সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রবন্ধঃ চন্দ্রাবতীঃ আমার করুণ অশ্রুগাঁথা


চন্দ্রাবতীর পিতা; মনসা মঙ্গল কাব্যের অন্যতম রচয়িতা দ্বিজবংশী দাস। মাতা সুলোচনা। আনুমানিক (১৫৫০)  ষোড়শ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেন চন্দ্রাবতী। মৈমনসিংহ গীতিকায় পাওয়া যাবে তাঁর সেই বিষাদমাখা শোককাহিনী। যে কাহিনীতে রয়েছে ভাষার অপার সৌন্দর্যমাখা এক করুন সুর। এই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে রয়েছে সেই করুন কাহিনীর বর্ণনা। কবে রচিত হয়েছিল এ করুন কাহিনী ? কেন গাঢ় দুঃখগুলো জমা হলো চন্দ্রাবতীর জীবনে ? কি ঘটে গিয়েছিল তাঁর প্রবাহমান জীবনে! প্রেম, ভালোবাসা, ব্যর্থতা আর তার করুন সুর বাঙলা সাহিত্যেয় রচিত হয়েছে শতকের পর শতকে। কিন্তু; সেই কাহিনী থেকেও অনেক করুন হ’য়ে বেজে উ’ঠে চন্দ্রাবতীর শোক। সেই শোক কি অনেক করুন আর বিষাদময় ছিল অন্যান্য কাহিনী থেকে ? না, ভাষার নিটোল স্পর্শে সেই কাহিনী প্রকাশিত হয়েছিল কবিতা নামক পঙক্তির মতো। যা নাড়া দেয় আমাদের হৃদয়ে; লুকায়িত করুন সুরে। সেই বিষাদময় সুর থেকে চন্দ্রাবতী রচনা করেছিলেন ‘মলুয়া’, ‘দস্যু কেনারামের পালা’ এবং ‘রামায়ণ’ কাহিনী। যা তার-ই সুরে রচিত অম্লান শোকগাঁথা। এ কাহিনীর প্রবাদ পুরুষ হ’য়ে উঠেন ড. দীনেশচন্দ্র সেন। তিনি নিজ উদ্যোগে চন্দ্রাবতীর করুন কাহিনীর ‘রামায়ণ’ প্রকাশ করেনমানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে দেন সেই বিষাদমাখা কাহিনী। মৌলিক সৃষ্টির সাথে সংমিশ্রণ ঘটান কিছু মানবিক ও লৌকিক উপাদান; যার ফলশ্রুতিতে ‘রামায়ণ’ হ’য়ে এক অনবদ্য শোকগাঁথা। যে শোকগাঁথা সুর উচ্চারিত হয় আমাদের চেতনায় আর মননে। যা আমাদেরকেও ক’রে আবেগ আপ্লুত; সমানভাবে শোকগাঁথার সমান অংশীদার। অনাথ বালক জয়ানন্দ; চন্দ্রাবতীর একাকী বন্ধু ও খেলার সাথী। চন্দ্রাবতী গভীর ভালোবাসেন সেই নিঃসঙ্গ প্রিয় মানুষটিকে; নিজের জীবন থেকেও অধিক। অন্যের ভালোবাসার ছায়ায় বেড়ে উঠতে থাকেন জয়ানন্দ। স্থির করেন দু’জনের মনের ভাবনাবোধটিকে। আর পৃথক থাকবেন না দু’জন। ভালোবেসে দু’জনে বেছে নিবেন একটি জীবন। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আর কটা দিন; এই তো আর কটা দিন, এ ভাবে দিনের পর দিন কেটে যায় চন্দ্রাবতীর। অপেক্ষার প্রহর যেনো আর শেষ হয় না। এক একটা দিন যেনো এক একটা শতাব্দীর মতো দীর্ঘ মনে হয় চন্দ্রাবতীর কাছে। এতো গভীর ভালোবাসা জ’মে থাকে চন্দ্রাবতীর জীবনে; কখনো রাতকে তাঁর দিন আবার দিনকে রাত মনে হ’তে থাকে চন্দ্রাবতীর কাছে। অপেক্ষার প্রহর কি শেষ হয়েছিল চন্দ্রাবতীর ? তাঁরা কি পেয়েছিল তাঁদেরকে ? যারা গভীর ভালোবেসেছিল দু’জন দু’জনকে! জয়ানন্দ আবার ভালোবাসতে শিখে; অন্য একজনকেসে ভালোবাসা অনেক গভীর, দু’জনের মধ্যে চলে মন দেয়া-নেয়া। জয়ানন্দ কি অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে ? চন্দ্রাবতী ছাড়া ! সেই চন্দ্রাবতী, যে তাঁর জীবনের অম্লান সুর। যার সামনে তার দিন আর রাত একই মনে হয়; সেই চন্দ্রাবতী; যার সাথে জ্যোৎস্নাময় অনেক রাত কেটে গেছে জয়ানন্দর। উজ্জ্বল আলোয় ভেসেছে দু’টি স্বপ্ন; যা এক হ’য়ে গিয়েছিল গভীর ভালোবাসার কাছে। দেবদারু আর নারকেল বন যেনো এক ক’রে দিয়েছিল তাঁদের ভালোবাসাকে। যে ভালোবাসায় জ্যোৎস্নার আলোয় রক্তিম হ’য়ে উঠে দু’টি অধর। এ যেনো হারানো সুর কঠিন সুরে বেজে উ’ঠে আপন করতলে ! অপরূপ সৌন্দর্য বিরাজ ক’রে সমস্ত অবয়ব জুড়ে আসমানীর; জয়ানন্দর ভালোবাসার নতুন মানুষ। আসমানীর প্রতি জয়ানন্দর ভালোবাসা দিন দিন গভীর হ’তে থাকেআস্তে আস্তে দূরে সরে আসতে থাকেন চন্দ্রাবতীর থেকে। দিন দিন আরও গভীর ভালোবাসতে থাকেন চন্দ্রাবতী; জয়ানন্দকে। জয়ানন্দ কখনোও ভুলেও বুঝতে দেন না চন্দ্রাবতীকে; সে আর একজনকে ভালোবাসতে শুরু করেছেন। গভীরে মন দেয়া-নেয়া চলে জয়ানন্দর। জয়ানন্দ নিশিতে পত্র রচনা ক’রে প্রেরণ করেন নতুন ভালোবাসার মানুষটিকে। তু’লে ধরেন নতুন সুর; নতুন আর্তনাদ; নতুন ভালোবাসা, নতুন মানুষের প্রতি। ধর্ম, ধর্মান্তরিত পরিবর্তন ক’রে ফেলে জয়ানন্দকে। দু’জনকে ভালোবাসেন সমান ভাবে। পথ চেয়ে বসে আছে চন্দ্রাবতী; জয়ানন্দের অপেক্ষায়। তাঁর–ই জীবনসঙ্গী হ’য়ে ঘর বাঁধবেন জয়ানন্দের সাথে। কিন্তু জয়ানন্দ কাকে সাথী ক’রে নিবেন তাঁর জীবনে ? আসমানী না চন্দ্রাবতীকে ? কাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন জয়ানন্দ ! কেটে কেটে গেছে শতাদ্বীর পর শতাদ্বী।  আজও মানুষের কাছে  সেই কাহিনী যেন সুধার মতো বেজে উঠে। আজও ‘মনসা’ পূর্ববঙ্গে সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা; এতো দিন প’রে মেঘভরা  আকাশের করুন দুঃখ ভুলে গ্রাম্য মানুষের মনে জায়গা ক’রে  নেয় সেই করুন সুর; করুন সঙ্গীতে। দেখা দেয় হৃদয়ের অমর সঙ্গীত হ’য়েশ্রাবণের ম্লান আকাশের দিকে তাকিয়ে শুনা যায় সেই কণ্ঠস্বর। যা কানের নয়; বেজে উ’ঠে মনে। সেই অম্লানসুরে বেজে উ’ঠে এক মর্মস্পর্শী সঙ্গীত।
‘কি আনন্দ হইল সইগো রস বৃন্দাবনে
শ্যাম নগরে খেলায় পাশা মন মোহিনীর বনে
আজি কি আনন্দ ...।
উপরে চান্দোয়া টাঙান নীচে শীতল পাটি
তার নীচে খেলার পাশা জমিদারের বেটি
আজি কি আনন্দ...।
চন্দ্রাবতী বহে পাশা খেলায় বিনোদিনী
পাশাতে হারিল এবার শ্যাম গুণমণি !
আজি কি আনন্দ...।’
      চন্দ্রাবতী, দ্বিজবংশী দাসের একমাত্র কন্যা। যিনি মনে প্রাণে সাহায্য নেন পিতার; পুরাণ রচনার ক্ষেত্রে। চন্দ্রাবতী ছিলেন অপরূপ সুন্দরী। কবিতা লেখার হাত ছিল বাল্যকাল থেকে। সঙ্গীত, কবিতা আর সৌন্দর্য এক ক’রে দিয়েছিল চন্দ্রাবতীকে। এ ভাবে ছড়িয়ে পরে চন্দ্রাবতীর খ্যাতি। জায়গা ক’রে নেন মানুষের মনে। ‘মলুয়া’ চন্দ্রাবতী কৃত অন্যতম একটি রচনা। যেখানে প্রকাশ পায় শব্দ ও ছন্দের এক অভূতপূর্ব সমন্বয়; করুন কাহিনীর সুর।  
‘আদিতে বন্দিতে গাই আনাদি ঈশ্বর
দেবের মধ্যে বন্দি গাই ভোলা মহেশ্বর
দেবীর মধ্যে বন্দি গাই শ্রীদুর্গা ভবানী
লক্ষ্মী সরস্বতী বন্দুম যুগল নন্দিনী  
ধন সম্পদ মিলে লক্ষ্মীরে পূজিলে  
সরস্বতী বন্দি গাই বিদ্যা যাতে মিলে
কার্ত্তিক গণেশ বন্দুম যত দেবগণ 
আকাশ বন্দিয়া গাই গড়ুর পবন
চন্দ্র সূর্য বন্দিয়া গাই জগতের আখি
সপ্ত পাতাল বন্দুম নাগান্ত বাসুকি
মনসা দেবীর বন্দুম আস্তিকের মাতা
যাহার বিষের তেজ ডরায় বিধাতা
ভক্ত মধ্যে বন্দিয়া গাই রাজা চন্দ্রধর
তার সঙ্গে বন্দিয়া গাই বেউলা-লক্ষ্মীন্দর
নদীর মধ্যে বন্দিয়া গাই গঙ্গা ভাগীরথী
নারীর মধ্যে বন্দিয়া গাই সীতা বড় সতী
বক্ষের মধ্যে  বন্দিয়া গাই আদ্যের তুলসী
তীর্থের মধ্যে বন্দিয়া গাই গয়া আর কাশী
সংসারের সার বন্দুম বাপ আর মায়ে
অভাগীর জনম হইল যার পদ ছায়ে  
মুনির মধ্যে বন্দিয়া গাই বাল্মীকি তপোধন
তরুলতা  বন্দিয়া গাই স্থাবর জঙ্গম
জল বন্দুম স্থল বন্দুম আকাশ পাতাল
হর শিরে বন্দিয়া গাই কাল মহাকাল
তার পরে বন্দিলাম শ্রীগুরু চরণ 
সবার চরণ বন্দিয়া জানাই নিবেদন
চার কুনা পৃথিবী বন্দিয়া করিলাম ইতি
সলাভ্য বন্দনা গীতি গায় চন্দ্রাবতী।’  
একই ভাবে চন্দ্রাবতীর ‘দস্যু কেনারামের পালা’তে বলেন কোনো এক কাহিনীঃ

                                    ‘তার পরে যোশধর শুন দিয়া মন
 মাসেকের মধ্যে ৈহল গর্ভের লক্ষণ।
 সুগোল সুন্দর তনুগো লাবণি জড়িত।
 সর্বব অঙ্গ দিনে দিনে হইল পূরিত।
 অজীর্ণ অরুচি আর মাথা ঘোরা আদি
 আলস্য জড়তা ৈহল আছে যত ব্যাধি।
 সর্বব অঙ্গে জ্বলে মাথা তুলিতে না পারে
 আহার করিয়া মাত্র ফেলে বমি করে
 রুচি ৈহল চুকা আর ছিকর মাটিতে 
 বিছানা ছাড়িয়া শুয়ে কেবল ভূমিতে।
 এহি মতে দশ মাস দশ দিন গেল
 পরেত গর্ভেত এক ছাওয়াল জন্মিল
 চন্দ্রাবতী কয় শুনগো অপুত্রার ঘরে।
 সুন্দর ছাওয়াল ৈহল মনসার বরে।           
  মায়ের অঞ্চলের নিধিগো  মায়ের পরাণী।
  দিন দিন বাড়ে যেমন চাঁদের লাবণী।
  ছয় না মাসের শিশু গো হইল যখন।
  মহা আয়োজনে করে অন্ন পরশন।
  বাছিয়া রাখিল মায়ে গো শুন কিবা নাম।
  দেবীর পূজার কিনা তাই ‘কেনারাম’।
 হায়রে দারুণ বিধি কি লিখিয়া ভালে।
 মরিলা জননী হায়রে সাত মাসের কালে।
 কোলেতে লইয়া পুত্র কান্দে খেলারাম।
 কি হেতু ৈহল  মর প্রতি বাম।
 মাও ভিন্ন কে বা জানেরে পুত্রের বেদন
 যাহার স্তনেতে হয় শরীর পালন।  
 সেই মায়ের নিলা কারি কিসের কারণে।
 কি মতে বাঁচাইয়া পুত্র রাখিব জীবনে।
 অপুত্রা ছিলামগো মোরা সেই ছিল ভাল।
 ভুলাইয়া মায়ায় পরে কেন দেও শেল।
 কান্দিয়া কান্দিয়া তবে যায় খেলারাম
 পুত্র কোলে উপনিত দেবপুর গ্রাম
 সোহিত গ্রামেতে হয় মাতুল আলয়।
 মামার বাড়ীতে কেনা কিছুদিন রয়।
 দুগ্ধ দিয়া মামী তার পালয়ে কুমারে।
 দিনে দিনে বাড়ে গো শিশু দেবতার বরে।
 এক না বছরের শিশু হইল যখন।
 খেলারাম গেল তীর্থ করিতে ভ্রমণ।
 এক দুই করি পার তিন বছর গেল। 
 খেলারাম ঘরে আর ফিরিয়া না আসিল।  
 এমত সময় পরে শুন সভাজন।
 আকাল হইলগো অনাবৃষ্টির কারণ।
 এক মুষ্টি ধান্য নাহি গৃহস্থের ঘরে।
 অনাহারে পথে ঘাটে যত লোক মরে।
 আগেত বৃক্ষের ফল করিল ভোজন।
 তাহার পরে গাছের পাতা করিল ভক্ষণ।
 পরেও ঘাসেতে নাহি হইল কুলান।
 ক্ষুধায় কাতর হইল যত লোকজন।
 গরুবাছুর বেচিয়া খাইল খাইল হালিধান।
 স্ত্রীপুত্র বেচে নাহি গো গণে কুলমান।
 পরমাদ ভাবিল মাতুল কেমন বাচে প্রাণ।
 কেনারামে বেচল লইয়া পাঁচ কাঠা ধান।’

          যার কবিতা মানুষের মনের মধ্যে জেগে থাকে অম্লান সুর হ’য়েযা শোনা যায় জনে জনে । তিনি তাঁদের প্রাণের কবি; তিনি চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতী রচিত শ্লোকগুলো টান দেয় মনের গভীর থেকে; অপূর্ব হ’য়ে। এ সুর কম্পন জাগায় মনের গভীর থেকে আরও গভীরে। জয়ানন্দের সম্পর্ক বিচ্ছেদের সুর যেনো করুন হ’য়ে বেজে উঠে চন্দ্রাবতীর জীবনেভেঙে গেলো সব সম্পর্ক; দীর্ঘ দিনের সুর। রচিত হলো করুন ধারা। একই সাথে কষ্ট আর যন্ত্রণা মিশে আছে চন্দ্রাবতীর কোমল জীবনেদু’টি আবেদন জানায় পিতার নিকট। নির্জন ফুলেরশ্বরী নদীর তীরে শিবমন্দির স্থাপন; অন্যটি চিরকুমারী থাকার বাসনা। পিতা আপন মনে সম্মতি দেন কন্যার ইচ্ছা পূরণেফুলেরশ্বরী নদীর তীরে আপন মনে চন্দ্রাবতী গাঁথেন ‘রামায়ণ’চন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণ’ নারীকেন্দ্রিক রচনারাম’ থেকে ‘সীতা’ই এখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হ’য়ে দেখা দেয়; দেখা দেয় প্রধান চরিত্র হ’য়েচন্দ্রাবতীর ‘রামায়ণে’ সীতার করুন দুঃখের কথা আমাদের সামনে উপস্থাপন করেন কোনো  পুরুষ কবি নন; এবং একই সাথে তিনি দেখা দেন না কোনো পুরুষ কথক হ’য়ে; বরং তিনি আমাদের সামনে আসেন একজন নারী কবি হ’য়ে, এবং তার-ই কথক হ’য়ে। তাই এক সাথে ‘রামায়ণে’ শুনতে পাইঃ
‘ধারাস্রোতে ফুলেরশ্বরী নদী বহে যায়
বসতি যাদবানন্দ  করেন তথায়
ভট্টাচার্য বংশে জন্মও, অঞ্জনা ঘরণী
বাঁশের পালায় ঘর ছনের ছাউনী।
ঘট বসাইয়া সদা পুজে মনসায়
কোপ করি সেই হেতু লক্ষ্মী ছেড়ে যায়।
দ্বিজবংশী পুত্র ৈহলা মনসার বরে,
ভাসান গাহিয়া যিনি বিখ্যাত সংসারে।
ঘরে নাই ধান চাল চালে নাই ছানি,
আকর ভেদিয়া পড়ে উচ্ছিলার পানি।
ভাসান গাহিয়া পিতা বেড়ান নগরে,
চালকড়ি যাহা পান আনি দেন ঘরে।
বাড়াতে দরিদ্র জ্বালা কষ্টের কাহিনী
তার ঘরে জন্ম নিল চন্দ্রা অভাগিনী
সদাই মনসা পদ পুজে ভক্তি ভরে
চালকড়ি পান কিছু মনসার বরে।
দুরিতে দরিদ্র দুঃখ দিলা উপদেশ,
ভাসান গাহিতে স্বপ্নে করিলা আদেশ।’

        কোনো এক সন্ধ্যায় জয়ানন্দ ও চন্দ্রাবতীর বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু এই বিচ্ছেদ মনে-প্রাণে মেনে নিতে পারেননি  জয়ানন্দ। সেই বিচ্ছেদ কি আবার দেখা দিবে নতুন কোনো সম্পর্কের ? চন্দ্রাবতীর পথ ধ’রে এগোতে থাকেন জয়ানন্দ। জয়ানন্দ যখন পৌঁছান চন্দ্রাবতীর পথে; দিন প্রায় শেষ হ’য়ে আসে। সন্ধ্যালগ্ন নেমে আসে চতুর্দিকে। অপরদিকে শিব মন্দিরের ভিতর সমস্ত দ্বার বন্ধ ক’রে সন্ধ্যারতি ও জ্যোতির্ময় আলোয় নিজেকে ধ্যানে নিমগ্ন করেন চন্দ্রাবতী। বাহিরে জয়ানন্দ; কণ্ঠস্বর দিয়ে ডাকতে থাকেন চন্দ্রাবতীকে। আমার প্রাণের চন্দ্রাবতী; আমার জীবনের চন্দ্রাবতী, আমার স্বপ্ন ও সাধনা। কিন্তু কোনো শব্দ পান না জয়ানন্দ। সমস্ত দ্বার রুদ্ধ থাকায় এবং একাগ্রমনে ধ্যানে নিমগ্ন থাকায় কোনো শব্দই যেনো প্রবেশ ক’রে না চন্দ্রাবতীর কর্ণে। অবিচল ধ্যানে সময় কাটে চন্দ্রাবতীর। দুঃখ ভরা মন নিয়ে অপেক্ষায় থাকে জয়ানন্দ। অপেক্ষার পর অপেক্ষা। কিন্তু ধ্যান ভাঙে না চন্দ্রাবতীর। সন্ধ্যায়  মালতী ফুল শুকিয়ে আসে। বিবর্ণ হ’তে  থাকে তার রঙ। চার পঙক্তির একটি পদ রচনা ক’রে সেখান থেকে ফিরে যায় জয়ানন্দ। অনেক পরে ধ্যান ভাঙে চন্দ্রাবতীর। এবং বুঝতে পারেন মন্দিরে কারো পদচিহ্ন অঙ্কিত রয়েছে। সেই পদচিহ্ন মুছার জন্য কলসি কাঁধে জল আনতে যান ফুলেরশ্বরী (ফুলিয়া) নদীতে। নদীর ঘাটে যাওয়া মাত্র  চন্দ্রাবতী বুঝতে পারেন পদচিহ্ন অঙ্কিত মানুষটি কে। ফুলেরশ্বরী নদীতে জয়ানন্দ বিসর্জন দেন নিজেকে। সেই জয়ানন্দ; চন্দ্রাবতীর ভালোবাসার মানুষ। প্রাণহীন দেহ ভাসছে ফুলেরশ্বরী জলে। এই দৃশ্য দেখা মাত্র চন্দ্রাবতী নিজেকে আর ধ’রে রাখতে পারলেন না নিজের মাঝে; ঝাপ দিলেন ফুলেরশ্বরীর জলে। জীবন বিসর্জন দেন সেই জলে; যেখানে ভাসছে জয়ানন্দর দেহ।                              

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রবন্ধঃ বুদ্ধদেব বসু ও ‘কঙ্কাবতী’

বুদ্ধদেব বসু প্রেমের অজস্র কবিতা রচনা করেছেন । অন্য অনেকের মতো তিনিও বেছে নেন একজন প্রেমিকাকে , যে হ ’ য়ে উঠে বুদ্ধদেবের অতুল্য প্রেমিকা হিশেবে । ‘ কঙ্কাবতী ’ অনিন্দ্য প্রেমিকা হ ’ য়ে বুদ্ধদেবের কাব্যতে বিচরণ ক ’ রে স্বচ্ছন্দে । স্থির হয়ে বসে পড়ে কঙ্কাবতী ’ কাব্যগ্রন্থে । যে কাব্যগ্রন্থে ‘ কঙ্কাবতী ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে ‘ কঙ্কাবতীকে ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে কঙ্কাবতীকে আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো কবিতায় । যেখানে সে প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে কুৎসিত কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু নয় । প্রগাঢ় ভাবে প্রাপ্তির জন্যে সমস্ত কবিতা জুঁড়ে দেখতে পাই কবির অপরিবর্তনীয় আবেদন । কঙ্কাবতী , যাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময়ের জন্যে রক্তের হিমবাহে দেখা দেয় চঞ্চলতা । সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হাঁরিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো , যা বলার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন । প্রেমিকা যখন খুব কাছাকাছি হয়ে এগিয়ে আসেন , ওই ব্যর্থ ...

প্রবন্ধঃ অমিয় চক্রবর্তী : ‘বৃষ্টি’ নিয়ে তিনটি কবিতা

রবীন্দ্রনাথ, মেঘ-বরষা বৃষ্টি নিয়ে এতো সংখ্যক কবিতা লিখেছেন যে তাঁর সমান বা সমসংখ্যক কবিতা বাঙলায় কেউ লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কবিতায় বার বার এবং বহুবার ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, বরষা, বৃষ্টি। বৃষ্টি নামটি নিলেই মনে পড়ে কৈশোর পেড়িয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটির কথা। ‘দিনের আলো নিবে এল সূর্য্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।’ বৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার কথা মনে পড়লে এটাই চলে আসে আমার মনে। অমিয় চক্রবর্তী বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। বাঙলায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেনি এমন কবির সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় পাই ‘বৃষ্টি’ নামক কিছু সৌন্দর্যময় কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে। ওই কবিদের কারো কারো কবিতা দ্রুত নিঃশ্বাসে পড়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি নামক প্রথম কবিতাটি পাওয়া যাবে অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠোতে’। উন্নিশটি কবিতা নিয়ে গ’ড়ে উঠে ‘একমুঠো’ নামক কাব্য গ্রন্থটি। যেখান থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতায় তুলে নেওয়া হয় চারটি কবিতা। আমার আরো ভালোলাগে ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি ওই তালিকায় উঠে আসে। শ্রেষ্ঠ কবিতায় না আসলে আমার যে খুব খারাপ লাগতে তা-ও নয়। ওই কবিতা...

প্রবন্ধঃ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধ সংগ্রহ

সুধীন্দ্রনাথ , সাতটি কাব্যগ্রন্থের মতো সাতটি প্রবন্ধের গ্রন্থ লিখলে খারাপ হতো না , বেশ ভালোই হতো । সুধীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো হালকা মানের নয় , যদিও তাঁর কোন রচনাই হালকা নয় । সাহিত্যে বিচারে তা অনেক উঁচুমানের । তার উপর ভাষার ব্যাপারটি তো রয়েছেই । সুধীন্দ্রনাথ মাত্র দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন । গ্রন্থ দুটো ‘ স্বগত ’ ( ১৩৪৫ ঃ ১৯৩৮ ), অপরটি ‘ কুলায় ও কালপুরুষ ’ ( ১৩৬৪ : ১৯৫৭ ) । ‘ স্বগত ’- তে রয়েছে ষোলটি প্রবন্ধ । গ্রন্থ দুটি তিনি রচনা করেছেন দু ’ ভাগে । লরেন্স বা এলিয়ট এর প্রবন্ধ যেমন পাওয়া যাবে না ‘ কুলায় ও কালপুরুষ ’- এ ; তেমনি রবীন্দ্র সম্পর্কিত প্রবন্ধ নেওয়া হয়নি ‘ স্বগত ’- এ । প্রকাশ কাল অনুযায়ী ‘ স্বগত ’- এর প্রবন্ধসমূহ : ‘ কাব্যের মুক্তি ’ ( ১৯৩০ ); ‘ ধ্রুপদ পদ - খেয়াল ’ ( ১৯৩২ ), ‘ ফরাসীর হাদ্য পরিবর্তন ’ ( ১৯৩২ ), ‘ লিটনস্ট্রেচি ’ ( ১৯৩২ ), ‘ লরেন্স ও ভার্জনিয়া উল্ফ্ ’ ( ১৯৩২ ), ‘ উপন্যাস তত্ত্ব ও তথ্য ’ ( ১৯৩৩ ), ‘ উইলিয়ম ফকনর ’ ( ১৯৩৪ ), ‘ ঐতিহ্য ও টি , এস , এলিয়ট ’ ( ১৯৩৪ ), ...