধ’, ‘এমিলিয়ার প্রেম’, ‘আমরা তিনজন’, ‘চোর ! চোর’, ‘ফেরিওলা’,
‘খাতার শেষ পাতা’, ‘একটি কি দুটি পাখি’, ’জয় জয়ন্তী’, ‘একটি লাল গোলাপ’, ’একটি
জীবন’, ‘আবছায়া’ এবং ‘রজনী হ’লো উতলা’ এর মতো গল্প। যে গল্প সমান স্বাক্ষর রাখে
একজন সু-সাহিত্যিকের। বুদ্ধদেব বসু; বাঙলা সাহিত্যয় নিজের জায়গা ক’রে নিয়েছিলেন
কবিতার মধ্যে দিয়ে। সমান ভাবে এগিয়েছেন ছোট গল্পেও।‘রজনী হ’লো উতলা’ বুদ্ধদেব বসুর
একটি অন্যতম গল্প। বুদ্ধদেব বসু; গল্পটি শুরু করেন ‘মেঘনার ঘোলা জল দিয়ে’; যদিও
মেঘনার এই ঘোলা জল বেশিক্ষণ স্থির থাকেনি। গল্পটিতে তিনি অবতরণ করিয়েছেন আধো
ছায়া-আধো অন্ধকার, যা গল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যায় সামনের দিকে। মেঘনার জলকে তিনি
দেখেছেন সৌন্দর্যময় দু’চোখ দিয়ে। মেঘনার রূপের বর্ণনা দেন এভাবেঃ ‘মেঘনার ঘোলা জল
চিরে স্টিমার সামনের দিকে চলছে; তার দুপাশের জল উঠচে, পড়চে দুলচে- তার পর ফেনা
হ’য়ে গড়িয়ে প’ড়ে যাচ্ছে, জলকন্যার নগ্ন দেহের মতো শুভ্র, দ্রাক্ষারসের মতো স্বচ্ছ।
একদিকে তরু পল্লবের নিবিড় শ্যামলিমা, অন্যদিকে দূরদিগন্ত রেখার অস্পষ্ট নীলিমা’। একটি গল্পের শুরু হলেও এর মধ্যে সুস্পষ্ট ভাবে রয়েছে
কবিতার ছাপ। কিছু শব্দকে না সরিয়ে এটাকে যদি বলি কোন গদ্য কবিতার রূপ তাহ’লে-ও হয়তো ভুল
হ’বে না। গল্পের কয়েকটি স্থানে কবিতার রূপ দেখি আরও গভীর ভাবে।‘জলকন্যার নগ্নদেহের
মতো শুভ্র’ ; ‘তরু পল্লবের নিবিড় শ্যামলিমা’ এবং ‘দূর দিগন্তরেখার অস্পষ্ট
নীলিমা’। এ-শব্দগুলোকে পঙক্তির পর পঙক্তি সাজালে হয়তো রূপ পাবে একটি অপরূপ কবিতার।
যা দেখে আমাদের আর মনে হবে না যে, এটি নেয়া হয়েছিল কোনো এক গল্পের অংশ থেকে; যা
ছিল শুধুই গল্প, কিন্তু কবিতার মতো ক’রে চয়ন করা হয়েছিল তার ভাষা। যে ভাষা
সম্পূর্ণ গদ্যর নয়; তার গায়ে ছাপ লেগেছিল
কবিতার অপরূপ সৌন্দর্যবোধের। যা রূপ পেতে পারতো একটি তাৎপর্যময় কবিতার। যে কবিতা হ’য়ে
উঠতো শুধুই কবিতা। অন্য কিছু নয়। এগোনো যাক গল্পের আরও একটু গভীরে।“এই মাত্র সূর্য
অস্ত গেলো। আমাদের সামনে পুব দিক-সন্ধ্যারানীর লাজনম্র রক্তাভ মায়াটুকু আমরা দেখতে
পাচ্ছিনে- আমরা দেখছি খুব মস্ত এক টুকরো আকাশ- কুয়াশার মতো অস্পষ্ট; তার রংটা ঠিক
চেনা যাচ্ছে না- মনে হচ্ছে, কে যেন তার মুখ দেখে সমস্ত রঙের ছোপ মুছে নিয়েছে- অমন
বিবর্ণ, বিশ্রী ম্লান চেহারা আমাদের দেশে আকাশের বড়ো একটা হয় না”। বুদ্ধদেব বসুর
‘রজনী হ’লো উতলা’ গল্পটিতে রয়েছে কবিতার ভাবও তার সংমিশ্রণ। আমরা পূর্বেই জেনেছি,
কবি যখন কোনো গদ্য রচনা ক’রে সেখানে ছায়ার মতো লেগে থাকে ভাব-ভাবনা, শব্দ, রূপ এবং
বাক্যর ব্যবহার। এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। গল্পের অংশ বিশেষে আমরা যেমন লক্ষ্য করি;
‘সন্ধ্যারানীর লাজনম্র রক্তাভ মায়াটুকু’ , ‘টুকরো আকাশ কুয়াশার মতো অস্পষ্ট’, ‘কে
যেন তার মুখ দেখে সমস্ত রঙের ছোপ মুছে নিয়েছে’ কিংবা ‘ম্লান চেহারা আমাদের দেশের’
মতো বাক্যগুলো। যা গল্প থেকে যেন কবিতায় স্বাক্ষর রাখে বেশি।
বুদ্ধদেব বসু; গল্পটি
বলেছেন নিজের মতো ক’রে। এগিয়ে নিয়েছেন গল্পটির
কাহিনী তার গভীর থেকে আরও গভীরে। ‘আমরা দু’জন পাশাপাশি ডেক-চেয়ারে ব’সে আছি, কারো
মুখে কথা নেই’। কে এই দু’জন? কি সম্পর্ক তাঁদের ? তা সহজেই প্রকাশ করেননি
বুদ্ধদেব। এগিয়েছেন তাঁদের নিয়ে এবং তাঁরা যেন থেকে যায় অধরা। আধো ছায়া-আধো
অন্ধকারের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন গল্পটিতে। এখানে বুদ্ধদেবকে এক গল্পকারের
থেকে এক স্বাপ্নিক-ই বেশি মনে হয়। যিনি শুধু আমাদের স্বপ্নই দেখিয়ে যাবেন, যতক্ষণ
না আমাদের চেতন ঘটে তার অভ্যন্তরে যাওয়ার
জন্য। গল্পটিতে আবার যখন বলেন, ‘আমি মুখ ফিরিয়ে ওর চোখের দিকে চাইলুম-আশ্চয ! ওর
চোখের কোনো রং আমি আজ অবধি ঠিক করতে পারলুম না। ও যেন ক্ষণে ক্ষণে বদলায়, কখনও
সন্ধ্যার এই ছায়াটুকুর মতো ধূসর, কখনও ঐ সুদূর তারকার মতো সবুজ, কখনও ঐ নদীর জলের মতো কালো, কখনও দিগন্তরেখার অপরূপ ভঙ্গিমার মতো
নীল’। ‘ওর’ সম্পর্কিত ব্যক্তিটিকে আমরা কখনও চিনে উঠতে পারিনি। কি সম্পর্ক তাঁদের
দু’জনের, তা আমরা অতি সহজে জানতে পারি না। আমাদের মাঝে তা থেকে যায় অজ্ঞাত। প্রেমিক-প্রেমিকা,
ভালোবাসার মানুষ, স্বামী-স্ত্রী কিংবা এসব ব্যতিরেখে অন্য কোনো সম্পর্ক, যা শুধু
চরিত্রের কথক হিশেবে এগিয়ে নিয়ে যাবে মূল গল্পটি। গল্পটিতে রয়েছে স্বপ্ন ও তার বাস্তবতার মিশ্রণ। যে স্বপ্ন যেনো দেখা দিচ্ছে তো দিচ্ছে
না; ধরা দিচ্ছে তো দিচ্ছে না, তার পরও বুদ্ধদেব এগিয়ে নিয়ে যান গল্পটিকে। বুদ্ধদেব
বসু, গল্পটিকে নিয়ে গেছেন গভীর থেকে আরও অনেক গভীরে। গল্পটিকে গভীরে নিয়ে যাওয়াই
যেনো তার লক্ষ্য ছিল। যেখানে তিনি আবেদন ছড়াবেন মুগ্ধমনে এবং বেজে উঠবে যেনো এক
আপন সুর। যে সুর বুদ্ধদেব বসুর কণ্ঠস্বরের সাথে একাত্ম হ’য়ে বেজে উঠবে আপন মনে। বুদ্ধদেব বসু গল্পের মাঝে
আবার প্রকাশ করেন, ‘আমি তার মাথাটিকে কাছে টেনে এনে তার ঐ মায়াময় চোখ দুটির উপর
ঠোঁট রেখে নিঃশব্দে জবাব দিলুম। নীলিমার চোখ দুটি অবশেষে মুদিত হ’য়ে এলো। আমি এই
অবসরে তার সাড়া দেহের উপর একবার ভালো ক’রে চোখ বুলিয়ে গেলুম। অপরূপ ! বিশ্বশিল্পী তাঁর কত
স্নেহ, কত সুধা, কত মমতা দিয়েই না এই নারীদেহ গড়েছেন ! এ যেন একটি বীণা, তা
আপনা-আপনি বাজে না, তাকে কোলে তুলে নিয়ে কোনো সুররসিক সুর সাধনা করবে, এই তার
সার্থকতা’। মেঘনার ঘোলা জলকে তিনি দূরে সরিয়ে বেশ কিছুটা এগিয়েছেন। পাশাপাশি বসে
থাকা ব্যক্তি দু’জনের সম্পর্কের দিকটাও কিছুটা প্রকাশ পেয়েছে। একজনকে আমরা চিনে
উঠতে পারি, তিনি ‘নীলিমা’। যদিও এই নামটি আমাদের কাছে আর নতুন মনে হয় না।
জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এই নামটির সাথে আমরা পূর্বেই পরিচিত ছিলাম। উভয় ব্যক্তি
সম্পর্ক দিকটি আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট হ’য়ে উঠে গল্পের ভিতর এগোনো মাত্র। বুদ্ধদেব
বসু গল্পের এক স্থানে এসে যখন প্রকাশ
করেনঃ ‘নীলিমা মাথাটা একটু পেছন দিকে হেলিয়ে বললে, আচ্ছা তোমায় আবার দোষ দেব !
তুমি যে আমার বর’। আমাদের আর কোনো অজানা থাকে না উভয় ব্যক্তি সম্পর্কটি। ছয় বছর পূর্বে
ঘটে যাওয়া নিজের জীবনের ঘটনা আবার ফিরে আসে গল্প হ’য়ে। আসে তা আবার অতীতের গল্প হ’য়ে।
বাস্তবিক রূপ নয়; তা হ’য়ে উঠে এক কৈশোরিক প্রেমে, যে প্রেম বেশি দূর আর এগোয় না। এবং
তা রূপ নেয় যৌবনের কাঁচা রঙের। সেই প্রেম
অবস্থান ক’রে বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। ‘রজনী হ’লো উতলা’ গল্পে বুদ্ধদেব বসু গল্পের
প্রেক্ষাপটে প্রকাশ করেন নারী নিয়ে একটি উক্তি। গল্পের ভিতর তিনি প্রকাশ
করেনঃ ‘পৃথিবীর অনেক কিছুই তখন আমার কাছে
রহস্যময়, আর তার মধ্য সবচেয়ে রহস্য হ’লো নারী’। এই নারী শারীরিক প্রাপ্তির কোনো
নারী নয়; এই নারী বাস ক’রে মনের গভীরে এক স্বপ্নের মাঝে, যে আমাদের শুধু নিয়ে যায়
সেই স্বপ্নের মাঝে, যেখানে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে। তাঁর শাড়ীর আঁচল, চুড়ির
শব্দ বা তাঁর ছায়া-ই শরীরে কাঁপন জাগায়। গল্পের ভিতর আবার ফিরে আসে সেই নদী, যে নদীর দিকে মুখ ক’রে বসেছিলেন
তাঁরা। ভাবনা ও কল্পনায় তাঁরা আসে স্বপ্নের ভিতর। যাদের দেখে তিনি প্রকাশ করেন হৃদয়ের
গভীরে লুকিয়ে থাকা অব্যক্ত বাণী; যে বাণীর শ্রোতা তাঁরা ছাড়া অন্য কেউ নয়। আপন মনে
বলে উঠেন ‘ অমরাবতীর দুয়ারে জ্যোতির্ময়ী ঊষার ললাটের শিশির বিন্দু ’। গল্পের কথক
হ’য়ে যখন বলতে থাকেন গল্পটি, কিন্তু নিজেই
আবার হৃদপিণ্ড কেঁপে প্রকাশ করেন পাশে বসে থাকা সেই নারীর ভালোবাসার শ্রুতিময়
বাক্য, যেখানে নিজেকে আর অন্য কেউ মনে হয় না, মনে হয় যেন একান্ত ভালোবাসার মানুষ। অতীতের সেই চমৎকার
সম্পর্কের ভাবনাবোধটি কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্থিতি হ’য়ে রয়। বাড়তে থাকে পাশে বসে থাকা মানুষটির গল্প
ভাবনা। বুদ্ধদেব বসু গল্পের এক প্রান্তে এসে আবার ব’লে উঠেনঃ ’ মনে হ’লো, যেন আমি
জ্বলের নিচে ডুবে যাচ্ছিলুম, হঠাৎ উঠে
এসে আবার নিশ্বাসের সঙ্গে বাতাসের অমৃত সেবন করছি। চেয়ারের হাতলের উপর
ঝুঁকে প’ড়ে তার মুখের অত্যন্ত কাছে মুখ নিয়ে বললুম, আঃ এই যে তুমি নীলিমা ! এতো
কাছে ! আমি তোমার কেশের সৌরভ পাচ্ছি, তোমার নীল চোখ দুটির মধ্যে আমার নিজের চোখের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। আমার আর ভয়
নেই-আঃ নীলিমা, তুমি কত সুন্দর’। যে স্থানে বা বাড়ীতে কেটেছিল নিজের জীবনের কিছু
সময়। সে সময়টা কেমন কেটেছিল ? কি কল্পনা ছিল সেই ভাবনার জগতে ? একজন কবি, পরে একজন
গল্পকারের ভাবনায় সেই বাড়ী বা গৃহটি ছিল
যেন এক রূপের মেলা। বুদ্ধদেব বসু গল্পের মাঝে আবার ব’লে উঠেনঃ ‘ও বাড়ী তো নয়, যেন
রূপের মেলা! যেন ফুলের বাগান! তাতে কত ফুল ফুটে রয়েছে- তারা রূপের জৌলুশে চাঁদনি
রাতকে হার মানিয়ে দেয়, সৌরভের মাদকতায় বাতাসকে মাতাল ক’রে তোলে ! বলেইছি তো, আমার
সেই সদ্য জাগ্রত অসীম তৃষ্ণা নিয়ে আমি তাদের মধ্যে গিয়ে পরলুম। প’ড়ে হঠাৎ যেনো জীবন
সূত্রের খেই হারিয়ে ফেললুম’। সেই সন্ধ্যা, সেই বাড়ী, সেই মানুষগুলো সবই যেন এক
কল্পজগত তৈরি করেছিল গল্পটিতে। এটা যেন কোনো গল্প নয়; বাস্তবতার এক বহিঃপ্রকাশ। যা
ঘটে গিয়েছিল বুদ্ধদেবের জীবনে।
গল্পটির শ্রোতা একজন
নারী। যিনি সম্পর্কে তাঁর-ই স্ত্রী। ব’লে যাচ্ছেন পুরুষটির জীবনের মেঘের মতো উ’ড়ে
যাওয়া কিছু ঘটনা। গল্প বলাতে কোনো ক্লান্ত
নেই; তিনি শুনতে চাচ্ছেন যা ঘটে গিয়েছিল পুরুষটির জীবনে। গল্পের মধ্যে আবার ব’লে
উঠেনঃ ‘গলার স্বর হঠাৎ নামিয়ে ফেলে চুপিচুপি
জিজ্ঞেস করলুম, আরো শুনতে চাও ? নীলিমা
রুদ্ধস্বরে জবাব দিলো- চাই’। জমাটবদ্ধ মেঘের মতো ঘটনা; তা যেন বৃষ্টির ফোঁটার মতো
ঝ’রে প’ড়ে। এবং খেলা ক’রে এক আলো ছায়ার লুকোচুরি। সেই গৃহের বর্ণনা আবার ফিরে এসে
গল্পের শরীর জুড়ে। বুদ্ধদেব আবার তা প্রকাশ করেন নিজের মতো ক’রে। ব’লে উঠেনঃ ‘অমনি
আমার ঘরের পর্দা স’রে গেলো। ঘরের বাতাস মূর্ছিত হ’য়ে পড়লো, আমার শিয়রের উপর যেন
একটু চাঁদের আলো পড়েছিল, তা যেন একটু ন’ড়ে চ’ড়ে
সহসা নিবে গেলো, আমার সমস্ত দেহ মন এক স্নিগ্ধ অবসাদে শ্লথ হ’য়ে এলো, আমি যেন কিচ্ছু দেখছি না, শুনছি না, ভাবছি না,
এক তীব্র মাদকতার ঢেউ এসে আমাকে ঝড়ের বেগে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো-তারপর !’
তারপর, তারপর আর কি ঘটে
তা আমাদের জানাননি। থেমে যান এখানে। বুঝে নিতে হয় আমাদের গল্পের বাকি ঘটনাগুলো। যে
ঘটনাগুলো শুনার জন্য অপেক্ষা ক’রে
আছেন গল্পের সেই নারী। যিনি প্রথম থেকে
রয়েছেন গল্পের শ্রোতা হ’য়ে। তিনি বার বার শেষ করবেন ব’লে গল্পটি আর শেষ করেন না।
অপেক্ষায় থাকে গল্পের সেই নারীটি, এবং সেই সাথে আমরা। যা ঘটেছিল ওই গৃহে বহু পূর্বে, তা আবার সত্য
মিথ্যা হ’য়ে দেখা দেয়। যা ঘটেছিল তা
কি শুধুই স্বপ্ন। যেভাবে বুদ্ধদেব বসু
গল্পের মাঝে নিজেকে উপস্থাপন করেন, কিন্তু আজকে কিছুই সত্য বলে আমাদের আর মনে
হচ্ছে না। সব ছায়া, বাসি ফুলের মতো ম্লান, অশ্রুপূর্ণ চোখে দেখা জিনিসের মতো
ঝাপসা। যে ঝাপসা শুধু আচ্ছন্ন ক’রে না, নিয়ে যায় অতীত চিন্তার জগতে। যে ভাবনা বা
স্বপ্ন নিয়ে বুদ্ধদেব বসু এগিয়ে যান
সামনের দিকে। স্বপ্নের সেই সব নারী, যারা কখনও ধরা দেয় না; তারা থেকে যায় স্বপ্নের
মাঝে। গল্পের মধ্যে আবার বলেনঃ ‘প্রজাপতির
ডানার মতো কোমল দুটি গাল, গোলাপের পাপড়ির মতো দুটি ঠোঁট, চিবুকটি কি কমনীয়
হ’য়ে নেমে এসেছে, চারু কণ্ঠটি কি মনোরম,
অশোকগুচ্ছের মতো নমনীয়, স্নিগ্ধ শীতল দুটি কক্ষও, কি সে উত্তেজনা, কি সর্বনাশা সেই
মুখ, তা তুমি বুঝবে না’। লিখে উঠেছেন একটি গল্প, কিন্তু ভাবনায় স্থির ক’রে নিয়েছেন
কবিতার পঙক্তি; যা প্রকাশ পেয়েছে কোনো কবিতা নয়, গল্পের অভ্যন্তরে। যে ভাবনা বোধ
বুদ্ধদেব বসুর শুধু কবিতায় নয়; তার প্রকাশ রয়েছে কিছু ছোটো গল্পে-ও। বুদ্ধদেব,
শারীরিক ও মানসিক উত্তেজনার চরম দিকটি প্রকাশ করেছেন ‘রজনী হলো উতলা’ গল্পটিতে। সেই
সাথে প্রকাশ করেন নারীপুরুষের সম্পর্ক। তাই গল্পের ভিতরে আবার বলে উঠেনঃ ‘ বিপুল
উত্তেজনার পর যে অবসাদ আসে, তার মতো ক্লান্তিকর বোধ হয় জগতে আর কিছু নেই।
বাহুবন্ধন ধীরেধীরে শিথিল হ’য়ে এলো’। এই ভাবনা বা চরমসত্য রূপটি প্রকাশ করতে দরকার
হয় দৃঢ় মনোভাব ও সাহিত্যবোধ; যার দুটোই ছিল বুদ্ধদেব বসুর। নারী ও পুরুষের
সম্পর্কের পরিণতি কোথায়; কোথায় তার নিয়তি বা নির্ভরতা, তা সুস্পষ্ট হ’য়ে উঠে
গল্পটিতে। নারী পুরুষের মাঝে যে সম্পর্ক রয়েছে তার ব্যাপক ব্যবহার করেছেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমস্ত সাহিত্য জুড়ে। তাঁর কিছু ভাবনা আবার আমরা দেখতে পাই
বুদ্ধদেব বসুর ক্ষেত্রে। যার ব্যাপক ছাপ রয়েছে এই গল্পটিতে। নারী, শারীরিক না
মানসিক তা বড়ো হ’য়ে দেখা দেয় না গল্পটিতে; বরং দেখা দেয় নারীর
উপস্থিতি। তাই বুদ্ধদেব বসু এই গল্পে যখন বলে উঠেন, ‘নারীর মুখ কি শুধু দেখবার
জন্যই ? তাঁর উত্তর আবার যখন ফিরে আসে, ‘তা যে অফুরন্ত সুধার আধার’। যে সুধা
বুদ্ধদেব বসু পান করতে চেয়েছেন ধীরস্থির ভাবে এবং ক্ষণে ক্ষণে। যেনো তিনি বার বার
ফিরে আসেন সেই একই পাত্রে। গভীর ভাবনাবোধ যেনো সব কিছুকে এক নিরবতায় আচ্ছন্ন ক’রে
ফেলে। কোনো শব্দও যেনো তাকে আর ভাবিত করতে পারে না। যার উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই
বুদ্ধদেব বসুর এই গল্পটিতে। গল্পটিতে তিনি বলেন, ‘ষ্টীমারটি কি বিশ্রী শব্দ করছে।
ও কি অনন্তকাল ধ’রে চলতেই থাকবে ? কোনোখানেই
কি থামবে না ?’ এ শব্দ ব্যতিক্রম কোনো শব্দ নয়। সর্বদা যে রকম শব্দ হয় এটা
তার-ই প্রকাশ। কিন্তু তারপরও এই রকম শব্দটা ‘বিশ্রী’ হ’য়ে দেখা দেয়। যে শব্দ যেন
আর শব্দ নয়; তা যেন নিরবতার বিচ্ছিন্নতা। যে নিরবতা যেন কোনো কবির বহিঃপ্রকাশ।
পরের আরেকটি কথার প্রকাশ ‘অনন্তকাল ধ’রে চলতেই থাকবে ?’ এ-প্রশ্নের কোনো উত্তর
আমাদের জানা নেই। কারণ, কোনো কিছুই আর
অনন্তকাল ধ’রে চলতে পারে না। সেটা যেমন সত্য, তার চেয়ে আরও আশ্চর্য হ’তে হয় এ রকম
প্রশ্নের মুখোমুখি হ’য়ে। এই অনন্ত প্রবাহমান হওয়া কি শুধু মাত্র স্টিমারের
ক্ষেত্রেই হ’য়ে দেখা দেয়; না, তার দ্বারা তিনি আমাদের দেখাতে চেয়েছেন জীবনের
প্রবাহকে ? যে প্রবাহে বুদ্ধদেব বসু শুধু নিজেই নয়; গল্পটিকে নিয়েছেন আরও গতিশীল
ক’রে। এর কিছুক্ষণ পরে আবার যখন বলেন, ‘কোনো খানেই কি থামবে না ?’ এ রকম প্রশ্ন বা
ভাবনা শুধু বুদ্ধদেবকে নয়; আরও চিন্তিত ক’রে তোলে আমাদেরকেও।
বুদ্ধদেব বসু, ‘রজনী
হলো উতলা’ গল্পটি স্ত্রী নীলিমাকে বলেছিলেন। যা ঘটে গিয়েছিল তাঁর-ই জীবনে। গল্পটি তিনি
বলতে থাকেন থেমে-থেমে। গল্পটির অন্তরে রয়েছে কবিতার ছাপ। যেমন আমরা দেখতে পাই, ‘জলতরঙ্গের
মতো মিষ্টি সুর, ওদের হাসির রোল ঘরের শান্ত হাওয়াকে আকুল ক’রে ছুটতে লাগলো, হাত
নাড়াবার সময় ওদের বালা চুড়ির মিঠে আওয়াজ রোজকার মতোই সেজে উঠলো, সবাকার মুখই ফুলের মতো রুপময়, মধুর মতো লোভনীয়
! কিন্তু আমার কণ্ঠ মৌন, হাসির উৎস অবরুদ্ধ’। বুদ্ধদেব বসু গল্পটিতে প্রকাশ করতে চেয়েছেন এক
অস্থির ভাবনা। স্থির থাকেননি গল্পের কোনো
একক স্থানে। নারী অভিব্যক্তির ভালোলাগা দিকগুলো গল্পটিতে ফিরে আসে বার বার। যা ঘটে
গিয়েছিল গত রাতে তা আর নতুন ক’রে ফিরে
আসবে আজকে ? এ রকম ভাবনা সর্বদা কাজ ক’রে বুদ্ধদেব বসুর মাঝে। অকুণ্ঠে প্রকাশ
করেছেন নিজের ভাবনার চরম দিকটি। কখনও নিজের মাঝে প্রকাশ করেছেন হয়তো তা ঘটবে বা
পরক্ষনে বলেছেন তা ঘটবে না। এ
রকম দ্বন্দ্ব আমরা দেখতে পাই সম্পূর্ণ গল্পটি জুড়ে। বুদ্ধদেব বসু আবার বলেন, ‘
কিন্তু দুপুরের পর থেকে আর এক নতুন সংশয় আরম্ভ হ’লো। আজ রাত্রে ও কি সে আসবে ?
আমার মধ্যে যা কিছু ভদ্র ও মার্জিত ছিল, সমস্ত এক যোগে ব’লে উঠলো- না। আর আসবে না।
আর বাঁচা গেলো। আমার আহত দর্প বললে, যাক, অপমান থেকে রেহাই পেলুম। কিন্তু আমার
পিতৃপুরুষের রক্ত অস্থির হ’য়ে বলতে লাগলো- না, আসবে, আসবে, নিশ্চয়ই আসবে। যাও
ফেরো- বাসায় ফেরো’।
বুদ্ধদেব বসু গল্পটি বলতে চেয়েছেন নিজের মতো ক’রে। এতক্ষণ
গল্পটি যাকে ব’লে আসছেন তিনি যদি আর গল্পটি শুনতে না চান তাঁর জন্য নিজের মাঝে এক
প্রকার দ্বন্দ্ব কাজ করে। তাই পাশে থাকা
নারীটিকে ব’লে উঠেন, ‘নীলিমা,
এতোখানি যখন শুনলে, তখন দয়া ক’রেন বাকিটুকুও শুনবে না কি ? এইটুকু দয়া আমায় করো,
নীলিমা’। আমরা সর্বদা দেখেছি গল্প শোনার জন্য মানুষ অনুনয় ক’রে ; আর তার ব্যতিক্রম
দেখতে পাই বুদ্ধদেব বসুর এই গল্পটিতে। যেখানে গল্প বলার জন্য কথক অনুনয় না বিনয়
প্রকাশ করেন। কি আছে সেই গল্পের মাঝে যা তিনি বলার জন্য উদগ্রীব হ’য়ে পড়েন !
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন