কুশারীবংশের জয়রাম ঠাকুরের কনিষ্ঠ সন্তান গোবিন্দরাম ঠাকুর। তাঁর সঙ্গে বিয়ে হয় খুলনার দক্ষিণডিহি গ্রামের নন্দরাম গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে রামপ্রিয়া দেবীর। গোবিন্দরামের মৃত্যুর পর; রামপ্রিয়া দেবী তাঁর বিষয়-সম্পত্তি গোবিন্দরামের ভাইদের কাছ থেকে আলাদা করে নেন আইনের আশ্রয়ের মাধ্যমে। রামপ্রিয়া দেবীর ভ্রাতুষ্পুত্র জগন্মোহনকে তিনি লালনপালন করতে শুরু করেন। রামপ্রিয়া দেবী, তাকে কলকাতার ‘হাড়কাটা’ এলাকায় নিজ উদ্যোগে একটি বাড়ী তৈরি করে দেন। তিনি জগন্মোহনকে বিয়ে দেন দ্বারকানাথ ঠাকুরের মামা কেনারাম রায়চৌধুরীর মেয়ে শিরোমণির সাথে। ঠাকুর পরিবারের সাথে রামপ্রিয়া দেবীর সম্পর্ক ছিল পূর্ব থেকেই। কুশারীবংশের পঞ্চানন ঠাকুর ছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরদেরও পূর্ব আদিপুরুষ। এই বিয়ের মাধ্যমে আবার যেন সম্পর্কের প্রাণ পেল। ভোজনরসিক, সুস্বাস্থ্যর অধিকারী জগন্মোহনের সঙ্গীতপ্রীতি ছিল অসাধারণ। সঙ্গীতের একজন যথার্থ সমজদার ব্যক্তি হিসেবে সেকালে তাঁর নাম ফুটে উঠেছিল চতুর্দিকে। জগন্মোহনের পাঁচ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় রসিকলালের দুই মেয়ের বিয়ে হয় দ্বারকানাথ ঠাকুরের ভাগ্নে ও দাদার পৌত্রের সঙ্গে। ঠনঠনের শশিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে ত্রৈলোক্য সুন্দরীকে বিয়ে করেছিলেন জগন্মোহনের চতুর্থ সন্তান শ্যামলাল। তাঁর চার মেয়ের তৃতীয়া হচ্ছেন জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নতুন বৌঠান। শ্যামলালের বসবাস ছিল কলকাতাতেই। কাদম্বরী দেবীর জন্ম ১২৬৬ সালের ২১ আষাঢ়, ১৮৫৯-এর ৪ জুলাই। কাদম্বরী দেবীর বড় দুই বোন হল বড়দা আর মনোরমা। পরের বোন শ্বেতাম্বরী। মহর্ষি যখন ঠাকুর পরিবারে কাদম্বরী দেবীকে বউ হিসেবে নিয়ে আসেন, তখন তাঁর বয়স নয় বছর। কাদম্বরী দেবী শ্যামবর্ণা সুন্দরী ছিলেন। ঠাকুর বাড়ীর অন্যান্য বউরাও এই শ্যামবর্ণা ছিলেন। অসম্ভব রকম সুন্দর ছিল কাদম্বরী দেবীর চোখ আর চুল। চোখ ফিরানোই যেন কষ্টকর ছিল। ইন্দিরা দেবী নতুন কাকিমার প্রসঙ্গে বলেন, ‘তাঁর বড় বড় চোখ আর দীর্ঘ ঘন কেশ ছিল।’ এ-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘নতুন বৌঠানের চোখ দুটো এমন ভাবে তাঁর মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে গেছে যে মানুষের ছবি আঁকতে বসলে অনেক সময়েই ঐ চোখ দুটো তাঁর চোখের সামনে জ্বলজ্বল করতে থাকে।’ অনায়াসেই আকৃষ্ট করবার একটা সহজাত ক্ষমতা ছিল তাঁর। মহর্ষির দ্বিতীয় পুত্র, সত্যেন্দ্রনাথ সিভিল সার্ভিস পাশ করে বিলেত থেকে ফিরে আসেন ১৮৬৪ সালে। দেশে ফিরে তিনি কয়েক বছরের মধ্যে পরিবারের আমূল পরিবর্তন আনয়ন করেন। বিলেতেই তাঁর একমাত্র সপ্ন হয়ে উঠেছিল স্ত্রী-স্বাধীনতার ব্যাপক পরিবর্তন করা। স্বর্ণকুমারী দেবী সে সময়ের কোনো আক লেখায় প্রকাশ করেন, ‘তখন অন্তপুরের অবরোধ প্রথা পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান। তখনো মেয়েদের একই প্রাঙ্গণের এ-বাড়ি হইতে ও-বাড়ি যাইতে হইলে ঘেরাটোপ মোড়া পালকির সঙ্গে প্রহরী ছোটে।’ মহর্ষির কাছ থেকে সম্মতি আদায় করে সত্যেন্দ্রনাথ স্ত্রীকে কর্মস্থান বম্বে নিয়ে গেলেন, সেই প্রথম ঠাকুরবাড়ির বধূর অন্তঃপুর ছেড়ে বেরুনো। এ-সম্পর্কে জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর স্মৃতি কথায় লিখেছেন, ‘কর্তামশায় আমাকে বম্বে নিয়ে যাবার অনুমতি দিলে, আমাকে ঐ পোশাক পরিয়ে ঘেরাটোপ দেওয়া পালকি করে জাহাজে তুলে দেওয়া হল। সে সময়ে আমাদের খালি এক শাড়ি পরা ছিল, তা পরে তো বাইরে যাওয়া জায় না। তাই উনি কোনো ফরাসী দোকানে ফরমাস দিয়ে একটা কি পোশাক আমার জন্য করালেন, বোধ হয় তাদের মতে ওরিয়েন্টাল যাকে বলে।’ তার দু’বছর পর জ্ঞানদানন্দিনী যখন বাড়ির সদরের সামনে গাড়ি থেকে নামলেন, ঘরের বউ এর মেমের মত অভিনব আচরণ দেখে পরিবারের মেয়েরা মেলামেশা করতে ভয় করছেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের মন তখনো উন্নতর পর্যায়ে পৌঁছেনি। এসব ঘটনার কয়েক বছর পর মেয়েদের স্বাধীনতাকে ব্যঙ্গ করে লেখা হয় প্রহসন কিঞ্চিৎ জল যোগ । সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছেলেবেলা থেকেই স্ত্রী স্বাধীনতা বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর উৎসাহ ছিল লেখাপড়া জানা কোনো সাবালিকার সঙ্গে ভাইয়ের বিয়ে দেন। তাছাড়া সেই মুহূর্তে বিয়ে হোক এটাও তিনি চাননি। পারিবারিক ভাবে তিনি চেয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ উচ্চ শিক্ষার জন্য বিলেত যান। তিনি তখন বম্বে প্রবাসে, ৮ই জুন ১৮৬৮ সালে আহম্মদনগর থেকে জ্ঞানদানন্দনীকে লিখেন, ‘নতুনের (জ্যোতিরিন্দ্রনাথের) বিবাহের আর বিলম্ব নাই-শ্যাম গাঙ্গুলীর আট বৎসরের মেয়ে, আমি যদি নতুন হইতাম তবে কক্ষনই এ বিবাহে সম্মত হইতাম না। কোন হিসাবে যে এ কন্যা নতুনের উপযুক্ত হইয়াছে জানি না। নতুনের কি মত-তিনি সন্তুষ্ট হইলেই হইল। এই বিবাহের পর বোধ করি নতুনের আর বিলাত যাইবার ইচ্ছে থাকিবে না।’ সত্যেন্দ্রনাথ, অনুমান করেছিলেন আকবর সংসারী হ’য়ে পড়লে বিদেশ যাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। তিনি আবার তিনদিন পর লিখছেন, ‘তুমি লিখিতেছ নতুন হয়তো একজন মনের মতন লোক পাইয়া চিরজীবন সুখে থাকিতে পারেন-তেমন হইলেও পরম সৌভাগ্য। কিন্তু আমার বোধ হয় তাহার বিপরীত হওয়া অধিক সম্ভাব এবং সেরূপ হইলেও মনে করো দেখি কতদূর পরিতাপের বিষয়।’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিয়ে ঠিক করে মহর্ষি সত্যেন্দ্রনাথকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলেন, ‘এক তো পিরালী বলিয়া ভিন্ন শ্রেণীর লোকেরা আমাদের সঙ্গে বিবাহে যোগ দিতে চাহে না, তাহাতে আবার ব্রাহ্মধর্মের অনুষ্ঠানের জন্য পিরালীরা আমাদিগকে ভয় করে।’ এ ব্যাপারে সেকালে ঠাকুরবাড়ির এক ঘরে অবস্থা ছিল; কাদম্বরীর পাঁচ নন্দাইদের মধ্যে একজন ছাড়া সকলেই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বাস করতেন। জামাইরা কুলীন ব্রাহ্মণের ছেলে, কেউ হয়তো কলকাতায় পড়ালেখা করতে এসেছিলেন, সম্পর্কের বাঁধনে পড়ে আশ্রয় পেলেন ঠাকুর বাড়িতে। এভাবেই তাঁরা ঠাকুর পরিবারে একান্তজন হ’য়ে উঠলেন।
অবশেষে ২৩ আষাঢ়, ১২৭৫ বাঙলা, ১৮৬৮ সালের ৫ই জুলাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে কাদম্বরীর বিয়ে হয়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বয়স তখন উনিশ বছর। তিনি ১৮৬৫ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজে এফ-এ ভর্তি হয়েছিলেন; কিন্তু চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। ১৮৬৭ সালে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে নবনাটক অভিনীত হয়। নটীর ভূমিকায় অভিনয় করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। বিয়ের দু’মাস আগে হিন্দুমেলার অধিবেশনের জন্য স্বদেশী কবিতা রচনা করেন তিনি। সেজদা সেই কবিতা মেলায় পাঠ করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সাথে কাদম্বরীর বিয়ে হয়ে যাবার সাতদিন পর আবার সত্যেন্দ্রনাথ লিখছেন স্ত্রীকে, ‘শ্যামবাবুর মেয়ে মনে করিয়া আমার মনে হয় না যে ভাল মেয়ে হইবে- কোন অংশেই জ্যোতির উপযুক্ত তাহাকে মনে হয় না।‘ কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বিলেত যাওয়া হয়নি অন্য কারণে, জোড়াসাঁকো নাট্যশালা তৈরি হয়ে গেছে, নাটকের মধ্যে ডুবে গিয়েছিলেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকোর বাড়ির বাইরে তেতলার অর্ধেকটা হলো নতুন বৌ-এর। অর্ধেকটায় পরে এসেছিলেন স্বর্ণকুমারী। নতুন বৌ এসেই ছাদে বাগান করে নিলেন নিজের মত করে। সেখানে তিনি রোপণ করলেন চামেলি, গন্ধরাজ, করবী, রজনীগন্ধা, দোলন চাঁপা সহ আরও নানা রকমের ফুল। ঠাকুর বাড়ির সাথে সঙ্গীতের সম্পর্ক ছিল অনেক পূর্ব থেকেই। এই সম্পর্ক যেন আরও গভীর হয়ে উঠলো জ্যোতিরিন্দ্রনাথের হাত ধরে। উপরের ঘরে আসে গেল পিয়ানো। পশ্চিমের বারান্দায় নানা রকমের পাখির আশ্রয় হলো। সেই স্থানে চীন দেশের একটি শ্যামাও রাখলেন তিনি। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের জীবনী প্রণেতা মম্মথনাথ ঘোষ বলেন, ‘গৃহ-সজ্জার প্রতি কাদম্বরী দেবীর প্রখর দৃষ্টি থাকতো, নিখুঁতভাবে তিনি সাজাতেন সবকিছু, বাগান আর নানা রকম গাছের ছিল সখ। সন্ধের সময় এই ছাঁদের বাগানে শুরু হতো গান বাজনা। তিনি শখ করে এর নাম দিয়েছিলেন ‘নন্দনকানন’। এখানে আরও সখ করে আসতেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সহপাঠী সঙ্গীত রসিক অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী। তিনি একাধারে গায়ক, লেখক। সাহিত্যেয় তাঁর বিশেষ পাণ্ডিত্য ছিল অসাধারণ। তিনি ছিলেন উদার শিল্পরসিক। তাঁর স্ত্রী ছিলেন লেখিকা শরৎকুমারী। তিনিও সময় করে চলে আসতেন কোনো এক সন্ধ্যায়। নিজ হাতে রান্না করে তিনি খাওয়াতেন তাদের। রবীন্দ্রনাথের সেই খাবার ছিল যেন অমৃত। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বৌঠাকরুন রাঁধতে পারতেন ভালো, খাওয়াতে ভালোবাসতেন।’ এই খাওয়ানোর সখ মেটাতে গিয়ে অনেকটা সময় কাছে পেতেন রবীন্দ্রনাথকে। স্কুল থেকে ফিরে বৌঠাকরুনের দেখা না পেলে সেই দিনটা অনেক কষ্ট পেতেন রবীন্দ্রনাথ। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কিছু সময়ের জন্য পান জমিদারী দেখার দায়িত্ব। দুপুরে যেতেন কাছারিতে। যেখানে তাঁর জন্য পাঠানো হতো রুপোর রেকাবিতে ফল আর মিষ্টি। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বৌঠাকরুন ফলের খোসা ছাড়িয়ে কেটে কেটে যত্ন করে রুপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দিতেন। নিজের হাতের মিষ্টান্ন কিছু কিছু থাকতো তাঁর সঙ্গে, আর তার উপরে ছড়ানো হতো গোলাপের পাপড়ি। গেলাসে থাকতো ডাবের জল বা ফলের রস কিংবা কচি তালশাঁস বরফে ঠাণ্ডা করা।’
‘ভারতী’ নিয়মিত প্রকাশিত হওয়া শুরু করলে প্রতি রবিবারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, ‘ভারতী’র ভাণ্ডার নিয়ে অক্ষয় বাবুর বাড়িতে উপস্থিত হতেন। তাঁদের সেই পর্ব শেষ হলে সেখান থেকে আবার চলে যেতেন বিহারীলালের বাড়িতে। কখনো আবার জানকীবাবুর বাড়িতে বসতো তাঁদের সাহিত্যনির্ভর আলাপ-আলোচনা। এখানে উল্লেখ্ করা যায় যে, ‘ভারতীর’ প্রাণ ছিলেন কাদম্বরী দেবী। অনেকে আবার তাকে পত্রিকাটির মধ্যেমনি বলে গণ্য করতেন। স্বর্ণকুমারী দেবী বলেন, ‘প্রায় সমবয়সী বলে আমাদের মধ্যেকার বন্ধুত্ব ছিল অনেক গভীর। কাদম্বরী সব সময় সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করে আনন্দ পেতেন।’ সন্ধ্যা হওয়া মাত্র, প্রতিদিন, বাড়িতে বসতে শুরু করলো সাহিত্যের আসর, আলোচনা, কবিতাপাঠ ও গান। এখানে বলে রাখি যে, সেই আসরের ‘ভারতী’র সাহিত্য সমালোচক ছিলেন অক্ষয়বাবু।
সেই সময়ে কাদম্বরী দেবীর জীবনে ঘটে যায় একটি শোকাবহ ঘটনা। কাদম্বরী দেবী সন্তানহীনা ছিলেন। তাই স্বর্ণকুমারী দেবীর ছোট মেয়ে ঊর্মিলাকে তিনি ভালোবাসতেন মন-প্রাণ দিয়ে। তেতলার ঘরে নিজের কাছে রেখে দিতেন তাকে সর্বদা। তাকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সব কিছুই কাদম্বরী করতেন নিজের সন্তানের মত করেই। একটু বর হলে তাকে ভর্তি করা হলো স্কুলে। স্কুলে যাবার দু’মাস পরে একদিন তেতলার ছাদের বাঁকা সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় হোঁচট খেয়ে নিচে পড়ে যায়। তাকে আর রক্ষা করা সম্ভাব হয়নি। এ প্রসঙ্গে, সরলা দেবী লিখেছেন, ‘ঊর্মিলা ছিল নতুন মামীর আদুরে। এত বড় প্রকাণ্ড বাড়িতে যেখানে বড়দের সবই চলছে, আমোদ-প্রমোদ ও স্নেহ-ভালোবাসা অন্য ছেলেমেয়েদের জন্য- সেখানে নতুন মামী ছোট বোন ঊর্মিলাকে যেমন ভালোবাসতেন, তাকে যেমন বুকে করে নিয়েছিলেন, আমাকে যদি তেমনি কেউ স্নেহ দিয়ে ঘিরত। নিঃসন্তান নতুন মামীর মেয়ে যেন সে।’ এর থেকেই অনুমান করা যায় তার মৃত্যুতে তিনি কি পরিমাণ ব্যথা পেয়েছিলেন। বাড়ীর ছোটোরা সামান্য অসুস্থ হলে তিনি তাঁদের নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘আমার একটা বড় মুস্কুল ছিল, শরীরটাকে সহজে রোগে ধরত না। বাড়ির আর যে সব ছেলে রোগে পড়তে জানতো তারা পেত তার হাতের সেবা। তারা শুধু যে তার সেবা পেত তা নয়, তার সময় জুড়ে বসত।’ আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না এই অসামান্য গুণের রমণী কেন রবীন্দ্রনাথের এত প্রাণের গভীরে ছিলেন। ধারাবাহিকভাবে বিহারীলালের ‘সারদামঙ্গল’ যখন প্রকাশিত হচ্ছে, তিনি তা নিয়মিত পড়তেন। তিনি খুব পছন্দ করতেন বিহারীলালের রচনা। তাঁর অনেক লেখাই তিনি মুখস্ত বলতে পারতেন। মাঝে-মাঝে নিমন্ত্রণ করে তাকে খাওয়াতেন। নিজ হাতে বুনে একখানি সুন্দর কাজ করা আসন উপহার দিয়েছিলেন, তাতে বিহারীলালের রচনাই কয়েক লাইন লেখা ছিল। ‘ভারতী’ যে বছর প্রথম বেরোয়, সেই বছরই
জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা ‘এমন কর্ম আর করবো না’ অভিনীত হয়েছিল ঘরোয়া পরিবেশে
জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। কাদম্বরী দেবী নায়িকা ‘হেমাঙ্গিনী’র ভূমিকায় অভিনয়
করেছিলেন। অনুমান করা হয়, এটাই তাঁর প্রথম অভিনয়। রবীন্দ্রনাথের ‘ভগ্নহৃদয়’
গ্রন্থের উৎসর্গে পত্রে যে ‘শ্রীমতী হে’- কে বইটি উৎসর্গ করেছিলেন, তা হলো এই
হেমাঙ্গিনীর ‘হে’। এই অনুমান বিশিষ্ট সাহিত্যিক সজনীকান্ত দাসের। ইন্দিরা দেবীর
কাছ থেকে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের শোনা ‘হেকেটি’ থেকে ‘হে’। হেকেটির আড়ালে রয়েছে
সেই প্রিয় মুখ কাদম্বরী। ‘হেকেটি’ একজন গ্রিক দেবী। রবীন্দ্রনাথের ‘মালতী পুঁথি’
বা ওই ধরনের গ্রন্থে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় দেখেছিলেন ‘হেকেটি’ শব্দটি। রবীন্দ্রনাথের
প্রথম বিলেত যাবার সময় কাদম্বরী দেবীর বয়স উনিশ। রবীন্দ্রনাথ চলে যাবার পরেই
‘নন্দনকানন’ একেবারেই শূন্য হয়ে উঠেছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নাটক রচনা নিয়ে ব্যস্ত
ছিলেন কিছুদিন। এর কিছুদিন পর, অসুস্থতার জন্য সস্ত্রীক দীর্ঘকাল ষ্টিমারে বেরিয়ে
পড়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসা মাত্রই আবার শুরু হলো নাটকে অভিনয়ের পালা। রবীন্দ্রনাথ
বিলেত থেকে ফিরে আসে দেখলেন ‘মানময়ী গীতিনাট্য’ শেষ হয়েছে। তিনি ‘আয় তবে সহচরী,
হাতে হাতে ধরি ধরি’ শেষ দিকে এই গানখানি জুড়লেন। এখানে আমরা বলে নিতে পারি,
‘মানময়ী’তে কাদম্বরী দেবী ‘উর্বশী’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ
‘ইন্দ্র’ আর রবীন্দ্রনাথ ‘মদনে’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এর আগেই স্বর্ণকুমারী
দেবীর লেখা ‘বসন্ত উৎসবে’ কাদম্বরী দেবী ‘লীলা’র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই
নাটকে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রনাথ দু’ভাবে তলোয়ার ঘুরিয়ে পরস্পর যুদ্ধ
করেছিলেন।
হাওয়া বদল করতে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবী প্রায়ই যেতেন গঙ্গাতীরে। চন্দননগর শহরের কোণে একটা ছোট দোতলা বাড়িতে তাঁরা উঠেছিলেন বারকয়েক। এবার উঠলেন মোরান সাহেবের বিখ্যাত বাগান বাড়িতে। বাড়িটিকে একপ্রকার রাজবাড়িই বলা যায়। কাঁচের তৈরি রঙিন জানালা, আর মেঝে শোভা পাচ্ছে শাদা মার্বেল পাথর। সোজা গঙ্গার পার থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত লম্বা বারান্দা। সবচেয়ে উঁচুতে ছিল গোলাকার একটা ঘর, তার চারদিকেই ছিল খোলামেলা। রবীন্দ্রনাথ এসে প্রায় একবছর এখানে কাটিয়েছিলেন নতুন বৌঠান আর জ্যোতিদাদার সাথে। রবীন্দ্রনাথ সন্ধ্যাসংগীতের শেষ পর্বের কবিতাগুলি এখানে বসেই রচনা করেছিলেন। চন্দননগরের স্মৃতি জড়ানো দিনগুলির কথা মনে রেখে কাদম্বরী দেবীকেই ‘বিবিধ প্রসঙ্গ’ উৎসর্গ করেছেন।
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘রবীন্দ্রজীবনী’তে ‘তারকার আত্মহত্যা’ কবিতাটি প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ‘তারকা হইতেছেন কাদম্বরী দেবী। এই কাদম্বরী দেবী তাঁর শেষ জীবনা হুতি দানের পূর্বে আর একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করিয়াছিলেন। ‘তারকার আত্মহত্যা’ কবিতার উৎস সেইখানে অনুসন্ধনীয়। এ তথ্যকে আসলে ততটা সঠিক বলা যাবে না। কাদম্বরী দেবী আগে আরও একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকতে পারেন কিন্তু ‘তারকার আত্মহত্যা’ কবিতাটি কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে রচিত হয়নি। কবিতাটির পটভূমিতে যে কোনো সুনির্দিষ্ট ঘটনা নেই। সেই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘দায়িত্বহীন কর্মহীন দিনগুলি। তখনও বিবাহ হয় নাই। ‘গান আরম্ভ’- কবিতা এখানেই লেখা। সেই রূপে বিনা কষ্টের কষ্ট অনির্দিষ্ট বেদনা, তারকার আত্মহত্যা।’ কোনো কারণে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কাদম্বরীর মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি চলছিল, তিনি আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করলেন। রবীন্দ্রনাথ যেমন তাঁর নতুন বৌঠানকে খুব কাছ থেকে পেয়েছিলেন। সেই রকম নতুন বৌঠানের স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথও তাঁর এক বৌদির সান্নিধ্য খুব পছন্দ করতেন। সত্যেন্দ্রনাথের স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। আগেই আমরা বলেছি, সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর এই ভাইয়ের বিয়ে অনুমোদন করেননি। পরবর্তীকালে যে সত্যেন্দ্রনাথ- জ্ঞানদানন্দিনী নতুন বৌ কাদম্বরীকে সুনজরে দেখেছেন, তার কোন প্রমাণ আমরা পাই না। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, জ্ঞানদানন্দিনীর কাছে যাতায়াত করতেন নিয়মিত। কাদম্বরীর মৃত্যুর কিছু কাল পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও তাঁর বৌদি, বৌদির সন্তান ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে সরোজিনী জাহাজে চড়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু অপরপক্ষে এও সত্য যে, কাদম্বরীর মৃত্যুর পর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ আর বিয়ে করেননি। কেন করেননি এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘তাকে ভালোবাসি’। অবনীন্দ্রনাথের বোন সুনয়নী দেবী কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু বর্ণনায় বলেছেন, ‘সেই সময়ে আমাদের বাড়িতে এক কাপড়ওয়ালি প্রায়ই কাপড় বেচতে আসতেন। তার নাম ছিল বোধ হয় বিশু। তাকে টাকা দিয়ে তিনি লুকিয়ে আফিম আনান। তাই খেয়ে আত্মহত্যা করেন। আমরা এ বাড়ির জানলা দিয়ে দেখছি। ঘরে তাঁর মৃত্যুদেহ পড়ে আছে।’ এই মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন চরম শোক। কাদম্বরীর আকস্মিক মৃত্যু, রবীন্দ্রনাথের পায়ের নীচ থেকে পৃথিবী সরে গেল।
আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে ইন্দিরা দেবী বলেন, ‘নতুন কাকিমা জেদি মেয়ে ছিলেন। একদিন জ্যোতিকাকাকে বললেন, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো। জ্যোতিকাকা প্রায়ই বাড়ি ফিরতেন না। তাঁর প্রধান আড্ডা ছিল বিরাজিতলার আমাদের বাড়ি। আমার মা জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর সাথে তাঁর খুব ভাব ছিল। সেদিনও যথারীতি সন্ধ্যাবেলা আমাদের বাড়িতে এসেছেন জ্যোতিকাকা। আড্ডায়-আড্ডায়, গানে-গানে এমন দেরি হয়ে গেল, সে রাত্রে আর জোড়াসাঁকোতে ফিরলেন না। পরদিন যখন বাড়ি ফিরলেন, নতুন কাকিমার মুখ থমথমে- কথাই বললেন না। তাঁর অভিমান হল প্রচণ্ড, জন্মদিনে বলা সত্ত্বেও কেন জ্যোতিকাকা এলেন না। তার দুদিন পরেই সেই দুর্ঘটনা। আমাদের জোড়াসাঁকো বাড়িতে এক কাপড়ওয়ালা আসত, তার নাম বিশু। সেই বিশুকে দিয়ে নতুন কাকিমা লুকিয়ে আফিম আনালেন, সেই আফিম খেয়েই নতুন কাকিমার সব শেষ।’ বাড়িতে পুলিশ এসে কাদম্বরী দেবীর দেহ নিয়ে গেল। মৃতুদেহ পোস্টমর্টেম করতে পাঠানো হয়। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে পাওয়া যায় পাকস্থলীতে আফিমের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন