সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রবন্ধঃ নিষিদ্ধ ‘প্রজাপতি’ এবং কাঠগড়ায় বুদ্ধদেব বসু


১৩৭৪ সাল, শারদীয় দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সমরেশ বসুরপ্রজাপতিউপন্যাস তাকে বহন করতে হয় অনেক শ্লীল-অশ্লীলের দায় নিষিদ্ধ হয় বাঙলা সাহিত্যের একটি কথাসাহিত্য মানবিক ভাবে আঘাত করা হয় সমরেশ বসুকে কেন নিষিদ্ধ করা হয় প্রজাপতিকে ? কি ছিল তাতে ? বই নিষিদ্ধ হবে, অন্য অনেক কিছুর মতো ! ‘নিষিদ্ধ প্রজাপতিউচ্চারিত হয় সর্বমহলে তাকে বহন করতে হয় দীর্ঘ কালিমা সাহিত্যের বিচারে কোথায় রাখবো প্রজাপতিকে ? সে কি টিকে থাকবে বাঙলা সাহিত্যেয় তার আসনে! ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারীতে, প্রজাপতিকে প্রথম আঘাত করলেন এক তরুণ অ্যাডভোকেট, অমল মিত্র তাঁর -কাজে তাকে সাহায্য করলেন অন্য অনেকে; এমনকি সরকারি আমলা-মোক্তার এগিয়ে এলেন -পবিত্র কাজে যে কোনো উপায়েই হোক নিষিদ্ধ করতে হবেপ্রজাপতি শারদীয় -সংখ্যার জন্য দোষী করা লো তার প্রকাশককেও -ভাবে কেটে যায় আঠারোটি বছর মানবিক ভাবে বিপর্যয় য়ে পড়েন লেখক সমরেশ বসু কি হবে প্রজাপতির ? সে-কি বেঁচে থাকবে ? না, তাকে ধীরে-ধীরে হত্যা করা হবে ? -গ্রন্থটি কি টিকে থাকবে বাঙলা ভাষা সাহিত্যেয় ? তার কি কোনো মুক্তি নেই ! কেউ কি তাকে মুক্ত করবে না ? সে-কি তার ডানা মিলে ড়ে যাবে না নীল আকাশে, শুভ্র মেঘে;  সে-কি মিলে যাবে তার সমস্ত রঙে, রঙধনুর মাঝে ! শুধু ভারতীয় সাহিত্য জুড়ে নয়; তার করুণ আর্তনাদ শুনতে পাই আমাদের -পারের সাহিত্যেও ১৯৮৫ সাল, দু-দুটো আদালতের রায়কে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য রে সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি শ্রী আর এস পাঠক এবং শ্রী অমরেন্দ্রনাথপ্রজাপতিউপন্যাসকে সব কিছু থেকে মুক্ত করে দিলেন প্রজাপতি উপন্যাসের অংশ বিশেষ পাঠকের কাছে অরুচিকর মনে হলেও, সেই দোষে তাকে আর শাস্তি দেওয়া যাবে না মুক্ত য়ে গেল প্রজাপতি সে আবার ডানা মিলে উড়ে গেল তার প্রসারিত নীল আকাশে প্রজাপতির ভাষা অশ্লীল, তা অনেকে বলেছেন; কিন্তু তার পরিবেশ কাঠামো এবং চরিত্র নির্মাণে জন্য সমরেশ বসু যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তা ঠিক ছিল তাঁর এবং অনেকের মতে তাই লেখক হিশেবে এর কোনো একক যুক্তি দাড় করাননি তিনি নিজেও প্রজাপতির ক্ষেত্রে একটি দিক আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই; আর তা হলো লেখকের পাশাপাশি প্রকাশকেও দোষী করা হয় কোনো ভাবে প্রকাশকও এই দোষ থেকে মুক্ত নন তাইদেশপত্রিকার সে দিনের সম্পাদক অশোক কুমার সরকারকেও উপস্থিত হতে লো আদালতে দীর্ঘ এই উপন্যাস থেকে অংশ বিশেষ বাদ দেওয়ার প্রস্তাবও উঠে; কেটে-ছেঁটে দিতে হবে তার অনেক অংশকে -রকম প্রস্তাব এক জন লেখক বা প্রকাশনের জন্য হুমকি স্বরূপ মেনে নেননি তারা- রকম প্রস্তাবকে উচ্চ আদালতে বিচার চেয়ে আবার শুরু লো অপেক্ষার পালা প্রজাপতি সম্পর্কে এই প্রথম মুখ খুললেন বুদ্ধদেব বসু, তিনি বলে উঠলেন, ‘হয়তো -ভাষা সাহিত্যে বেশি ব্যবহৃত হয়নি কিন্তু -ভাষা এখন ব্যাপক ভাবে চালু লেখক এই ভাষা ব্যবহার করে সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধিই ঘটিয়েছেন বুদ্ধদেবের সাথে একই কথা উচ্চারিত করেছিলেন -মামলার অন্যতম আরেক সাক্ষী, কবি-অধ্যাপক ডঃ নরেশ গুহ তাঁর নিজস্ব মত এরকম, ‘প্রজাপতি কোনও ভাবেই পাঠকের নৈতিক চরিত্র কলুষিত করবে না প্রজাপতি অশ্লীল নয় না সামগ্রিক ভাবে, না অংশত  নিষিদ্ধ এই উপন্যাসের সাক্ষী হিশেবে নাম দেওয়া হয়েছিল বুদ্ধদেব বসু, কবি নরেশ গুহ, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্যের পরের দুজন আসেননি স্ব-শরীরে উপস্থিত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব বসু নরেশ গুহ ১৯৬৮ সালের জুলাই,প্রজাপতি মামলায় লেখক সমরেশ বসু কোর্টে হাজির হলেন তাঁর পক্ষ থেকে জামিনের আবেদন করা হলো আদালত এক হাজার টাকা জামিনে তাকে মুক্তির আদেশ দিলেন এক মাস পর তাকে আবার হাজির হতে হবে আদালতে প্রজাপতির মামলায় বলা হয়; ‘প্রজাপতির কোনও সাহিত্যিক মূল্য নেই এটি নিছক একটি অশ্লীল রচনা কাঠগড়ায় সবার আগে উপস্থিত হন -উপন্যাসের অভিযোগকারী অমল মিত্র; যিনি- বইটির বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করেন তিনি কাঠ গড়ায় আরোও বলেন, ‘আমি বাংলা সাহিত্যের একজন পাঠক বাংলা সাহিত্যের পবিত্রতা শুচিতা রক্ষা করাকে আমি আমার কর্তব্য বলে মনে করি আমার অভিযোগ প্রজাপতি অশ্লীল আমি প্রজাপতির বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ এনেছি, কারণ এর কোনও সাহিত্যিক মূল্য নেই আমি প্রজাপতিকে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করছি কারণ ছেলে বুড়ো যুবক কিশোর যে- এই উপন্যাস পড়ুন না কেন তাঁরই নৈতিক অধঃপতন হবে প্রজাপতি পড়ে আমার ধারণা হয়েছে এই উপন্যাসে নিশ্চয়ই পাঠককে দুর্নীতিপরায়ণ করবে মহামান্য আদালতের সুবিধার জন্য আমি অতি অশ্লীল অংশগুলি লাল কালি দিয়ে দাগিয়ে দিয়েছিসমরেশ বসুর পক্ষে সাক্ষী দেওয়ার জন্য কাঠগড়ায় উপস্থিত হোন বুদ্ধদেব বসু বুদ্ধদেব বসু যখন সাক্ষী দেওয়ার জন্য আদালতে আসেন; তখন লোকে পরিপূর্ণ সম্পূর্ণ আদালত প্রাঙ্গণ আইনজীবীর বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘আমি জানি কেন আমাকে এখানে ডাকা হয়েছে সমরেশ বসুকে আমি চিনি আমি তাঁর  কিছু-কিছু বই পড়েছি নিদ্বিধায় বলতে পারি তিনি কালের এক শক্তিমান লেখক তাঁর লেখাপ্রজাপতিউপন্যাস আমি শারদীয় দেশে পড়েছি বই হিশেবে বের হবার পরও পড়েছি এই উপন্যাসে নিয়েই বর্তমান বিচার চলছে কাঠগড়ায় স্ব-শরীরে উপস্থিত লেখক, সমালোচক, কবি, প্রাবন্ধিক বুদ্ধদেব বসু এক-এক রে চলতে থাকে তাঁর প্রতি আনিত প্রথম সাক্ষীর প্রশ্নোত্তর প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা হয় বুদ্ধদেব বসুকে; তিনি উত্তর দিতে থাকেন নিজের মতো করে
আপনি নি মনে করেন প্রজাপতি অশ্লীল ?
-মোটেই না কোনও অংশও অশ্লীল নয়
এর পর তাঁর হাতেশারদীয় দেশ’-এর একটি সংখ্যা দিয়ে আইনজীবী বলেন, এখানে লাল কালি দিয়ে দাগানো অংশটি দেখুন তো ! এই অংশটি কি আপনার কাছে অশ্লীল মনে হয় না ? বুধদেব বসু ওই অংশটি ভালো ভাবে দেখে তার পর বলেন, ‘দেখেছি, এর কোন অংশকে আপনি অশ্লীল বলছেন’ ! তিনি আরো বলেন, আমি বুঝতে পারছি না এই অংশটুকু কেন- বা লাল কালি দিয়ে দাগানো লো এবার আইনজীবী তাকে লক্ষ্য করে বলেন, মিঃ বসু, ১৭৯ পৃষ্ঠাটি দেখুন, যেখানে লেখা আছেপিঠের  যেখানে শেষ আর কোমরের যেখানটার শুরু সেই সরু জায়গাটা ছাড়িয়ে নিচের চওড়া দিকে বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে আর একটু নিচেই লক্ষ্য করুণ, ‘আমি জানি,সসাহ আমার হাত দুটো যেন হাংলো কুকুরের মত’, বলুন এখানে আপনি কি অশ্লীলতার কিছু দেখতে পাচ্ছেন ? বুদ্ধদেব বসু সোজা উত্তর দেন, ‘না, আমি সে রকম কিছু দেখতে পাচ্ছি না তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি এই অংশটি খুব বলিষ্ঠ আমার মতে এখানে আপত্তিকর কিছুই নেই এবার আইনজীবী ১৮৯ পৃষ্ঠা খুলে  তাঁকে আবার প্রশ্ন করলেন, দেখুন এখানে দ্বিতীয় কলমে যে প্যারাটা শুরু হয়েছেমেজদা হয়তো একটা ঘরে আমাদের ঝিয়ের ষোল- সতের বছরের মেয়েটাকে সেই সব করছে, আমি কয়েকদিন দেখেছিলাম কি-না, ফ্রক পরা ধুমসো বেঁটে ভদকা জন্তুর মতন চোখ বলে আবার বুদ্ধদেব বসুকে প্রশ্ন করা লো, ‘এখানে আপনি কি অশ্লীলতার কিছু দেখতে পাচ্ছেন’ ? বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘ একেবারে ঠিক আছে  আজকের এই দিনে ১৯৬৮ সালে এসব  কথাকে অশ্লীলতা বলা হচ্ছে কি করে টা ভেবে আমি বিস্মিত হচ্ছি তাঁর এই পক্ষ থেকে -রকম উত্তর পেয়ে আদালতের হাঁসির জোয়ার উঠে যেন তিনি অনেক আগুন বাড়িয়ে দিলেন এই উপন্যাসের ১৯৮পৃষ্ঠা খুলে আইনজীবী আবার পড়ে শোনালেন,
পাশে দাঁড়িয়ে হাবড়ে চুমু খাচ্ছিল তার পর আদালত আবার জানতে চাইলেন এতে কি আপত্তিকর কিছু নেই ? বুদ্ধদেব বসু বললেন, ‘না, আপত্তিকর কিছু নেই এই উপন্যাসের নায়ক আজকের দিনের একটি রকবাজ ছেলে উপন্যাসটি লেখা হয়েছে তার- জবানীতে তার- ভাষাতে এটি বিন্যাস হয়েছে তাঁর মুখে যদি মার্জিত ভাষা বসিয়ে দেওয়া হত তাহলেই উপন্যাসটি ব্যর্থ হত উপন্যাসটি এতে বাস্তবধর্মী হয়েছে; আরো হয়ে উঠেছে জীবন্ত যাঁদের  কথা বলা হয়েছে তাঁদের মুখের কথাই লেখক তুলে ধরেছেন আমি মনে করি এই উপন্যাসেস্ল্যাংশব্দটি বেশি ব্যবহার করা হয়েছে এটাই তার মূল কারণ আইনজীবী আবার বসুকে অনুরোধ করেন ১৮৬ পৃষ্ঠার প্রথম কলমটি পড়ার জন্য তিনি আবার তাঁকে অনুরোধ করেনআপনি কি এর মধ্যে অশ্লীলতার কিছু পাচ্ছেন না’? বুদ্ধদেব বসু উত্তর দেন, ‘না, এখানেও অশ্লীলতার কিছুই নেই এখানে কিছু প্রেমের বিষয় বলা হয়েছে আমি বলছি- দৈহিক প্রেমের কথা নারী-পুরুষের দৈহিক সম্পর্কের কথা কিন্তু এটা তো সাহিত্যের শাশ্বত বিষয় আমি বুঝতে পারছি না এইটা আবার এমন কি বিষয় আইনজীবী আবার তাঁকে অনুরোধ করেন, ১৭৮ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় কলামটি দেখুন অনুগ্রহ করে ব্যাপারে আপনার নিজস্ব অভিমত দিন ? উত্তরে তিনি বলেন, ‘এখানে নায়ক কিছু অস্বাভাবিক মিলনের ছবির কথা বলেছেন ছবি সে দেখেছে বলে বর্ণনা করতে পেরেছে এখানে এই ছবির স্মৃতি তাঁর মনে বিতৃষ্ণাই জাগাচ্ছে মানুষ ধরনের  কাজ করতে পারে এটা ভেবেও সে বিরক্ত হচ্ছে তার এই বিরক্তিরই প্রকাশ হয়েছে ছবির উল্লেখে এতেই দেখা যাচ্ছে তার মনের ভিতর একটা ভাল লোকও আছে ধরনের বিকৃতির নিন্দার মধ্য দিয়ে এই প্যাসেজ অনেকটা নৈতিক মূল্যই পাচ্ছে একই কথা বলা যায় ২০০ পৃষ্ঠার তৃতীয় কলাম সম্পর্কেও প্রজাপতি কতোটা সাহিত্যে নির্ভর উপন্যাস, তা যে কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে বুদ্ধদেব বসুকে প্রশ্ন করা হয়েছিলএই উপন্যাসে সাহিত্যে বলে কিছু আছে বলে আপনি মনে করে ? তার উত্তর তিনি দেন এভাবে, ‘তার উত্তর আমি অনেকটা পূর্বেই দিয়েছি সাধারণত এখানে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তা মোটেই সাহিত্য নির্ভর ভাষা নয়; কিন্তু পরিবেশ কাঠামোর ভিতর দিয়ে এখানে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তার মধ্যে দিয়েই উপন্যাসটি জীবন্ত য়ে উঠেছে উপন্যাসটি পশ্চিমবঙ্গ সমাজের একটি চিত্র মাত্র বুদ্ধদেব বসু আবার থেমে-থেমে বলতে থাকেন, এই উপন্যাসে জিনার কাহিনি সমাজব্যবস্থার সমালোচনা একদল ধনী শিল্পপতি সুখেনকে ব্যবহার করতো সে ছিল তাদেরই রক্ষাকর্তা আইন পক্ষের আরেকজন আবার প্রশ্ন করে বসেন তাঁকে; আপনি কি মনে করেন এই উপন্যাসকে সমাজের পক্ষে প্রয়োজনীয় কোনোও দলিল হিশেবে গণ্য করা যায় ? তার উত্তর বুদ্ধদেব বসু দেন এভাবে, ‘সামাজিক এবং নৈতিক উদ্দেশ্য নিয়েই এই উপন্যাসটি লেখা হয়েছে এর মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে সম- সাময়িক সমাজের চিত্র, এর মাধ্যমে পাঠকের চেতনা বৃদ্ধিতো পাবেই; এছাড়া যে সমাজে আমরা বসবাস করি তাকে চিনে নিতে কোনো কষ্ট হবে না বলে আমি মনে করি বস্তুত নিষিদ্ধ এই উপন্যাস নিয়ে বুদ্ধদেব বসু আরো বলেন, ‘ আমি একজন অভিজ্ঞ পাঠক তাই আমার মনে ঘৃণা বা হতাশা জাগার কোনো প্রশ্নই উঠে না আমি বিচলিত হবো না কিন্তু আমি মনে করি বাঙালী পাঠকের এমন অনেকে আছেন, যারা এই বই পড়ে বিচলিত হবেন এবং বিচলিত বোধ করবেন ভালোর জন্যই যারা সমাজে অপেক্ষাকৃত নিরাপদে আছেন তাঁরা; এবং বহু মানীব্যক্তি এই উপন্যাস পড়ে বুঝতে পারবেন আজকের বাস্তব অবস্থাটা কি ! কোন সামাজিক পরিবেশে তাঁরা বাস করছেন সে দিক দিয়ে বিচার করলেপ্রজাপতিবিশেষভাবে অর্থবহ য়ে উঠে নিষিদ্ধ প্রজাপতি, শুধু নিষিদ্ধ য়ে থাকেনি; সেখানে আবার প্রশ্ন উঠেছে তারপবিত্রতানিয়ে পবিত্রতার সাথে সাহিত্যের কি সম্পর্ক; তা স্থির করা আমাদের পক্ষে সম্ভাব নয় যদিও সেই ব্যাপারটিও ঘটে গেছেপ্রজাপতি ক্ষেত্রে আসলেপবিত্রতাবা সাহিত্যেপবিত্রতা মুক্ত ব্যাপারগুলো বার-বার দেখা দিয়েছে বুদ্ধদেব বসুর সাক্ষীর ধারায় তাই রকম প্রশ্নের মুখোমুখি তে হয়েছে বুদ্ধদেবকেপবিত্রতাসম্পর্কে তিনি বলেন, ‘পবিত্রতা  বলতে আপনারা মিলনের স্বাধীনতার অনুপস্থিতির কথা বলছেন এটাই আমি ধরে নেব কেন না আমার যতদূর মনে হয় অশ্লীলতা  নিয়ে যত প্রশ্ন সবই ওঠে নরনারীর এই মিলনের সম্পর্কের বিষয় থেকে কিভাবে এই সম্পর্কের কথা লেখা হয়েছে তাকে কেন্দ্র করেই অশ্লীলতা সংক্রান্ত যত প্রশ্ন সব আবর্তিত প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই সুপ্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সাহিত্য শিল্পে এই মিলনের কথা অবাধে এসেছে কেউ তার উপর কোনও নিষেধবিধি জারি করেননি মহাভারতে বা কালিদাসের কাব্য কিংবা কোনারক খাজুরাহ বা পুরীর মন্দিরে এর দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় এগুলি মহৎ শিল্পকর্ম হিশেবে স্বীকৃত বাংলা সাহিত্যেও ভারত চন্দ্রের বিদ্যা সুন্দর এবং বহু বৈষ্ণব কবিতায় এই সম্পর্কের কথা বেশ খোলাখুলি ভাবে আছে মনে রাখতে হবে জয়দেবের গীতগোবিন্দ এবং অন্যান্য বৈষ্ণব পদাবলী আমাদের দেশে ধর্মীয় সাহিত্য হিশেবে স্বীকৃত সে দিনের মতো কাঠগড়ার সব প্রশ্ন দেন বুদ্ধদেব বসু এভাবে একে-একে সব সময় ব্যয় হয়ে যায় বুদ্ধদেবের পিছনে কিন্তু বাদ থেকে যায় আরো নানা প্রশ্ন কাঠগড়ার এরকম প্রশ্ন শুনে মনে হয় যেন বিচার নির্ভর প্রশ্ন নয়; বাঙলা  সাহিত্যের বিতর্ক সভা কারণ, একজনের সাক্ষী দিতে এসে যদি আইনজীবী প্রশ্ন করেনসাহিত্য কি’ ? যেটা ঘটেছে বুদ্ধদেবের ক্ষেত্রে তাঁকে করা হয়েছিল ঠিক এই প্রশ্নটি বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘সাহিত্য হলো মানব মনের অনুভূতির প্রকাশ; ভাষার মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধিমত্তার রুপায়নপ্রজাপতিউপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছিল বাস্তব চরিত্রের রুপায়ন তাই এখান থেকেও নিস্তার পাননি বুদ্ধদেব বসু তাঁকে আবার প্রশ্ন করা হয়; ‘বাস্তবশব্দটি আপনার কাছে কি হিশেবে ব্যবহার হয় ? তিনি উত্তর দেন, রূপকথা বা রোমান্সে যেসব চরিত্র থাকে ঠিক সে রকম নয় বাস্তব চরিত্র মানে হলো সমসাময়িক সমাজ জীবনে যেরকম মানুষের দেখা পাওয়া যায় তার সঠিক চরিত্রের চিত্রণ উঁচু মাপের সাহিত্যিক হিশেবে নাম উচ্চারিত হয় রবীন্দ্র বঙ্কিমের আদালত দাবী রে তাঁদের রচিত সাহিত্য থেকে এমন কোনো অংশ উল্লেখ করতে যেখানে রয়েছে শ্লীল এর অশ্লীলের ব্যাপারটি কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চূপ থাকেন বুদ্ধদেব বসু স্থির করেন তাঁর মন মতো একটি উত্তর; তিনি বলেন, ‘আমি  মনে করি কোনো রচনা যদি প্রসাদগুণে  সাহিত্য য়ে উঠে তবে তাকে অশ্লীল বলা চলে না আঙ্গিকের দিক দিয়ে বিচার করতে গেলে সাহিত্য হলো  কল্পলোকের সৃষ্টি, কল্পনা প্রসূত লেখা কোনো এক প্রশ্নোত্তরে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্য সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্পর্কে যাঁদের সম্যক জ্ঞান আছে তাঁরাই জানেন সারা জীবন তিনি ছিলেন স্বাধীনতার প্রবক্তা স্বাধীনতার মধ্যে সামাজিক মিলনের স্বাধীনতার কথাও আছে আমি সকলকে মনে করিয়ে দিতে চাই রবীন্দ্রনাথ তাঁরচোখের বালিউপন্যাসে এক হিন্দু বিধবার সঙ্গে এক যুবকের প্রেমের বর্ণনা দিয়েছন এখানে যারা আছেন তাঁদের কি আমি মনে করিয়ে দিতে পারি যে; রবীন্দ্রনাথেরঘরে-বাইরেতে এক অভিজাত বিবাহিতা মহিলা তাঁর স্বামীর বন্ধুর প্রেমে পড়েছেন একথাও আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে; ‘চতুরঙ্গেরবীন্দ্রনাথ একটি মিলনের দৃশ্যকে অপূর্ব কাব্যিক মহিমায় বর্ণনা করেছেন বুদ্ধদেব বসুকে আলোচনার এক সময় বলা হয়আপনার সাহিত্যিক জীবনের শুরু হয়েছিল কল্লোল যুগের বিপ্লবী চিন্তাধারার সঙ্গে, এবং সেটা শেষ হয়েছিল পরবর্তীকালে তার- সমধর্মীদের প্রতি সমর্থনে প্রশ্নের কোনো উত্তর তিনি এড়িয়ে যাননি বুদ্ধদেব বসু বলেন, ‘কল্লোল যুগের জন্য আমি গর্বিত কোনো যুবক লেখক কোনো না কোনো অর্থে যদি বিপ্লবাত্মক না হোন তবে তিনি সার্থক নন যারা বাংলায় লেখেন স্বভাবতই তাঁদের সকলের জন্যই আমার সহানুভূতি আছে আলোচ্য উপন্যাস সম্পর্কে নিশ্চয়ই আমার একটি সুনির্দিষ্ট মতামত আছে এবং আমি তা আগেই জানিয়েছি সাহিত্যেয় অবাধ দৈহিক মিলন নিয়ে লেখা হোক  আপনি কি এই মতবাদের প্রচারক ? রকম একটি প্রশ্ন করা হয় বুদ্ধদেবকে তিনি উত্তর দেন, ‘আমি নিশ্চয়ই স্বাধীনতার দিকে কিন্তু সাহিত্যের স্বাধীনতা কখনোই নির্বিচার হতে পারে না হতে পারে না লাগাম ছাড়া আইনের বাঁধন যদি উঠেও যায় তবুও শিল্পের নিয়ম নীতির গণ্ডী তাকে নিয়ন্ত্রণ করবেই কাঠগড়ায় বুদ্ধদেব বসুকে শুধু সাহিত্য নির্ভর প্রশ্ন করা হয় না; প্রশ্ন করা হয় তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়েও সে সব প্রশ্নের গণ্ডী বেশি দূর আদালত গড়াতে দেননি সাক্ষীর কাঠগড়ায় এসে তিনি কথা বলেছেন সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্য নিয়ে এক সময় বুদ্ধদেব বসুকে আবার প্রশ্ন করা হয়; সাহিত্য সৃষ্টি হয় সমাজের মঙ্গলের জন্য এটা আপনি স্বীকার করেন তো ? বুদ্ধদেব বসু  চমৎকার একটি উত্তর দেন তিনি বলেন, ‘প্রেম-ভালোবাসা এবং সৌন্দর্য যেমন সমাজের পক্ষে উপকারী সাহিত্যেও তেমনই আদালতে সাক্ষী  দিতে এসে বুদ্ধদেব বসুকে আক্রমণাত্মক প্রশ্নে বিদ্ধ করা হয় চতুর্দিক দিয়ে; তাতে তিনি বিচলিত হননি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি উত্তর  দিয়েছেননিষিদ্ধ প্রজাপতিরপক্ষে আদালতের পক্ষ থেকে বুদ্ধদেব বসুকে সর্বশেষ প্রশ্ন করা হয়; আমি মনে করি সাহিত্যের ভাল-মন্দ বিচার করার মতো কোনোও যোগ্যতাই আপনার নাই প্রশ্নের জবাবে বসু উত্তর দেন, ‘দেশে- বিদেশে বহু লোকেই মনে করেন আমি উচ্চ মানের সাহিত্যিক, সমালোচক সাহিত্যবোদ্ধা আমিও তাঁদের সঙ্গে একমত       

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রবন্ধঃ বিষ্ণু দে : ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ থেকে ‘চোরাবালি’

বিষ্ণু দে , তিরিশি কবিদের অন্যতম । কবিতা রচনাই যাঁর কাছে এক এবং অদ্বিতীয় হ ’ য়ে দেখা দেয় । কাব্যে সংখ্যার দিক থেকে অতিক্রম করেছেন সতীর্থদের । বিষ্ণু দে , যাঁর কবিতা রচনার সূচনা পর্বটিও শুরু হয় খুব দ্রুততম সময়ে । কবিতা সৃষ্টির পর্বটি অব্যাহত রেখেছেন সর্বদা । পঁচিশটি কবিতা নিয়ে ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এ নিজেকে প্রকাশ করেন স্ব - মহিমায় । যে কবিতাগুলা বিস্ময়বিমুগ্ধ ক ’ রে অন্যেদেরকেও । ওই কবিতা শুধু বিষ্ণু দে ’ কে নয় , বরং নতুনতর হ ’ য়ে দেখা দেয় বাঙলা কবিতা । বিষ্ণু দে ’ র ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’ রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হয়েছিল দু ’ বার । ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এর কবিতাগুলির রচনাকালের ব্যাপ্তি দেওয়া আছে ( ১৯২৮ - ১৯৩৩ ) সময়ের মধ্যে , এবং গ্রন্থকারে প্রকাশ পায় ওই একই বছরে অর্থাৎ , ১৯৩৩ - এ । কিন্তু রচনাকালের ব্যাপ্তি ১৯২৮ দেওয়া থাকলেও প্রকৃত পক্ষে এ সকল কবিতাগুলো রচনা পর্ব শুরু হয় আরো দু ’ বছর পূর্বে অর্থাৎ , ১৯২৬ - এ । যখন কবি হিশেবে বিষ্ণু দে একেবারেই নতুন এবং নবীন । ১৯৩৩ - এ ...

প্রবন্ধঃ অমিয় চক্রবর্তী : ‘বৃষ্টি’ নিয়ে তিনটি কবিতা

রবীন্দ্রনাথ, মেঘ-বরষা বৃষ্টি নিয়ে এতো সংখ্যক কবিতা লিখেছেন যে তাঁর সমান বা সমসংখ্যক কবিতা বাঙলায় কেউ লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কবিতায় বার বার এবং বহুবার ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, বরষা, বৃষ্টি। বৃষ্টি নামটি নিলেই মনে পড়ে কৈশোর পেড়িয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটির কথা। ‘দিনের আলো নিবে এল সূর্য্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।’ বৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার কথা মনে পড়লে এটাই চলে আসে আমার মনে। অমিয় চক্রবর্তী বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। বাঙলায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেনি এমন কবির সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় পাই ‘বৃষ্টি’ নামক কিছু সৌন্দর্যময় কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে। ওই কবিদের কারো কারো কবিতা দ্রুত নিঃশ্বাসে পড়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি নামক প্রথম কবিতাটি পাওয়া যাবে অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠোতে’। উন্নিশটি কবিতা নিয়ে গ’ড়ে উঠে ‘একমুঠো’ নামক কাব্য গ্রন্থটি। যেখান থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতায় তুলে নেওয়া হয় চারটি কবিতা। আমার আরো ভালোলাগে ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি ওই তালিকায় উঠে আসে। শ্রেষ্ঠ কবিতায় না আসলে আমার যে খুব খারাপ লাগতে তা-ও নয়। ওই কবিতা...

প্রবন্ধঃ বুদ্ধদেব বসু ও ‘কঙ্কাবতী’

বুদ্ধদেব বসু প্রেমের অজস্র কবিতা রচনা করেছেন । অন্য অনেকের মতো তিনিও বেছে নেন একজন প্রেমিকাকে , যে হ ’ য়ে উঠে বুদ্ধদেবের অতুল্য প্রেমিকা হিশেবে । ‘ কঙ্কাবতী ’ অনিন্দ্য প্রেমিকা হ ’ য়ে বুদ্ধদেবের কাব্যতে বিচরণ ক ’ রে স্বচ্ছন্দে । স্থির হয়ে বসে পড়ে কঙ্কাবতী ’ কাব্যগ্রন্থে । যে কাব্যগ্রন্থে ‘ কঙ্কাবতী ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে ‘ কঙ্কাবতীকে ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে কঙ্কাবতীকে আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো কবিতায় । যেখানে সে প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে কুৎসিত কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু নয় । প্রগাঢ় ভাবে প্রাপ্তির জন্যে সমস্ত কবিতা জুঁড়ে দেখতে পাই কবির অপরিবর্তনীয় আবেদন । কঙ্কাবতী , যাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময়ের জন্যে রক্তের হিমবাহে দেখা দেয় চঞ্চলতা । সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হাঁরিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো , যা বলার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন । প্রেমিকা যখন খুব কাছাকাছি হয়ে এগিয়ে আসেন , ওই ব্যর্থ ...