সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রবন্ধঃ স্বর্ণকুমারী দেবীঃ সাহিত্যের পথে


রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত ভাইবোন ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬), সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪২-১৯২৩), জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪৯-১৯২৫) এবং স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৬-১৯৩২) রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি; তাঁরা সবাই জড়িত ছিল শিল্প-সাহিত্যে ও সংস্কৃতি পরিবেশের সাথে। ভাইদের মধ্যে কেউ ছিল চিত্রশিল্পী; বোন ছিল লেখক  রবীন্দ্রনাথের জ্যোতির্ময় আলোয়; তাঁদের মেধা আর প্রাজ্ঞতা যেন অনেকটা ম্লান হ’য়ে আসে, তারপরও তাঁরা থেমে থাকেননি; এগিয়ে গেছেন আপন মহিমায়। রবীন্দ্রনাথ থেকে পাঁচ বছরের বড়ো ছিলেন স্বর্ণকুমারী দেবীএখানে উল্লেখ্য যে,  স্বর্ণকুমারী দেবীই ছিলেন আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের প্রথম উল্লেখযোগ্য মহিলা সাহিত্যিক।  জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে’ই স্বর্ণকুমারী দেবীর জন্ম। তিনি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮১৭-১৯০৫) চতুর্থ কন্যা। তাঁর শিক্ষা শুরু হয় তৎকালীন ঠাকুর পরিবারের রীতি অনুযায়ী। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে শিক্ষার পরিবেশ ছিল। দেবেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র, হেমেন্দ্রনাথ শিক্ষার প্রসারের বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন।

 ব্রাহ্মসমাজ প্রবর্তিত অন্তঃপুরে স্ত্রী শিক্ষা আইন তাঁর উপর অর্পিত হ’য়ে উ’ঠে অনেকটা। পরবর্তীতে, ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে গ্রহণ করেন আদর্শ শিক্ষা। এ ছাড়াও শিক্ষকগণের মধ্যে নাম আসে ‘তত্ত্ববোধনী পত্রিকা’র সুদীর্ঘ দিনের সম্পাদক অযোধ্যানাথ পাকড়াশী। যার কাছে শুধু স্বর্ণকুমারী দেবী নয়, জ্ঞানদানন্দিনীসহ ঠাকুর পরিবারের অন্যান্য পুত্রবধূরা পড়তেন সংস্কৃত। বাঙলা সাহিত্যের পাঠ নিতেন হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছ থেকে; আর ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকেজ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘জীবন স্মৃতিতে প্রকাশ পায় ছোটবেলা থেকেই লেখার অভ্যাস ছিল স্বর্ণকুমারী দেবীর; এবং তা মাঝে-মাঝে এনে দেখাতেন ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। সেই সব লেখাগুলো যে খুব বেশি সাহিত্যেমান সম্পন্ন ছিল তা স্পষ্ট ক’রে বলা যায় না। স্বর্ণকুমারী দেবীর লেখক পরিচিতি এবং বিষয় নির্বাচনের বিষয়টি বুঝতে হ’লে প্রথমে দরকার সেই সময়কার আর্থসামাজিক কাঠামো এবং শিক্ষাব্যবস্থা। উনিশ শতকের বাঙলা তথা ‘নবজাগরণ’ এবং তার ব্যাপক বিস্তার যে আবদ্ধ ছিল একক কোনো কাঠামোর মধ্যে তা কিন্তু নয়। বরং তার আধুনিকতার প্রসারিতরূপ প্রবাহিত হয়েছিল অনেক বৈচিত্র্যময় পথে। উপনিবেশের বিস্তার যেহেতু শুরু হয়েছিল বাঙলা থেকে; তাই ‘নবজাগরণ’ এবং ‘আধুনিকতা’ যেন বার-বার ফিরে আসছিল উনিশ শতকেই। তাই এই শতকেই নির্দিষ্ট হ’য়ে যায় বাঙলার কাঠামোগত ভিত্তির দিকনির্দেশনার পথ। ১৮৮০ থেকে ১৮৮৯-এর মধ্যে তিনি রচনা করেন প্রায় ১৭টি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ। বিজ্ঞান বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন ২৪টি প্রবন্ধ, তাঁর থেকেও অনেক বেশি লিখেছেন ভ্রমন ও সমাজ বিষয়ক প্রবন্ধ স্বর্ণকুমারী দেবী, ১৮৮৪ সালে দ্বিজেন্দ্রনাথের কাছ থেকে ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদকীয় কাজের ভার গ্রহণ করেন। ১৮৮৬-তে, ‘সখি-সমিতি’ এবং মহিলা শিল্পমেলার পত্তন, ১৮৯০-এ, কংগ্রেসের কলকাতা অধিবেশনের একমাত্র মহিলা প্রতিনিধি হিসেবে যোগদেন স্বর্ণকুমারী দেবীলেখালেখির ক্ষেত্র হিসেবে বৈচিত্র্যময় বিষয়কেই তিনি বেঁছে নেন। বিজ্ঞান, ইতিহাস, সমাজ, জীবনী, ভ্রমন কাহিনি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে লিখেছেন প্রচুর। তাঁর লেখা ৭০টির মতো প্রবন্ধ সে সময়কার ‘ভারতীয়’ সহ সমসাময়িক বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। স্বর্ণকুমারী দেবীর ‘জাতীয়তাবাদে’ হাতে খড়ি হয় তাঁর পরিবারের অভ্যন্তর থেকেই। ১৮৬৬ সালে গগেন্দ্রনাথের উদ্যোগে গ’ড়ে ওঠা চৈত্রমেলা এবং ১৮৬৭ সাল থেকে চালু হওয়া ‘হিন্দুমেলায়’  স্বর্ণকুমারীর অবাধ যাতায়াত ছিল। এর পরবর্তী সময়ে;  জানকীনাথের ১৮৯০-এ; কংগ্রেসের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে সেখানেও যাতায়াত ছিল তাঁর। ১৮৯০-এ; কংগ্রেসের প্রতিনিধি পদপ্রাপ্তি সেটাকে আরও সামনের দিকে নিয়ে যায়। স্বর্ণকুমারী প্রাচ্যবাদীদের সঙ্গে তাল রেখে বিশ্বাস করতেন ‘সনাতন ভারতীয় সংস্কৃতি’ এবং ‘ইউরোপীয় সভ্যতার’ মিলন। এ দেশে  ইংরেজ শাসনের সুফল সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। ব্যক্তিগত ভাবে, বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছেন চরমপন্থা ও সশস্ত্র আন্দোলনের। স্বর্ণকুমারী দেবী কবিতা লেখা শুরু করেন বিহারীলালকে অনুসরণ করে তাঁর রচিত কাব্যের মধ্যে রয়েছে ‘গাথা’ ও ‘কবিতা ও গান’। ‘ভারতীয়’ পত্রিকার প্রয়োজন মেটাতেই গল্প-উপন্যাস-কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখে উঠেন বিজ্ঞান বিষয়ক বিপুল প্রবন্ধ। স্বর্ণকুমারী দেবী রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে, ‘দীপ-নির্বাণ’, ‘ছিন্নমুকুল’, ‘মালতী’, ‘মিবাররাজ’, ‘হুগলীর ইমামবাড়ী, ‘বিদ্রোহ’, ‘ফুলের মালা’, ‘কাহাকে’, ‘বিচিত্রা’, ‘স্বপ্নবানী’, ‘মিলনরাত্রি’ ইত্যাদি। নাটক ‘নিবেদিতা’, ‘দিব্য কোমল’, প্রহসন ‘কনে বদল’, ‘পাকচক্র’, ছোট গল্প ‘নব কাহিনী’, কাব্যনাট্য ‘যুগান্ত’, ‘দেব কৌতুক’ ইত্যাদি। সাহিত্যে তাঁর দান বিপুল। বঙ্গমহিলাদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম সার্থক উপন্যাস, গাঁথা ও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ রচনা করেন।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রবন্ধঃ বুদ্ধদেব বসু ও ‘কঙ্কাবতী’

বুদ্ধদেব বসু প্রেমের অজস্র কবিতা রচনা করেছেন । অন্য অনেকের মতো তিনিও বেছে নেন একজন প্রেমিকাকে , যে হ ’ য়ে উঠে বুদ্ধদেবের অতুল্য প্রেমিকা হিশেবে । ‘ কঙ্কাবতী ’ অনিন্দ্য প্রেমিকা হ ’ য়ে বুদ্ধদেবের কাব্যতে বিচরণ ক ’ রে স্বচ্ছন্দে । স্থির হয়ে বসে পড়ে কঙ্কাবতী ’ কাব্যগ্রন্থে । যে কাব্যগ্রন্থে ‘ কঙ্কাবতী ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে ‘ কঙ্কাবতীকে ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে কঙ্কাবতীকে আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো কবিতায় । যেখানে সে প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে কুৎসিত কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু নয় । প্রগাঢ় ভাবে প্রাপ্তির জন্যে সমস্ত কবিতা জুঁড়ে দেখতে পাই কবির অপরিবর্তনীয় আবেদন । কঙ্কাবতী , যাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময়ের জন্যে রক্তের হিমবাহে দেখা দেয় চঞ্চলতা । সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হাঁরিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো , যা বলার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন । প্রেমিকা যখন খুব কাছাকাছি হয়ে এগিয়ে আসেন , ওই ব্যর্থ ...

প্রবন্ধঃ অমিয় চক্রবর্তী : ‘বৃষ্টি’ নিয়ে তিনটি কবিতা

রবীন্দ্রনাথ, মেঘ-বরষা বৃষ্টি নিয়ে এতো সংখ্যক কবিতা লিখেছেন যে তাঁর সমান বা সমসংখ্যক কবিতা বাঙলায় কেউ লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কবিতায় বার বার এবং বহুবার ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, বরষা, বৃষ্টি। বৃষ্টি নামটি নিলেই মনে পড়ে কৈশোর পেড়িয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটির কথা। ‘দিনের আলো নিবে এল সূর্য্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।’ বৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার কথা মনে পড়লে এটাই চলে আসে আমার মনে। অমিয় চক্রবর্তী বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। বাঙলায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেনি এমন কবির সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় পাই ‘বৃষ্টি’ নামক কিছু সৌন্দর্যময় কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে। ওই কবিদের কারো কারো কবিতা দ্রুত নিঃশ্বাসে পড়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি নামক প্রথম কবিতাটি পাওয়া যাবে অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠোতে’। উন্নিশটি কবিতা নিয়ে গ’ড়ে উঠে ‘একমুঠো’ নামক কাব্য গ্রন্থটি। যেখান থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতায় তুলে নেওয়া হয় চারটি কবিতা। আমার আরো ভালোলাগে ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি ওই তালিকায় উঠে আসে। শ্রেষ্ঠ কবিতায় না আসলে আমার যে খুব খারাপ লাগতে তা-ও নয়। ওই কবিতা...

প্রবন্ধঃ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধ সংগ্রহ

সুধীন্দ্রনাথ , সাতটি কাব্যগ্রন্থের মতো সাতটি প্রবন্ধের গ্রন্থ লিখলে খারাপ হতো না , বেশ ভালোই হতো । সুধীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো হালকা মানের নয় , যদিও তাঁর কোন রচনাই হালকা নয় । সাহিত্যে বিচারে তা অনেক উঁচুমানের । তার উপর ভাষার ব্যাপারটি তো রয়েছেই । সুধীন্দ্রনাথ মাত্র দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন । গ্রন্থ দুটো ‘ স্বগত ’ ( ১৩৪৫ ঃ ১৯৩৮ ), অপরটি ‘ কুলায় ও কালপুরুষ ’ ( ১৩৬৪ : ১৯৫৭ ) । ‘ স্বগত ’- তে রয়েছে ষোলটি প্রবন্ধ । গ্রন্থ দুটি তিনি রচনা করেছেন দু ’ ভাগে । লরেন্স বা এলিয়ট এর প্রবন্ধ যেমন পাওয়া যাবে না ‘ কুলায় ও কালপুরুষ ’- এ ; তেমনি রবীন্দ্র সম্পর্কিত প্রবন্ধ নেওয়া হয়নি ‘ স্বগত ’- এ । প্রকাশ কাল অনুযায়ী ‘ স্বগত ’- এর প্রবন্ধসমূহ : ‘ কাব্যের মুক্তি ’ ( ১৯৩০ ); ‘ ধ্রুপদ পদ - খেয়াল ’ ( ১৯৩২ ), ‘ ফরাসীর হাদ্য পরিবর্তন ’ ( ১৯৩২ ), ‘ লিটনস্ট্রেচি ’ ( ১৯৩২ ), ‘ লরেন্স ও ভার্জনিয়া উল্ফ্ ’ ( ১৯৩২ ), ‘ উপন্যাস তত্ত্ব ও তথ্য ’ ( ১৯৩৩ ), ‘ উইলিয়ম ফকনর ’ ( ১৯৩৪ ), ‘ ঐতিহ্য ও টি , এস , এলিয়ট ’ ( ১৯৩৪ ), ...