কুয়াশাগুলো সাদা কেন ? তারা কি অন্য কোনো
রঙের হতে পারত না ! এই যেমন লাল, হলুদ, সবুজ, গোলাপি বা কালো রঙের। তাহলে কি ওই কুয়াশাগুলো দেখতে অনেক
সুন্দর লাগতো, আমার জানতে বা দেখতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার ইচ্ছে করলেই কী সব
কিছুর রঙের পরিবর্তন সাথে-সাথে হ’য়ে যাবে ! আমি জানি, এটা কখন সম্ভব নয়। বড় কোন
যাদুকর হ’লে, সে হয়তো কিছুটা সময়ের জন্য আমার ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে পারত। কিন্তু সব
সময়ের জন্য সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু মাঝে-মাঝে আমার যে খুব ইচ্ছে করে, সাদা
কুয়াশাগুলোকে গাঢ় লাল রঙের করে দেখতে ! না, রঙটা লাল না, যদি সবুজ হতো তাহলে কেমন
হতো। যদি হলুদ হতো, তবে কি আমার খুব খারাপ লাগতো ? আমি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে
ব্যাপারটি ভাবতে থাকি। নীরব একটি রাস্তা দিয়ে আমি হাঁটছি; আর আমার চতুর্দিকে লাল
রঙের কুয়াশায় ভ’রে আছে। আমি যেন অনেক লালের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার এই
সুন্দর দু’চোখ যতদূর দেখতে পাচ্ছে, সেখানে যেন লাল ছাড়া অন্যকোন রঙ নেই। সেই লাল
রঙের কুয়াশার জন্য পৃথিবীটা কী লাল হ’য়ে উঠবে ? সেই লাল কি আবার দেখতে আগুনের মতো
? আগুন তো দেখতে অনেক লাল। কিন্তু আগুন দেখতে তো আমার খারাপ লাগে না ! তাহ’লে কী
লাল কুয়াশা দেখতে আমার অনেক ভালো লাগবে, না কম ভালো লাগবে ? আমি কী একটু চোখ বন্ধ
ক’রে রঙগুলো দেখতে থাকবো ? সাদা কুয়াশা দেখতে আমার আর ভালো লাগে না। সেই ছোট থেকে
আমি তো সাদা কুয়াশা দেখে আসছি। আমি কেন, যে কেউ এই রঙটা দেখে
দেখেই বড় হয়েছে। সেই সাদাটা আবার মেঘের সাথে মিশে যাচ্ছে আপন মনে। আমিও অনেক সাদা
কুয়াশা দেখেছি। অনেক দূর থেকে তাদেরকে দেখলে কুয়াশা থেকে মেঘ বলেই আমার বেশী মনে হ’তে
থাকে। আমার মনে হতে থাকে, আমি যেন মেঘের ভিতর দিয়ে ভেসে যাচ্ছি, এক আকাশ থেকে আরেক
আকাশে। আমার সাথে-সাথে সেই কুয়াশাগুলো, মেঘের মতো ক’রে বাতাসের সাথে হারিয়ে যাচ্ছে;
নিজের মতো ক’রে। আমার চোখ দিয়ে, আমি তা
দেখছি আপন মনে। আমার খুব ভালো লাগতে থাকে। আমার তো মাঝে-মাঝেই মনে হয়, আমি যেন ওই
কুয়াশার সাথে মিশে যাই। ওদের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলি। তাদের সাথে, মেঘের মধ্যে
হারিয়ে যাই। তুলোর মতো নরম, আর অনেকটা কোমল হ’য়ে উঠে আমার অনুভূতিগুলো। আমি অনেক
সময়, সেই কুয়াশার মধ্যে আমার সম্পূর্ণ হাত ডুবিয়ে দিয়েছি। হালকা একরকম ঠাণ্ডা যেন
খেলা ক’রে যায় আমার অনুভূতিতে। শুধু হাত নয়, আমার শরীরটাও যেন কেঁপে-কেঁপে উঠে,
কুয়াশার হিমেল ঠাণ্ডায়। ঠাণ্ডার সময় কুয়াশা না নামলে আমার ভালো লাগে না, মনটা অনেক
খারাপ হ’য়ে উঠে। যদিও কুয়াশা, অনেক কিছুকে ঢেকে দেয়। দৃশ্যমান অনেক কিছুকে সে
অদৃশ্য ক’রে রাখে। কাছের জিনিসটাকেও সে দেখতে দেয় না। যেন সাদা এক কোমল আবরণ দিয়ে,
সে চতুর্দিক ঢেকে দিচ্ছে। ঘর থেকে একটু বেড় হলেই, আমি খেজুর গাছটা দেখতে পাই না,
নারকেল গাছটা দেখতে পাই না, সুপারি গাছটা দেখতে পাই না, জামরুল গাছটা দেখতে পাই
না, প্রিয় আম গাছটাও যেন হারিয়ে গেছে তার জায়গা থেকে। দীর্ঘ কৃষ্ণচূড়াটা যেন
ক্ষণিকের জন্য মিশে যায় কুয়াশার ভিতর। আর দূরের তাল গাছটা যে ওখানে আছে, তা যেন
আমি ভুলে যাই। বেলা বাড়ার সাথে-সাথে সব কিছু যেন যাদুর মতো আমার সামনে দৃশ্যমান হ’তে
থাকে। আমার প্রিয় গাছগুলো যেন আমাকে ডাকছে, আর আমি যেন তাদের প্রত্যকটি ডাকের
উত্তর নিচ্ছি। আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে, গাছগুলো তোমরা কেমন ছিলে ঘন কুয়াশার
ভিতর, তোমাদের কী ঠাণ্ডা লাগেনি তাদের ছোঁয়ায় ? আমি তো কেঁপে-কেঁপে উঠছি ! তোমাদের
বুঝি কোনো ঠাণ্ডাই লাগেনি ! প্রতিদিনই কুয়াশায় তোমাদের ঢেকে থাকে, তোমাদের বুঝি
কোন কষ্ট হয় না ? কিন্তু তোমাদের জন্য আমার তো অনেক কষ্ট লাগে ! আমি কাউকে সেই
কথাগুলো বলিনি, আমার বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখি, আমার কষ্ট ভেবে। বাড়ির পাশ দিয়েই
বয়ে চলেছে মধুমতী নদী। নামটি আমার বেশ মিষ্টি-মিষ্টি লাগে। যেন নাম নেওয়া মাত্রই
সুখকর কিছু ঘটে যায় আমার ইন্দিয়ে। একপ্রকার সুখ যেন আমার নাকে গেঁথে থাকে। গাঢ়
কুয়াশার মধ্যেও আমি এ-নদীটির দিকে তাকিয়ে থেকেছি। তার উপর দিয়ে
একপ্রকার নরম ধুঁয়ার মতো কিছু একটা দেখতে পাই। যেন মুহূর্তে সে উড়ে যাবে। নদীটির
এ-পার আর ওপার ঠিক স্থির করা যায় না। তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলে, আমার আরও
মনে হয়েছে আসলে এখানে কী কোন নদী আছে ? যেন সব সমান। বহমান একটি ধারা যেন তার মাঝে
খেলা ক’রে যাচ্ছে। আমি অনেকগুলো টুকরো-টুকরো কালো মেঘ দেখতে পাই। আকাশে যেন
তারা উ’ড়ে বেড়াচ্ছে এক আকাশ থেকে আরেক আকাশে। কিছুটা সময়ের মধ্যে, তারা হয়তো সম্পূর্ণ
আকাশটায় ছেয়ে যাবে। আমি অনেকটা পথ ধরে হাঁটতে থাকি। আমি জানি, বেলা
বাড়ার সাথে-সাথে, কুয়াশাগুলো হারিয়ে যাবে আর সেই জমানো কালো মেঘ থেকে ঝ’রে পড়বে গাঢ়
বৃষ্টির ফোঁটা। কেমন লাগবে তখন আমার ! আমার দু’চোখ কী তাদের অপেক্ষায় বসে থাকবে ! না,
আমি বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে থাকবো ? কুয়াশার জন্য আমি ঠিক ভাবে বাড়িতে যেতে পারবো ?
সে কি একটুও বাঁধা দিবে না ! যদি আমি যেতে না পারি তাহ’লে কী আমি কুয়াশার মধ্যে
হারিয়ে যাবো ! কেউ কী আমাকে আর খুঁজে পাবে না ? কাউকে যদি আমি বলি, অনেকগুলো
কুয়াশার মধ্যে আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম, তারা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে ? না, বলবে
আমি মিথ্যা বলছি। আমি মিথ্যা বলতে যাবো কেন ? মানুষ কী হারিয়ে যেতে পারে না ? আমি
না হয়, কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গেছি। কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাবার একটা মজাই আলাদা।
বেলা যখন বেড়ে যাবে, কুয়াশা কেটে গেলে আমি আবার আমার জায়গায় সহজেই ফিরে আসতে
পারবো। কেউ কখনও জানতেও পারলো না, সত্যিই আমি কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলাম। মানুষ
যে হারিয়ে যেতে পারে, এটা ভাবতেও আমার অনেক অবাক লাগে। আমি কী হারিয়ে যাব কুয়াশা
বা কালো মেঘের ভিতরে। সবাই যেমন তাদের শৈশবে কোন না কোন এক সময়ে হারিয়ে যায়। আবার তারা ফিরে আসে তাদের আপন জগতে। আমিও
কী তাঁদের মতো অনেক বড় হ’য়ে গেছি ! হয়ত হয়েছি, আবার কখনও মনে হয় হয়তো হয়নি। এ-নিয়ে
আমি তো কারও সাথে কোন কথা বলিনি। আমি তো শুধু কুয়াশা আর কালো মেঘের মধ্যেই ডুবে
আছি। আমার স্বপ্ন আর চলার পথ অনেকটা তাদের ঘিরেই রয়েছে। কাউকে প্রভাবিত করিনি আমার
ভাবনার সাথে। কুয়াশা আর মেঘ আমার যে এতো পছন্দ; অন্যরা তা পছন্দ নাও করতে পারে। আমি
মেঘের মধ্যে হারিয়ে যেতে চাই, কুয়াশায় মুগ্ধ হ’য়ে পড়ি। বৃষ্টির শব্দ কান পেতে
শুনি। এগুলো সবার হয়তো ভালো নাও লাগতে পারে। তা নিয়ে আমি মোটেও কষ্ট পাই না। কষ্ট
লাগলেও তা সবাইকে বলতে হয়না; বুকের ছোট কোণে তাকে লুকিয়ে রাখতে হয়। এ-রকম ছোট-ছোট
কষ্ট, কম বেশী সবার থাকে, যেমন তা আমারও রয়েছে। কেউ দেখতে পায় না, কাউকে দেখায়নি,
বলিনি। বৃষ্টির শব্দ, প্রোজ্জ্বল রোদ, কালো মেঘ, মাঘের আকাশ, বৈশাখের হাওয়া,
ক্লান্ত দুপুর, মধ্যে পুকুরে মাছের লাফালাফি, লাল কৃষ্ণচুড়ার ছায়া, হেমন্তের
বিকাল, নিঃসঙ্গ রাস্তা, শিউলি ফুলের ঘ্রাণ, হাসনাহেনা-কামিনী, কাঁঠাল চাঁপা,
গন্ধরাজ, বকুল আর গাঁদা এগুলো যে আমার অনেক-অনেক ভালো লাগে। আমিও তো তাদের সাথেই
থাকতে চাই; তাদের নিয়েই বাঁচতে চাই। আমি যেন কোন এক নিঃসঙ্গ বালকে রূপান্তরিত
হচ্ছি। যে নিজেকে অনেক বেশী ভালোবাসে; অন্যদের আরও বেশী। যার হাতে স্বপ্ন আসে
কেঁপে-কেঁপে; শূন্য বাতাসে ভর ক’রে, কোকিলের সুরে-সুরে, রোদের ঝিলিক আর জমে উঠা
শীতে। যে
সাতার কাটে মধুমতীতে, মুখ রাখে নরম ঘাস ফুলে। চোখের মধ্যে ব’য়ে চলে পূর্ণিমার
চাঁদ আর জ্যোৎস্নাময় সন্ধ্যা।
যার সোনালী আঙুলে গেঁথে থাকে কয়েক কোটি নীল স্বপ্ন; বালুচর, আঁকাবাঁকা পথ,
কুমার নদীর ঢেউ, প্রিয় মুখ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন