মাত্র ২৮
বছরের শিল্পী জীবনে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের
সাহিত্যকর্ম সংখ্যায় বিপুল। উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, নাটক ও সর্বোপরি রয়েছে বেশ
কিছু কবিতা। সাহিত্য রচনার সমান্তরালে যে জীবনও তিনি রচনা করেছিলেন এই সত্য সর্বদা
স্মরণযোগ্য। তার প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
(১৯০৮-১৯৫৬) তার সাহিত্যিক নাম। পূর্ববাংলা সাধারণ চিত্র তার চোখে গেঁথে রয়েছে সৌন্দর্য নিয়ে।
অল্পকালের মধ্যে তিনি কলকাতার আধুনিক গোষ্ঠীর প্রধান লেখকে পরিণত হলেন। বস্তুত, মানব সম্পর্ক নিয়ে তার লেখার সাথে আমাদের পরিচয়।
তার রচিত সমস্ত চরিত্রেই একটি ধাঁচ আছে, যার চিত্র আমরা দেখতে পাই সমস্ত সাহিত্য
জুড়ে। সাধারণ মানুষের মন, মৌলিকভাবে যদি বা কখনো সরল থেকেই থাকে, পারিপার্শ্বিকতা
তাকে হয়তো বা তার অজান্তেই আরও জটিল-কুটিল ও বঙ্কিম করে তুলবে। এই জটিলতা বা
ব্যক্তির ইচ্ছা নিরপেক্ষ চিন্তা ও কর্মপরস্পরা নিয়ন্ত্রিত হয় বহু উপাদানের
মিশ্রণে। যার চিত্র আমরা সুস্পষ্ট দেখতে পাই তার উপন্যাস ও ছোটগল্পে। এখানে একটি
কথা স্পষ্ট করে বলতে পারি যে, ব্যক্তিমানুষের মনোজগতে যে দুর্জ্ঞেয় অপার রহস্য
তিনি ছড়িয়ে দিলেন তার অজস্র কাহিনি পরস্পরায় সম্ভাব হত না, যদি না তিনি মেনে নিতেন
অন্য ধরণের জীবনযাত্রা, অন্য ধরণের শৈল্পিক লেখা। দীর্ঘ ২৮ বছরের সাহিত্য
সৃষ্টিকালে তার কাছ থেকে আমরা পেয়েছি ৪০টি উপন্যাস, ২৬০টির মতো ছোটগল্প, ১৫টি
গল্পগ্রন্থ, একটি প্রবন্ধ ও বেশ কিছু কবিতা। সেই সাথে রয়েছে অজানা ঘটনার বেশ কিছু
চিঠিপত্র। মানিক যে সময় দ্রুতবেগে এগিয়ে নিচ্ছেন তার লেখাকে, চোখের নিমিষেই সবকিছু
যেন পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্য, রাষ্ট্রচিন্তা
কোন কিছু যেন বাদ পড়ছে না সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া থেকে। এর সাথে নিজের চোখেই দেখলেন ঘরে-বাইরে অভাব, দুঃখ, দারিদ্র, কত নির্মম
হয়ে দেখা দেয়। এও দেখলেন মানুষ কত অসহায়। সেই সাথে আরও দেখা দিল অসহযোগ আন্দোলন,
সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, কম্যুনিস্ট আন্দোলন,
জাতি বিদ্বেষ, দেশ ভাগ, চীনা বিপ্লব, শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন আরও কত নিষ্ঠুর চিত্র।
এ সবের অনেক কিছুই মানিকের মনে নাড়া দিয়েছিল। তিনি যেন দু’চোখ মিলে দেখছেন সব
কিছু। এ সব ঘটে যাওয়া ঘটনা তার সৃষ্টিতে এনেছিল নতুন চিন্তার ভাবধারা। তাই বলতে হয়
মানিকের বিশ্বে প্রবেশ করতে হলে আমাদের যেন অনেকটা প্রস্তুতি নিয়েই প্রবেশ করতে
হয়। কারণ হিসেবে আমরা বলতে পারি, তিনি সহজ-সরল বা প্রথাগত ধারার লেখক ছিলেন না। তিনি
ছিলেন বিশশতকের আধুনিক মতবাদের অগ্রসর লেখক। তাকে বুঝতে হলে যেমন বুঝতে হয় ফ্রয়েড
ও মার্কসবাদকে, তেমনি বিজ্ঞান ও সমাজতত্ত্বকে। বস্ত ও বাস্তবচিত্র মানুষের চেতনার
ভিত্তি, যা দু’চোখ জুড়ে আহরণ করে নিয়েছিলেন মানিক তার নিজের ভিত্তি মজবুত করার
জন্য। সত্যকে শিল্পের সত্য দিতে ঢেকে দিলে তা জীবন বা সমাজের কোনো কাজে লাগে না।
যে শিল্প-সাহিত্য-সৌন্দর্য মানুষের বাঁচার কাজে লাগে না, সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের
জন্য প্রয়োজনে আসে না তাকে মানুষের প্রয়োজন কি ? জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে মানিক এই
সত্যটা মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন। মধ্যচল্লিশের দশক থেকে এই চেতনা মানিকের
জীবনকে গভীরভাবে আলোড়িত করে তোলে। এ-সময় থেকে তিনি ভাবালুতা, রোমান্সকে বাদ দিতে
প্রবেশ করেন সমাজের সরাসরি অভ্যন্তরে। সমকালীন সমাজের প্রচলিত অংশের তুলনায় অনেক
এগিয়ে ছিলেন মানিক, যেমন সাহিত্যেয় তেমনি রাজনীতির ক্ষেত্রে। শতাব্দীর পরিবর্তনের
ধারায় মানিকের প্রাসঙ্গিকতা যেমন কমেনি, তেমনি কমেনি মন ও মননের পরিবর্তনের ধারায়
গড়ে উঠা মনন প্রকৃতি।
১৯৪৪-এ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কম্যুনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য হবার পর
তার জীবন-সমাজ-সাহিত্য ভাবনায় যে নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটে তা আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই
তার অনেক লেখায়। যে বিশ্বাস ও আদর্শ থেকে তিনি উচু-নিচু, ধনী-দরিদ্রকে দেখেছিলেন
এবং তাদের অধীত জীবনের চিত্র এঁকেছিলেন। তা ছিল সেই সময়ের ইতিহাস। যে নিচুতলার মানুষদের
প্রতি মমতায় তিনি এ পথে পা বাড়িয়েছিলেন সে পথ তখনও ছিল পথিকশূন্য। যে পথে কেউ পা
বাড়ায় না, যে পথ নতুন ও বন্ধুর সেই পথে যে লেখক পা রাখার সাহস দেখান, তিনিই
আধুনিকের দাবিদার। মানিক মার্কসবাদী চিন্তায় মিশে গেলেও, কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য
গ্রহণ করলেও সঙ্গে-সঙ্গেই পার্টির পক্ষ থেকে তার রচনায়
পার্টির প্রাণ প্রতিষ্ঠার কোনো রকম আহ্বান আসেনি। সেটা আসে আরও পরে, ১৯৪৬-এর
আগস্টে। যদিও এ-ব্যাপারে মানিকের ব্যক্তিগত আগ্রহ যে খুব বেশী ছিল তা স্পষ্ট করে
বলা যাবে না। বরং অনেকটা নিশ্চুপ হয়েই থাকেন তিনি সুন্দর একটি সময়ের জন্য। যে সময়
অনেকটা তার হয়েই কথা বলবে। ব্যক্তি চেতনায় ধরা দিবে মৌলিক একজন লেখককে, তিনি মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়
ছাড়া অন্য কেউ নয়।
মানিকের জীবন দৃষ্টি ও শিল্পীমানসের
ক্রমবিভাজন স্তরবিন্যাসের সতর্ক পর্যবেক্ষণে তার সৃষ্টিশীল সত্তার বিভিন্ন
বৈশিষ্ট্য বিশেষ ভাবেই প্রতীয়মান হয়। জীবনের প্রতি সুনিবিড় আগ্রহ, সতর্ক অভিনিবেশ
ও সদাজাগ্রত চেতনালোকে পুঞ্জিভূত সংবেদনরাশির মিথস্ক্রিয়ায় তিনি যে শিল্পসত্তায়
মনোনিবেশ করেন, তা প্রকৃত অর্থেই বিশ শতকের বাঙালি ভাবনাচিত্তে মৌলিক চেতনার
বিস্তার বলেই আমরা মেনে নিই। তিনি যে এ-ধারা থেকে খুব বেশী দূরে ছিলেন তা কিন্তু
আমরা বলতে পারি না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ‘কল্লোল’
অথবা তার সহযোগী ‘কালিকলম’ পত্রিকায় কখনো কোনো লেখা প্রকাশ করেননি। মানিকের প্রথম
ছোটগল্প ‘অতসীমামী’ প্রকাশিত হয় উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮৩-১৯৬০) সম্পাদিত
‘বিচিত্রা’ পত্রিকায় ১৯২৮ সালে। তখন মানিকের বয়স মাত্র বিশ বছর। এখানে
উল্লেখ্যযোগ্য যে, ‘কল্লোল’ ও ‘বিচিত্রা’ উভয়ই মাসিক পত্রিকা ছিল। দীনেশরঞ্জন
দাসের সম্পাদনায় ‘কল্লোল’ প্রকাশিত হয়
১৯২৩ সালে। পত্রিকাটির আয়ুষ্কাল ছিল সাত বছর। তিনি ইচ্ছা করলে ‘অতসীমামী’ লেখার
পর, কল্লোলের পরবর্তী বারটি সংখ্যার যে কোনো একটিতে অন্য গল্প লিখতে পারতেন। অন্যদিকে
মুরলীধর বসুর সম্পাদনায় ‘কালিকলম’ পত্রিকাটি তখন যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছে। পত্রিকাটি
তিনজনের সম্পাদনায় প্রকাশিত হতো শৈলজানন্দ, প্রেমেন্দ্র ও মুরলীধর বসু। এক বছর পর
প্রেমেন্দ্র, দু’বছরের মাথায় শৈলজানন্দ দায়িত্ব ত্যাগ করলে মুরলীধর একাই আরও তিন
বছর পত্রিকাটি পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। মানিক ইচ্ছা করলে এখানেও লেখা
দিতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। অন্যদিকে মানিক, ‘কল্লোল’ ও ‘কালিকলমের’
আড্ডাতে নিজেকে কখনো সম্পৃক্ত রাখেননি। যদিও পত্রিকা দু’টির লেখকগোষ্ঠীর অনেকেই
ছিলেন তার সমবয়সী। বুদ্ধদেব বসু ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম একই বছরে অর্থাৎ ১৯০৮ সালে। প্রেমেন্দ্র মিত্র ও অচিন্ত্যকুমারের
জন্ম যথাক্রমে ১৯০৪ ও ১৯০৩ সালে। ‘অতসীমামী’ প্রকাশিত হওয়ার পূর্বে এদের কারো সাথে
কারো পরিচয় ছিল না। অচিন্ত্যকুমার, তাকে প্রথম দেখেন ‘বিচিত্রা’ অফিসে। তিনি তখন
ওই পত্রিকায় চাকুরী করতেন একজন প্রুফরিডার হিসেবে। মানিকের প্রথম পরিচয়ের চমৎকার
বর্ণনা দিয়েছেন ‘কল্লোলযুগ’ গ্রন্থে, ‘একদিন দুপুরবেলা বসে আছি বা বলতে পারি কাজ
করছি- একটি দীর্ঘকায় ছেলে ঢুকলো বিচিত্রা অফিসে। দোতলায় সম্পাদকের ঘরে। উপেনবাবু
তখনও আসেননি। আমি উপনেতা। ‘একটা গল্প আনেছি বিচিত্রার জন্য’- হাতে একটি লেখা,
ছেলেটি হাত বাড়াল। প্রখর একটি ক্ষিপ্রতা তার চোখেমুখে, যেন বুদ্ধির সন্দীপ্তি।
গল্প যেন এখুনি শেষ করেছে আর যদি কালবিলম্ব না করে এখুনি ছেপে দেওয়া হয় তা হলেই
যেন ভাল। ‘এই রইল’।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের ভাষার বিস্তার ও প্রকরণে মানবজীবনের অন্তর্গত
এবং বহির্গত বিষয়ের উন্মোচনে বাংলা উপন্যাসের সম্ভাবনার সীমাকে অনেকটা এগিয়ে নিয়ে
যায়। তিনি উপন্যাস-শিল্পে অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে মানুষের মনোবিশ্ব ও বহিবাস্তবতার
সঙ্গে নিজস্ব জীবনাবেগ ও তত্ত্বাবেগের সুষম সমন্বয় সাধনে অসাধারণ দক্ষতার পরিচয়
দিয়েছেন। সে জন্যই তার উপন্যাসে বিন্যস্ত মানবজীবনের মনোবিশ্ব যেমনি স্বতন্ত্র ও
বৈচিত্র্যময়, তেমনি অভিনিবেশ্য ও বিশেষত্বপূর্ণ। এ-বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকায়
রাবীদ্রিক উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তার প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির কাব্য
তারই শিল্পচেতনার সৌন্দর্যমণ্ডিত
বহিঃপ্রকাশ বলেই আমাদের মনে হয়। বিষয় ও বৈচিত্র্যময়তায় যা অভিনব বলে আমরা মেনে
নিতে পারি। দিবারাত্রির কাব্য‘র
সেই তিনটি স্তর বার-বারই আমাদেরকে
মানিকের কবিতার কথাই মনে করে দেয়। প্রথম ভাগের ‘দিনের কবিতা’; দ্বিতীয় ভাগের
‘রাতের কবিতা’ এবং সর্বশেষ ভাগের ‘দিবারাত্রির কাব্য’। মানিক কবিতা দিয়েই যে
স্তরগুলো নিজের মত শুরু করেছেন। দিবারাত্রির কাব্য’র প্রকাশকাল ১৯৩৫-এর
ডিসেম্বর; জননী উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার ন’মাস পরে প্রকাশিত হয়। কিন্তু
প্রকৃত পক্ষে এটিই মানিকের লেখা প্রথম উপন্যাস। ‘লেখকের ভূমিকা’ শিরোনামে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই একটি ভূমিকা সংযুক্ত করেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, ‘দিবারাত্রির কাব্য’ আমার একুশ বছর বয়সের রচনা।
শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল।
অনেক পরিবর্তন করে গত বছর (১৩৪১) ‘বঙ্গশ্রী’তে প্রকাশ করি। ‘দিবারাত্রির কাব্য’
পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয়, বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক- তখন মনে রাখতে হবে এটি
গল্পও নয়, উপন্যাস ও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটি নতুন রূপ। একটু চিন্তা করলেই
বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতকগুলি
অনুভুতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়,
মানুষের Projection- মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।’
কবিতা চর্চায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে হাত ছিল না তা কিন্তু আজ আর বলা যাবে না। স্থায়ী আসন
যে তিনি ওখানে তৈরি করেননি তা আজ আর আমাদের অজানা নয়। কথাসাহিত্য ও ছোটগল্পে তার
আসন যে মজবুত হয়ে রয়েছে তা তিনি স্পষ্ট করেই বুঝতে পেরেছিলেন লেখার শুরুতেই। সেই
আত্মবিশ্বাস আর গভীর উপলব্ধি নিয়েই তিনি এগিয়েছেন সেই চেনা পথেই। তাই কবিতা চর্চায়
সময় আর নষ্ট না করে, কবিতার প্রতি নিজের যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা বুঝে নিয়েছিলেন
লেখার ঊষা পর্বেই। এত কিছুর পরও আমরা বলতে পারি তিনি কবিতা লিখে গেছেন নিজের মত
করে। লেখার প্রয়োজনে লিখে গেছেন, কখনো হয়তো সে স্থানটির প্রতি খুব বেশী মনোযোগ
দেননি। আজ এতদিন পরেও আমরা স্পষ্ট করে বলতে পারি মানিকের কবিতার স্বাদ ব্যতীত
মানিক সাহিত্য চর্চা যেন অনেকটা অসমাপ্ত থেকে যায়। তাই নিবিড় সংযোগ তৈরি করতে হয়
সেই কবিতার সাথে। তার জীবিতকালে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সেই সব কবিতা প্রকাশ হতে
থাকে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত কবিতা তার
প্রায় প্রথম গদ্য রচনার সমসাময়িক। রচনাকালের দিক থেকে তার প্রথম উপন্যাস দিবারাত্রির
কাব্য ‘র
তিনটি পৃথক বিভাগের ভূমিকাস্বরূপ মুদ্রিত
কবিতা তিনটি। অন্তত বলা যায়, প্রকাশকালের দিক থেকে, মানিকের প্রথম কবিতার নিদর্শন।
মানিকের প্রথম কবিতা তাই তার প্রথম উপন্যাসের ভূমিকা হিসেবে দেখা দেয়। এই ভূমিকা
যথার্থরূপে দেখা দেয় এই উপন্যাসের তাৎপর্যময় ভূমিকা হয়ে। দিবারাত্রির কাব্য
‘র এই ভূমিকা প্রমাণ করে যে, মানিকের কবিতা তার গদ্যের চেয়ে প্রাচীন। যে অর্থে
অনেক লেখক কবিতা লিখে শুরু করেন ঠিক সে অর্থে নয়; কবিতার মৌলিক অভিজ্ঞতা ছাড়া দিবারাত্রির
কাব্য ‘র মতো প্রথম উপন্যাস লেখা যে কোনো লেখকের পক্ষে সম্ভাব ছিল না।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য তার কবিতার’ই ভূমিকা, তাই প্রকৃত অর্থেই তা
দেখা দেয় মৌলিক হয়ে। কবিতার কাছে এর চেয়ে কিছুমাত্র কম বা বেশী দাবি ছিল না বলেই দিবারাত্রির
কাব্য ‘তে যা আক্ষরিক অর্থে ভূমিকা, মানিকের সাহিত্য ভাষায় তাই প্রথম থেকে এক
শব্দচেতন আধুনিকতার যুক্তি হয়ে উঠে। মানিকের সাহিত্য শব্দের এই ভূমিকা আমরা লক্ষ্য
করিনি বলেই, তার সমগ্র রচনায় একমাত্র বাস্তবতার অভিপ্রায় ছাড়া আর কিছুই আমরা
ভালোভাবে লক্ষ্য করিনি। আমরা লক্ষ্য করিনি, মানিকের শব্দশ্রয়ী অভিজ্ঞতায় কবিতার
মৌলিক যুক্তি কেন কবিতার বিরুদ্ধশক্তির মত কাজ করে। কেন তার শব্দশ্রয়ী অভিজ্ঞতা
শেষ পর্যন্ত কবিতার রুপগত প্রয়োজনের চেয়েও বড় হয়ে উঠে। কীভাবে এই অভিজ্ঞতা তার
সাহিত্যভাষার অবয়ব ও আত্মায় শেষদিন পর্যন্ত প্রতিভার মত সক্রিয় থাকে। এইসব
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা লক্ষ্য করিনি বলেই বাংলা সাহিত্যেয় মানিকের আধুনিকতার
তাৎপর্য পর্যন্ত আমাদের কাছে মূলগতভাবে অস্পষ্ট থেকে যায়। বস্তুত, কবিতার সাধ ও
উপন্যাসের স্বাভাবিক ধারায় মানিকের লেখক জীবনের এক মৌলিক দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বের
যুক্তিগত সমাধান মানিক নিজেই কখনো করে যাননি। মানিকের লেখক জীবনের প্রস্তুতির
পর্বের ইতিহাসে দিবারাত্রির কাব্য ‘র ভুমিকার মতোই সুন্দর। কবিতার কল্পনা
আর গদ্যের বিষয়বস্তুর প্রবহমান ধারা যেন মানিকের সাহিত্যেয় শিল্পগত দিকগুলো তুলে
ধরা হয়েছে আপন মহিমায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবদ্দশায় প্রকাশিত তার কবিতাগুলি ছাড়াও শুধু মাত্র
কবিতার দু’টি খাতা তিনি রেখে যান। প্রথম খাতাটির কবিতাগুলি একেবারে তার প্রথম
জীবনের রচনা। রচনাকাল হিসেবে পাওয়া যায় (১৯২৪-১৯২৯) সময়কে, অর্থাৎ, এই খাতার
কবিতাগুলি তার ষোল থেকে একুশ বছর বয়সের রচনা। মানিকের এই স্তরের কবিতাগুলি তাই
প্রাথমিক স্তরের কবিতা বলেই গণ্য হয়। পরের খাতায় পাওয়া যায় তার পরিণত বয়সের বেশ
কিছু কবিতা। নিজের কবিতার একটি গ্রন্থ প্রকাশের ইচ্ছা তিনি নিজ থেকেই পোষণ
করছিলেন। এই সব ভাবনা-চিন্তার কথা সেই খাতায় লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন। এই সব কবিতার
চার-পাঁচটি জীবিত থাকাকালীন সময়ে প্রকাশ পেয়েছিল। দু’একটি মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়।
অন্যসব কবিতা অপ্রকাশিত’ই থেকে যায়। সেই ক্ষেত্রে আমরা ধরে নিতে পারি মানিকের
কবিতা আমাদের কাছে একদম নতুন হয়েই দেখা দিচ্ছে। কবিতা সংগ্রহে প্রাধান্য দেওয়া
হয়েছে পশ্চিম বাংলা অ্যাকাডেমির গ্রন্থটিকে। যেখানে রয়েছে তার এই সব
কবিতাগুলি।
মানিকের কবিতা তার জীবনব্যাপী দ্বন্দ্বের
শিল্পগত প্রকাশ মাত্র। উপন্যাস ও গল্প থেকে যদিও তিনি কবিতায় প্রবেশ করেছেন সেটা
তার কৌতূহল আর আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। এর পরেও আমাদের বলতে হয়, তিনি কবি নন,
গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক। দুষ্প্রাপ্য মানিকের কবিতা হয়ে উঠুক আজ এবং আগামীর
সাহিত্যপ্রিয়দের অনুপ্রেরণার বিষয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন