সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রবন্ধঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: চেতনায় ধর্ম বিশ্বাস


"দাও হস্তে তুলি
নিজ হাতে তোমার অমোছা শরতাল,
তোমার অক্ষয় তূর্য। অস্ত্রে দীক্ষা দেহো
রুণতরু। তোমার প্রবল পিতৃস্নেহ
ধ্বনিরা উঠুক আজি কঠিন আদেশে।
করো মোরে সম্মানিত নব্বীর বেশে,
দুরূহ কর্তব্যভারে দুঃসাহ কঠোর
বেদনায় পরাইয়া দাও অঙ্গে মোর-
ক্ষতচিহ্ন অলংকার। ধন্য করো দাসে
সফল চেষ্টায় আর নিস্ফল প্রয়াসে।”
                                (ধর্ম, ৬ মাঘ ১৩১৫: ১৯ জানুয়ারি-১৯০৯)

রবীন্দ্রনাথ, চিন্তা করেছেন সমাজ, রাষ্ট্র, সভ্যতা, প্রেম, দুঃখ, আনন্দ, হাসি, কান্না এবং বেদনা নিয়ে। মানব মনের এ দিকগুলো তাঁর সৃষ্টিতে এসেছে বার বার। মনের এমন কোনো দিক নেই, যেখানটাতে তিনি বিচরণ করেননি। বিশ্বাস অবিশ্বাস চেতনাসত্তায় স্থান ক’রে নিয়েছেন ধর্মীয় ভাব এবং তাঁর মূল্যবোধকে। মানব জীবনের এ সত্তায় তিনি বেড়িয়েছেন দিক থেকে দিগান্তরে। কতটুকু বিশ্বাস বা আস্থা ছিল তাঁর ধর্মীয় চেতনা বা বিশ্বাসে? তিনি অটল ছিলেন বিশ্বাস, আর অবিশ্বাস নিয়ে? তাঁর ধর্মীয় চেতনার স্থানটিতে ‘ধর্ম’ (৬ মাঘ ১৩১৫: ১৯ জানুয়ারি ১৯০৯) নামক একটি চেতনা সর্বস্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। সত্য, সুন্দর, মিল, প্রেম ইত্যাদি দিকগুলো তু’লে এনেছেন নানা দিক থেকে, বহুভাবে। ধর্মীয় চেতনার সাথে সত্যের একটি অভূর্তপূর্ব মিল তৈরি করেছেন। তিনি বলেন :
‘মিলনের মধ্যে যে সত্য তাহা কেবল বিজ্ঞান নহে, তাহা আনন্দ, তাহা রসস্বরূপ, তাহা প্রেম। তাহা আংশিক নহে, তাহা সমগ্র কারণ তাহা কেবল বুদ্ধিকে নহে তাহা হৃদয়কেও পূর্ণ করে। যিনি নানাস্থান হইতে আমাদের সকলকে একের দিকে আকর্ষণ করিতেছেন, যাহা সম্মুখে যাঁহার দক্ষিণকর তলছায়ায় আমরা সকলে মুখামুখি করিয়া বসিয়া আছি, তিনি নীরস সত্য নহেন, তিনি প্রেম’। এই প্রেমই উৎসবের দেবতা-মিলনই তাঁহার সজীব সচেতন সন্ধি। সত্য, সুন্দর, দেবতা, মন্দির-এর এক সুন্দর মিলে তৈরি করেছেন ‘প্রেম’ দিয়ে। যে প্রেম কোন জাগতিক প্রেম নয়, পরলৌকিক এবং বিশ্বাস সর্বত্র প্রেমের সাথে উৎসবের এক চমৎকার মিলবন্ধন তৈরি করেছেন। প্রেম একান্ত এবং সেই উৎসব হ’য়ে ওঠে সার্বজনীন। সার্বজনীন উৎসবকে তিনি নিয়ে আসেন বিপরীত মুখী একক সত্তায়। সত্য-সুন্দর এবং প্রেম এর থেকে কোন সময়ই নি®কৃতি পাননি রবীন্দ্রনাথ। তাই আবার বলেন:
“সত্যের পরিপূর্ণতাই প্রকাশ, সত্যের পরিপূর্ণতাই প্রেম, আনন্দ। আমরা তা লৌকিক ব্যাপারেই দেখিয়াছি অপূর্ণ সত্য অপরিস্ফুট। এবং ইহাও দেখিয়াছি যে, যে সত্য আমরা যত সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করিব, তাহাতেই আমাদের তত আনন্দ, তত প্রেম। উদাসীনের নিকট একটা তৃণে কোনো আনন্দ নাই, তৃণ তাহার নিকট তুচ্ছ তৃণের প্রকাশ তাহার নিকট অত্যন্ত ক্ষীণ। কিন্তু উদ্ভিদ বেত্তার নিকট তৃনের মধ্যে যথেষ্ট আনন্দ আছে, কারণ, তৃণের প্রকাশ তাহার নিকট অত্যন্ত ব্যাপক, উদ্ভিদ পর্যায়ের মধ্যে তৃণের সত্য যে ক্ষুদ্র নহে তাহা সে জানে। যে ব্যক্তি আধ্যত্বিক দৃষ্টিদ্বারা তৃণকে দেখিতে জানে তৃণের মধ্যে তাহার আনন্দ আরো পরিপূর্ণ-তাহার নিকট নিখিলের প্রকাশ এই তৃণের প্রকাশের মধ্যে প্রতিবিম্বিত। তৃণের সত্য তাহার নিকট ক্ষুদ্র অষ্ফুট সত্য নয় বলিয়াই সে তাহার আনন্দ তাহার প্রেম উদবোধিত করে। যে মানুষের প্রকাশ আমার নিকট ক্ষুদ্রে, আমার নিক অষ্ফুট, তাহাতে আমার প্রেম অসম্পূর্ণ। যে মানুষকে আমি এতখানি সত্য বলিয়া জানি যে, তাহার জন্য প্রাণ দিতে পারি, তাহাতে আমার আনন্দ আমার প্রেম। অন্যের স্বার্থ অপেক্ষা নিজের স্বার্থ আমার কাছে এত অধিক সত্য যে, অন্যের স্বার্থসাধনে আমার প্রেম নাই-কিন্তু বুদ্ধদেবের নিকট জীব মাত্রেরই প্রকাশ এত সুপরিষ্ফুট যে তাহাদের মঙ্গল চিন্তায় তিনি রাজ্য ত্যাগ করিয়াছিলেন।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সত্যকে দু’টো ভাগে ভাগ ক’রে দেখিয়েছেন। একটি ‘সত্য’ এবং তার অপরটি হলো ‘অপূর্ণ সত্য’। সত্যের সম্পূর্ণটাই যদি সত্য হয় তাহলে তা সত্য। আর অপূর্ণ সত্যের কিছু অংশ যদি সত্য হয়, তাহলে ও তা ‘সত্য’, আর অপূর্ণ সত্যের কিছু অংশ যদি সত্য হয়, তাহলে ও তা ‘সত্য’ এবং অবশিষ্টাংশ ঠিক সত্যের বিপরীতরূপ মিথ্যা। তিনি তাই মিথ্যাটিকে মিথ্যা না ব’লে ওঠেন অপূর্ণ সত্য। যে অপূর্ণ সত্য একক কোন রূপ নয়, তা সত্যর-ই বিপরীতরূপ প্রকাশ করে তোলে। সত্যকে উপলব্ধি করার ব্যাপারটিকে তিনি দেখিয়েছেন সম্পূর্ণরূপ দিয়ে। সেটা কখন অসম্পূর্ণরূপ হ’য়ে উঠে তা আর সত্য হ’য়ে উঠে না, মিথ্যার কথা-ও তিনি বলেননি, বলেছেন অসম্পূর্ণরূপে। সত্যকে সম্পূর্ণরূপে নিলে তা থেকে পাওয়া যাবে আনন্দ এবং প্রেম। আর তার থেকে যদি অসম্পূর্ণরূপ নিই তাহলে কী পাবো, বেদনা আর অপ্রেম না তীব্র ঘৃণা!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎসবের দিনকে ক’রে তুলেছেন সৌন্দর্যের দিন। যে দিনকে নিয়ে তিনি মগ্ন থাকেন চিন্তা-চেতনার সংগীতের সুর দ্বারা। তিনি তাকে আরো গভীর ক’রে তোলেন সুর সংগীতের মধুর কম্পন দ্বারা। তিনি বলেন:
‘মিলনের দ্বারা, প্রাচুর্যের দ্বারা, সৌন্দর্যের দ্বারা আমরা উৎসবের দিনকে বৎসরের সাধারণ দিনগুলির মুকুট মনিস্বরূপ করিয়া তুলি। যিনি আনন্দের প্রাচুর্যে, ঐশ্বর্যে সৌন্দর্যে বিশ্বজগতের মধ্যে অমৃতরূপে প্রকাশমান। উৎসবের দিনে তাঁহারই উপলব্ধি দ্বারা পূর্ণ হইয়া আমাদের মনুষ্যত্ব আপন ক্ষণিক অবস্থাগত সমস্ত দৈন্য দূর করিবে এবং অন্তরাত্মার চিরন্তন ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্য প্রেমের আনন্দে অনুভব ও বিকাশ করিতে থাকিবে। এই দিনে যে অনুভব করিবে, সে ক্ষুদ্র নহে, সে বিচ্ছিন্ন নহে, বিশ্বই তাহার নিকেতন সত্যই তাহার আশ্রয়, প্রেম তাহার চরমগতি। সকলেই তাহার আপন-ক্ষমা তাহার পক্ষে স্বাভাবিক ত্যাগ তাহার পক্ষে সহজ, মৃত্যু তাহার পক্ষে নাই।’ (ধর্ম: ১৩৩৫)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দিনের উজ্জ্বল আলোয়-আলোকিত ক’রে তুলেছেন নিজের বিশ্বাস এবং চেতনায় বিস্তার ঘটিয়েছেন ব্যাপক ও বিস্তৃতভাবে। বিশ্বজগত বা পৃথিবী বা ইহলৌকিক যা-ই বলি না কেন, তিনি দেখতে পেয়েছেন অমৃতরূপে তার প্রকাশ। যে প্রকাশ ইহলৌকিক নয়, তা প্রকাশ পায় পারলৌকিক রূপে, চিন্তা ও চেতনার সত্তায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইতোপূর্বে যে প্রকাশ ধ্বনি ক’রে তুলেছেন, তাঁর বহিঃপ্রকাশ রূপে প্রকাশ পায় এ স্থানটিতে এসে। যখন তিনি ব’লে উঠেন: ‘হে বিশ্বযজ্ঞ প্রাঙ্গনের উৎসব দেবতা আমি কে?’ তাঁর এই ‘আমি কে’-এর সাথে আমার মনে পড়ে যায়... কিছু কবিতার অংশ।

“পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তনের সবক’টি পথ রুদ্ধ যার-
 যদি জানতাম, আমার সব উচ্চারণ তারই উদ্দেশে
এই লিলিহান শিখা এগোতো না এক পাও নিশ্চল দাঁড়াতো।
 কিন্তু যেহেতু এই অন্ধ গহ্বর থেকে জীবিত পালানোর
কোনো পথ নেই, যা শুনছি তা যদি সত্যি হয়
ঈশ্বর নিন্দনে নির্ভর আমি, অবশ্যই জবাব দেবো
তোমার সকল প্রশ্নের।”

এরপর ব্যথিত এবং ব্যাকুল চিত্তে তিনি আবার প্রকাশ করেন: ‘আজ উৎসব দিনে এই আসন গ্রহণ করিবার অধিকার আমার কী আছে? জীবনের নৌকাকে আমি যে প্রতিদিন দাঁড় টানিয়া বাহিয়া চলিয়াছি, সে কি তোমার মহোৎসবের সোনাবাঁধানো ঘাটে আসিয়া আজও পৌঁছিয়াছে? তাহার বাধা কি একটি? তাহার লক্ষ্য কি ঠিক থাকে? প্রতিকূল তরঙ্গে আঘাত সে কি সামলাইতে পারিল? দিনের পর দিন কোথায় সে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে? আজ কোথা হইতে সহসা তোমার উৎসবে সকলকে আহ্বানের ভার লইয়া হে অন্তর্যামিন, আমার অন্তরাত্মা তোমার সমক্ষে লজ্জিত হইতেছে। তাহাকে ক্ষমা করিয়া তুমিই আমাকে আহ্বান করো। একদিন নহে, প্রত্যেহ তাহাকে আহ্বান করো।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার ব্যাকুলচিত্তে অপেক্ষা করতে থাকেন এবং আহবান করেন এক অনন্ত অন্তযার্মির। যিনি তার অস্থির চিত্তকে আরো ব্যাকুল না করে ক’রে তুলে সুস্থির। যে সুস্থির ভাবনা বোধ কবিকে ক’রে তোলেন উৎসব তরঙ্গের এক কাঠামো, যেখানে তিনি-ই এক আশ্চর্য সৌন্দর্যময়ী ভাষ্কর্য।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঈশ্বর ভাবনায় আবার কাতরতা বোধ করেন। এবং নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মসর্ম্পন করেন ঈশ্বরের সামনে। যেখানে তিনি এক অনন্তরূপে, নিজেকে তুলে ধরেন।

রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘হে বিরাম বিভাবরীর ঈশ্বরী মাতা, হে অন্ধকারের অধিদেবতা, হে সুপ্তির মধ্যে জাগ্রত, হে মৃত্যুর মধ্যে বিরাজমান, তোমার- নক্ষত্রদীপিত অঙ্গনতলে তোমার চরণচ্ছায়ায় লুন্ঠিত হইলাম। আমি এখন আর কোনো ভয় করিব না, কেবল আপন ভার তোমার দ্বারে বিসর্জন দিব, কোনো চিন্তা করিব না, কেবল চিত্তকে তোমার কাছে একান্ত সমর্পণ করিব, কোনো চেষ্টা করিব না, কেবল তোমার ইচ্ছায় আমার ইচ্ছাকে বিলীন করিব; কোনো বিচার করিব না, কেবল তোমার সেই আনন্দে আমার প্রেমকে নিমগ্ন করিয়া দিব যে- রবীন্দ্রনাথ, নিজস্ব ভাবনা চেতনা এবং তাঁর এক সুন্দর সমন্বয় ক’রে তোলেন ঈশ্বর ভাবনার সাথে। যে ভাবনা চেতনাগত এবং তার বহিঃপ্রকাশ সুদীর্ঘ। ধর্মীয় বোধ এবং তার কাতরতা রবীন্দ্রনাথকে ক’রে তোলে এক প্রচণ্ড বিশ্বাসীরূপে। যিনি কাতরতা এবং আশ্রয় প্রার্থনা করেন এক বহিঃস্থরূপে। আশ্রয়, প্রার্থনা, কাতরতা, বিসর্জন, সম্পূর্ণ-সবই একক রূপ হয়ে উঠে রবীন্দ্রনাথের কাছে। নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি এবং তার বহিঃ প্রকাশ থেকেও তিনি বিরত থাকেন। সংমিশ্রণ ঘটান নিজস্ব ইচ্ছা নামক শক্তিকে, ঈশ্বর ভাবনার ইচ্ছার শক্তির সাথে। আনন্দ, প্রেম এবং তার সাথে ধর্মীয়বোধকে একক ক’রে তোলেন রবীন্দ্রনাথ। ইচ্ছা আর বিচারশক্তির বিচ্যুতির পূর্বেই সম্পূর্ণ করেন, ভাবগত ভাবনার সাথে, এক চেতনাগত ধর্মীয়বোধকে একক করে।
ধর্মীয় কাতরতাবোধ রবীন্দ্রনাথকে ক’রে তোলে চেতনাগত’র বহিঃপ্রকাশ রূপে। যেখানে তিনি আকুলতা ছাড়া আর কিছুই প্রার্থনা করেন না। আকুলতার পর আকুলতা কবিকে ক’রে তোলে এক বিশ্বজনীন বিশ্বাসী রূপে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন : ‘আমি এখন তোমার নিকট শক্তি প্রার্থনা করি না, আমাকে প্রেম দাও, আমি সংসারে জয়ী হতে চাহি না, তোমার নিকট প্রণত হইতে চাই, আমি সুখ দুঃখকে অবজ্ঞা করিতে চাহি না, সুখ, দুঃখকে তোমার মঙ্গল হস্তের দান বলিয়া বিনয়ে গ্রহণ করিতে চাই।’

ব্যর্থ আর ব্যকুল হৃদয় এক সময় একাকার হ’য়ে উঠে রবীন্দ্রনাথের নিকট মনোভাবনা এবং তার বিনাশ ঘটে যেন খুব কম সময়ে। তিনি হ’য়ে উঠেন এক বহিঃস্থরূপে। ভাবনা আর চেতনাগত দিকগুলো খুব দীর্ঘ হ’য়ে উঠে না, যেভাবে উঠেছিল স্বপ্নগুলো। তিনি বলেন ঃ ‘আজ আমি আর কিছুই চাই না, আমি আজ পাইবার প্রার্থনা করিব না, আজ আমি দিতে চাই, দিবার শক্তি চাই, তোমার কাছে আমি আপনাকে পরিপূর্ণরূপে রিক্ত করিব, রিক্ত করিয়া পরিপূর্ণ করিব। তোমার সংসারে কর্মের দ্বারা তোমার যে সেবা করিব, তাহা নিরন্তর হইয়া আমার প্রেমকে জাগ্রত নিষ্ঠাবান করিয়া রাখুক, তোমার অমৃত সমুদ্রের মধ্যে অতলস্পর্শ যে বিশ্রাম তাহাও আমাকে অবসানহীন শান্তি দান করুক। তুমি দিনে দিনে স্তরে স্তরে আমাকে শতদল পদ্মের ন্যায় বিশ্বজগতের মধ্যে বিকশিত করিয়া তোমারই পূজার অর্ঘ্যরূপে গ্রহণ করো।’

ধর্ম এবং তার ভাববোধকে আরো গভীর ক’রে তোলে তাঁর আবশ্যিকতা থেকে যেখানে এইবোধ প্রকাশ পায় সর্বশ্রেষ্ঠরূপে। প্রয়োজনীয়তা এবং তার বোধ বিশ্লেষণ তাঁকে আরো ব্যাপক করে তোলে ধর্মীয়বোধ থেকে। যে ধর্মীয়বোধ একক ক’রে তোলে রবীন্দ্রনাথকে। ব্যক্তি এবং সার্বজনীন জীবনে কতটুকু প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এই ধর্মবোধের। যাহা-কে কবি আহ্বান করেন ভাবনা আর চেতনা দিয়ে। যে চেতনার বহিঃপ্রকাশ রবীন্দ্রনাথের চিত্তে। ব্যক্তিজীবন এবং পারিপার্শ্বিকতা কতটুকু প্রভাব বিস্তার তার ধর্মীয়বোধ বা চেতনায় ক’রে যে চেতনার ব্যাপক বিস্তৃত উপস্থিতি রয়েছে রবীন্দ্র ভাবনায়। সকল সৌন্দর্য, প্রেম এবং মানব প্রকৃতি সবই একক হয়ে ওঠে ভাবনা বা তার চেতনার দ্বারা যে চেতনার ব্যাপক বিস্তৃত-বিস্তার ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। একক চেতনার ভাবনা বিস্তার থেকে, তার ব্যাপক বিস্তৃত ভাব বিশ্লেষণ রবীন্দ্রনাথকে      ক’রে তোলে আরো বেশি চেতনাময়। যে চেতনায় মগ্ন রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। চিত্র্য- বৈচিত্র্য ভাবনাময় জগৎ এক সময় রবীন্দ্রনাথের নিকট হ’য়ে উঠে ধর্মীয় চেতনাময় জগৎ হ’য়ে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন: ‘ধর্ম আমাদের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ আবশ্যক সন্দেহ নাই-কিন্তু সেই জন্যই তাহাকে নিজের উপযোগী করিয়া লইতে গেলেই তাহার সেই সর্বশ্রেষ্ঠ আবশ্যকতাই নষ্ট হইয়া যায়। তাহা দেশকাল পাত্রের ক্ষুদ্র-প্রভেদের অতীত, তাহা নিরঞ্জন বিকারবিহীন বলিয়াই তাহা আমাদের চিরদিনের পক্ষে আমাদের সমস্ত অবস্থার পক্ষে এত একান্ত আবশ্যক। তাহা আমাদের অতীত বলিয়াই তাহা আমাদিগকে নিত্যকাল সমস্ত পরিবর্তনের মধ্যে ধ্রুব অবলম্বন দান করে। কিন্তু ধর্মকে ধারণা করতে হইবে তো। ধারনা করিতে হইলে তাহাকে আমাদের প্রকৃতির অনুযায়ী করিয়া লইতে হয়। অথচ মানব প্রকৃতি বিচিত্র-সুতরাং সেই বৈচিত্র্য-অনুসারে যাহা এক, তাহা অনেক হইয়া উঠে। যেখানে অনেক, সেখানে জটিলতা অনিবার্য-সেখানে জটিলতা, সেখানে বিরোধ আপনি আসিয়া পড়ে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ধর্ম’-কে ধারণ করেছেন বিস্তারমুখী চেতনাদ্বারা। যে চেতনায় আশা-ভরসায় চিত্ত পূর্ণ হ’য়ে আসে প্রেম, সুন্দর, সত্য এবং প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে। এই বিশ্বাস তাঁর চেতনা দ্বারা কতটা ধ্রুব হ’য়ে ওঠে তাহা ভাব আর ভাবনা কে বিচিত্র মুখী ক’রে তোলে। আনন্দ এবং প্রেমকে সন্নিবেশ করেন ধর্মীয় ভাবদ্বারা। যে ভাবনায় একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করেন আপনসত্তায়। বিস্তারমুখী- ধর্মীয়ভাব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ক’রে তোলে এক চরম বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসেবে। যেখানে বিশ্বাসী হ’য়ে দাঁড়িয়ে থাকেন রবীন্দ্রনাথ নিজ সোপানে।

রবীন্দ্রনাথ বলেন: “ঈশ্বর সম্বন্ধে যত কথা আছে, এই কথাই সর্বাপেক্ষা সরল, সর্বাপেক্ষা সহজ। ব্রহ্মের এই ভাব গ্রহণ করিবার জন্য কিছু কল্পনা করিতে হয় না, কিছু রচনা করিতে হয় না, দূরে যাইতে হয় না, দিনক্ষনের অপেক্ষা করিতে হয় না। -হৃদয়ের মধ্যে আগ্রহ উপস্থিত হইলেই, তাঁহাকে উপলব্ধি করিবার-যথার্থ ইচ্ছা জন্মিলেই, নিঃশ্বাসের মধ্যে তাহার আনন্দ প্রবাহিত হয়, প্রাণে তাঁহার আনন্দ কম্পিত হয়, বুদ্ধিতে তাঁহার আনন্দ বিকীর্ণ হয়, ভোগে তাঁহার আনন্দ প্রতিবিম্বিত দেখি। দিনের আলোক যেমন কেবলমাত্র চক্ষু মেলিবার অপেক্ষা রাখে, ব্রহ্মের আনন্দ সেইরূপ হৃদয় উন্মীলনের অপেক্ষা রাখে মাত্র।”

ঈশ্বর ভাবনা এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা রবীন্দ্রনাথের নিকট হ’য়ে ওঠে এক নৈতিক দায়িত্ব। যে দায়িত্ব বা কতর্ব্য জ্ঞান থেকে তিনি বিচ্যুতি ঘটাননি নিজের ভাব-বিশ্লেষণকে। বিশ্বলোকে নিজের উজ্জ্বল উপস্থিতিকে আরো গভীর ক’রে তোলেন প্রতি মুহূর্তে এবং ব্যাপক ভাবে। শক্তির সাথে সৌন্দর্য এবং প্রেমকে একই বৃত্তে নিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথ। যা সমগ্রভাব নিজস্ব সত্তায় গেঁথে থাকে সু-দৃঢ় ভাবে। রবীন্দ্রনাথ বলেন: ‘এই বিশ্বলোকের মধ্যে সেই বিশ্বলোকেস্বরের যে শক্তি প্রত্যক্ষ, তাহাকেই ধ্যান করি। এইবার উপলব্ধি করি বিপুল বিশ্বজগৎ একসঙ্গে এই মুহূর্তে এবং প্রতিমুহূর্তেই তাহা হইতে অবিশ্রাম বিকীর্ণ হইতেছে। আমরা যাহাকে দেখিয়া শেষ করিতে পারি না, জানিয়া অন্ত করতে পারি না, তাহা সমগ্রভাব নিয়তই তিনি প্রেরণ করিতেছেন। এই বিশ্ব প্রকাশক অসীম, শক্তির সহিত আমার অব্যবহিত সম্পর্ক কী সূত্রে? কোন সূত্র অবলম্বন করিয়া তাঁহাকে ধ্যান করিব।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার ধ্যান করেন একাগ্রচিত্তে মন ও মননে। তিনি বলেন: ‘যিনি আমাদিগকে বুদ্ধিবৃত্তি সকল প্রেরণ করিতেছেন, তাঁহার প্রেরিত সেই ধীসূত্রেই তাঁহাকে ধ্যান করিব। সূর্যের প্রকাশ আমরা প্রত্যক্ষভাব কিসের দ্বারা জানি? সূর্য নিজে আমাদিগকে যে কিরণ প্রেরণ করিতেছেন, সেই কিরণেরই দ্বারা। সেই রূপ বিশ্বজগতের সবিতা আমাদের মধ্যে অহরহ যে ধীশক্তি প্রেরণ করিতেছেন-যে শক্তি থাকাতেই আমি নিজেকে ও বাহিরের সমস্ত প্রত্যক্ষ ব্যাপারকে উপলব্ধি করিতেছে-সেই ধীশক্তি তাঁহারই শক্তি-এবং সেই ধীশক্তি দ্বারাই তাঁহারই শক্তি প্রত্যক্ষভাবে অন্তরের মধ্যে অন্তরতম রূপে অনুভব করিতে পারি।’

‘সত্য’ এবং ‘ধর্ম’, ‘ধর্ম ও ‘সত্য’-একই ভাবে জড়ো হয় তাঁর আপন চিত্তে। যেখানে রয়েছে ধর্ম ভাবনা, সেখানেই উপস্থিত করেছেন সত্যকে। সত্য, আলো, সুন্দর- এই ভাবগুলো একইভাবে একক হ’য়ে উঠে সত্যের মধ্যে দিয়ে। যে সত্যকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধারণ করেছেন সত্য ও সুন্দর রূপে।

ধর্ম ও সত্যকে তিনি কখনও ভাবতে শিখেননি পৃথক ভাবে, বরং ধারণ করেছেন একই সাথে মেধা ও মননে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন-ই চিন্তা করেছেন ধর্ম বা তাঁর তাৎপর্যময় সংজ্ঞা নিয়ে, পাশেই অবস্থান করিয়েছেন ‘সত্য’ নামক বস্তুকে, যা কখনও সত্য বা অসত্য হয়ে রয়।

‘সত্য’-সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাগ্রচিত্তে বলেন: ‘আমাদের অভাব কেবল সত্যের অভাব, আলোকের অভাব, অমৃতের অভাব-আমাদের জীবনের সমস্ত দুঃখ পাপ নিরানন্দ কেবল এই জন্যই। সত্যের জ্যোতির অমৃতের ঐশ্বর্য যিনি কিছু পাইয়াছেন, তিনিই জানেন, ইহাতে আমাদের জীবনের সমস্ত অভাবের একেবারে মূল্যচ্ছেদ করিয়া দেয়। যে সকল ব্যাঘাতে তাঁহার প্রকাশকে আমাদের নিকট হইতে আচ্ছন্ন করিয়া রাখে, তাহাই বিচিত্ররূপ ধারণ করিয়া আমাদিগকে নানা দুঃখ এবং অকৃতিমত্তার মধ্যে অবতীর্ণ করিয়া দেয়। সেই জন্যেই আমাদের মন অসত্য অন্ধকার ও বিনাশের আবরণ হইতে রক্ষা চাহে।’

ধ্যান, সত্য, প্রার্থনা, অন্ধকার এবং তাঁর সাথে নিজের আত্মার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অন্তর এবং তাঁর বাহিরকে আত্মস্থ করিয়েছেন ধ্যানের মাধ্যমে। ধ্যান বা প্রার্থনা-প্রকাশ পায় ধর্মীয় চেতনার-সবচেয়ে বহিঃস্থরূপটি নিয়ে। যাঁর মাধ্যমে একজন সাধারণ ব্যক্তি হ’য়ে উঠে ধর্মীয় ভাব বা চেতনায় ধর্মীয় লোক ব’লে। প্রার্থনা বা ধ্যানকে উপলব্ধি করেছেন আত্মার চেতনালোকের গভীরে নিয়ে, যেখানে তাঁর উদার চিত্তের নির্মল বহিঃপ্রকাশ রয়েছে।
প্রার্থনা, চেতনালোকের বিশ্বাস নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: আমরা ধ্যান যোগে আমাদের অন্তর বাহিরকে যেমন বিশ্বেস্বরের দ্বারাই বিকীর্ণ দেখিতে চেষ্টা করিব তেমনি আমরা প্রার্থনা করিব যে, যে সত্য যে জ্যোতি যে অমৃতের মধ্যে আমরা নিত্যই রহিয়াছি তাহাকে সচেতনভাবে জানিবার যাহা কিছু বাধা, সেই অসত্য সেই অন্ধকার সেই মৃত্যু যেন দূর হইয়া যায়। যাহা নাই তাহা চাই না, আমাদের যাহা আছে তাহাকেই পাইব, ইহাই আমাদের প্রার্থনার বিষয়, যাহা দূরে তাহাকে সন্ধান করিব না, যাহা আমাদের ধীশক্তিতেই প্রকাশিত তাহাকেই আমরা-উপলব্ধি করিব, ইহাই আমাদের ধ্যানের লক্ষ্য। আমাদের প্রাচীন ভারতবর্ষের ধর্ম এইরূপ সরল, এইরূপ উদার, এইরূপ অন্তরঙ্গ, তাহাতে স্বরচিত কল্পনাকুহকের স্পর্শ নাই।’

দুঃখ, শোক, তাপ, শক্তি, উদারতা এবং তার মহত্ব ইত্যাদি শব্দগুলোকে আরো জোড়ালোভাবে চেতনায় স্থির ক’রে নেন রবীন্দ্রনাথ। যার ব্যাপক বিস্তৃত ব্যবহার ঘটিয়েছেন সমস্ত রচনা জুঁড়ে। যেখানে তিনি স্বাধীন, সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যবহারকারী। ‘ধর্ম’- ‘সত্য’-আবার কখনও হ’য়ে ওঠে মানব সমাজের উপাদান ব’লে এবং কখনও সেটাই আবার ফিরে আসে ভারতবর্ষ বা তাঁর আপন লোকে। সেখানে তা ‘সত্য’ বা ‘অ-সত্য’ হ’য়ে রয়। রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থায় কখনো তার ব্যবহার ঘটিয়েছেন শিক্ষা, খষি বা উপনিষদের দ্বারা, যেখানে অবতীর্ণ হয়েছেন অগ্রপথিকের ন্যায়, যিনি সর্বদা এগিয়ে রয়েছেন অন্যদের চেয়ে একটু এগিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন : ‘একদিন নানা দুঃখ ও আঘাতে বৃহৎ শ্মশানের মধ্যে এই দুর্যোগের নিবৃত্তি হইবে-তখন যদি মানবসমাজ এই কথা বলে যে, শক্তির পূজা, ক্ষমতার মত্ততা, স্বার্থের দারুণ দুঃচেষ্টা যখন প্রবলতম, মোহান্ধকার কখন ঘনীভূত এবং দলবদ্ধ ক্ষুধিত আত্ম-ম্ভরিতা যখন উত্তরে-দক্ষিণে পূর্বে-পশ্চিমে গর্জন করিয়া ফিরিতেছিল, তখনো ভারতবর্ষ আপন ধর্ম হারায় নাই, বিশ্বাস ত্যাগ করেন নাই, একমাত্র নিত্যসত্যের প্রতি নিষ্ঠা স্থির রাখিয়াছিল। একের আনন্দ ব্রহ্মের আনন্দ, যিনি জানিয়েছেন, তিনি কিছু হইতেই ভয় প্রাপ্ত হন না। ইহাই যদি হয় তবে ভারতবর্ষে খষিদেব জন্ম, উপনিষদের শিক্ষা, গীতার উপদেশ, বহুশতাব্দী হইতে নানা দুঃখ ও অবমাননা, সমস্তই সার্থক হইবে-ধৈর্য্যরে দ্বারা সার্থক হইবে, ধর্মের দ্বারা সার্থক হইবে, ব্রহ্মের দ্বারা সার্থক হইবে।
‘দম্ভের দ্বারা নহে, প্রতাপের দ্বারা নহে, স্বার্থসিদ্ধির দ্বারা নহে।’

দুঃখ, শোক, অনুতাপ, এগুলোকে জড়ো ক’রে রবীন্দ্রনাথ এগিয়ে যান আপনলোকে যেখানে তিনি নিজেকে বিকশিত করতে পারেন আপন হৃদয়বৃত্তির বিস্তার ঘটিয়ে। মন এবং বিশ্বলোক এক হ’য়ে যায়। প্রার্থনা, দুঃখ-তাপ, এবং আপন বিশ্বলোকে নিমগ্ন থাকেন নিজের চেতনার ধর্মবিশ্বাস দ্বারা। বিশ্বাস বা হৃদয়বৃত্তির বহিঃ প্রকাশ যা-ই বলি না কেন, রবীন্দ্রচেতনায় উন্মেষ ঘটে এক ধর্মীয় বিশ্বাস বোধের। যে বোধ বা শক্তির একক অগ্রদূত হ’য়ে রয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই। তাই আবার ‘দুঃখ’ সম্পর্কে বলেন: ‘দুঃখের মধ্যে, শোকের মধ্যে, অভাবের মধ্যে নতমস্তকে তাঁহাকেই স্বীকার করি যাহার মধ্যে যুগযুগান্তর হইতে সমস্ত জগৎ সংসারে সমস্ত দুঃখ তাপের সমস্ত তাৎপর্য অখণ্ড মঙ্গলে পরিসমাপ্ত হইয়া আছে।’

প্রার্থনা, কামনা, সত্য, ঈশ্বর ভাবনা, গৌরব এবং তাতে তুষ্টি ইত্যাদি প্রকাশ পায় রবীন্দ্র ভাবনায়। সত্যকে ধারণ ক্ষমতা ব্যাপক হ’য়ে উঠে প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে। যে প্রার্থনা কেবল মাত্র আপনলোকের বহিঃপ্রকাশ নয়, তা হ’য়ে ওঠে ঈশ্বরের নিকট নিজের আকুল আর ব্যাকুলচিত্তের মনোবাসনা পূর্ণ উক্তি। প্রাপ্তি এবং প্রার্থনা পূর্বের ‘ধর্ম’ এবং ‘সত্যের’ ন্যায়- এখানে আবার নিজের মতো হ’য়ে উঠে। যার মধ্যে দিয়ে রবীন্দ্র মনোভাব বা সফলতার যাদুর কাঠির আকার ধারণ ক’রে যা কয়েক মূহূর্তের মধ্যেই তার কষ্টের নিঃসারন ঘটায়। সত্য, অসত্য প্রাপ্তি ইত্যাদি ব্যাপারগুলো আবার রবীন্দ্রনাথের নিকট হ’য়ে উঠে ঈশ্বর ভাবনার মতো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন :
 (ক) ‘ইহা মনে রাখিতে হইবে, আমাদিগকে যাহা কিছু দিবার তাহা আমাদের প্রার্থনার বহুপূর্বেই দেওয়া হইয়া গেছে। আমাদের যথার্থ ঈপ্সিত ধনের দ্বারা আমরা পরিবেষ্টিত বাকি আছে কেবল লইবার চেষ্টা, তাহাই যথার্থ প্রার্থনা।’
 (খ)‘ ঈশ্বর এইখানেই আমাদের গৌরব রক্ষা করিয়াছেন। তিনিই সব দিয়াছেন। অথচ এটুকু আমাদের বলিবার মুখ রাখিয়াছেন যে, আমরাই লইয়াছি। এই লওয়াটাই সফলতা, ইহাই লাভ-পাওয়াটা সকল সময়ে লাভ নহে- তাহা অধিকাংশস্থলেই পাইয়াও না পাওয়া, অবশিষ্টস্থলে বিষম একটা বোঝা।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্ম, সাধনা, প্রার্থনা, সত্য-অসত্য, সুন্দর, অসুন্দর ইত্যাদি পর্বগুলো চেতনালোকের প্রকাশ ঘটিয়ে স্থির হননি। তিনি বলেছেন ধর্ম এবং তার প্রচার কার্য নিয়ে। যে ধর্মকে রক্ষণাবেক্ষণ এবং চেতনায় ধারণ করলেই রক্ষা পাবে ধর্ম। প্রচারের মাধ্যমে ধর্মের প্রকাশ না তাকে রক্ষা করলেই তার প্রকাশ এরকম পরিস্থিতিতে তিনি প্রকাশ করেছেন, ধর্মীয় চেতনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি।

তাই এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন: ‘ধর্ম প্রচার কার্য ধর্মটা আগে, প্রচারটা তাহার পরে। প্রচার করিলেই তবে ধর্মরক্ষা হইবে, তাহা নহে, ধর্মকে রক্ষা করিলেই প্রচার আপনি হইবে। মনুষ্যত্বের সমস্ত মহাসত্যগুলিই পুরাতন এবং ‘ঈশ্বর আছেন’ একথা পুরাতনতম। এই পুরাতনকে মানুষের কাছে চিরদিন  নূতন করিয়া রাখাই মহাপুরুষের কাজ। জগতের চিরন্তন ধর্মগুরুগণ কোনো নূতন সত্য আবিষ্কার করিয়াছেন, তাহা নহে-তাঁহারা পুরাতনকে তাঁহাদের জীবনের মধ্যে নূতন করিয়া পাইয়াছেন এবং সংসারের মধ্যে তাহাকে নূতন করিয়া তুলিয়াছেন।’

ধর্মকে রক্ষা এবং তার প্রচার কার্য কতটা স্থিতিবোধগম্য হ’লে তা প্রচার স্বীকার্য হ’বে তা আলোচ্য হ’য়ে উঠে। চেতনাও মানস লোকের স্থির ধর্ম, এখন আর নির্দিষ্ট কোন স্থানে আর স্থির নেই, ধর্ম হ’য়ে উঠে প্রচারযোগ্য। ধর্ম চেতনালোকের একক কোন স্থান থেকে, তাঁর বিচরণ ঘটে বহুরূপে। যেখানে তা প্রকাশ বা প্রচারযোগ্য হয়ে ওঠে। নিজস্ব চেতনায় ধারণ করেই স্থির হয়ে থাকেননি রবীন্দ্রনাথ বরং তাঁর উপলব্ধি এবং প্রচার অনস্বীকার্য নিয়ে চিন্তায় মগ্ন থেকেছেন দিবস-রজনী।

তাই রবীন্দ্রনাথ আবার বলেন: ‘ধর্মকে যাহারা সম্পূর্ণ উপলব্ধি না করিয়া প্রচার করিতে চেষ্টা করে, তাহারা ক্রমশই ধর্মকে জীবন হইতে দূরে ঠেলিয়া দিতে থাকে। ইহারা ধর্মকে বিশেষ গন্ডি আঁকিয়া একটা বিশেষ সীমানার মধ্যে বন্ধ করে। ধর্ম বিশেষ দিনের বিশেষ স্থানের বিশেষ প্রণালীর ধর্ম হইয়া উঠে। তাহার কোথাও কিছু ব্যতায় হইলেই সম্পদ্রায়ের মধ্যে হুলস্থুল পড়িয়া যায়।’

সত্য, সুন্দর, প্রেম, সৃষ্টি, কামনা-এবং সর্বোপরি অপারসৗন্দর্য আরো কমল এবং মসৃন হ’য়ে উঠে যার স্পর্শে, তিনি রবীন্দ্রনাথ। নিজের জীবনকে চালিত করেছেন সত্য সুন্দর- সুন্দরই সত্য। এবং এরই ক্ষণিক প’রে সেই সত্যকে আরো প্রচন্ডরূপে রূপান্তর ঘটান ধর্মের মাধ্যমে। যে ধর্মে বাক্যের পর বাক্যেয় ফিরে আসে সত্য, সত্য, সত্য, । এ ‘সত্য’ একক কোন সত্য নয়। এটা চেতনার বিচ্ছুরণ, যে বিচ্ছুরণ থেকে উজ্জ্বল আলো ঝ’রে পড়ে চেতনা থেকে চেতনায়। যে চেতনার জ্যোর্তিময় সৌন্দর্যে নিজেই স্থির থাকেননি, বরং তাঁর বহুমুখী প্রকাশ ঘটিয়েছেন বহিঃ ভাবনায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরঃ মনও মননে যে ধর্মকে তিনি পোষণ করেছেন, তাঁতে আবার যদি বলা হয় ধর্ম কী? যা আপনি লালন বা ধ্যান করেছেন জীবনময়।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘ধর্ম’ হল: ‘সংসারে একমাত্র যাহা সমস্ত বৈষম্যের মধ্যে ঐক্য, সমস্ত বিরোধের মধ্যে শান্তি আনয়ন করে, সমস্ত বিচ্ছেদের মধ্যে একমাত্র যাহা মিলনের সেতু, তাহাকেই ধর্ম বলা যায়। তাহা মনুষ্যত্বের এক অংশে অবস্থিত হইয়া অপর অংশের সহিত অহরহ কলহ করে না। সমস্ত মনুষ্যত্ব তাহার অন্তর্ভুক্ত তাহাই যথার্থভাবে মনুষ্যত্বের ছোটো বড়ো, অন্তর বাহির সর্বাংশে পূর্ণ সামঞ্জস্য। সেই সুবৃহৎ’ সামঞ্জস্য হইতে বিচ্ছিন্ন হইলে মনুষ্যত্ব সত্য হইতে স্খলিত হয়, সৌন্দর্য হইতে ভ্রষ্ট হইয়া পড়ে। সেই অমোঘ ধর্মের আদর্শকে গির্জার গণ্ডির মধ্যে নির্বাসিত করিয়া দিয়া অন্য যে কোনো উপস্থিত প্রয়োজনের আদর্শ দ্বারা সংসারের ব্যবহার চালাইতে যাই। তাহাতে সর্বনাশী অমঙ্গলের সৃষ্টি হইতে থাকে।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজের জীবনের ধর্ম-কে নিয়ে আসেন গভীর করে। যে ‘ধর্ম’ শুধু রবীন্দ্রনাথের ‘ধর্ম’ হয়ে-ই থাকেনি, বরং তা- হয়ে ওঠে সমগ্র ভারতবর্ষের ধর্ম হয়ে। যা পোষণ করে একটি সমগ্র জাতিসত্তা। শুধু নিজস্ব ভু-মন্ডল বা তাঁর সীমা নয়- বরং গভীর হ’য়ে ওঠে ওই জাতিসত্তার মানসলোকে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজস্ব ‘ধর্ম’-সম্পর্কে বলেন: ‘আমাদের ধর্ম রিলিজন নহে, তাহা মনুষ্যত্বের একাংশ নহে-তাহা পলিটিকস্ হইতে তিরস্কৃত, যুদ্ধ হইতে বহিস্কৃত ব্যবসা হইতে নির্বাসিত, প্রাত্যহিক ব্যবহার হইতে দূরবর্তী নহে। সমাজের কোনো বিশেষ অংশে তাহাকে প্রাচীর বন্ধ করিয়া মানুষের আরাম আমোদ হইতে, কাব্য-কলা হইতে, জ্ঞান- বিজ্ঞান হইতে তাহার সীমানা রক্ষার জন্য সর্বদা পাহারা  দাঁড়াইয়া নাই। ব্রহ্মচর্য গার্হস্থ্য বান প্রস্থ প্রভৃতি আশ্রমগুলি এই ধর্মকেই জীবনের মধ্যে, সংসারে মধ্যে সর্বতোভাবে সার্থক করিবার সোপান। ধর্ম সংসারের আংশিক প্রয়োজন সাধনার জন্য নহে, সমগ্র সংসারই ধর্ম সাধনের জন্য এই রূপে ধর্ম গৃহের মধ্যে গৃহধর্ম রাজত্বে মধ্যে রাজধর্ম হইয়া ভারতবর্ষের সমগ্র সমাজকে একটি অখন্ড তাৎপর্য দান করিয়াছিল। সেই জন্য ভারতবর্ষ, যাহা অধম, তাহাই অনুপযোগী ছিল-ধর্মের দ্বারাই সফলতা বিচার করা হইত। অন্য সফলতা দ্বারা ধর্মের বিচার চলিত না।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হ’য়ে উঠেন ধর্মের অগ্রপথিক। যে পথে শুধু নিজেকে নয়, মানবচেতনার প্রতিটি ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দিকটিও তু’লে আনেন নিজের দিকেই। ভাবও ভাবনাকে একত্রে সংমিশ্রণ ঘটান সংসার নামক জায়গাটিতে। ব্যক্তি এবং তাঁর প্রাত্যহিক কর্মগুলোকে স্থান করে দেন ধর্মীয়ভাবাপন্নতায়। ধর্মীয় ভাবনা এবং তাঁর প্রতি একনিষ্ঠ উপাসনা নামক ক্রিয়াগুলো ও হ’য়ে উঠে প্রাত্যহিক কর্মে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আরো বলেন: ‘এই জন্য মানব সংসারের মধ্যেই প্রতিদিনের ছোটো বড়ো সমস্ত কর্মের মধ্যেই ব্রহ্মের উপাসনা মানুষের পক্ষে একমাত্র সত্য উপাসনা। অন্য উপাসনা আংশিক, কেবল জ্ঞানের উপাসনা, কেবল ভাবের, উপাসনা-সেই উপাসনা দ্বারা আমরা ক্ষণে ক্ষণে ব্রহ্মকে স্পর্শ করিতে পারি, কিন্তু ব্রহ্মকে লাভ করিতে পারি না।’
সত্য, অ-সত্য, প্রার্থনা, উপাসনা, ইত্যাদি দিকগুলো থেকে বিচ্যুতি হননি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভাব-ভবনাও ভাবাবেগের চেয়েও বেশি কাতরতা বোধ করেছেন ধর্মীয়নুভূতি দিকগুলোর প্রতি। যে সকল অনুভূতি চরম ও সত্যরূপে প্রবেশ করেছে রবীন্দ্রচেতনায়। রবীন্দ্রনাথ ‘সত্য’ এবং তাঁর প্রতি আকূল আবেদন ছিল রবীন্দ্র জীবন দর্শায়। সত্য কখনো প্রকাশ পেয়েছে সুন্দর হয়ে; আবার একই ভাবনায় ‘সুন্দর’ ও হ’য়ে উঠেছে ‘সত্য’ রূপে। যে ‘সত্য’ ও ‘সুন্দরের’ পূজারী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘ জীবনব্যাপি। সত্য ও সুন্দর-কে আহ্বান কখনোও কখনোও, রবীন্দ্রনাথের নিকট হ’য়ে উঠেছে একজন বিশ্বাসী ধর্মপরায়ণরূপে। যিনি সমগ্র জীবন ধ’রে শুধুই বলেছেন- সত্য-সত্য-সত্য, সুন্দর-সুন্দর-সুন্দর। যে সত্য ও সুন্দর যেন রবীন্দ্রনাথের এক দীর্ঘ প্রতিবিম্ব হ’য়ে রয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন : ‘আমাকে অসত্য হইতে সত্যে লইয়া যাও, প্রতিনিমেষের খণ্ডতা হইতে তোমার অনন্ত পরিপূর্ণতার মধ্যে আমাকে উপনীত করো; অন্ধকার হইতে আমাকে জ্যোতিতে লইয়া যাও-অহংকারের যে অন্তরাল, বিশ্বজগৎ আমার সম্মুখে যে স্বাতন্ত্র লইয়া দাঁড়ায়, আমাকে এবং জগৎকে তোমার ভিতর দিয়া না দেখিবার যে অন্ধকার তাহা হইতে আমাকে মুক্ত করো, মৃত্যু হইতে আমাকে অমৃতে লইয়া যাও-আমার প্রবৃত্তি আমাকে মৃত্যু দোলায় চড়াইয়া দোল দিতেছে, মুহূর্তকাল অবসর দিতেছে না, আমার মধ্যে আমার ইচ্ছাগুলোকে খর্ব করিয়া আমার মধ্যে তোমার আনন্দকে প্রকাশমান করো, সেই আনন্দই অমৃতলোক।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ধর্ম’-গ্রন্থের বেশির ভাগ অংশগুলো রচনা করেন, যখন তাঁর বয়স চল্লিশ থেকে সাতচল্লিশ এর মধ্যেবর্তী সময়ে। এই গ্রন্থে তিনি তুলে আনেন বিভিন্ন সমাজ, রাষ্ট্র সভ্যতা, এর দিকগুলোর চেয়েও মানুষের ধমানুভূতির দিকগুলো। তাই রচনা করেন “মনুষত্ব”, “ধর্মের সরল আদর্শ,” “প্রার্থনা,” “ধর্মপ্রচার,” এবং “দুঃখ” নামক বিভিন্ন লেখাগুলো। যে রচনার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের মানবীয় দিকগুলো। প্রকাশ পায় রবীন্দ্র ব্যাকুল চিত্তের উৎফুল্ল বহিঃ প্রকাশ। বিশ্বাস এবং তাঁর গভীর অস্তিত্বের প্রকাশ পায় ‘ধর্ম’-নামক গ্রন্থে। যে গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ হ’য়ে উঠেন একজন বিশ্বাসী, প্রার্থনাকারী, অনুনয়কারী, ধর্মে নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি হিশেবে। কি ভাবনা ছিল নিজের মাঝে? এবং বিশেষ ক’রে ধর্মের দিকগুলোর প্রতি, যার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ পায় এ গ্রন্থে। ঈশ্বরের শক্তি বা তাঁর বিকাশকে নিজের মতো করে প্রকাশ করেন, এবং বলেন:
‘ঈশ্বরের শক্তি বিকাশকে আমরা প্রভাতের জ্যোতিরুন্মেষের মধ্যে দেখিয়াছি, ফাল্গুনের পুষ্প পর্যাপ্তির মধ্যে দেখিয়াছি মহা সমুদ্রের নীলাম্বুনৃত্যের মধ্যে দেখিয়াচি। কিন্তু সমগ্র মানবের মধ্যে যেদিন তাহার বিরাট বিকাশ দেখিতে সমাগত হই, সেইদিন আমাদের মহামহোৎসব। মনুষ্যত্বের মধ্যে ঈশ্বরের মহিমা যে শত শত অভ্রভেদী শিখর মালায় জাগ্রত-বিরাজিত সেখানে সেই উড়–ঙ্গ শৈলাশ্রমে আমরা মানবমাহাত্মের ঈশ্বরকে মানব সংঘের মধ্যে বসিয়া পূজা করিতে আসিয়াছি।’

ঈশ্বর এবং ঈশ্বর ভাবনা ও তাঁর প্রতি আকুলতা রবীন্দ্রনাথকে ক’রে তোলে একজন বিশ্বাসী এবং ধর্মপরায়ন ব্যক্তিরূপে। যে প্রার্থনা বা আকুলতার মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পায় রবীন্দ্রনাথের অভ্যন্তরীণ বিশ্বাসবোধের স্থানটি। তিনি আহ্বান করেন :
“হে ঈশ্বর, তুমি আজ আমাদিগকে আহ্বান করো। বৃহৎ মনুষ্যত্বের মধ্যে আহ্বান করো। আজ উৎসবের দিন শুধুমাত্র্ ভাব ও রস সম্ভোগের দিন নহে। শুধুমাত্র মাধুর্যের মধ্যে নিমগ্ন হইবার দিন নহে-
আজ বৃহৎ সম্মিলনের মধ্যে শক্তি উপলব্ধির দিন, শক্তি সংগ্রহের দিন। আজ তুমি আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন জীবনের প্রাত্যহিক জড়ত্ব প্রাত্যহিক ঔদাসীন্য হইতে উদবোধিত করো, প্রতিদিনের নিবীর্য নিশ্চেষ্টতা হইতে আরাম আবেশ হইতে উদ্ধার করো। যে কঠোরতায় যে উদ্যমে যে আত্মবিসর্জনে আমাদের সার্থকতা, তাহার মধ্যে আমাদিগকে প্রতিষ্ঠিত করো। আমরা এতগুলি মানুষ একত্র হইয়াছি। আজ যদি যুগে যুগে তোমার মনুষ্য সমাজের মধ্যে যে সত্যের গৌরব যে প্রেমের গৌরব যে মঙ্গলের গৌরব যে কঠিন বীর্য নির্ভীক মহত্ত্বের গৌরব উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছে, তাহা না দেখিতে পাই, দেখি কেবল ক্ষুদ্রদীপের আলোক, তুচ্ছ ধনের আড়ম্বর, তবে সমস্তই ব্যর্থ হইয়া গেল-যুগে যুগে মহাপুরুষের কণ্ঠ হইতে যে সকল অভয়বাণী অমৃতবাণী উৎসারিত হইয়াছে, তাহা যদি মহাকালের মঙ্গলশঙ্খ নির্ঘোষের মতো আজ না শুনিতে পাই-শুনি কেবল লৌকিকতার কলকলা এবং সাম্প্রদায়িকতার বাগ্ বিন্যাস-তবে সমস্তই ব্যর্থ হইয়া গেল।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সত্য, সুন্দর, ঈশ্বর, প্রার্থনা, পবিত্র, অপবিত্র ইত্যাদির মধ্যেই স্থির হননি, বরং কবিতা এবং তাতে নিজের ধর্মবোধের দিকটি তুলে এনেছেন সুষ্প®ষ্টভাবে। ধর্ম, প্রেম এবং তাঁর সৌন্দর্যবোধে তিনি-ই অবতীর্ণ হয়েছেন, হ’য়ে উঠেছেন একজন চরম সত্য ও সুন্দরের সাধক পুজারীরূপে। ‘চৈতালি’ (১৫ আশ্বিন ১৩০৩: ৩০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৬) গ্রন্থে ‘মানসী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়ে আসেন বিধাতার দ্বারা নারী সৃষ্টির ক্রিয়াটি।

‘শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী
পুরুষ গড়েছে তোরে-সৌন্দর্য সঞ্চারি’

যে নারী আবার কখনও হ’য়ে উঠেন সৌন্দর্যের চরম বহি: প্রকাশ রূপে। একই কাব্যগ্রন্থের ঠিক পরের কবিতাটি ‘নারী’। যেখানে তিনি নারী বা তার সৌন্দর্যকে নিয়ে আসেন প্রতিমা সমপর্যায়ে। যে প্রতিমা তার নিজের ধর্মবোধের বা বিশ্বাসের একটি উপাদান বা নিয়ামক হিসেবে গণ্য হয়। তাই বলেন:

‘তুমি এ মনের সৃষ্টি, তাই মনোমাঝে
এমন সহজে তব প্রতিমা বিরাজে।’

রবীন্দ্রনাথ ভাবনা ও বোধের সাথে একত্রে নিয়ে আসেন নিজের চেতনার দিকটিও। একই সাথে একজন প্রার্থনাকারী হিসেবে উপস্থিত হন। ‘প্রার্থনা’-কবিতায় (চৈতালি: ১৪ শ্রাবণ ১৩০৩), যেখানে মনে হয়, সমস্তু কিছু শেষ হওয়ার পরও যেন চাওয়ার বাকী রয়েছে, অন্য কোন ভাবনাও ভাবাবেগময় একই সাথে প্রকাশ করেন:

‘প্রাণে দিবস রজনী উঠিতেছে ধ্বনি
তোমারি বীণার গুঞ্জনা।’

যে ধ্বনি গুঞ্জনা সম-সাময়িক কোন ব্যাপার নয়, বরং তা মননের সাথে সংম্রিশন রয়েছে তাঁর, যা রবীন্দ্রনাথের অভ্যন্তরীণ ভাবনা বোধের স্থানটি, যেখানে তিনি একাকী এবং একজন বিশ্বাসী ব্যক্তি রূপে জাগ্রত হন।
‘পূরবী’ (শ্রাবণ ১৩৩২ : ১৯২৫) গ্রন্থে ‘চাবি’- কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হয়ে ওঠেন বিধাতার মনও মননের প্রতীক রূপে। যেখানে নিজের সৃষ্টিকে প্রকাশ না করলেও ‘মনকে’ সৃষ্টির ব্যাপারটি নিয়ে আসেন সুষ্পষ্ট ভাবে। তাই-ওই বোধ এর বহিঃপ্রকাশ ঘটান এভাবে ঃ

‘বিধাতা যেদিন মোর মন
করিলা সৃজন
বহু কক্ষে-ভাগ করা হর্স্যরে মতন,
শুধু তার বাহিরের ঘরে
প্রস্তুত রহিল সজ্জা নানামত অতিথির তরে,
নীরব নির্জন অন্তঃপুরে
তালা তার বন্ধ করি চাবিখানি ফেলি দিলা দূরে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পুরবী’ (১৯২৪) কাব্যগ্রন্থে রচনা করেছেন ‘সৃষ্টিকর্তা’ নামক একটি কবিতা। যে কবিতা শুধু কবিতা নয় বরং রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় ভাব-দর্শনের একটি জ্যোতির্ময় অবস্থান। ঈশ্বর, ভাবনা, প্রার্থনা সত্য, প্রতিমা, বিধাতা ইত্যাদি দিকগুলো তু’লে আনার পর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবার কবিতায় অবস্থান করান সৃষ্টিকর্তা’কে, যে সৃষ্টিকর্তা, রবীন্দ্রনাথের মনোভাবনা এবং মানসলোকের বিশ্বাসের এক আশ্চর্য সৃষ্টি। ‘সৃষ্টিকর্তা’ (পূরবী: ২৫ ডিসেম্বর ঃ ১৯২৪)-এ বলেন:

‘জানি আমি মোর কাব্য ভালোবেসেছেন মোর বিধি,
ফিরে যে পেলেন তিনি দ্বিগুণ আপন-দেওয়া নিধি।
তাঁর বসন্তের ফুল বাতাসে কেমন বলে বাণী
সে যে তিনি মোর গানে বারংবার নিয়েছেন জানি।
আমি শুনায়েছি তাঁরে শ্রাবণরাত্রির বৃষ্টিধারা
কী অনাদি বিচ্ছেদের জাগায় বেদন সঙ্গীহারা।
যেদিন পূর্ণিমা রাতে পুষ্পিত শালের বনে বনে
শরীরী ছায়ার মতো একা ফিরি আপনার মনে
গুঞ্জরিয়া অসমাপ্ত সুর, শালের মঞ্জুরী যত
কী যেন শুনিতে চাহে ব্যগ্রতায় কবি শিয় নত,
ছায়াতে তিনিও সাথে ফেরেন নিঃশব্দ পদচারে
বাঁশির উত্তর তাঁর আমার বাঁশিতে শুনিবারে।
যেদিন প্রিয়ার কালো চক্ষুর সজল করুণায়
রাত্রির প্রহর মাঝে অন্ধকারে নিবিড় ঘনায়
নিঃশব্দ বেদনা, তার দুটি হাতে মোর হাত রাখি
স্তিমিত প্রদীপালোকে মুখে তার শুদ্ধ চেয়ে থাকি,
তখন আধারে বসি আকাশের তারকার মাঝে
অপেক্ষা করেন তিনি, শুনিতে কখন বীণা বাজে
সে সুরে আপনি তিনি উম্মাদিনী অভিসারিনীরে-
ডাকিতেছেন সর্বহারা মিলনের প্রলয় তিমিরে।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্তত পক্ষে এতোটুকু সান্ত্বনা পেয়েছেন এখানে এসে ‘সৃষ্টিকর্তা’ বা ঈশ্বর’ যা-ই বলি না কেন সাদরে গ্রহণ করেছেন তাঁর সৃষ্টিময় কাব্যকে। সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা, শ্রাবণরাত্রিময় কোন সময়-ই তিনি বাদ দেননি, যে সময় বা মুহূর্তগুলোতে তিনি স্মরণ করেননি সৃষ্টিকর্তাকে। যে সৃষ্টিকর্তা হ’য়ে উঠে তাঁর কবিতার উজ্জ্বল ভাবময় স্মৃতি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ‘সৃষ্টিকর্তা’ কবিতার-ই সৃষ্টিকর্তার মাঝে স্থির থাকেন নি। ‘কড়ি ও কোমল’ (১২৯৩); কাব্যগ্রন্থে ‘প্রার্থনা’-কবিতায় আবার আকুল চিত্তে প্রকাশ করেন সৃষ্টিকর্তার প্রতি নিজের আকুলতা। যে আকুলতা এবং সুধা পিপাসা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবনা ও গুরুগাম্ভীর্যে হয়ে ওঠে এক অনন্ত প্রজ্জ্বলন। যে প্রজ্জ্বলিত দীপ আর নিস্তব্ধ নয়। ‘প্রার্থনা’-কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন:

‘তুমি কাছে নাই ব’লে হেরো, সখা তাই-
‘আমি বড়ো; আমি বড়ো করেছি সবাই।
সকলেই উঁচু হয়ে দাঁড়ায়ে সম্মুখে।
বলিতেছে, এ জগতে আর কিছু নাই।
নাথ, তুমি একবার এসো হাসিমুখে
এরা সবে ম্লান হয়ে লুকাক লজ্জায়
সুখ দুঃখ টুটে যাক তব মহাসুখে
যাক আলো-অন্ধকার তেমার প্রভায়।’

‘প্রার্থনা’, কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আপন মনে আহবান করেন সৃষ্টিকর্তাকে। যে সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর সমতা বা সমভাবাপন্ন হ’য়ে রয়েছেন মানুষের মাঝে। রবীন্দ্রনাথের এই আকুলতা বা প্রার্থনা সঙ্গীত সাময়িক নয়, বরং তা দীর্ঘ ও সুদূরপ্রসারী। জগৎ এবং তাঁর মাঝে থাকা বা না থাকা বা বিরাজ করা বা না করা সবই হয় প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে। যে প্রার্থনার আহ্বান পৌঁছে যায় ‘সৃষ্টিকর্তা’- কবিতা পর্যন্ত। ‘ধর্ম’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আবার ঈশ্বর সন্তুষ্ট বা তুষ্টি দেখা দেয় ক্ষণিক প’রে। কিভাবে বা কী উপায়ে তিনি ঈশ্বরকে তুষ্ট করবেন সে চেষ্টায় বগ্র হ’য়ে উঠে। ধন, মান এবং মানসিকতা দিয়ে তিনি এগিয়ে যান সন্তুষ্টির দিকে। ‘ধর্ম’ (১৩১৫: ১৯০৯) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন :
‘আমাদের পক্ষ হইতে ঈশ্বরকে যদি কিছু দিতে হয়ে তবে কী দিব, কী দিতে পারি? তাঁহার ধন তাঁহাকে দিয়া তো তৃপ্তি নাই-আমাদের একটি মাত্র আপনার ধন দুঃখ ধন আছে তাহাই তাঁহাকে সম্পূর্ণ করিতে হয়। এই দুঃখকেই তিনি আনন্দ দিয়া, তিনি আপনাকে দিয়া পূর্ণ করিয়া দেন-নাহিলে তিনি আনন্দ ঢালিবেন কোনখানে? আমাদের এই আপন ঘরের পাত্রটি না থাকিলে তাঁহার সুধা তিনি দান করিতেন কী করিয়া? ওই কথাই আমরা গৌরব করিয়া বলিতে পারি। দানেই ঐশ্বর্যের পূর্ণতা? হে ভগবান, আনন্দকে দান করিবার বর্ষণ করিবার প্রবাহিত করিবার-এই যে তোমার শক্তি ইহা তোমার পূর্ণতারই অঙ্গ। আনন্দ আপনাতে বদ্ধ হইয়া সম্পূণ হয় না, আনন্দ আপনাকে ত্যাগ করিয়াই সার্থক- তোমার সেই আপনাকে দান করিবার পরিপূর্ণতা আমরাই বহন করিতেছি, আমাদের দুঃখের দ্বারা বহন করিতেছি, এই আমাদের বড়ো অভিমান, এইখানেই তোমাতে আমাতে মিলিয়াছি, এইখানেই তোমার ঐশ্বর্যে আমার ঐশ্বর্যে যোগ-এইখানে তুমি আমাদের অতীত নহ। এইখানেই তুমি আমাদের মধ্যে নামিয়া আসিয়াছ, তুমি তোমার অগণ্য গ্রহ, সূর্য, নক্ষত্র খচিত মহাসিংহাসন হইতে আমাদের এই দুঃখের জীবনে তোমার লীলা সম্পূর্ণ করিতে আসিয়াছ। হে রাজা, তুমি আমাদের দুঃখের রাজা; হঠাৎ যখন অধরাতে তোমার রথচক্রের বজ্র গর্জনে মেদিনী বলির পশুর হৎপিন্ডের মতো কাঁপিয়া উঠে তখন জীবনে তোমার সেই প্রচন্ড আবির্ভাবের মহাক্ষণে যেন তোমার জয়ধ্বনি করিতে পারি, হে দুঃখের ধন, তোমাকে চাহি না এমন কথা সেদিন যে ভয়ে না বলি; সেদিন যেন দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া তোমাকে ঘরে প্রবেশ করিতে না হয়- যেন সম্পূর্ণ জাগ্রত হইয়া সিংহদ্বার খুলিয়া দিয়া তোমার উদ্দীপ্ত ললাটের দিকে দুই চক্ষু তুলিয়া বলিতে পারি, হে দারুণ, তুমিই আমার প্রিয়।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দুঃখ এবং তার সাথে ধর্মের সংমিশ্রন ঘটিয়োছেন পূর্বেই। দুঃখের মধ্যে দিয়ে যেমন তিনি সত্য ও সুন্দরকে দেখতে পান, সেই একইভাবে, সেই দুঃখের মধ্যে দিয়েও ধর্মের দিকটিও তু’লে ধরেন। যে ধর্ম শুধু নিজের ধর্ম নয়; বরং অন্য ধর্মের দিকেও সেই দুঃখ, শোক, অনুতাপ এবং তাঁর বহিঃপ্রকাশ ঘটান। ‘ধর্ম’ গ্রন্থে ‘খৃস্টান ধর্ম’ সম্পর্কে বলেন:
‘মানুষের সকল প্রকার পরিত্রানের একমাত্র মূল্যই সেই দুঃখ। মানুষের নিতান্ত আপন সামগ্রী যে দুঃখ, প্রেমের দ্বারা তাহাকে ঈশ্বরও আপন করিয়া এই দুঃখ সংগমে মানুষের সঙ্গে মিলিয়াছেন- দুঃখকে অপরিসীম মুক্তিতে ও আনন্দ উত্তীর্ণ করিয়া দিয়াছেন- ইহাই খৃস্টান ধর্মের মর্মকথা।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মগ্রন্থ রচনার সমসময়ে রচনা করেন ‘গোরা’ (আষাঢ়: ১৩১৪-১৩১৬) উপন্যাস। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়: গোরা রচনা শুরু শিলাইদহে। ১৩১৪ সালের আষাঢ়ের শেষাধি থেকে ১৩১৬ সালের মাঘ/ফাল্গুন পর্যন্ত। যুক্তির মাধ্যমে তর্ক বিশ্লেষণকে প্রাধান্য দিয়ে ‘ধর্ম’ বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আসেন ‘গোরা’ উপন্যাসে। ‘গোরা’ উপন্যাস রচনা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর (৭ আশ্বিন ঃ ১৯০৮) হেমন্ত বালা দেবীকে বলেন:
‘একটা কথা মনে রেখো, গল্প ফোটোগ্রাফ নয়। যা দেখেছি যা জেনেছি তা যতক্ষন না মরে গিয়ে ভূত হয়, একটায় সঙ্গে আরেকটা মিশে গিয়ে পাঁচটায় মিলে দ্বিতীয়বার পঞ্চত্ব পায় ততক্ষণ গল্পে তাদের স্থানে হয় না। গোরা ও নৌকাডুবির কল্পনা সম্পূর্ণই আমার মাথার থেকে বেরিয়েছে। এমন ঘটনা ঘটেছে বলে জানি নে কিন্তু ঘটলে কী হতে পারত সেইটে ইনিয়েবিনিয়ে লিখেছি। বিদেশের উপাদান নিয়ে আমি কখনো কিছু লিখিনি। বাইরের থেকে মাল মসলা ধার নিয়ে লেখা আমার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসে শুধু ধর্ম নিয়েই কথা বলেননি, বরং বলেছেন হিন্দু ধর্ম এবং গূঢ় মর্ম উপলব্ধি যেখানে শাস্ত্র এবং তার ব্যাপকতা আরো দীর্ঘ হ’য়ে উঠে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কথোপকথন আরো সুদীর্ঘ হতে থাকে, ধর্ম এবং তাঁর যুক্তিতর্ক নিয়ে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: ‘কিন্তু কৃষ্ণদয়াল গোরার এই নতুন পরিবর্তনে যে খুশি হইলেন তাহা মনে হইল না। এমন কি, তিনি একদিন গোরাকে ডাকিয়া বলিলেন, “দেখো বাবা, হিন্দুশাস্ত্রে বড়ো গভীর জিনিস। ঋষিরা যে ধর্ম স্থাপন করে গেছেন তা তলিয়ে বোঝা যে-সে লোকের কর্ম নয়। আমার বিবেচনায় না বুঝে এ নিয়ে নাড়াচাড়া না করাই ভালো। তুমি ছেলে মানুষ, বরাবর ইংরেজি পড়ে মানুষ হয়েছ, তুমি যে ব্রাহ্ম সমাজের দিকে ঝুঁকেছিলে সেটা তোমার ঠিক অধিকারের মতোই কাজ করেছিলে।   সেই জন্যেই আমি তাতে কিছুই রাগ করিনি, বরঞ্চ খুশিই ছিলুম। কিন্তু এখন তুমি যে পথে চলেছ এটা ঠিক ভালো ঠেকছে না। এ তোমার পথই নয়। “গোরা কহিল” বলেন কী বাবা? আমি যে হিন্দু। হিন্দুধর্মের গূঢ় মর্ম আজ না বুঝি তো কাল বুঝব- কোনোকালে যদি না বুঝি তবু এই পথ চলতেই হবে। হিন্দু সমাজের সঙ্গে পূর্ব জন্মের সম্বন্ধ কাটাতে পারিনি বলেই তো এ জন্মে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছি, এমনি করেই জন্মে জন্মে এই হিন্দু ধর্মেরও হিন্দু সমাজের ভিতর দিয়েই অবশেষে এর চরমে উত্তীর্ণ হব। যদি কখনো ভুলে অন্য পথের দিকে একটু হেলি আবার দ্বিগুণ জোরে ফিরতেই হবে।” কৃষ্ণদয়াল কেবলই মাথা নাড়িতে নাড়িতে কহিলেন, “কিন্তু বাবা হিন্দু বললেই হিন্দু হওয়া যায় না। মুসলমান হওয়া সোজা, খৃস্টান যে-সে হতে পারে- কিন্তু হিন্দু! বাস রে ও বড়ো শক্ত কথা। গোরা। সে তো ঠিক। কিন্তু আমি যখন হিন্দু হয়ে জন্মেছি, তখন তো সিংহদ্বার পার হয়ে এসেছি। এখন ঠিকমত সাধন করে গেলেই অল্পে অল্পে এগোতে পারব।”

কৃষ্ণদয়াল। বাবা তর্কে তোমাকে ঠিকটি বোঝাতে পারব না। তবে তুমি যা বলছ সেও সত্য। যার যেটা কর্মফল, নির্দিষ্ট ধর্ম, তাকে একদিন ঘুরে ফিরে সেই ধর্মের পথেই আসতে হবে-কেউ আটকাতে পারবে না। ভগবানের ইচ্ছে। আমরা কী করতে পারি। আমরা তো উপলক্ষ।

কর্মফল এবং ভগবানের ইচ্ছা, সোহংবাদ এবং ভক্তিতত্ত্ব সমস্তই কৃষ্ণদয়াল সম্পূর্ণ সমান ভাবে গ্রহণ করেন-পরস্পরের মধ্যে যে কোনো প্রকার সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে তাহা অনুভব মাত্র করেন না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ধর্ম ভাবনা ও তাঁর চেতনা সংমিশ্রণের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়েছেন ‘গোরা’ উপন্যাসে। যেখানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে একত্রিভূত হ’য়ে উঠে ধর্ম। যে ধর্ম নিজের নির্দিষ্ট ধর্ম নয়, বরং তা হয়ে উঠে সমস্ত ধর্মের সার ভূমিকা হয়ে। স্থানে স্থানে নির্দিষ্ট ক’রে উল্লেখ করেছেন ধর্মগুলো। ‘হিন্দু ধর্ম, ‘মুসলমান ধর্ম এবং ‘খ্রিস্টান ধর্ম’। যে সকল ধর্মের সারতত্ত্ব প্রকাশ পায় ধর্ম-এবং তাঁর তত্ত্ব প্রকাশের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসে তৈরি করেন পৃথক তর্ক কাঠামো যেখানে ধর্ম বক্তব্যেই বেশি হয়ে দেখা দেয়। যিনি চেতনা সর্বস্ত দিয়ে ধারণ করেছেন ধর্ম এবং তার কর্মগুলো। যে কর্ম রবীন্দ্রকর্ম নয়, বরং হয়ে রয় ‘ধর্মকর্ম’ রূপে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “গোরা” উপন্যাসে আবার বলেন: ‘বিনয়ের সহিত কহিল, “আমি দেশের কথা কখনো এমন করে, বড়ো করে, সত্য করে ভাবিনি। কিন্তু একটা আমি জিজ্ঞাসা করি-ধর্মের সঙ্গে দেশের যোগ কী? ধর্ম কি দেশের অতীত নয়?” গোরার কানে সুচরিতার মৃদু কণ্ঠের এই প্রশ্ন বড়ো মধুর লাগিল। সুচরিতার বড়ো বড়ো দুইটি চোখের মধ্যে এ প্রশ্নটি আরো মধুর করিয়া দেখা দিল। গোরা কহিল’, ‘দেশের অতীত যা, দেশের চেয়ে যা অনেক বড়ো, তাই দেশের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায়। ঈশ্বর এমনি করে বিচিত্র ভাবে আপনার অনন্ত স্বরূপকেই ব্যক্ত করছেন। যাঁরা বলেন সত্য এক, অতএব কেবলই একটি ধর্মই সত্য, ধর্মের একটি মাত্র রূপই সত্য-তাঁরা, সত্য যে  এক কেবল এই সত্যটিই মানেন, আর সত্য যে অন্তহীন সে সত্যটা মানতে চান না। অন্তহীন এক অন্তহীন অনেকে আপনাকে প্রকাশ করেন জগতে সেই লীলাই তো দেখেছি। সেই জন্যেই ধর্মমত বিচিত্র হয়ে সেই ধর্মরাজকে নানা দিক দিয়ে উপলব্ধি করাচ্ছে। আমি আপনাকে নিশ্চয় বলছি, ভারতবর্ষের খোলা জানলা দিয়ে আপনি সূর্যকে দেখতে পাবেন- সে জন্যে সমুদ্রে পারে গিয়ে খৃস্টান গির্জার জানলায় বসবার কোনো দরকার হবে না।’

‘সুচরিতা কহিল ‘আপনি বলতে চান, ভারতবর্ষের ধর্মতন্ত্র একটি বিশেষ পথ দিয়ে ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায়।’
‘গোরা’ উপন্যাসের প্রধান দু’টি চরিত্র ‘গোরা এবং ‘সুচরিতা’। যাদের কথোপকথোনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যায় ‘ধর্ম’ এবং তার অন্তনির্হিত তাৎপর্যময় দিকগুলো যেখানে ধর্ম এবং ব্রহ্ম এরকম আরো কতিপয় দিক উঠে আসে, ভাবনা ও চেতনা দ্বারা, যে ভাবনা এবং চেতনা ‘গোরা’ উপন্যাসকে আরো গতিময় ও তাৎপর্যশীল ক’রে তোলে।
সুচরিতার ধর্ম নয় বরং সম্পূর্ণ ভারতবর্ষের ধর্মতন্ত্র নিয়ে একটি বিশেষ প্রশ্ন করেন গোরার নিকট: ভারতবর্ষের ধর্মতন্ত্র একটি বিশেষ পথ দিয়ে ঈশ্বরের দিকে নিয়ে যায় এর বিশেষত্বটি কী?’ এরকম বহুমুখী এবং চেতনা সর্বস্ত প্রশ্ন ‘গোরা’কে বিচলিত না ক’রে বরং তার উত্তরে ‘গোরা’ যখন বলেন:
“সেটা হচ্ছে এই যে, ব্রহ্ম যিনি নির্বিশেষ তিনি বিশেষের মধ্যেই ব্যক্ত। কিন্তু তাঁর বিশেষের শেষ নেই। জল তার বিশেষ, স্থল তাঁর বিশেষ, বায়ু, তাঁর বিশেষ, অগ্নি তাঁর বিশেষ, প্রাণ তাঁর বিশেষ, বুদ্ধি প্রেম সমস্তই তাঁর বিশেষ- গণনা করে কোথাও তাঁর অন্ত পাওয়া যায় না-বিজ্ঞান তাই নিয়ে মাথা ঘুরিয়ে মরছে। যিনি নিরাকার তাঁর আকারের অন্ত নেই। হ্রস্বদীর্ঘ-স্থূলসূক্ষ্মের অনন্ত প্রবাহই তাঁর। যিনি অন্তত বিশেষ তিনিই নির্বিশেষ, যিনি অন্তরূপ তিনিই অরূপ। অন্যান্য দেশে ঈশ্বরকে ন্যূনাধিক পরিমাণে কোনো একটি মাত্র বিশেষের মধ্যে বাঁধতে চেষ্টা করেছে-ভারতবর্ষে ও ঈশ্বরকে বিশেষের মধ্যে দেখবার চেষ্টা আছে বটে, কিন্তু সেই বিশেষকেই ভারতবর্ষ একমাত্র ও চূড়ান্ত বলে গণ্য করে না। ঈশ্বর যে সেই বিশেষকে অনন্ত গুনে অতিক্রম করে আছেন এ কথা ভারতবর্ষের কোনো ভক্ত কোনোদিন অস্বীকার করেন না।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসে ভাবনা, প্রার্থনা, উপাসনা, ঈশ্বর, চেতনা, বিশ্বাস, অবিশ্বাস এবং আরো কতিপয় যুক্তিতর্কময় বিশ্লেষনের দিকগুলো তুলে আনেন আপন মানসে। যে মানসে শুধু ভাবনা নয়, বরং যুক্তিময় দিক উঠে আসে মন ও মানসিকতার। যে মানসিকতায় ঈশ্বর ভাবনা এবং চেতনা পরিপূর্ণ হ’য়ে রয় ঈশ্বরের বন্দনা দিয়ে। যে বন্দনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট হ’য়ে রয় সত্য ও সুন্দর রূপে। যে সত্য ও সুন্দর রবীন্দ্রনাথের নিকট ঈশ্বর প্রার্থনার-ই আর একটি দিক। ঈশ্বরের নিকট শুধু প্রার্থনা নয়, বরং সম্পূর্ণ এবং সর্বস্ত আত্ম সমর্পণ-ই হ’য়ে উঠে ভাবনার দিকটি। যা শুধু প্রার্থনা বা বিশ্বাসের মধ্যে আবদ্ধ থাকে নি, বরং হ’য়ে উঠেছে বিস্তৃত ব্যাপি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাসে আবার বলেন:
“উপাসনা শেষ হইয়া গেল। তখন সুচরিতার চোখ দিয়া জল পড়িতেছে, পরেশবাবু কহিলেন, ‘মা, পিছন দিকে ফিরে তাকিয়ো না, সম্মুখের পথে অগ্রসর হয়ে যাও-মনে সংকোচ রেখো না। যাই ঘটুক, যাই তোমার সম্মুখে উপস্থিত হোক, তার থেকে সম্পূর্ণ নিজের শক্তিতে ভালোকে গ্রহণ করবে এই পণ করে আনন্দের সঙ্গে বেড়িয়ে পড়ো। ঈশ্বরকে সম্পূর্ণরূপে আত্মসমপর্ণ করে তাঁকেই নিজের একমাত্র সহায় করো-তা হলে ভুল ত্রুটি ক্ষতির মধ্যে দিয়েও লাভের পথে চলতে পারবে। আর যদি নিজেকে আধা-আধি ভাগ করো, কতক ঈশ্বরের কতক অন্যত্রে, তা হলে সমস্ত কঠিন হয়ে উঠবে।ঈশ্বরে এই করুণ, তোমার পক্ষে আমাদের ক্ষুদ্র আশ্রয়ের আর যেন প্রয়োজন না হয়।”

ব্রাহ্ম সমাজ ও তাঁর ধর্ম এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন ভাবতে থাকেন তাঁর সংশ্লিষ্টতা এবং ধর্মমত নিয়ে। তিনি আবার বলেন:
‘আনন্দময়ী কহিলেন’ তোমাদের ব্রাহ্মাসমাজে ওকি মানুষের সঙ্গে মানুষকে মিলতে দেবে না? ঈশ্বর ভিতরে যাদের এক করেছেন তোমাদের সমাজ বাহির থেকে তাদের তফাত করে রাখবে? মা, যে সমাজে ছোটো অমিলকে মানে না, বড়ো মিলে সবাইকে মিলিয়ে দেয়, সে সমাজ কি কোথাও নেই? ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষ কি কেবল এমনি ঝগড়া করেই চলবে? সমাজ জিনিসটা কি কেবল এই জন্যেই হয়েছে?’

ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম এ রকম নানাদিকগুলো তু’লে আনেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসে। সমাজ এবং তাঁর সাথে সংশ্লিষ্ট ধর্ম মতের দিকগুলো এক হ’য়ে উঠে এই উপন্যাসে। যে উপন্যাস ভাবাবেগে বা স্রোত প্রবাহিত প্রেমের দীর্ঘ উপাখ্যান নয়।  ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন:
“সমাজের প্রতি কর্তব্য স্মরণ করিয়াই বিনয় ব্রাহ্মবিবাহে সম্মত হয় নাই সে কথা সে বলিল না, তাহার তর্ক চড়িয়া উঠিল। সে কহিল ‘ঐ জায়গায় তোমার সঙ্গে বোধ হয় আমার মিল হবে না। আমি তো ব্যক্তির দিক টেনে সমাজের বিরুদ্ধে কথা বলেছি নে। আমি বলছি, ব্যক্তি এবং সমাজ দুইয়ের উপরেই একটি ধর্ম আছে। সেইটের উপরে দৃৃষ্টি রেখে চলতে হবে। যেমন ব্যক্তিকে বাঁচানোই আমার চরম কর্তব্য নয় তেমন সমাজকে বাঁচানোও আমার চরম কর্তব্য নয়, একমাত্র ধর্মকে বাঁচানোই আমার চরম শ্রেয়।”

ধর্ম, ব্যক্তি, সমাজ-এবং তার উপর টিকে থাকা মানব ধর্মের দিকগুলো আবার বড়ো হ’য়ে উঠে ‘গোরা’ উপন্যাসে। গোরার সেই বহুমুখি প্রশ্ন তুলে আনা হয় এই উপন্যাসে। ব্যক্তি, সমাজ, ধর্মকে কার উপর কতটা নির্ভরশীল তা আবার দেখা দেয় এখানে। গোরার প্রশ্নে আবার প্রকাশ পায়-ব্যক্তি ও সমাজের উপর ধর্ম, না ধর্মের উপর ব্যক্তি ও সমাজ, এই দ্বৈতমুখি প্রশ্ন জোড়ালো হয় ‘গোরা’ উপন্যাসে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপন্যাসে আবার বলেন:
“ব্যক্তি ও নেই সমাজও নেই, অথচ ধর্ম আছে এমন ধর্মকে  আমি মানি নে।” বিনয়ের চোখ চড়িয়া উঠিল। সে কহিল, ‘আমি মানি’। ব্যক্তি ও সমাজের ভিত্তির উপরে ধর্ম নয়, ধর্মের ভিত্তির উপরেই ব্যক্তি ও সমাজ। সমাজ যেটাকে চায় সেইটেকেই যদি ধর্ম বলে মেনে নিতে হয় তা হলে সমাজেরই মাথা খাওয়া হয়। সমাজ যদি আমার কোনো ন্যায়সংগত ধর্ম সংগত স্বাধীনতায় বাধা দেয় তা হলে সেই অসংগত বাধা লঙ্ঘন করলেই সমাজের প্রতি কর্তব্য করা হয়।”

ধর্মবিশ্বাস এবং তার ঐক্যের দিকগুলো নিয়ে আরো গতিশীল হ’তে থাকে ‘গোরা’ উপন্যাস। ‘ধর্ম’ ও ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার জাগিয়ে তোলেন একটি প্রশ্ন। যে প্রশ্ন প্রকাশ পায় ‘গোরা’ উপন্যাসের চরিত্র পরেশবাবুর মাধ্যমে। পরেশবাবু প্রশ্ন করেন, ধর্ম বিশ্বাস সম্বন্ধে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে তোমার মতের ঐক্য আছে তো?
“বিনয় এতটুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল” আপনাকে সত্য- কথা বলি, আগে মনে করতুম আমার বুঝি একটা কিছু ধর্ম বিশ্বাস আছে, তা নিয়ে অনেক লোকের সঙ্গে অনেক ঝগড়াও করেছি, কিন্তু আজ আমি নিশ্চয় জেনেছি, ধর্মবিশ্বাস আমার জীবনের মধ্যে পরিণতি লাভ করেনি। এটুকু যে বুঝেছি সে আপনাকে দেখে। ধর্মে আমার জীবনের কোনো সত্য প্রয়োজন ঘটেনি এবং তার প্রতি আমার সত্য বিশ্বাস জন্মে নি বলেই আমি কল্পনা এবং যুক্তিকৌশল দিয়ে এতদিন আমাদের সমাজের প্রচলিত ধর্মকে নানা প্রকার সূক্ষ্ম ব্যাখা দ্বারা কেবল মাত্র তর্ক নৈপুণ্যে পরিণত করেছি। কোন ধর্ম যে সত্য তা ভাববার আমার কোনো দরকারই হয় না; যে ধর্মকে সত্য বললে আমার জিত হয় আমি তাকেই সত্য বলে প্রমাণ করে বেড়িয়েছি। যতই প্রমাণ করা শক্ত হয়েছে, ততই প্রমাণ করে অহংকার বোধ করেছি। কোনোদিন আমার মনে ধর্ম বিশ্বাস সম্পূর্ণ সত্য ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে কি না তা আজও আমি বলতে পারি নে কিন্তু অনুকূল অবস্থা এবং দৃষ্টান্তের মধ্যে পড়লে সে দিকে আমার অগ্রসর হবার সম্ভাবনা আছে এ কথা নিশ্চিত। অন্তত যে জিনিস ভিতরে ভিতরে আমার বুদ্ধিকে পীড়িত করে, চিরজীবন তারই জয়পতাকা বহন ক’রে বেড়াবার হীনতা থেকে উদ্ধার পাব।”

‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ চরিত্রের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেন হিন্দু এবং তাঁর জাতি ধর্ম। ‘গোরা’ যখন প্রকাশ করেন ‘আমি হিন্দু’। হিন্দু তো কোনো দল নয়। হিন্দু একটা জাতি। এ জাতি এত বৃহৎ যে কিসে এই জাতির জাতিত্ব তা কোনো সংজ্ঞার দ্বারা সীমাবদ্ধ করে বলাই যায় না। সমুদ্রে যেমন ঢেউ নয়, হিন্দু তেমনি দল নয়।’
গোরা আবার যখন বলেন,  ‘যে ঈশ্বর মানুষকে বিচিত্র করে সৃষ্টি করেছেন এবং বিচিত্রই রাখতে চান তাঁকেই আপনারা পূজা করেন এই কথা কল্পনা করেন। যদি সত্যই আপনারা তাঁকে মানেন তবে তাঁর বিধানকে আপনারা স্পষ্ট করে দেখতে পান না কেন, নিজের বুদ্ধির এবং দলের অহংকারে কেন এর তাৎপর্যটি গ্রহণ করছেন না?’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই উপন্যাসে একক কোনো ধর্মকে না এনে বরং তুলে আনে হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের কথা। যে ধর্মের কথা বিরাজ করে ‘গোরা’ উপন্যাসে। ধর্ম এবং তাঁর বহুমুখিতা ভাব নিয়ে এগিয়ে যায় উপন্যাসটি। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুঁড়ে থাকে ধর্ম নিয়ে তাঁর মর্ম কথা। বৈচিত্র্য এবং তাঁর বস্তুনিষ্ট ভাব আরো জোড়ালো হ’য়ে উঠে ওই ভাবের মাধ্যমে। যেখানে ধর্ম তাঁর বিচিত্রতম আরো বহুমুখী হয়ে ওঠে। স্থান, কাল, পাত্র, সময়, এবং তাঁর বহুমুখী কর্মগুলো গভীর হ’য়ে উঠে ‘গোরা’ উপন্যাসে। যে উপন্যাসে ব্যক্তি চরিত্র থেকে ভাববোধ ও ধর্মবোধ বা তাঁর তত্ত্ব বিশ্লেষণ আরো গভীর হ’য়ে দেখা দেয়। ‘গোরা’ উপন্যাসে গোরা বলেন :
“যে হিন্দুধর্ম মায়ের মতো নানাভাবের নানা মতের লোককে কোল দেবার চেষ্টা করেছে, অর্থাৎ, কেবল হিন্দু ধর্মই জগতে মানুষকে মানুষ বলেই স্বীকার করেছে, দলের লোক বলে গণ্য করেনি। হিন্দুধর্ম মূঢ়কেও মানে, জ্ঞানীকেও মানে, এবং কেবলমাত্র জ্ঞানের এক মূর্তিকেই মানে না, জ্ঞানের বহু প্রকার বিকাশকে মানে। খৃস্টানরা বৈচিত্র্যকে স্বীকার করতে চায় না,তারা বলে এক পারে খৃস্টানরা ধর্ম আর এক পারে অনন্ত বিনাশ, এর মাঝখানে কোনো বিচিত্রতা নেই। আমরা সেই খৃস্টানের কাছ থেকেই পাঠ নিয়েছি। তাই হিন্দুধর্মের বৈচিত্র্যের জন্য লজ্জা পাই। এই বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়েই হিন্দুধর্ম যে এককে দেখবার জন্যে সাধনা করছে সেটা আমরা দেখতে পাই না। এই খৃস্টানি শিক্ষার পাক মনের চারিদিক থেকে খুলে ফেলে মুক্তি লাভ না করলে আমরা হিন্দু ধর্মের সত্য পরিচয় পেয়ে গৌরবের অধিকারী হব মা।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এই উপন্যাসে শুধু ধর্মবোধ নয়, সেই সাথে পূজা, ভক্তি, অর্চনা, সমর্পণ ইত্যাদি দিকগুলো জ্ঞানের সাথে সংমিশ্রণে করেন। যে সত্য এবং তার সাথে মূর্তিপূজা এবং ধর্মের একাগ্রতা নিয়ে সেটা আরো গভীর থেকে গভীরে জোড়ালো হ’য়ে দেখা দেয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: “ধর্ম সম্বন্ধে আমার নিজের কোনো বিশেষ সাধনা নেই, কিন্তু সাকার পূজা এবং পৌত্তলিকতা যে একই, মূর্তিপুজাতেই- যে ভক্তিতত্ত্বের একটি চরম পরিনতি নেই, এ কথা আমি নিতান্ত অভ্যস্ত বচনের মতো চোখ বুজে আওড়াতে পারব না। শিল্পে সাহিত্য এমন কি বিজ্ঞানে, ইতিহাসেও মানুষের কল্পনাবৃত্তির স্থান আছে, একমাত্র ধর্মের মধ্যে তার কোনো কাজ নেই এ কথা আমি স্বীকার করব না। ধর্মের মধ্যেই মানুষের সকল বৃত্তির চূড়ান্ত প্রকাশ। আমাদের দেশের মূর্তি পূজায় জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে কল্পনার সম্মিলন হবার যে চেষ্টা হয়েছে সেটাতে করেই আমাদের দেশের ধর্ম কি মানুষের কাছে অন্য দেশের চেয়ে সম্পূর্ণতর সত্য হয়ে ওঠে নি?”
‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সূচরিতা’ ও ‘গোরার’ কথোপকথনের মাধ্যমে তু’লে আনেন শুধু স্বধর্ম নয়, বরং তাঁর আচার এবং মূর্তিপূজাও ধর্ম-কর্মের দিকগুলো।
‘গোরা’ উপন্যাসে সুচরিতার এক প্রশ্ন: ‘গ্রীসে রোমেও তা মূর্তিপূজা ছিল’। এর উত্তরে গোরা প্রকাশ করেন ধর্মবোধ এবং একটি সুষ্পষ্ট প্রতিউত্তর।

“সেখানকার মূর্তিতে মানুষের কল্পনা সৌন্দর্যবোধকে যতটা আশ্রয় করেছিল জ্ঞানভক্তিকে ততটা নয়। আমাদের দেশে কল্পনা জ্ঞান ও ভক্তির সঙ্গে গভীররূপে জড়িত। আমাদের কৃষ্ণ রাধাই বলো, হর পার্বতীই বলো, কেবলমাত্র ঐতিহাসিক পূজার বিষয় নয়, তার মধ্যে মানুষের চিরন্তন তত্ত্বজ্ঞানের রূপ রয়েছে। সেই জন্যই রামপ্রসাদের; চৈতন্যদেবের ভক্তি এই সমস্ত মূর্তিকে অবলম্বন করে প্রকাশ পেয়েছে। ভক্তির এমন একান্ত প্রকাশ গ্রীস রোমের ইতিহাসে কবে দেখা দিয়েছে? আবার যখন প্রশ্ন করেন, ‘কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম ও সমাজের কোনো পরিবর্তন আপনি একেবারে স্বীকার করতে চান না?”

উত্তরে ‘গোরা’ বলেন, “কেন চাইব না? কিন্তু পরিবর্তন তো পাগলামি হলে চলবে না। মানুষের পরিবর্তন মনুষ্যত্বের পথেই ঘটে-ছেলে মানুষ ক্রমে বুড়ো মানুষ হয়ে ওঠে, কিন্তু মানুষ তো হঠাৎ কুকুর বিড়াল হয় না। ভারতবর্ষের পরিবর্তন ভারতবর্ষের পথেই হওয়া চাই, হঠাৎ ইংরাজি ইতিহাসের পথ ধরলে আগাগোড়া সমস্ত পর্যন্ত ও নিরর্থক হয়ে যাবে। দেশের শক্তি, দেশের ঐশ্বর্য, দেশের মধ্যেই সঞ্চিত হয়ে আছে সেইটে আমি তোমাদের জানাবার জন্যই আমার জীবন উৎসর্গ করেছি। আমার কথা বুঝতে পারছ?”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গোরা’ উপন্যাস শেষ করেন এক পবিত্র ভাব গাম্ভীর্যের  মধ্যে দিয়ে। যেখানে ‘ধর্ম’ এবং ‘সত্য’ এক হয়ে রয়। গোরার মধ্যে দিয়ে যখন প্রকাশ পায় ঃ
“কাল রাতে আমি বিধাতার কাছে প্রার্থনা করেছিলাম যে আজ প্রাতঃকালে আমি যেন নূতন জীবন লাভ করি। এতদিন শিশুকাল থেকে আমাকে যে-কিছু মিথ্যা যে কিছু অশুচিতা আবতৃ করেছিল আজ যেন তা নিঃশেষে ক্ষয় হয়ে গিয়ে আমি নবজন্ম লাভ করি। আমি ঠিক যে কল্পনার সামগ্রী প্রার্থনা করেছিলুম ঈশ্বর সে প্রার্থনায় কর্ণপাত করেননি। তিনি তাঁর নিজের সত্য হঠাৎ একেবারে আমার হাতে এনে দিয়ে আমাকে চমকিয়ে দিয়েছেন।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থটি রচনা করেন (১৯০৯-১৯১৬) এবং তা সমসময়েই প্রকাশিত হয়। ১৩১৫ থেকে ১৩২১ পৌষ-পর্যন্ত শান্তিনিকেতন মন্দিরে ও অন্যান্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ যে সকল উপদেশ দিয়েছিলেন তার অধিকাংশই এই গ্রন্থে গ্রন্থিত হয়। রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’-এর উপদেশগুলির অনেকগুলি মৌখিক ভাষণ, পরে বক্তা কর্তৃৃক নূতন করে লিখিত। কতগুলি মূলতই লিখিত ভাষণ।

‘সংশয়’, ‘আত্মার দৃষ্টি’, ‘পাপ’, ‘দুঃখ’, ‘ত্যাগ’, ‘প্রেম’, ‘প্রার্থনা’, ‘মানুষ’, ‘ভাঙাহাট’, ‘দিন’, ‘রাত্রি’ ‘প্রভাতে’, ‘বিশেষ ইচ্ছা’, ‘সৌন্দর্য’, ‘প্রার্থনার সত্য’, ‘বিধান’, ‘পার্থক্য’ ইত্যাদি আরো অনেক লেখা জড়ো হয় শান্তিনিকেতন গ্রন্থে।
(২৯ অগ্রহায়ণ: ১৩১৫ সনে রচিত।) “সামঞ্জস্য” নামক রচনায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেমকে উপলক্ষ্য করে রচনা করেন প্রেম নির্ভর কিছু লেখা। যেখানে তিনি বলেন:
“আমাদের প্রকৃতির মধ্যেও এই স্থিতি ও গতির সামঞ্জস্য আমরা একটি মাত্র জায়গায় দেখতে পাই, সে হচ্ছে প্রেম। এই চঞ্চল সংসারের মধ্যে যেখানে আমাদের প্রেম, কেবলমাত্র সেইখানেই আমাদের চিত্তের স্থিতি- আর সমস্তকে আমরা ছুঁই আর চলে যাই, ধরি আর ছেড়ে দিই, যেখানে প্রেম সেইখানেই আমাদের মন স্থির হয়। অথচ সেইখানেই তার ক্রিয়াও বেশি। সেইখানেই আমাদের মন সকলের চেয়ে সচল। প্রেমেতেই যেখানে স্থির করায় সেইখানেই অস্থির করে। প্রেমের মধ্যেই স্থিতি গতি এক নাম নিয়ে আছে।”

প্রেম এবং তাঁর অপার সৌন্দর্য থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার সেই নিবন্ধেই আলোচনা করেন ‘ঈশ্বর এবং তাঁর ভাবনা নিয়ে। সকল ইন্দ্রিয় জুঁড়ে রয়েছে তার অপার সৌন্দর্য হয়ে। ‘সামঞ্জস্য’ (২৯ অগ্রহায়ণ: ১৩১৫) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন-
“ঈশ্বর তা কেবলমাত্র মুক্ত নন, তা হলে তো তিনি একেবারে নিস্ক্রিয় হতেন। তিনি নিজেকে বেঁধেছেন। না যদি বাঁধতেন, তা হলে সৃষ্টিই হত না এবং সৃষ্টির মধ্যে কোনো নিয়ম কোনো তাৎপর্যই দেখা যেত না। তাঁর যে আনন্দরূপ, যে রূপে তিনি প্রকাশ পাচ্ছেন, এই তো তাঁর বন্ধনের রূপ। এই বন্ধনেই তিনি আমাদের কাছে আপন। আমাদের কাছে সুন্দর। এই বন্ধন তার আমাদের সঙ্গে প্রণয়বন্ধন। এই তাঁর নিজকৃত স্বাধীন বন্ধনেই তো তিনি আমাদের সখা, আমাদের পিতা। এই বন্ধনে যদি তিনি ধরা না দিতেন তা হলে আমরা বলতে পারতুম না যে, স এর বন্ধুজর্নিতা স বিধাতা, তিনিই- বন্ধু তিনিই পিতা তিনিই বিধাতা, এত বড়ো একটা আশ্চর্য কথা মানুষের মুখ দিয়ে বের হতেই পারত না। কোনটা বড়ো কথা? ঈশ্বর শুদ্ধ বুদ্ধ মুক্ত, এইটে?”

না তিনি আমাদের সঙ্গে পিতৃত্বে সখিত্বে পতিত্বে বদ্ধ-এইটে? দুটোই সমান বড়ো কথা। অধীনতাকে অত্যন্ত ছোটো করে দেখে তার সম্বন্ধে আমাদের একটা হীন সংস্কার হয়ে গেছে। এরকম অন্ধ সংস্কার আরো আমাদের অনেক আছে। যেমন আমরা ছোটোকে মনে করি তুচ্ছ। বড়োকেই মনে করি মহৎ-যেন গণিত শাস্ত্রের দ্বারা কাউকে মহত্ব দিতে পারে। তেমনি সীমাকে আমরা গাল দিয়ে থাকি। যেন সীমা জিনিসটা যে কি, তা আমরা কিছুই জানি? সীমা একটি পরমাশ্চর্য রহস্য। এই সীমাই তো অসীমকে প্রকাশ করছে। এ কী অনিবচর্নীয়। এর কী আশ্চর্যরূপ কী আশ্চর্য গুণ, কী আশ্চর্য বিকাশ। একরূপ থেকে আর এক রূপ, এক গুণ হতে আর এক গুণ, এক শক্তি হতে আরেক শক্তি- এরই বা নাশ কোথায়। এরই বা সীমা কোনখানে।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শান্তিনিকেতন’-গ্রন্থের “সংশয়” (২৩ অগ্রহায়ণ: ১৩১৫)-এ এসে আবার সেই ধর্ম এবং তাঁর মনত্বাত্তিক দিকগুলো তুলে আনেন। যা ‘ধর্ম’ এবং তাঁর সংশয়বাদ নিয়ে আরো জোড়ালো হয়ে ওঠে। সংশয় বা আশ্রয় নয় বরং তিনি স্বচিত্তে প্রকাশ করেন মানুষ এবং তাঁর ধর্মবোধের অন্তর দিকটি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এই প্রথম মানুষের অভ্যন্তরের বিশ্বাসের জায়গাটি প্রকাশ করেন বিশ্বাস আর অবিশ্বাস দিয়ে নয় বরং তা প্রকাশ পায় আস্তিক আর নাস্তিক রূপে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: “আমরা মনে করি যে ব্যক্তি নাস্তিক সেই সংশয়ী, কিন্তু আমরা যেহেতু ঈশ্বরকে স্বীকার করি অতএব আমরা আর সংশয়ী নই। এই বলে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছি- এবং ঈশ্বর সম্বন্ধে যাদের সঙ্গে আমাদের মতে না মেলে তাদেরই আমরা পাষণ্ড বলি, নাস্তিক বলি, সংশয়াত্ব বলি। এই নিয়ে সংসারে কত দলাদলি কত বিবাদ বিরোধ কত শাসন পীড়ন তার আর অন্ত নেই। আমাদের দল এবং আমাদের দলের বাহির, এই দুইভাগে মানুষকে বিভক্ত ক’রে আমরা ঈশ্বরের অধিকারকে নিজের দলের বিশেষ সম্পত্তি বলে গণ্য করে আরামে বসে আছি। এ সম্বন্ধে কোনো চিন্তা নেই সন্দেহ নেই। এই বলে কেবল কথাটুকুর মধ্যে ঈশ্বরকে স্বীকার করে আমরা সমস্ত সংসার থেকে তাঁকে নির্বাসিত করে দেখছি। আমরা এমনভাবে গৃহে এবং সমাজে বাস করছি যেন সে গৃহে সে সমাজে ঈশ্বর নেই। আমরা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এই বিশ্বজগতের ভিতর দিয়ে এমনভাবে চলে যাই যেন এ জগতে সেই বিশ্বভূবনেশ্বরের কোনো স্থান নেই। আমরা সকাল বেলায় আশ্চর্য আলোকের অভ্যুদয়ের মধ্যে জাগ্রত হয়ে সেই অদ্ভূত আবির্ভাবের মধ্যে তাঁকে দেখতে পাই নে, এবং রাত্রিকালে যখন অনিমেষ জাগ্রত নিঃশব্দ জ্যোতিস্কলোকের মাঝখানে আমরা নিদ্রার গভীরতার মধ্যে প্রবেশ করতে যাই তখন এই আশ্চর্য শয়নাগারের বিপুল মহিমান্বিত অন্ধকার শয্যাতলের কোনো এক প্রান্তেও সেই বিশ্বজননীর নিস্তব্ধ গম্ভীর স্নিগ্ধমূর্তি অনুভব করে সে। এই অনির্বচনীয়  অদ্ভূত জগৎ কে আমরা নিজের জমিজমা ঘরবাড়ির মধ্যেই সংকীর্ণ করে দেখতে সংকোচবোধ করি নে। আমরা যেন ঈশ্বরের জগতে জন্মই নি-নিজের ঘরেই জন্মেছি-এখানে আমি আমি আমি ছাড়া আর কোনো কথাই নেই-তবু আমরা বলি  আমরা ঈশ্বরকে মানি, তাঁর সম্বন্ধে আমার মধ্যে কোন সংশয় নেই।”

পূর্বেই বলেছি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বর ভাবনা এবং তাঁর প্রতি প্রেমময় ভাবনা আরো অনেক বেশি গতিশীল ক’রে তোলেন। যে ভাবনা রবীন্দ্রনাথের অর্ন্তমুখী ভাবনা নয় বরং তা হ’য়ে ওঠে বহিঃমুখী ভাবনার চেতনার বিস্তার। যে চেতনার দ্বারা কিছুটা অবমুক্ত হোন রবীন্দ্রনাথ নিজেই।

‘সংশয়’ এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আবার বলেন: “ঈশ্বর যে আছেন এবং সর্বত্রই আছেন এ কথাটা যে আমার জানার অভাব আছে তা নয়, কিন্তু আমি অহরহ সম্পূর্ণ এমনভাবেই চলি যেন তিনি কোনোখানেই নেই। এর কারণ কী? তাঁর প্রতি আমার প্রেম জন্মেনি, সুতরাং তিনি থাকলেই বা কী, না থাকলেই বা কী? তাঁর চেয়ে  আমার নিজের ঘরের অতি তুচ্ছ বস্তুও  আমার কাছে বেশি করে আছে। প্রেম নেই-বলেই তাঁর দিকে আমাদের সমস্ত চোখ চায় না, আমাদের সমস্ত কান যায় না, আমাদের সমস্ত মন খোলে না। এই জন্যেই যিনি সকলের চেয়ে  আছেন তাঁকেই সকলের চেয়ে পাই নে-তাই এমন একটা অভাব জীবনে থেকে যায় যা আর কিছুতেই কোনোমতেই পোরাতে পারে না। ঈশ্বর থেকেও থাকেন না-এত বড়ো প্রকান্ড না থাকা আমাদের পক্ষে আর কী আছে। এই না থাকার ভাবে আমরা প্রতি মুহূর্তেই মরছি। এই না থাকার মানে  আর কিছুই না, আমাদের প্রেমের অভাব। এই না-থাকার শুষ্কতায় জগতের সমস্ত লাবণ্য মারা গেল, জীবনের সমস্ত সৌন্দর্য নষ্ট হল। যিনি আছেন তিনি নেই, এতবড়ো ক্ষতি কী দিয়ে পূরণ হবে। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দিনে রাত্রে এই জন্যেই যে গেলুম। সব জানি সব বুঝি, কিন্তু সমস্তই ব্যর্থ-প্রেম আলোকে প্রকাশো জগপতি হে।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “বিশেষ” (১৬ পৌষ : ১৩১৫) শিরোনামে যে অনুচ্ছেদটি রচনা করেন তা-ও হ'য়ে ওঠে ঈশ্বর নির্ভর বা ভাববিশিষ্ট নির্ভর। পরোক্ষভাবে আহ্বান নয়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এখানে উপস্থিত হন  একজন প্রার্থনাকারী হিসেবে। যিনি প্রার্থনা করেন একজন সরল-সোজা মানুষ হিশেবে, যাঁর কাজ-ই যেন অকুণ্ঠচিত্তে প্রার্থনা করা। যে প্রার্থনা যেন চিত্তে জমা থাকা  দীর্ঘ দিনের দুঃখ, কষ্ট, শোকগুলো প্রকাশ পায় সচিত্রে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন:
“হে আমার প্রভু, সেই একলা আমি, বিশেষ আমি, তার মধ্যে  তোমার বিশেষ আনন্দ, বিশেষ আর্বিভাব আছে- সেই বিশেষ আর্বিভাবটি আর কোনো দেশে কোনো কাল নেই। আমার সেই বিশিষ্টতাকে আমি সার্থক করব প্রভু। আমি নামক তোমার সকল হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এই যে  একটি বিশেষ লীলা  আছে, এই বিশেষ লীলায় তোমার সঙ্গে যোগ দেব। এইখানে একের সঙ্গে  এক হয়ে মিলব।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রেম এবং তাঁর সৌন্দর্যকে  আত্মার সাথে একত্রে নিয়ে আসেন বিশ্বভূবনে। যে ভূবনে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, রবং সেই ধর্মবোধও কাজ করে মননে। সৌন্দর্য ও সৃষ্টিশীলতায় বিশাল এক কারিগড় যখন প্রার্থনা করেন আত্মা বা মনের সৃষ্টি সেই ‘নাথের’ নিকট যে ‘নাথ’ তাকে দূরে নয় বরং আরো কাছে আত্মার সাথে একাত্ম ক'রে নেয়। তিনি প্রার্থনা করেন এর মাঝে যেন কোনো দূরত্ব বা ব্যবধান না থাকে। তা যেন হ'য়ে উঠে আত্মার সাথে আত্মার অপার সৌন্দর্যের এক অভূতপূর্ব সমন্বয়। “প্রেমের অধিকার” (১৭ পৌষ: ১৩১৫)-এর রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করেন এক প্রার্থনাময় কবিতা:

“নাথ হে, প্রেম পথে সব বাধা ভাঙিয়া দাও।
মাঝে কিছু রেখো না, থেকো না দূরে।
নির্জনে সজনে অন্তরে বাহিরে নিত্য তোমারে হেরিব,
সব বাধা ভাঙিয়া দাও।“

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেমে  থাকেননি শুধু এই ভাবনা বা ভাবের মাঝে। বরং নিজ থেকেই করেন প্রার্থন্ াযে প্রার্থনা রবীন্দ্রনাথের আত্মার ও মনের প্রার্থনা। “এ প্রেম কার সঙ্গে মানুষ কেমন করে এ কথা কল্পনাতে এনেছে এবং মুখে উচ্চারণ করেছে যে বিশ্বভূবনেশ্বরের সঙ্গে তাঁর প্রেম হবে। বিশ্বভূবন বলতে কতখানি বোঝায় এবং তাঁর তুলনায় একজন মানুষ যে কত ক্ষুদ্র সে কথা মনে করলে যে মুখ দিয়ে কথা সয়ে না। সমস্ত মানুষের মধ্যে আমি ক্ষুদ্র, আমার সুখ-দুঃখ কতই অকিঞ্চিৎকর। সৌরজগতের মধ্যে সেই মানুষ এক মুষ্টি বালুকার মতো যৎসামান্যে এবং সমস্ত নক্ষত্রলোকের মধ্যে এই সৌরজগতের স্থান এত ছোটো যে অঙ্কর দ্বারা তার গণনা করা দুঃসাধ্য প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সৌন্দর্য’ (১৯ পৌষ: ১৩১৫) শীর্ষক রচনায় সেই ‘সত্য’, ‘সুন্দর’ ‘প্রার্থনা’ এবং তার সাথে ঈশ্বরের ভাবনার সত্য নিযে আসেন আপনরূপে। যে রূপ এবং তাঁর সৌন্দর্যের সাথে সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর-ও এক হ’য়ে ধরা দেয়। সৌন্দর্য রচনার শুরুটাই হয় ঈশ্বর সত্য নিয়ে। তাঁর মনও মগজে গেঁথে রয়  সত্যের ভাবনা নিয়ে। সেই ভাবনা শুধু সত্য নয়, একই সাথে তা স্বীকার ক’রে নিতে হয় ভাবনার সাথে। তিনি বলেন:
‘ঈশ্বর সত্য’। তাঁর সত্যকে আমরা স্বীকার করতে বাধ্য। সত্যকে এতটুকু মাত্র স্বীকার না করলে আমাদের নি®কৃতি নেই। সুতরাং অমোঘ সত্যকে আমরা জলে স্থলে আকাশে সর্বত্র দেখিতে পাচ্ছি। কিন্তু তিনি তো শুধু সত্য নন-তিনি “আন্দরূপম মৃতং”। তিনি আনন্দরূপ, অমৃতরূপ। সেই তার আনন্দরূপকে দেখছি কোথায়?

 ‘সৌন্দর্য’-রচনার পরের রচনাটি হলো “প্রার্থনার সত্য” (২০ পৌষ: ১৩১৫), যেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপাসনা, ধ্যান, ঈশ্বর, প্রার্থনা, ইত্যাদি ব্যাপারগুলোকে আবার তুলে আনেন। প্রার্থনার সত্য তা আবার প্রার্থনার মতোই সত্য হয়ে আসে। যা মনোনিবেশ ক’রে সত্যের মতো। ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তাকে ধারণ করা, বা তাঁর জন্য উপাসনা করো যা হ’য়ে উঠে ধর্মবোধেরই চরম বহিঃপ্রকাশ রূপে।

“কেউ কেউ বলেন, উপাসনায় প্রার্থনার কোনো স্থান নেই-উপাসনা কেবলমাত্র- ধ্যান। ঈশ্বরের স্বরূপকে মনে উপলব্ধি করা। সে কথা স্বীকার করতে পারতুম যদি জগতে আমরা ইচ্ছার কোনো প্রকাশ না দেখতে পেতুম। আমরা লোহার কাছে প্রার্থনা করি নে, পাথরের কাছে প্রার্থনা করি নে-যার ইচ্ছাবৃত্তি আছে তার  কাছেই প্রার্থনা জানাই। ঈশ্বর যদি কেবল সত্যস্বরূপ হতেন। কেবল অব্যর্থ নিয়মরূপে তাঁর প্রকাশ হত তা হলে তাঁর কাছে প্রার্থনার কথা আমাদের কল্পনাতেও উদিত হতে পারত না। কিন্তু তিনি নাকি “আন্দরূপমমৃতং”। তিনি নাকি  ইচ্ছাময়, প্রেমময়, আনন্দময়, সেইজন্যে কেবলমাত্র বিজ্ঞানের দ্বারা তাঁকে আমরা জানি নে, ইচ্ছার দ্বারাই- তাঁর ইচ্ছাস্বরূকে আন্দরূপকে জানতে হয়।’ পূর্বেই বলেছি জগতে ইচ্ছার একটি নিদর্শন পেয়েছি সৌন্দর্যে। এই সৌন্দর্য আমাদের ইচ্ছাকে জাগ্রত করে এবং  ইচ্ছার উপরেই তার নির্ভর। এই জন্য আমরা সৌন্দর্যকে উপকরনরূপে ব্যবহার করি প্রেমের ক্ষেত্রে, প্রয়োজনের ক্ষেত্রে নয়।  এই জন্য আমাদের সজ্জ, সংগীত, সৌগন্ধ্য সেইখানেই যেখানে ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার যোগ, আনন্দের সঙ্গে আনন্দের মিলন। জগদীশ্বর তাঁর  জগতে এই অনাবশ্যক সৌন্দর্যের এমন বিপুল আয়োজন করেছেন বলেই আমাদের হৃদয় বুঝেছে, জগৎ একটি মিলনের ক্ষেত্রে-নইলে এখানকার এত সাজসজ্জা একেবারেই বাহুল্য।”

“শান্তিনিকেতন” গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ‘পার্থক্য’ (২৩ পৌষ : ১৩১৫)- শিরোনামে আবার  ঈশ্বর এবং তার প্রকৃতি এক হয়। প্রকৃতি,   ঈশ্বর, ভাব এবং চেতনা সব কিছু নিয়ে বিশ্বজগতের মাঝে নিজের একটি উজ্জ্বল উপস্থাপন করেন। যেখানে ‘প্রকৃতি’ এবং ‘ঈশ্বর ভাবনা’-এক হ'য়ে রয় রবীন্দ্রনাথের ভাবনালোকে।
‘পার্থক্য’-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন:
ক. “ঈশ্বর যে কেবল মানুষকেই পার্থক্য দান করেছেন আর প্রকৃতির সঙ্গে মিলে এক হয়ে রয়েছেন, একথা বললে চলবে কেন? প্রকৃতির সঙ্গেও তাঁর একটি স্বাতন্ত্র আছে নইলে প্রকৃতির উপরে তাঁর তো কোনো ক্রিয়া চলত না।”
খ. “ঈশ্বর এই প্রকৃতিকে কী দিয়ে পৃথক করে দিয়েছেন। নিয়ম দিয়ে।  নিয়ম দিয়ে না যদি পৃথক করে দিতেন তা হলে প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর ইচ্ছার যোগ থাকত না।
একাকার হয়ে থাকলে ইচ্ছার গতিবিধির পথ থাকে না।”
গ. “বিশ্বজগতে ঈশ্বর জলের নিয়ম, স্থলের নিয়ম, বাতাসের নিয়ম, আলোর নিয়ম, মনের নিয়ম, নানা প্রকার নিয়ম বিস্তার করে দিয়েছেন। এই নিয়মকেই আমরা বলি সীমা। এই সীমা প্রকৃতি কোথাও থেকে মাথায় করে এনেছে, তা তো নয়। তার ইচ্ছাই নিজের মধ্যে এই নিয়মকে এই সীমাকে স্থাপন করেছে-নতুবা,  ইচ্ছা বেকার থাকে, কাজ পায় না। এই জন্যই যিনি অসীম তিনিই সীমার আকর হয়ে উঠেছেন-কেবল মাত্র ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা। সেই কারণের উপনিষ্য বলেন, ‘আনন্দদ্যের খল্বিমানি ভূতামি জায়ন্তে।’ সেই জন্যেই বলেন, যিনি  প্রকাশ পাচ্ছেন তাঁর যা কিছু রূপ তা আনন্দরূপ অর্থাৎ মূর্তিমান ইচ্ছা-ইচ্ছা আপনাকে সীমার বেঁধেছে, রূপে বেঁধেছে।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য এবং সেই সাথে ঈশ্বর ভাবনা ও তাঁর নিজের প্রেমের সাথে একাত্ব ক’রে নিয়েছেন তার নিজের আত্মাকে। যে সৌন্দর্য ও প্রেম ভাবনাকে। নিজের মধ্যে না রেখে নিয়ে এগিয়েছেন প্রকৃতির মধ্যে। যে প্রকৃতি ‘প্রেম’ ও ‘ঈশ্বর’ ভাবনা দ্বারা রবীন্দ্রনাথকে আরো প্রকৃতি ও ঈশ্বরপ্রেম রূপে এগিয়ে দেয়।
“প্রকৃতি” (২৪ পৌষ: ১৩১৫) এ বলেন: “ঈশ্বরের সমান না তে পারলে তাঁকে উপলব্ধি করব কী করে? আমরা যতই রেলগাড়ি চালাই আর টেলিগ্রাফের তার বসাই শক্তি ক্ষেত্রে আমরা ঈশ্বর হতে অনন্ত দূরে থেকে যাই। যদি ষ্পর্ধা করে তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবার চেষ্টা করি তা হলে আমাদের চেষ্টা আপন অধিকারকে লঙ্ঘন করে, ব্যাসকাশীর মতো অভিশপ্ত এবং বিশ্বামিত্রের সৃষ্টি জগতের মতো বিনাশপ্রাপ্ত হয়।”

এই জন্যেই জগতের সমস্ত ধর্ম সাধকেরা বারংবার বলেছেন, ঐশ্বর্য পথের পথিকদের পক্ষে ঈশ্বর দর্শন অত্যন্ত দুঃসাধ্য। অন্তহীন চেষ্টা চরমতাহীন পথে তাদের কেবলই ভূলিয়ে ভুলিয়ে নিয়ে যায়।
অতএব, ঈশ্বরকে বাহিরে অর্থাৎ তাঁর শক্তির ক্ষেত্রে কোনো জায়গায় আমরা  লাভ করতে পারি নে। যেখানে যে বালুকনাটির অন্তরালে তিনি রয়েছেন সেই বালুকণাটিকে নিঃশেষে  অতিক্রম করে এমন  সাধ্য কোনো বৈজ্ঞানিকের, কোনো যান্ত্রিকের নেই। অতএব শক্তির ক্ষেত্রে যে লোক ঈশ্বরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে যায়, সে অর্জুনের সঙ্গে  ছদ্মবেশী মহাদেবকে বান মারে-সে বান তাঁকে স্পর্শ করে না। সেখানে না  হেরে উপায় নেই।

এই শক্তির ক্ষেত্রে আমরা ঈশ্বরের দুই মূর্তি দেখতে পাই-এক হচ্ছে অন্নপূর্ণা মূর্তি-এই মূর্তি ঐশ্বর্যের দ্বারা আমাদের শক্তিকে পরিপুষ্ট করে তোলে। আর এক হচ্ছে করালী কালী মূতি-এই মূর্তি আমাদের সীমাবব্ধ শক্তিকে সংহরণ করে নেয়, আমাদের কোনো দিক দিয়ে শক্তির চরমতায় যেতে দেয় না-না টাকায়, না খ্যাতিতে না অন্য কোনো কামনার বিষয়ে। বড় বড় রাজসাম্রাজ্য ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়-বড়ো বড়ো ঐশ্বর্যভান্ডার ভুক্তশেষ নারিকেলের খোলার মতো পড়ে থাকে। এখানে পাওয়ার মূর্তি খুব সুন্দর উজ্জ্বল এবং মহিমান্তিত, কিন্তু যাওয়ার মূতি, হয় বিষাদে পরিপূর্ণ নয় ভয়ঙ্কর। তা শুণ্যতার চেয়ে শূন্যতর, কারণ তা পূর্ণতার অন্তর্ধান।

জগৎ, চিন্তা এবং তাঁর ভাবনা সব  কিছুই রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এসেছেন তাঁর সমস্ত লেখায়। ‘ঈশ্বর’, ‘প্রার্থনা’, ‘পূজা’, ‘নমস্কার’, ‘অর্চনা’, ‘শক্তি’ এবং ‘ঈশ্বর বন্দনা’ সবই একে একে ঈশ্বর সন্তুষ্ট বা তাঁর অর্চনায় নিমগ্ন থেকেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানে রবীন্দ্রানাথকে এক পূজারী বা ঈশ্বর প্রার্থনকারী যা-ই বলি না কেন, তিনি হ'য়ে উঠেন একজন প্রচন্ড বিশ্বাসী ধর্মানুরাগী হ'য়ে। যে চেতনা বা বিশ্বাস তাঁকে আরো বেশি বিশ্বাসী ক'রে তোলে।
একজন বিশ্বাসী বা প্রার্থনাকারী যেমন প্রত্যহ পালন করেন কিছু নিত্যনৈমিত্তিক কর্ম, রবীন্দ্রনাথ ও হ'য়ে উঠেন তাদের মতো। তিনি ও নিজেকে বিচ্যুতি  ঘটান না ওই ক্রিয়াকর্ম থেকে। এই জন্যেই প্রতিদিন প্রার্থনা করেন, প্রার্থনা করেন একজন প্রার্থনকারী হ’য়ে।

“পাওয়া” (২৫ পৌষ: ১৩২৫)-এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন:
“জগতে তুমি রাজা অসীম প্রতাপ,
হৃদয়ে তুমি হৃদয়নাথ হৃদয়হরণরূপ।
নীলাম্বর জ্যোতি খচিত চরণপ্রান্তে প্রসারিত,
ফিরে সভয়ে নিয়মপথে অনন্তলোক।
নিভৃত হৃদয় মাঝে কিবা প্রসন্ন মুখচ্ছবি,
প্রেমপরিপূর্ণ-মধুরভাতি।
ভক্তহৃদয়ে তব করুনা রস সতত বহে,
দীনজনে সতত কর অভয়দান।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “কালান্তর” রচনা করেন (১৩২১-১৩৪৩)-এর মধ্যে, এবং এটি গ্রন্থকারে প্রকাশ পায় ১৩৪৪-এর বৈশাখে।
“কালান্তর”-এ অন্তর্ভূক্ত করেন ‘কালান্তর’, ‘ছোটো ও বড়ো’, ‘শক্তি পূজা’, ‘সত্যের আহবান’, ‘সমাধান’, ‘ক্ষুদ্রধর্ম’, ‘বৃহত্তর ভারত’, ‘হিন্দু মুসলমান’, ‘নারী’ এবং এরকম শিরোনামের আরো কিছু লেখা।
ধর্ম ভাবনা ‘কালান্তর’-এ এসে হয়ে ওঠে হিন্দু-মুসলমানের এক সংঘাত ও সংঘর্ষময়, যেখানে এসে উপস্থিত হয় প্রধান দু’টি জাতি, হিন্দু ও মুসলমান। যে হিন্দু ও মুসলমান শুধু নিজেকে নয় বরং একত্রিত ক’রে তোলে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বলোক ও সম্পূর্ণ ভারতবর্ষকে।

“কালান্তর” গ্রন্থের ‘ছোটো ও বড়ো’ (অগ্রহায়ণ : ১৩২৪)- এ, এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন:
“একথা মানিতেই হইবে আমাদের দেশে ধর্ম লইয়া হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা কঠিন বিরুদ্ধতা আছে। যেখানে সত্যভ্রষ্টতা সেখানেই অপরাধ, যেখানে অপরাধ সেইখানেই শাস্তি। ধর্ম যদি অন্তরের জিনিস না হইয়া শাস্ত্রমত ও বাহ্য আচারকেই মুখ্য করিয়া তোলে তবে সেই ধর্ম যত বড়ো অশান্তির কারণ হয়, এমন আর কিছুই না। এই ‘ওগমা’ অর্থাৎ শাস্ত্রমতকে বাহির হইতে পালন করা লইয়া যুরোপের ইতিহাস কতবার রক্তে লাল হইয়াছে। অহিংসাকে যদি ধর্ম বলো, তবে সেটাকে কর্মক্ষেত্রে দুঃসাধ্য বলিয়া ব্যবহার না মানিতে পারি, কিন্তু বিশুদ্ধ আইডিয়ালের ক্ষেত্রে তাহাকে স্বীকার করিয়া ক্রমে সে দিকে অগ্রসর হওয়া অসম্ভব নহে। কিন্তু বিশেষ শাস্ত্রমতের অনুশাসন্যে- বিশেষ করিয়া যদি কেবল বিশেষ পশুহত্যা না করাকেই ধর্ম বলা যায় এবং সেইটে জোর করিয়া যদি অন্য ধর্মমতের মানুষকেও মানাইতে চেষ্টা করা হয়, তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরোধ কোনাকালেই মিটাতে পারে না। নিজে ধর্মের নামে পশুহত্যা করিব অথচ অন্য ধর্মের নামে পশুহত্যা করিলেই নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব, ইহাকে অত্যাচার ছাড়া আর কোনো নাম দেওয়া যায় না। আমাদের আশা এই যে, চিরদিন আমাদের ধর্ম আচার প্রধান হইয়া থাকিবে না। আরো একটি আশা আছি, একদিন হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে দেশহিত সাধনের একই রাষ্ট্রীয় আইডিয়াল যদি আমাদের রাষ্ট্রতন্ত্রে বাস্তব হইয়া উঠে তবে সেই অন্তরের যোগে বাহিরের সমস্ত পার্থক্য তুচ্ছ হইয়া যাইবে।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্থির থাকেননি নিজের স্বধর্মের মাঝে, বরং বিচরণ করেছেন মানুষের কল্যাণে এবং ব্যক্তি জীবনের ধর্মে। সেই ধর্মের প্রভাব কতটা বিরাজ ক’রে তা নিয়ে। আর তার জন্য তিনি আলোচনা করেছেন বহু ধর্ম নিয়ে। যে ধর্ম ব্যক্তিক নয়, বরং তা দেখা দেয় বহু জাতিক ধর্মে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আবার ‘কালান্তর’ (১৩৪৪)-এ বলেন: “স্বীকার করি, কাজ কঠিন হইয়াছে। বাংলাদেশের একদল বালক ও যুবক স্বদেশের সঙ্গে স্বদেশীর সত্য যোগসাধানের বাধা-অতিক্রমের যে পথ অবলম্বন করিয়াছে তাহার জন্য আমরা লজ্জিত আছি। আরো লজ্জিত এই জন্য যে, দেশের প্রতি কর্তব্যনীতির সঙ্গে ধর্মনীতির বিচ্ছেদ সাধন করায় অকর্তব্য নাই এ কথা আমরা পশ্চিমের কাছে হইতেই শিখিয়াছি। পলিটিক্সের গুপ্ত ও প্রকাশ্য মিথ্যা এবং পলিটিক্সের গুপ্ত ও প্রকাশ দস্যুবৃত্তি পশ্চিম সোনার সহিত খাদ মিশানোর মতো মনে করেন, মনে করেন ওটুকু না থাকিলে সোনাশক্ত হয় না। আমরাও শিখিয়াছি যে, মানুষের পরমার্থকে  দেশের স্বার্থের উপরে বসাইয়া ধর্ম লইয়া টিক টিক করিতে থাকা মূঢ়তা, দূর্বলতা, ইহা সেন্টিমেন্টালিজম-বর্বরতাকে দিয়াই সভ্যতাকে এবং অধর্মকে দিয়াই ধর্মকে মজবুত করা চাই। এমনি করিয়া আমরা যে কেবল অধর্মকে বরণ করিয়া লইয়াছি তাহা নহে, আমাদের গুরুমশায়দের যেখানে বীভৎসতা, সেই বীভৎসতার কাছে মাথা হেঁট করিয়াছি। নিজের মনের জোরে ধর্মের জোরে গুরুমশায়ের উপরে দাঁড়াইয়াও এ কথা বলিবার তেজ ও প্রতিভা আমাদের আজ নাই যে, অর্থাৎ অর্ধমের দ্বারা মানুষের বাড়িয়া উঠে, অধর্ম হইতে সে আপন কল্যাণ দেখে, অর্ধমের ধারা সে শত্রুদিগকেও জয় করে, কিন্তু একেবারে মূল হইতে বিনাশ পায়। তাই বলিতেছি, গুরুমশায়দের কাছে আমাদের ধর্মবুদ্ধিরও যে এত বড়ো পরাভব হইয়াছে হইাতেই আমাদের সকলের চেয়ে বড়ো লজ্জা। বড়ো আশা করিয়াছিলাম, দেশে যখন দেশভক্তির আলোক জ্বলিয়া উঠিল তখন আমাদের প্রকৃতির মধ্যে যাহা সকলের চেয়ে মহৎ তাহাই উজ্জ্বল হইয়া প্রকাশ পাইবে; আমাদের যাহা যুগসঞ্চিত অপরাধ তাহা আপন অন্ধকার কোন ছাড়িয়া পালাইয়া যাইবে; দুঃসহ নৈরাশ্যের পাষাণস্তর বিদীর্ণ করিয়া অক্ষয় আশার উৎস উৎসারিত হইয়া উঠিবে এবং দুরূহ নিরুপায় তাকেও উপেক্ষা করিয়া অপরাহত ধৈর্য্য এক এক পা করিয়া আপনার রাজপথ নির্মাণ করিবে, নিষ্ঠুর আচারের ভারে এ দেশে মানুষকে মানুষ যে অবনত অপমানিত করিয়া রাখিয়াছে অকৃত্রিম প্রীতির আনন্দময় শক্তির দ্বারা সেই ভারকে দূর করিয়া সমস্তু দেশের লোক একসঙ্গে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইব। কিন্তু আমাদের ভাগ্যে এ কী হইল। দেশ ভক্তির আলোক জ্বলিল। কিন্তু সেই আলোতে এ কোন দৃশ্য দেখা যায়-এই চুরি ডাকাতি গুপ্তহত্যা? দেবতা যখন প্রকাশিত হইয়াছেন তখন পাপের অর্ঘ্য লইয়া তাঁহার পূজা? যে-দৈন্য যে জড়তায় এতকাল আমরা পোলিটিক্যাল ভিক্ষাবৃত্তিকেই সম্পদ লাভের সদুপায় বলিয়া কেবল রাজদরবারে দরখাস্ত লিখিয়া হাত পাকাইয়া আসিয়াছি, দেশ-প্রীতির নববসন্তেও সেই দৈন্য সেই জড়তা সেই আত্মবিশ্বাস পলিটিক্যাল চৌর্যবৃত্তিকেই রাতারাতি ধনী হইবার একমাত্র পথ মনে করিয়া সমস্ত দেশকে কি কলঙ্কিত করিতেছে না।”

একই গ্রন্থে আবার দুই দেবতা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন: “বাংলার মঙ্গলকাব্যগুলির বিষয়টা হচ্ছে, এক দেবতাকে তারা সিংহাসন  থেকে খেদিয়ে দিয়ে আর এক দেবতার অভ্যূদয়। সহজেই এই কথা মনে হয় যে, দুই-দেবতার মধ্যে যদি কিছু নিয়ে প্রতিযোগিতা থাকে তা হলে সেটা ধর্ম নীতিগত আদর্শেরই তারতম্য নিয়ে। যদি মানুষের ধর্ম বুদ্ধিকে নূতন দেবতা পুরাতন দেবতার চেয়ে বেশি তৃপ্তি দিতে পারেন তা হলেই তাঁকে বরণ করিবার সংগত কারণ পাওয়া যায়।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৫ জ্যোষ্ঠ : ১৩২৬)-এ “কালান্তর” গ্রন্থে উল্লেখ করেন: “এ কথা মনে রাখতে হবে, বাইরের বাধাবিঘœ বিরুদ্ধতা চিরদিনই থাকবে, থাকলে ভালো বৈ মন্দ নয়-কিন্তু অন্তরে বাধা থাকলেই বাইরের বাঁধা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। এই জন্যে ভিক্ষার দিকে না তাকিয়ে সাধণার দিকে তাকাতে হবে, তাতে অপমানও যাবে, ফলও পাব।”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন : “একটি কথা মনে রাখতে হবে, দস্যুর উপাস্য দেবতা শক্তি, বর্গীর উপাস্য দেবতা শক্তি, কাপালিকের উপাস্য দেবতা শক্তি। আরো একটি ভাববার কথা আছে, পশুবলি বা নিজের রক্তপাত, এমন-কি নরবলি স্বীকার করে মানত দেবার প্রথা শক্তিপূজায় প্রচলিত। মিথ্যা মামলায় জয় থেকে শুরু করে জ্ঞাতিশত্রুর বিনাশ কামনা পর্যন্ত সকল প্রকার প্রার্থনাই শক্তি পূজায় স্থান পায়। এক দিকে দেবচরিত্রের হিংস্রতা, অপর দিকে মানুষের ধর্মবিচারহীন ফলকামনা এই দুয়ের যোগ যে পূজায় আছে, তার চেয়ে বড়ো শক্তি পূজায় কথা কোনো বিশেষ শাস্ত্রে নিগূঢ় আছে কি না সেটা আমার আলোচ্য ছিল না। শক্তিপূজার যে অর্থ লৌকিক বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত সে অর্থকে অসংগত বলা যায় না, কারণ লোক প্রচলিক কাহিনী এবং রূপকচিহ্নে সেই অর্থই প্রবল এবং সভ্য ও বর্বর সকল দেশে সকল ভাবেই শক্তিপূজা চলছে। অন্যায় অসত্য সে পূজায় লজ্জিত নয়, লোভ তার লক্ষ্য এবং হিংসা তার পূজোপচার। এই লোভ মন্দ নয়, ভালোই, হিংস্রশক্তি মনুষ্যত্বের পক্ষে অত্যাবশ্যক এমন সকল তর্ক শক্তি পূজক য়ুরোপ স্পর্ধার সঙ্গে চলছে, য়ুরোপের ছাত্ররূপে আমাদের মধ্যেও চলছে-সে সম্বন্ধে আমার যা বলবার অন্যত্র বলেছি; এখানে এইটুকু বক্তব্য যে, সাধারণ লোকের মনে শক্তিপূজার সঙ্গে একটি উলঙ্গ নিদারুণতার ভাব, নিজের উদ্দেশ্য সাধনের জন্য বলপূর্বক দূর্বলকে বলি দেবার ভাব সংগত হয়ে আছে- ‘বাতায়নিকের পত্রে’ আমি তারই উল্লেখ করেছি। কিন্তু তবুও এ কথা স্বীকার করা উচিত যে, কোনো ধর্ম সাধনার উচ্চ অর্থ যদি দেশের কোনো বিশেষ শাস্ত্র বা সাধকের মধ্যে কথিত বা জীবিত থাকে তবে তাকে সম্মান করা কর্তব্য। এমন কি ভূরিপরিমিত প্রচলিত ব্যবহারের চেয়েও তাকে বড়ো বলে জানা চাই। ধর্মকে পরিমানের দ্বারা বিচার না করে তার উৎকর্ষের দ্বারা বিচার করাই শ্রেয়।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, (কার্ত্তিক : ১৩২৮) : “কালান্তার” গ্রন্থে ‘সত্যের আহ্বান’ শিরোনামে লেখায় তু’লে আনেন ধর্মের সাথে বিশ্বাস এবং তার দৃঢ়তা। যে দৃঢ়তা শুধু ধর্মের প্রতি বিশ্বাস-ই নয় বরং, তার পারিপার্শ্বিকতার ব্যাপকতা, যে ব্যাপকতা শুধু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেই নয়, বিশ্বাসের সাথে সমগ্র ভারতবর্ষও জড়িত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে এসে আবার বলেন : “সত্য আলোর মতো, তার শিখাটা জ্বলবা মাত্র দেখা যায় মায়া নেই। ভয় হচ্ছে মনের নাস্তিকতা, তাকে না এর দিকে থেকে নিকেশ করা যায় না, উপস্থিত মত তার একটা কারণ গেলেও রক্তবীজের মতো আর একটা কারণরূপে সে জন্ম নেয়। ধর্ম হচ্ছে সত্য, যে মনের আস্তিকতা, তার অল্পমাত্র আবির্ভাবে হ্যাঁ প্রকাণ্ড না’কে একেবারে মূলে গিয়ে অভিভূত করে। ভারতে ইংরেজের আবির্ভাব নামক ব্যাপারটি বহুরূপী; আজ সে ইংরেজের মূর্তিতে, কাল সে অন্য বিদেশীর মূর্তিতে এবং তার পরদিন সে নিজের দেশী লোকের মূর্তিতে নিদারুণ হয়ে দেখা দেবে। এই পরতন্ত্রতাকে ধনুর্বান হাতে বাইরে থেকে তাড়া করলে সে আপনার খোলস বদলাতে বদলাতে আমাদের হয়রান করে তুলবে। কিন্তু আমার দেশ আছে এইটি হল সত্য, এইটিকে পাওয়ার দ্বারা বাহিরের মায়া আপনি নিরস্ত হয়।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু ধর্মচিন্তা নিয়ে স্থির থাকেননি। হিন্দু এবং মুসলমানের সাথে তাদের সংমিশ্রণের চেষ্টায় নিমগ্ন থেকেছেন। যে সাধনা এবং কর্মে রবীন্দ্রনাথ নিয়োজিত ছিলেন জীবনের দীর্ঘ সময়। হিন্দুও মুসলমানের বিপরীত মুখী ভাবনা নিয়ে চিন্তায় থেকেছেন জীবন ব্যাপী। চেষ্টাও সাধনার দ্বারা এই প্রধান দু’টি জাতিকে নিয়ে আসতে চেয়েছেন একই সুতায়। ভাবনার জগতে তিনি থেকেছেন অবিচলও সুদৃঢ়।
অগ্রহায়ণ : ১৩৩০-“কালান্তর” গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘হিন্দু ও মুসলমান’-নিয়ে বলেন :
“খেলাফতের ঠেকো দেওয়া সন্ধিবন্ধনের পর আজকের দিনে হিন্দু মুসলমানের বিরোধ তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মূলে ভূল থাকলে কোনো উপায়েই স্থূল সংশোধন হতে পারে না। এ সব কথা শুনলে অধৈর্য হয়ে কেউ কেউ বলে উঠেন, আমাদের চারদিকে যে বিদেশী তৃতীয় পক্ষ শত্রুরূপে আছে সেই আমাদের মধ্যে ভেদ ঘটাচ্ছে, অতএব দোষ আমাদের নয়, দোষ তারই-ইতিপূর্বে আমরা হিন্দু মুসলমান পাশাপাশি নির্বিরোধেই ছিলুম কিন্তু ইত্যাদি ইত্যাদি-শাস্ত্রে বলে, কলি শান ব্যাধি মানুষের ছিদ্র খোঁজে। পাপের ছিদ্র পেলেই তারা ভিতরে প্রবেশ করে, সর্বনাশের পালা আরম্ভ করে দেয়। বিপদটা বাইরের, আর পাপটা আমার, এই কারণে বিপদের প্রতি ক্রোধও পাপের প্রতি মমতা করাই হচ্ছে সকল বিপদের সেরা।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একই গ্রন্থে আবার বলেন :
“আমি পূর্বে অন্যত্র বলেছি, ধর্ম যাদের পৃথক করে তাদের মেলবার দরজায় ভিতর দিক থেকে আগল দেওয়া। কথাটা পরিষ্কার করে বলবার চেষ্টা করি। সকলেই বলে থাকে, ধর্ম শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে যা আমাদের ধারণ করে অর্থাৎ, আমাদের যে-সকল আশ্রয় ধ্রুব তারা হচ্ছে ধর্মের অধিকারভূক্ত। তাদের সম্বন্ধে তর্ক নেই। এই সকল আশ্রয়ের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। এদের সঙ্গে ব্যবহার যদি চঞ্চলতা করি, কথায় কথায় যদি মত বদল করতে থাকি, তা হলে বাঁচি নে।”

পূর্বেই আমাদের জাতি ভেদের প্রধান দু’টি ধর্মের প্রভাবের কথা উল্লেখ করেছি। হিন্দু ও মুসলমান-এ দু’টি গোষ্ঠীর মাঝে যে ভেদাভেদ রয়েছে যুগ থেকে যুগান্তরব্যাপী। যা চিন্তার জগতে রবীন্দ্রনাথ ধারণ করেছেন কাল থেকে কালান্তর পর্যন্ত। যে সমস্যা শুধু প্রধান দু’টি জাতি গোষ্ঠীরই নয়, বরং তা হ’য়ে ওঠে রবীন্দ্র মানসের চিন্তা ধারায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কালান্তর’- গ্রন্থে হিন্দু-মুসলমান নিয়ে বলেন:
“আমাদের আর একটি প্রধান সমস্যা হিন্দু-মুসলমান সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান এত দুঃসাধ্য তার কারণ দুই পক্ষই মুখ্যত আপন আপন ধর্মের দ্বারাই অচলভাবে আপনাদের সীমা নির্দেশ করেছে। সেই ধর্মই তাদের মানব বিশ্বকে সাদা কালো ছক কেটে দুই সুষ্পষ্ট ভাগে বিভক্ত করেছে- আত্ম ও পর। সংসারে সর্বত্রই আত্মপরের মধ্যে কিছু পরিমাণে স্বাভাবিক ভেদ আছে। সেই ভেদের পরিমাণটা অতিমাত্র হলেই, তাতে তার কল্যাণ হয়। বুশম্যান জাতীর লোক পরকে দেখবা মাত্র তাকে নির্বিশেষে বিষবান দিয়ে মারে। তার ফল হচ্ছে, পরের সঙ্গে সত্য মিলনে মানুষের যে মনুষ্যত্ব পরিষ্ফুট হয় বুশম্যানের তা হতে পারে নি, সে চূড়ান্ত বর্বরতার মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। এই ভেদের মাত্রা যে জাতির মধ্যে অন্তরের দিক থেকে যতই কমে এসেছে সেই জাতি ততই উচ্চ শ্রেণির মনুষ্যত্বে উর্ত্তীণ হতে পেরেছে। সে জাতি সকলের সঙ্গে যোগে চিন্তার কর্মের চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন করতে পেরেছে।

হিন্দু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলে পরিচয় দেয়, মুসলমানও তাই দেয়। অর্থাৎ, ধর্মের বাহিরে উভয়েরই জীবনের অতি অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকে। এই কারণে এরা নিজ নিজ ধর্ম দ্বারাই পরষ্পরকে ও জগতের অন্য সকলকে যথা সম্ভব দূরে ঠেকিয়ে রাখে। এই যে দূরত্বের ভেদ এরা নিজেদের চারিদিকে অত্যন্ত মজবুত করে গেঁথে রেখেছে, এতে করে সকল মানুষের সঙ্গে সত্যযোগে মনুষ্যত্বের যে প্রসার হয় তা এদের মধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ধর্মগত ভেদবুদ্ধি সত্যের অসৎ স্বরূপ থেকে তাদের সংকীর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। এই জন্যেই মানুষের সঙ্গে ব্যবহারে নিত্যসত্যের চেয়ে বাহ্যবিধান কৃত্রিম প্রথা এদের মধ্যে এত প্রবল হয়ে উঠেছে।

পূর্বেই বলেছি, মানব জগৎ এই দুই সম্প্রদায়ের ধর্মের দ্বারা আত্ম ও পর এই দুই ভাগে অতিমাত্রায় বিভক্ত হয়েছে। সেই পর চিরকালই পর হয়ে থাকে হিন্দুর এই ব্যবস্থা; সেই পর, সেই স্লেচ্ছা বা অন্ত্যজ কোনো ফাঁকে তার ঘরের মধ্যে এসে ঢূকে না পড়ে এই তার ইচ্ছা। মুসলমানের তরফে ঠিক এর উল্টো। ধর্মগন্ডীর বহিবর্তী পরকে সে খুব তীব্রভাবেই পর বলে জানে, কিন্তু সেই পরকে, সেই কাফেরকে বরাবরকার মতো ঘরে টেনে এনে আটক করতে পারলেই সে খুশি। এদের শাস্ত্রে কোনো একটা খুঁটি বের করা শ্লোক কী বলে সেটা কাজের কথা নয়। কিন্তু লোক ব্যবহারে এদের এক পক্ষ শত শত বৎসর ধরে ধর্মকে আপন দুর্গম দূর্গ করে পরকে দূরে ঠেকিয়ে আত্মগত হয়ে আছে, আর অপর পক্ষ ধর্মকে আপন ব্যুহ বানিয়ে পরকে আক্রমণ করে তাকে ছিনিয়ে এনেছে এতে করে এদের মনঃপ্রকৃতি দুই রকম ছাঁদের ভেদবুদ্ধিতে একেবারে পাকা হয়ে গেছে। বিধির বিধানে এমন দুই দল ভারতবর্ষে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে প্রধান স্থান অধিকার করে নিয়েছে-আত্মীয়তার দিক থেকে মুসলমান হিন্দুকে চায় না, তাকে কাফের বলে ঠেকিয়ে রাখে, আত্মীয়তার দিক থেকে হিন্দুও মুসলমানকে চায় না, তাকে ম্লেচ্ছা বলে ঠেকিয়ে রাখে।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রধান দুটি জাতি ‘হিন্দু’ ও ‘মুসলমানকে’ একই সুত্রে গাঁথতে চেয়েছেন। টেনে এনেছেন ‘আত্মীয়তার সম্পর্ক’। যে আত্মীয়তায় রক্ষা পাবে উভয় পক্ষের নিবিড় সম্পর্কের মাধ্যমে। কিন্তু সে সম্পর্ক হয়ে ওঠে না দৃঢ় ও মজবুত, যা হয় তা হলো একটি থেকে আরেকটির মনও জাতিগত ব্যবধান। এই আত্মীয়তা কাছে টানে না প্রধান দু’টি জাতিকে, বরং ব্যবধান বা দূরত্ব তৈরি করে একটি থেকে আরেকটিকে। জাতিগত এই সমস্যা স্বল্প সমস্যা নয়, বরং এই সমস্যা হ’য়ে ওঠে শতাব্দী থেকে শতাব্দী পরম্পরায়। সংখ্যাগত দিক থেকে কালে কালে বিবিধ জাতি দেখা গেলেও, জাতিগত সমস্যা দেখা দেয় মুসলমানও হিন্দুতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রধান দুটি জাতিকে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন থেকেছেন দীর্ঘ সময়। প্রধান দু’টি জাতিকে গাঁথতে চেয়েছেন একই সুতোয়। দেখতে চেয়েছেন মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ ক’রে।
হিন্দু-মুসলমান এর এই ভাবনা শুধু যে রবীন্দ্রনাথ-ই করেছেন তা নয়। 
এই ভাবনা ছিল তিরিশ প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)-এর। ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭) কাব্যগ্রন্থে ‘হিন্দু-মুসলমান’ কবিতায়। প্রকাশ করেন হিন্দুও মুসলমানের এক অপূর্ব সমন্বয়। তিনি বলেন:

“মহামৈত্রীর বরদ-তীর্থে-পুণ্য ভারতপুরে-
পূজার ঘন্টা মিশিছে হরষে নামাজের সুরে সুরে!
আহ্নিক হেথা শুরু হয়ে যায় আজান বেলার মাঝে,
মুয়াজ্জেনের উদাস ধ্বনিটি গগণে গগনে বাজে;
জপে ঈদগাতে তসবী ফকির, পূজারী মন্ত্র পড়ে
সন্ধ্যা-ঔষায় বেদবানী যায় মিশে কোরানের স্বরে;
সন্ন্যাসী আর পীর
মিলে গেছে হেথা,-মিশে গেছে হেথা মসজিদ, মন্দির।
কে বলে হিন্দু বসিয়ে রয়েছে একাকী ভারত জাকি?
-মুসলমানের হস্তে হিন্দু বেঁধেছে মিলন-রাখী”

 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কালান্তর’ গ্রন্থে এসে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে আবার বলেন:
“বাংলাদেশে স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দুর সঙ্গে মুসলমান মেলেনি। কেননা বাংলার অখন্ড অঙ্গকে ব্যঙ্গ করার দুঃখটা তাদের কাছে বাস্তব ছিল না। আজ অসহকার- আন্দোলনে হিন্দুর সঙ্গে মুসলমান যোগ দিয়েছে, তার কারণ রোম-সাম্রাজ্যের অখন্ড অঙ্গকে ব্যঙ্গীকরনের দুঃখটা তাদের কাছে বাস্তব। এমনতরো মিলনের উপলক্ষটা কখনোই চিরস্থায়ী হ’তে পারে না। আমরা সত্যত: মিলি নি; আমরা একদল পূর্ব মুখ হয়ে, অন্যদল পশ্চিম মুখ হয়ে কিছুক্ষণ পাশাপাশি পাখা ঝাপটেছি। আজ সেই পাখার ঝাপট বন্ধ হল, এখন উভয়পক্ষের চঞ্চু এক মাটি কাপড়ে না থেকে পরস্পরের অভিমুখে সবেগে বিক্ষিপ্ত হচ্ছে। রাজনৈতিক অধিনেতারা চিন্তা করেছেন, কী দিয়ে এদের চঞ্চু দু’টোকে ভুলিয়ে রাখা যায়। আসল ভুলটা রয়েছে অস্থিতে মজ্জাতে, তাকে ভোলাবার চেষ্টা করে ভাঙ্গা যাবে না। কম্বল চাপা দিয়ে যে মনে ভাবে বরফটাকে গরম করে তোলা গেল সে একদিন দেখতে পায় তাতে করে তার শৈত্যটাকে স্থায়ী করা গেছে।”

হিন্দুতে মুসলমানে কেবল যে এই ধর্মগত ভেদ তা নয়, তাদের উভয়ের মধ্যে একটা সামাজিক শক্তির অসমকক্ষতা ঘটেছে। মুসলমানের ধর্মসমাজের চিরাগত নিয়মের জোরেই তার আপনার মধ্যে একটা নিবিড় ঐক্য জন্মে উঠেছে, আর হিন্দুর ধর্ম সমাজের সনাতন অনুশাসনের প্রভাবেই তার আপনার মধ্যে একটা প্রবল অনৈক্য ব্যাপ্তি হয়ে পড়েছে। এর ফল এই যে, কোনো বিশেষ প্রয়োজন না থাকলেও হিন্দু নিজেকেও মারে, আর প্রয়োজন থাকলেও হিন্দু অন্যকে মারতে পারে না। আর মুসলমান কোনো বিশেষ প্রয়োজন না ঘটলেও নিজেকে দৃঢ়ভাবে রক্ষা করে, আর প্রয়োজন ঘটলে অন্যকে বেদম মার দিতে পারে। তার কারণ এ নয়, মুসলমানের গায়ে জোর আছে, হিন্দুর নেই; তার আসল কারণ, তাদের সমাজের জোর আছে, হিন্দুর নেই। একদল আভ্যন্তরিক বলে বলী, আর একদল আভ্যন্তরিক দুর্বলতায় নির্জীব। তাদের মধ্যে সমকক্ষভাবে আপোষ ঘটবে কী করে। অত্যন্ত দুর্যোগের মুখে ক্ষনকালের জন্যে তা সমম্ভব, কিন্তু যে দিন অধিকারের ভাগ-বাটোয়ারার সময় উপস্থিত হয় সেদিন সিংহের ভাগটা বিসদৃশ রকম বড়ো হয়ে ওঠে, তার কারণটা তার থাকার মধ্যে। গত য়ুরোপীয় যুদ্ধে যখন সমস্ত ইংরেজ জাতের মুখশ্রী পাংশুবর্ণ হয়ে উঠেছিল। তখন আমাদের মতো ক্ষীণপ্রান জাতিকেওতারা আদর করে সহায়তার জন্য ডেকেছিল। শুধু তাই নয়, ঘোর বিষয়ী লোকেরও যেমন শ্মশান বৈরাগ্যে কিছুক্ষণের জন্য নিষ্কাম বিশ্বপ্রেম জন্মায়, তেমনি যুদ্ধশেষের কয়েক দন্ড পরেও রক্ত আহুতি যজ্ঞে তাদের সহযোগী ভারতীয়দের প্রতি তাদের মনে দাক্ষিণ্যের ও সঞ্চার হয়েছিল। যুদ্ধের ধাক্কাটা এল নরম হয়ে আর তারপরেই দেখা দিল জালিয়ান বাগে দানবলীলা; আর তার এল কেনিয়ার সাম্রাজ্যের সিংহদ্বারে ভারতীয়দের জানা অর্ধচন্দ্রের ব্যবস্থা। রাগ করি বটে, কিন্তু সত্য সমকক্ষ না হয়ে উঠলে সমকক্ষের ব্যবহার পাওয়া যায় না। এই কারণেই মহাত্মাজি খুব একটা ঠেলা দিয়ে প্রজাপক্ষের শক্তিটাকে রাজপক্ষের অনুভরযোগ্য করে তোলবার চেষ্টা করেছেন। উভয় পক্ষের মধ্যে আপোষ নিষ্পত্তিই তাঁর লক্ষ্য ছিল। এই আপোষ নিষ্পত্তি সবল-দুর্বলের একান্ত ভেদ থাকলে হতেই পারে না। আমরা যদি ধর্মবলে রাজার সিংহাসনে ভূমিকম্প ঘটাতে পারতুম, তা হলে রাজার বাহুবল একটা ভালোরকম রফা করবার জন্য আপনিই আমাদের ডাক পড়ত। 

ভারতবর্ষ হিন্দুতে মুসলমানে প্রতিনিয়তই পরষ্পরই রফানিষ্পত্তির কারণ ঘটবে। অসমকক্ষতা থাকলে যে নিষ্পত্তি নিয়তই বিপত্তির আকার ধারণ করবে। ঝরনার জল পানের অধিকার নিয়ে একটা বাঘ ও মেষের মধ্যে একটা আপোষের কনফারেন্স বসেছিল, ঈশপের কথামালায় তার ইতিহাস আছে। উপসংহারে প্রবলতার চতুষ্পদটি তর্কের বিষয়টাকে কি রকম অত্যান্ত সরল করে এনেছিল সে কথা সকলেরই জানা আছে। ভারতবর্ষের কল্যাণ যদি চাই তা হলে হিন্দু-মুসলমানে কেবল যে মিলিত হতে হবে তা নয়, সমকক্ষ হতে হবে। সেই সমকক্ষতা তাল ঠোকা পালোয়ানির ব্যক্তিগত সমকক্ষতা নয়, উভয় পক্ষের সামাজিক শক্তির সমকক্ষ। মালাবারে মোপলাতে-হিন্দুতে যে কুৎসিত কান্ড ঘটেছিল সেটা ঘটেছিল খিলাফৎ সূত্রে হিন্দু মুসলমানের সন্ধির-ভরা জোয়ারের মুখেই। যে দুই পক্ষে বিরোধ তারা সুদীর্ঘকাল থেকেই ধর্মের ব্যবহারকে নিত্য ধর্মনীতির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে এসেছে। নম্বুদি ব্রাক্ষসের ধর্ম মুসলমানকে ঘৃনা করেছে, মোপলা মুসলমানের ধর্ম নম্বুদ্রি ব্রাহ্মনকে অবজ্ঞা করেছে আজ এই দুই পক্ষের কনগ্রেসনজ্ঞ-ঘটিত ভ্রাতৃভাবের জীন মসলার দ্বারা তাড়াতাড়ি অল্প কয়েক দিনের মধ্যে খুব মজবুত করে পোলিটিক্যাল সেতু বানাবার চেষ্টা বৃথা। অথচ আমরা বার বারই বলে আসছি, আমাদের সনাতন ধর্ম যেমন আছে তেমনিই থাক্ আমরা অবাস্তবকে দিয়েই বাস্তব ফল লাভ করব, তার পরে ফললাভ হলে আপনিই সমস্ত গলদ সংশোধন হয়ে যাবে। বাজিমাৎ করে দিয়ে তারপরে চালের কথা ভাবব, আগে স্বরাট হব, তার পরে মানুষ হব।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ভাবনার জগতে দীর্ঘ সময় জুঁড়ে রয়েছে ধর্ম ভাবনা। যে ধর্ম-ভাবনা শুধু ভারতীয় হিন্দু ধর্ম নয়, বরং তা হ’য়ে ওঠে সমস্ত ধর্ম ভাবনার সারসত্তা। যে ধর্মীয় ভাবনা শুধু জাগ্রত করে না, তা ব্যক্তির অভ্যন্তরে স্থান ক’রে নেয় দীর্ঘ সময়ের জন্য, যে সময়ে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিকে গ’ড়ে তোলেন আরো বেশি বিশ্বমানসলোকে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কালান্তর’ (অগ্রহায়ণ : ১৩৩২) এ বলেন:
[ক.] ‘ধর্ম’ আমাদের কাছে ত্যাগ দাবি করে। সেই ত্যাগে আমাদের দৈন্য নয়, আমাদের গৌরব। ধর্ম আমাদের দেশে ব্রাহ্মণ ক্ষুদ্র সকলকেই কিছু না কিছু ত্যাগের পরামর্শ দিয়েছে। ব্রাহ্মণকেও অনেক ভোগ বিলাস ও প্রলোভন পরিত্যাগ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার সঙ্গে ব্রাহ্মণ প্রচুর সম্মান পেয়েছিল। না পেলে সমাজে সে নিজের কাজ করতেই পারত না। ক্ষুদ্র ও যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছে, কিন্তু সমাদর পায় নি। তবুও সে কিছু পাক আর না পাক, ধর্মের খাতিরে হীনতা স্বীকার করার মধ্যেও তার একটা আত্ম প্রসাদ আছে।”

[খ.] “বস্তুত জীবিকা নির্বাহকে ধর্মের শ্রেণীতে ভুক্ত করা-তখনই চলে যখন নিজের প্রয়োজনের উপরেও সমাজের প্রয়োজন লক্ষ্য থাকে। ব্রাহ্মণ ভাতে-ভাত খেয়ে বাহ্য দৈন্য স্বীকার করে নিয়ে সমাজের আধ্যাত্মিক আদর্শকে সমাজের মধ্যে বিমুগ্ধ যদি রাখে তবে তার দ্বারা তার জীবিকা নির্বাহ হলেও সেটা জীবিকা নির্বাহের চেয়ে বড়ো, সেটা ধর্ম। চাষী যদি চাষ না করে তবে একদিনও সমাজ টেনে না। অতএব, চাষী আপন জীবিকাকে যদি ধর্ম বলে স্বীকার করে তবে কথাটাকে মিথ্যা বলা যাবে না। অথচ এমন মিথ্যা সান্ত্বনা তাকে কেউ দেয়নি যে, চাষ করার কাজ বাহ্মণের কাজের সঙ্গে সম্মানে সমান। যে-সব কাজে মানুষের উচ্চতর বৃত্তি খাটে, মানব সমাজে স্বভাবতই তার সম্মান শারীরিক কাজের চেয়ে বেশি, এ কতা সুষ্পষ্ট।”
[গ.] “যে দেশে জীবিকা অর্জনকে ধর্মকর্মের সামিল করে দেখে না সে দেশেও নিম্ন শ্রেণীর কাজ বন্ধ হলে সমাজের সর্বনাশ ঘটে। অতএব সেখানেও অধিকাংশ লোককেই সেই কাজ করতেই হবে। সুযোগের সংকীর্ণতাবশত সে রকম কাজ করবার লোকের অভাব ঘটে না, তাই সমাজ টিকে আছে। আজকাল মাঝে মাঝে যখন সেখানকার শ্রমজীবিরা সমাজের সেই গরজের কথাটা মাথা নাড়া দিয়ে সমাজের নিষ্কর্মা বা পরাসও বা বুদ্ধিজীবিদের জানান দেয় তখন সমাজে একটা ভূমিকম্প উপস্থিত হয়। তখন কোথাও বা কড়া রাজ্য শাসন, কোথাও বা তাদের আর্জি-মঞ্জুরির দ্বারা সমাজ রক্ষার চেষ্টা হয়। আমাদের দেশে বৃত্তিভেদকে ধর্মশাসনের অন্তর্গত করে দেওয়াতে এ রকম অসন্তোষ্ট ও বিপ্লব চেষ্টায় গোড়া নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতে করে জাতিগত কর্মধারা গুলির উৎকর্ষ সাধন হয়েছে কি না ভেবে দেখবার বিষয়।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ধর্ম’, ‘হিন্দু’, ‘মুসলমান’-ইত্যাদি ব্যাপরগুলো নিয়ে ভেবেছেন সাড়া জীবন ব্যাপী। এসব বিষয় নিয়ে লিখেছেন পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা। কিন্তু সেই ভারতবর্ষে হিন্দু-মুসলমান সমস্যার সমাধান কোথায়? সেই সমস্যার সমাধান কি সম্পূর্ণ বরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের না পুরো ভারতবর্ষের? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরো ভারতবর্ষের এই জাতিগত সমস্যার সমাধান দিবেন নিজের ভাবনা-চেতনা বিশ্লেষণ থেকে, যে চেতনার দ্বারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হ’য়ে উঠবেন একজন পুরোহিত হ’য়ে, না একজন জাতিগত সমস্যার সমাধানকারী হিশেবে?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘কালান্তর’-গ্রন্থে (শ্রাবণ : ১৩২৯)-এ ‘হিন্দু-মুসলমান’ সম্পর্কে বলেন: “পৃথিবীতে দুটি ধর্মসম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত ধর্মমতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অত্যুগ্র-সে হচ্ছে খৃস্টান আর মুসলমান-ধর্ম। তারা নিজের ধর্মকে পালন করেই সন্তুষ্ট নয়, অন্য ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত। এই জন্য তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলাবার অন্য কোনো উপায় নেই। খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের সম্বন্ধে একটা সুবিধার কথা এই যে, তারা আধুনিক যুগের বাহন: তাদের মন মধ্যযুগেরগন্ডির মধ্যে আবদ্ধ নয়। ধর্মমত একান্তভাবে তাদের সমস্ত জীবনকে পরিবেষ্টিত করে নেই। এই জন্য অপর ধর্মালম্বীদের তারা ধর্মের বেড়ার দ্বারা সম্পূর্ণ বাধা দেয় না। য়ুরোপীয় আর খৃস্টান এই দুটো শব্দ একার্থক নয়। ‘য়ুরোপীয় বৌদ্ধ’ বা ‘য়ুরোপীয় মুসলমান’ শব্দের মধ্যে স্বতোবিরুদ্ধতা নেই। কিন্তু ধর্মের নামে যে জাতির নামকরণ ধর্মমতেই তাদের মুখ্য পরিচয়। মুসলমান বৌদ্ধ বা মুসলমান খৃস্টান শব্দ স্বতই অসম্ভাব। অপর পক্ষে হিন্দু জাতিও এক হিসাবে মুসলমানদেরই মতো। অর্থাৎ, তারা ধর্মের প্রকারে সম্পূর্ণ পরিবেষ্টিত। বাহ্য প্রভেদটা হচ্ছে এই যে, অন্য ধর্মের বিরুদ্ধতা তাদের পক্ষে সকর্মক নয়/অহিন্দু সমস্ত ধর্মের সঙ্গে তাদের হড়হ-ারড়ষবহঃ, হড়হ-পড়-ড়ঢ়বৎধঃরড়হ, হিন্দুর ধর্ম মুখ্যভাবে জন্মগত ও আচার মূলক হওয়াতে তার বেড়া আরো কঠিন। মুসলমান ধর্ম স্বীকার করে মুসলমানের সঙ্গে সমানভাবে মেলা যায়, হিন্দুর সে পথও অতিক্রম সংকীর্ণ। আহারে-ব্যবহারে মুসলমান অপর সম্প্রদায়কে নিষেধের দ্বারা প্রত্যাখান করে না, হিন্দু সেখানেও সর্তক। তাই খিলাফৎ উপলক্ষে মুসলমান নিজের মসজিদে এবং অন্যত্র হিন্দুকে যত কাছে টেনেছে হিন্দু মুসলমানকে তত কাছে টানতে পারেনি। 

আচার হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্বন্ধের সেতু, সেইখানেই পদে পদে হিন্দু নিজের বেড়া তুলে রেখেছে। আমি যখন প্রথম আমার জমিদারি কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম তখন দেখেছিলাম কাছারিতে মুসলমান প্রজাকে বসতে দিতে হলে জাজিমের এক প্রান্ত তুলে দিয়ে সেইখানে তাকে স্থান দেওয়া হত। অন্য-আচার অবলম্বীদের অশুচি বলে গণ্য করার মতো। মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের এমন ভীষণ বাধা আর কিছু নেই। ভারতবর্ষের এমন কপাল যে, এখানে হিন্দু মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে, ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল হয়, আচারে-প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয়, ধর্মমতে প্রবল। এক পক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা, অন্য পক্ষের সে দিকে দ্বার রুদ্ধ। এরা কী করে মিলবে। এক সময়ে ভারতবর্ষে গ্রীক পারসিক শক নানা জাতির অবাধ সমাগম ও সম্মিলন ছিল। কিন্তু মনে রেখো সে হিন্দু যুগের-পূর্ববর্তীকালে। হিন্দুযুগ হচ্ছে একটা প্রতিক্রিয়ার যুগ-এই যুগ ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে সচেষ্টভাবে পাকা করে গাঁথা হয়েছিল। দুর্লঙ্ঘ্য আচারের প্রাকার তুলে এক দু®প্রবেশ্য করে তোলা হয়েছিল। একটা কথা মনে ছিল না, কোনো প্রাণবান জিনিসকে একেবারে আটঘাট বন্ধ করে সামলাতে গেলে তাকে মেরে ফেলা হয়। যাই হোক, মোট কথা হচ্ছে, বিশেষ এক সময়ে বৌদ্ধযুগের পরে রাজপুত প্রভৃতি বিদেশীয় জাতিকে দলে টেনে বিশেষ অধ্যবসায়ে নিজেদেরকে পরকীয় সংশ্রব ও প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ রক্ষা করবার জন্যেই আধুনিক হিন্দু ধর্মকে ভারতবাসী প্রকান্ড একটা বেড়ার মতো করেই গড়ে তুলেছিল-এর প্রকৃতিই হচ্ছে নিষেধ এবং প্রত্যাখান। সকল প্রকার মিলনের পক্ষে এমন সুনিপুর্ন কৌশলে রচিত বাধা জগতে আর কোথাও সৃষ্টি হয়নি। এই বাধা কেবল হিন্দু-মুসলমানে তা নয়। তোমার-আমার মতো মানুষ যারা আচারে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চাই, আমরাও পৃথক, বাধাগ্রস্ত। সমস্যা তো এই, কিন্তু সমাধান কোথায়। মনের পরিবর্তনে, যুগের পরিবর্তনে, যুগের পরির্বতনে।

য়ুরোপ সত্যসাধনা ও জ্ঞানের ব্যাপ্তির ভিতর দিয়ে যেমন করে মধ্যযুগের ভিতর দিয়ে আধুনিক যুগে এসে পৌঁচেছে হিন্দুকে মুসলমানকেও তেমনি গন্ডির বাইরে যাত্রা করতে হবে। ধর্মকে কবরের মতো তৈরি করে তারই মধ্যে সমগ্র জাতিকে ভূতকালের মধ্যে সর্বতোভাবে নিহিত করে রাখলে উন্নতির পথে চলবার উপায় নেই, কারও সঙ্গে কারও মেলবার উপায় নেই। আমাদের মানস প্রকৃতির মধ্যে যে অবরোধ রয়েছে তাকে ঘোচাতে না পারলে আমরা কোনো রকমের স্বাধীনতাই পাব না। শিক্ষার দ্বারা, সাধনার দ্বারা সেই মূলের পরিবর্তন ঘটাতে হবে-ডানার চেয়ে খাঁচা বড়ো এই সংস্কারটাকেই বদলে ফেলতে হবে-তারপরে আমাদের কল্যাণ হতে পারে। হিন্দু-মুসলমান মিলন যুগ পরিবর্তনের অপেক্ষায় আছে। কিন্তু এ কথা শুনে ভয় পাবার কারণ নেই, কারণ অন্য দেশে মানুষ সাধনার দ্বারা যুগ পরিবর্তন ঘটিয়েছে; গুটির যুগ থেকে ডানা মেলার যুগে বেরিয়ে এসেছে। আমরাও মানসিক অবরোধ কেটে বেরিয়ে আসব, যদি না আমি তবে নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (শান্তিনিকেতন : ১৬ পৌষ ১৩১৫)-‘বিশেষ’ অধ্যায় বলেন: “জগতের সর্ব সাধারণের সঙ্গে সাধারণভাবে আমার মিল আছে- ধূলির সঙ্গে পাথরের সঙ্গে আমার মিল আছে, ঘাসের সঙ্গে গাছের সঙ্গে আমার মিল আছে; পশুপক্ষীর সঙ্গে আমার মিল আছে, সাধারন মানুষের সঙ্গে আমার মিল আছে, কিন্তু এক জায়গায় একেবারে মিল নেই-যেখানে আমি হচ্ছি বিশেষ। আমি যাকে আজ আমি বলছি এর আর কোনো দ্বিতীয় নেই। ঈশ্বরের অনন্ত বিশ্বসৃষ্টির মধ্যে এ-সৃষ্টি সম্পূর্ণ অপূর্ব-এ কেবলমাত্র আমি একলা আমি, অনুপম অতুলনীয় আমি। এই আমির যে জগৎ সে একলা আমারই জগৎ-সেই মহা বিজনলোকে আমার অন্তর্যামী ছাড়া আর কারও প্রবেশ করবার কোনো পথ নেই।

হে আমার প্রভু, সেই যে একলা আমি, বিশেষ আমি, তার মধ্যে তোমার বিশেষ আনন্দ, বিশেষ আবির্ভাব আছে-সেই বিশেষ আর্বিভাবটি আর কোনো দেশে কোনো কালে নেই। আমার সেই বিশিষ্ট তাকে আমি সার্থক করব প্রভু। আমি নামক তোমার সকল হতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এই যে একটি বিশেষ লীলা আছে, এই বিশেষ লীলায় তোমার সঙ্গে যোগ দেব। এইখানে একের সঙ্গে এক হয়ে মিলব।

পৃথিবীর ক্ষেত্রে আমার এই মানবজন্ম তোমার সেই বিশেষ লীলাটিকে যেন সৌন্দর্যের সঙ্গে সংগীতের সঙ্গে পবিত্রতার সঙ্গে মহত্বের সঙ্গে সচেতন ভাবে বহন করে নিয়ে যায়।

আমাতে তোমার যে একটি বিশেষ অধিষ্ঠান আছে সে কথা যেন কোনোদিন কোনোমতেই না ভোলে। অনন্ত বিশ্বসংসারে এই যে একটি আমি হয়েছি মানবজীবনে এই আমি সার্থক হোক। আমি সেখানে জগতের শামিল যেখানে তোমাকে জগদ্বীশ্বর বলে মানি, তোমার সব নিয়ম পালন করবার চেষ্টা করি, না পালন করলে তোমার শাস্তি গ্রহণ করি-কিন্তু আমিরূপে তোমাকে আমি আমার একমাত্র বলে জানতে চাই সেইখানে তুমি আমাকে স্বাধীন করে দিয়েছ-কেননা স্বাধীন না হলে প্রেম সার্থক হবে না, ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছা মিলবে না। লীলার সঙ্গে লীলার যোগ হতে পারবে না। এই জন্যে এই স্বাধীনতার আমি ক্ষেত্রেই আমার সব দুঃখের চেয়ে পরম দুঃখ তোমার সঙ্গে বিচ্ছেদ অর্থাৎ অহংকারের দুঃখ আর সব দুখের চেয়ে পরম সুখ তোমার সঙ্গে মিলন, অর্থাৎ প্রেমের সুখ। এই অহংকারের দুঃখ কেমন করে ঘুচবে সেই ভেবেই বুদ্ধ তপস্যা করে ছিলেন এবং এই অহংকারের দুঃখ কেমন করে ঘোচে সেই জানিয়েই খৃষ্ট প্রাণ দিয়েছিলেন। এই দুঃখ ও সুখ বিচ্ছেদ ও মিলন অমৃত ও মৃত্যু, এই তোমার দক্ষিণ ও বাম দুই বাহু, এর মধ্যে সম্পূর্ণ ধরা দিয়ে যেন বলতে পারি, আমার সব মিটেছে , আমি আর কিছুই চাই নে।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বিশ্বমানসলোকে ও চেতনায় ধর্ম বিশ্বাস বোধটি ধারণ করেছিলেন দৃঢ়ভাবে। এবং তার দায়িত্বের রূপটি ছিল সম্পূর্ণ জীবনব্যাপী। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস ছিলেন সৃষ্টিকর্তার ও তাঁর সৃষ্টিতে। লিখেছেন একের পর এক বিশ্বাস’ ও ‘প্রার্থনা’ শিরোনামে একাধিক লেখা। যে লেখাগুলোতে সুষ্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশ্বাসের দিকটি। লিখেছেন ‘প্রার্থনার সত্য’, ‘বিধান’, ‘জগত মুক্তি’, বিশ্বব্যাপী’, ‘মৃত্যুর প্রকাশ’, ‘ভাবুকতা’, ‘পবিত্রতা’, ‘অন্তর বাহির’, ‘তীর্থ’ ‘নিত্য ধর্ম’, ‘প্রার্থনা’, ‘বিশ্বাস’, ‘মরণ’, ‘সত্যকে দেখা’, ‘সৃষ্টি’, ‘মৃত্যুও অমৃত’, ‘অহং’, ‘আত্মার প্রকাশ’, ‘আদেশ’, ‘সাধন’, পূর্ণতা’ ইত্যাদি শিরোনামে একাধিক লেখা। যে লেখাগুলোতে ফুটে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস-ধর্মবোধ-জাতীয়তা সর্বোপরি চরমরূপে ঈশ্বর বিশ্বাসী একজন রবীন্দ্রনাথ। যিনি মনে-প্রাণে তৈরি করেছেন বিশ্বাসের এক
স্তম্ভ, যে স্তম্ভয়ের উপর তিনি দাঁড় করিয়েছেন বিশ্বাসের এক দীর্ঘ প্রাসাদ এবং বসোবাস করেছেন তার'ই অভ্যন্তরে। 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রবন্ধঃ বুদ্ধদেব বসু ও ‘কঙ্কাবতী’

বুদ্ধদেব বসু প্রেমের অজস্র কবিতা রচনা করেছেন । অন্য অনেকের মতো তিনিও বেছে নেন একজন প্রেমিকাকে , যে হ ’ য়ে উঠে বুদ্ধদেবের অতুল্য প্রেমিকা হিশেবে । ‘ কঙ্কাবতী ’ অনিন্দ্য প্রেমিকা হ ’ য়ে বুদ্ধদেবের কাব্যতে বিচরণ ক ’ রে স্বচ্ছন্দে । স্থির হয়ে বসে পড়ে কঙ্কাবতী ’ কাব্যগ্রন্থে । যে কাব্যগ্রন্থে ‘ কঙ্কাবতী ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে ‘ কঙ্কাবতীকে ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে কঙ্কাবতীকে আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো কবিতায় । যেখানে সে প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে কুৎসিত কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু নয় । প্রগাঢ় ভাবে প্রাপ্তির জন্যে সমস্ত কবিতা জুঁড়ে দেখতে পাই কবির অপরিবর্তনীয় আবেদন । কঙ্কাবতী , যাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময়ের জন্যে রক্তের হিমবাহে দেখা দেয় চঞ্চলতা । সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হাঁরিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো , যা বলার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন । প্রেমিকা যখন খুব কাছাকাছি হয়ে এগিয়ে আসেন , ওই ব্যর্থ ...

প্রবন্ধঃ অমিয় চক্রবর্তী : ‘বৃষ্টি’ নিয়ে তিনটি কবিতা

রবীন্দ্রনাথ, মেঘ-বরষা বৃষ্টি নিয়ে এতো সংখ্যক কবিতা লিখেছেন যে তাঁর সমান বা সমসংখ্যক কবিতা বাঙলায় কেউ লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কবিতায় বার বার এবং বহুবার ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, বরষা, বৃষ্টি। বৃষ্টি নামটি নিলেই মনে পড়ে কৈশোর পেড়িয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটির কথা। ‘দিনের আলো নিবে এল সূর্য্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।’ বৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার কথা মনে পড়লে এটাই চলে আসে আমার মনে। অমিয় চক্রবর্তী বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। বাঙলায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেনি এমন কবির সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় পাই ‘বৃষ্টি’ নামক কিছু সৌন্দর্যময় কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে। ওই কবিদের কারো কারো কবিতা দ্রুত নিঃশ্বাসে পড়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি নামক প্রথম কবিতাটি পাওয়া যাবে অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠোতে’। উন্নিশটি কবিতা নিয়ে গ’ড়ে উঠে ‘একমুঠো’ নামক কাব্য গ্রন্থটি। যেখান থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতায় তুলে নেওয়া হয় চারটি কবিতা। আমার আরো ভালোলাগে ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি ওই তালিকায় উঠে আসে। শ্রেষ্ঠ কবিতায় না আসলে আমার যে খুব খারাপ লাগতে তা-ও নয়। ওই কবিতা...

প্রবন্ধঃ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধ সংগ্রহ

সুধীন্দ্রনাথ , সাতটি কাব্যগ্রন্থের মতো সাতটি প্রবন্ধের গ্রন্থ লিখলে খারাপ হতো না , বেশ ভালোই হতো । সুধীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো হালকা মানের নয় , যদিও তাঁর কোন রচনাই হালকা নয় । সাহিত্যে বিচারে তা অনেক উঁচুমানের । তার উপর ভাষার ব্যাপারটি তো রয়েছেই । সুধীন্দ্রনাথ মাত্র দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন । গ্রন্থ দুটো ‘ স্বগত ’ ( ১৩৪৫ ঃ ১৯৩৮ ), অপরটি ‘ কুলায় ও কালপুরুষ ’ ( ১৩৬৪ : ১৯৫৭ ) । ‘ স্বগত ’- তে রয়েছে ষোলটি প্রবন্ধ । গ্রন্থ দুটি তিনি রচনা করেছেন দু ’ ভাগে । লরেন্স বা এলিয়ট এর প্রবন্ধ যেমন পাওয়া যাবে না ‘ কুলায় ও কালপুরুষ ’- এ ; তেমনি রবীন্দ্র সম্পর্কিত প্রবন্ধ নেওয়া হয়নি ‘ স্বগত ’- এ । প্রকাশ কাল অনুযায়ী ‘ স্বগত ’- এর প্রবন্ধসমূহ : ‘ কাব্যের মুক্তি ’ ( ১৯৩০ ); ‘ ধ্রুপদ পদ - খেয়াল ’ ( ১৯৩২ ), ‘ ফরাসীর হাদ্য পরিবর্তন ’ ( ১৯৩২ ), ‘ লিটনস্ট্রেচি ’ ( ১৯৩২ ), ‘ লরেন্স ও ভার্জনিয়া উল্ফ্ ’ ( ১৯৩২ ), ‘ উপন্যাস তত্ত্ব ও তথ্য ’ ( ১৯৩৩ ), ‘ উইলিয়ম ফকনর ’ ( ১৯৩৪ ), ‘ ঐতিহ্য ও টি , এস , এলিয়ট ’ ( ১৯৩৪ ), ...