রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) ব্যাপক সাহিত্য রচনার মধ্যেও সাময়িক পত্র সম্পাদনার দায়িত্বটাও তিনি বহন করেছেন নিজ আগ্রহে। সংখ্যাগত দিক থেকে সেটা যে খুব কম হবে, তা কিন্তু বলা যাবে না। সেই সম্পাদনার ভারটা অনেকটাই প্রাসঙ্গিক হয়ে দেখা দেয় রবীন্দ্রনাথের জীবনে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে, সম্পাদনা নিয়ে অনেক বেশী চিন্তা-ভাবনা করেছেন। এর সুস্পষ্ট চিত্র দেখতে পাই তারই সম্পাদিত পত্রিকার দিকে চোখ দিলে। আমাদের চিন্তায় বিস্ময়কর হয়ে দেখা দেয়, তাঁর প্রতিভার এ-দিকটির দিকে চোখ দিলে। তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে বিচিত্র পথে প্রবাহিত করার জন্য, এ-ধরনের সম্পাদনার কাজটি যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেনি, তা কিন্তু বলা যাবে না। রবীন্দ্রনাথ, একত্রে অনেকগুলো পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নিলেও খুব বেশী সময় ধরে কোথাও স্থায়ী ভাবে অবস্থান করেননি, বঙ্গদর্শন ব্যতীত। এ-ধরনের কাজের মানসিকতার চিত্র আমরা দেখতে পাই, জোড়াসাঁকোতে রবীন্দ্রনাথের বেঁড়ে উঠা বয়স থেকেই। জোড়াসাঁকো থেকে যখন কিশোরদের জন্য প্রকাশিত হচ্ছিল হাউস জার্নাল ও বালক, সেখানেও সুস্পষ্টভাবে না হলেও ছায়ার মতো কাজ করেছেন তিনি। স্পষ্টভাবে বলে রাখি যে, বালকে’র সম্পাদক ছিলেন মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহধর্মিণী জ্ঞানদানন্দিনী দেবী (১৮৫০-১৯৪১)। ১২৯২ বঙ্গাব্দের বৈশাখে প্রকাশিত হয় এ-মাসিক পত্রটি। সুধীন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সরলা দেবী, প্রতিভা দেবী, ইন্দ্রিরা দেবী ও অবনীন্দ্রনাথের সাহিত্যচর্চার শুরু এ- পত্রিকার হাত ধরেই। কিছুকাল পরে, সম্পাদক জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, কলকাতা ত্যাগ করায় অনেকটা স্তব্ধ হয়ে উঠে বালক পত্রিকাটি। কিন্তু আশার আলো দেখায়, জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ি থেকে স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৬-১৯৩২) সম্পাদিত ভারতী পত্রিকাটির সাথে যুক্ত হয়ে ১২৯৯ বঙ্গাব্দে, যখন প্রকাশিত হচ্ছিল ভারতী ও বালক নাম ধারণ করে। রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত পত্রিকাগুলোর দিকে চোখ দিলে আমরা দেখতে পাই, পত্রিকাগুলো ‘মাসিক’ পত্রিকা হিসেবেই প্রকাশিত হতে থাকে। সম্পাদনার ধারাবাহিক চিত্রটিতে আমরা দেখতে পাই, সাধনা (অগ্রহায়ণঃ ১৩০১- কার্ত্তিকঃ ১৩০২); ভারতী (বৈশাখ-চৈত্রঃ ১৩০৫); বঙ্গদর্শন (বৈশাখ-চৈত্রঃ ১৩০৮-১৩১২); ভাণ্ডার (বৈশাখ-চৈত্রঃ ১৩১২-১৩১৪) এবং তত্ত্ববোধিনী (বৈশাখ-চৈত্রঃ ১৩১৮-১৩২১)। এ-ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ হিতবাদী পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন প্রায় ছয় সপ্তাহ। বালক ও সাধনার মধ্যেবর্তী সময়ে, রবীন্দ্রনাথ সপ্তাহ শিরোনামের কোন এক সাহিত্য পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সেই পত্রিকাটি কখনও প্রকাশিত হয়নি। বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে ১৮৮৭ সালে লেখা কোনো এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ এই ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন। সাধনা’ই রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত প্রথম পত্রিকা। এ-পত্রিকার হাত ধরেই রবীন্দ্রনাথ মূলত, তুলনামূলক সাহিত্য আলোচনা-সমালোচনা সাহিত্যের নতুন পথ সৃষ্টি করেন। রবীন্দ্রনাথ শুধু যে এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তা কিন্তু নয়; বরং প্রকাশিত লেখার বর্জন-পরিমার্জন, প্রুফ ইত্যাদি নানা দিকগুলো খুঁটিয়ে নিজের মতো করে দেখতেন। তার চাইতেও আসল কথা ওই পত্রিকার বেশীরভাগ লেখা রবীন্দ্রনাথকে লিখতে হত। এ-প্রসঙ্গে ১৩১৭ বঙ্গাব্দের ২৮শে ভাদ্র, পদ্মিনী মোহন নিয়োগীকে লেখা কোন এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘যখন আমার ১৬ সেই সময়ে ভারতী পত্রিকা বাহির হয়। প্রধানত এই পত্রিকাতেই আমার গদ্য লেখা অভ্যস্ত হয়। সোনার তরীর কবিতাগুলি প্রথম সাধনা পত্রিকাতেই লিখিত হইয়াছিল। আমার ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ তিন বৎসর এই কাগজের সম্পাদক ছিলেন। চতুর্থ বৎসরে ইহার সম্পূর্ণভার আমাকে লইতে হইয়াছিল। সাধনা পত্রিকার অধিকাংশ লেখা আমাকেই লিখিতে হইত এবং অন্য লেখকের রচনাতেও আমার হাত ভুরি পরিমাণে ছিল। সাধনা বাহির হইবার পূর্বেই হিতবাদী কাগজের জন্ম হয়। যাহারা ইহার জন্মদাতা ও অধ্যক্ষ ছিলেন তাহাঁদের মধ্যে কৃষ্ণকমল বসু, সুরেন্দ্রবাবু, নবীন্দ্র চন্দ্র বড়ালই প্রধান ছিলেন। কৃষ্ণকমল বসুও সম্পাদক ছিলেন। সেই পত্রে প্রতি সপ্তাহে আমি ছোটগল্প সমালোচনা ও সাহিত্য প্রবন্ধ লিখিতাম। আমার ছোটগল্প লেখার সূত্রপাত ঐখানেই, ছয় সপ্তাহকাল লিখিয়াছিলাম। সাধনা চারিবৎসর চলিয়াছিল। বন্ধ হওয়ার কিছুদিন পরে এক বৎসর ভারতী’র সম্পাদক ছিলাম, এই উপলক্ষেও গল্প ও অন্যান্য প্রবন্ধ কতকগুলি লিখিত হয়। আমার পরলোকগত বন্ধু শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের (১৮৬০-১৯০৮) বিশেষ অনুরোধে বঙ্গদর্শন পুনজ্জীবিত করিয়া তাহার সম্পাদনা ভার গ্রহণ করি। এই উপলক্ষে বড় উপন্যাস লেখায় প্রবৃত্ত হই। বঙ্গদর্শন পাঁচ বৎসর চালাইয়া তাহার সম্পাদনা পরিত্যাগ করিয়াছি। এখন বিদ্যালয় লইয়া নিযুক্ত আছি।’ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতেই ‘আত্মপরিচয়’ ও ‘ভারত ইতিহাসের ধারা’ দু’টি অনন্য সাধারণ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। তত্ত্ববোধিনী ছাড়াও সাধনার প্রতি রবীন্দ্রনাথের যে ব্যক্তিগত ভালোবাসার টান ছিল, সে কথা তিনি আমাদের জানিয়েছেন একাধিক লেখায়। এই পত্রিকাটিকে তিনি চেয়েছিলেন একটি অনন্য সাধারণ মাসিক পত্রিকা হিশেবে গড়ে তুলতে। জমিদারি কাজের ফাঁকে যখনই সময় পেয়েছেন, তখনই খোঁজ রেখেছেন পত্রিকাটির। পত্রিকাটির ব্যাপারে সর্বদা বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করেছেন সুধীন্দ্রকে। এই সময়েই রবীন্দ্রনাথের হাতে রচিত হয় অনবদ্য কিছু ছোটগল্প। তিনি যেমন সাধনা নিয়ে ভেবেছেন, তেমনি আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদনার কাজও করেছেন নিজস্ব চেষ্টায়। সাধনা সম্পর্কে, রবীন্দ্রনাথ ১৮৯৩ সালের ৩রা মার্চ পুনা থেকে সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথকে কোন এক চিঠিতে বলেন, ‘দেখিস আমার লেখা আজ হুহু করে এগিয়ে যাবে, চৈত্র মাসের সাধনার জন্য যে ডায়েরীটা লিখতে আরম্ভ করেছিলুম এবং যা ভাঙা রাস্তায় বহু ভারগ্রস্ত গোর গাড়ির মতো কিছুটা এগোতে পারছিল না, আজ সেটা নিশ্চয়ই শেষ করে ফেলব। যখন মন একটু খারাপ থাকে তখনই সাধনাটা অত্যন্ত ভারের মত বোধ হয়। মন ভালো থাকলে মনে হয় সমস্ত ভার আমি একলা বহন করতে পারি। আমি নিশ্চয় জানি আমার সাধনা কভু না নিস্ফল হবে, ক্রমে ক্রমে আমি দেশের মন হরণ করে আনব, নিদেন আমার দু’চারটি কথা তার অন্তরে গিয়ে সঞ্চিত হয়ে থাকবে। এই কথা যখন মনে আসে তখন আবার সাধনার প্রতি আকর্ষণ আমার বেড়ে ওঠে। তখন মনে হয় সাধনা আমার হাতের কুঠারের মতো, আমাদের দেশের বৃহৎ সামাজিক অরণ্য ছেদন করবার জন্য একে আমি ফেলে রেখে মরচে পড়তে দেব না, একে আমি বরাবর হাতে রেখে দেব। যদি আমি আরও আমার সাহায্যকারী পাইত ভালোই, না পাই তো কাজেই আমাকে একলা খাটতে হবে।’ ১২৯৯ বঙ্গাব্দের,
২য় বর্ষ, পৌষ সংখ্যা থেকে সাধনায় ‘প্রসঙ্গ কথা’ শিরোনামে একটি নতুন বিভাগ চালু
হয়। রবীন্দ্রনাথ নিয়মিত ভাবেই এ বিভাগে যুক্তিনির্ভর লেখা উপস্থাপন করতেন। এই
সংখ্যায় তিনি ‘শিক্ষার হেরফের’ নামে একটি মৌলিক চিন্তা নির্ভর প্রবন্ধ লিখলে তা
পড়ে আলোচনায় যোগ দেন সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্যার গুরুদাস
বন্দ্যোপাধ্যায় ও আনন্দমোহন বসু। সাধনা
অনেকটা, রবীন্দ্রনাথকে ভর করে বেড়ে উঠে। তার কারণ, সংখ্যাগুলোতে রবীন্দ্রনাথের
লেখাই প্রকাশ পেত সবচেয়ে বেশী। সম্পাদক হওয়ার পরও, এ অভ্যাস থেকে কোনো প্রকার
বিচ্যুতি ঘটেনি রবীন্দ্রনাথের। চতুর্থ বর্ষের প্রথম সংখ্যা অগ্রহায়ণ ১৩০১-এ,
প্রকাশিত ১১টি লেখার মধ্যে, রবীন্দ্রনাথের ৬টি।
রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত সাধনায় লেখকদের নাম কোথাও ছাপা হত না, তার
বর্ণানুক্রমিক সূচিতেও লেখকের কোন নাম নেই। যার ফলে অনেক লেখকের নাম অজ্ঞাত থেকে যেত।
তারপরেও জানা যায়, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রিয়ম্বদা দেবী, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর,
প্রমথনাথ, দেবেন্দ্রনাথ সেন, বসন্তকুমার, প্রমানন্দ, সতীশচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র, যতীন্দ্রমোহন,
বিজয়চন্দ্র, প্রিয়নাথ সেন, নগেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গের
লেখা প্রকাশিত হত। এ-সম্পর্কে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রশান্তকুমার পালের অভিব্যক্তি
হল, ‘এখনও রবীন্দ্রনাথের সম্পাদিত পত্রিকাগুলিতে তাঁর বেশ কিছু রচনা অচিহ্নিত ও
অগ্রন্থিত থেকে গেছে। সাধনা’র জন্য, রবীন্দ্রনাথ চার বছরে এতো পরিমাণ লেখা
লিখেছিলেন যে, নিজেই কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। যেন আর বেশী পথ এগোতে পারছিলেন
না। সাধনা’র শেষ সংখ্যা, ১৩০২ বঙ্গাব্দের ভাদ্র-আশ্বিন-কার্ত্তিক একসঙ্গে
প্রকাশিত হয়। এর পরবর্তী সময়ে, সাধনা এর কখনও প্রকাশিত হয়নি। সাধনা যেন
চিরদিনের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। রবীন্দ্রনাথের অগ্রজ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের
(১৮৪০-১৯২৬) সম্পাদনায় ১২৮৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে ভারতী আত্মপ্রকাশ করে।
দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদক হলেও, জ্যোতিরিন্দ্র ঠাকুর’ই (১৮৪৯-১৯২৫) ছিলেন
পত্রিকার পরিকল্পনার অগ্রদূত। তাঁর একান্ত ভাবনা-চিন্তা ও দূরদর্শী মনোভাবনার সাথে
যেন মিশে গিয়েছিল ভারতী পত্রিকার কাজ। ১৩০৫ বঙ্গাব্দে, রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনাকালে
এবং পরবর্তী সময়ে, ১৩০৮ থেকে ১৩২১ বঙ্গাব্দের মধ্যে ভারতীতে রবীন্দ্রনাথের
উল্লেখযোগ্য স্বাদেশিকতা মুলক রচনা প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রনাথ ও
জ্যোতিরিন্দ্র ছাড়াও সরলা দেবী, হিরন্ময় দেবী, প্রমথ চৌধুরী, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,
রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বিজয়চন্দ্র মজুমদার, শিবনাথ শাস্ত্রী, অমৃতলাল বসু,
রাধাকান্ত বসু, রমেশচন্দ্র বসু, সুরেশচন্দ্র চৌধুরী, স্বর্ণকুমারী দেবী, অনুপমা
দেবী ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গের লেখা নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হত। ১৯৩৫ সালে রবীন্দ্রনাথ ভারতী’র
সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার পূর্বের তিন বছর (১৩০২-১৩০৪), স্বর্ণকুমারী
দেবীর (১৮৫৬-১৯৩২)
দুই কন্যা হিরন্ময় দেবী ও সরলা দেবী এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। ভারতী সম্পাদনার
একটি বছরকে রবীন্দ্রনাথের গদ্যকাল বলে চিহ্নিত করা হয়। এই সময়ে তিনি সমসাময়িক রাজনৈতিক
ঘটনাবলী নিয়ে একাধিক প্রবন্ধ রচনা করেন। একই সঙ্গে রচনা করে চলছেন বিখ্যাত
অনেক ছোটগল্প। সেই একই বছরে, তিনি রচনা করেন কয়েকটি গান ও স্বল্প সংখ্যক কবিতা। বিশেষ
ভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এ-বছরে তাঁর কোন বই প্রকাশিত হয়নি। প্রসঙ্গকথা শিরোনামে
বিভাগটিতে প্রকাশ পেত দেশের শিল্প, রাজনীতি, বিজ্ঞান ও ইতিহাসের মতো বিষয়বস্তু।
দীর্ঘ এক বছর ভারতী সম্পাদনা করে
রবীন্দ্রনাথ সেখান থেকে বিদায় নিলেন। এ-সম্পর্কে, চৈত্র ১৩০৫ বঙ্গাব্দে সংখ্যায়
রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এক বৎসর ভারতী সম্পাদনা করিলাম। ইতিমধ্যে নানা রকার ত্রুটি
ঘটিয়াছে। সে সকল ত্রুটির যত কিছু কৈফিয়ৎ প্রায় সমস্তই ব্যক্তিগত। সাংসারিক চিন্তা
চেষ্টা আধিব্যাধি ক্রিয়া কর্মে সম্পাদকের সঙ্গে সঙ্গে ভারতীকেও নানারূপে
বিক্ষিপ্ত হইয়াছে। ঠিক মাসান্তে ভারতী বাহির করিতে পারি নাই; সেজন্য যথেষ্ট ক্ষোভ ও
লজ্জা অনুভব করিয়াছি। একা সম্পাদককে লিখিতে হয়, লেখা সংগ্রহ করিতে হয় এবং প্রুফ ও
প্রবন্ধ সংশোধন করিতে হয়। ললাটের ঘর্ম মুছিয়া সকলকে নববর্ষের অভিবাদন জানাইয়া
বিদায় গ্রহণ করিলাম।’ রবীন্দ্রনাথ ভারতী সম্পাদনা ত্যাগ করলেও ভারতী’কে ত্যাগ
করেননি। নানা অসুবিধার জন্য হয়তো তিনি নিয়মিত লিখতে পারেননি। ১৩৩৩ বঙ্গাব্দের শেষ
সংখ্যাটির পরে, ভারতী চিরদিনের
জন্য বন্ধ হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ এর পরে, শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের অনুরোধে
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত বঙ্গদর্শন পত্রিকায় যোগ দেন। এই
ঘটনার ত্রিশ বছর পর স্মৃতিচারণ করে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বঙ্গদর্শনের
নবপর্যায় আমার নাম প্রস্তাব করা হলে তাতে আমার মনের সমর্থন ছিল না।
কোন পূর্বতন খ্যাতির উত্তরাধিকার গ্রহণ করা সংকটের অবস্থা। আমার মনে এ সম্বন্ধে
যথেষ্ট সংকোচ ছিল। কিন্তু আমার মনে উপরোধ অনুরোধের দ্বন্দ্ব যেখানেই ঘটেছে সেখানে
আমি কখনো জয়লাভ করতে পারিনি, এবারও তাই হল।’ রবীন্দ্রনাথ উক্ত পত্রিকার দায়িত্ব
ভার গ্রহণ করায় শ্রীশচন্দ্র মজুমদার বেশ
আশ্বস্ত হলেন। রবীন্দ্রনাথ দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই বহু লেখকের সমাবেশ ঘটেছে
উক্ত পত্রিকায়। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা, ভ্রমণকাহিনী, স্মৃতিকথা, অনুবাদ ও
গ্রন্থ সমালোচনা ইত্যাদি বিষয়ে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল বঙ্গদর্শন । উপন্যাসের
পৃথকধারা এবং বঙ্কিমযুগীও চিত্র অনেকটা আলাদা হয়ে দেখা যায় এখান থেকে।
রবীন্দ্রনাথের নৈবেদ্য ও খেয়া’র অনেক কবিতাই নবপর্যায়ের বঙ্গদর্শনে
প্রকাশিত হতে থাকে। বঙ্গদর্শন পুনঃপ্রকাশ হওয়ার একটি নেপথ্য ঘটনা রয়েছে। আর
তা হল-সঞ্জীবচন্দ্র যখন অনিয়মিত ভাবেও বৈশাখ-চৈত্র, ১২৯৮-এর পর বঙ্গদর্শন প্রকাশ করতে পারলেন না, বঙ্কিম চন্দ্রের
সম্মতিতে শ্রীশচন্দ্র তখন সম্পাদক মনোনীত করে কার্ত্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ১২৯০ বঙ্গাব্দের
মোট চারটি সংখ্যা প্রকাশ করেন। মাঘ ১২৯০ সংখ্যার মধ্যে দিয়ে প্রথম পর্যায়ে বঙ্গদর্শন
বন্ধ হয়ে যায় স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের
নির্দেশেই। এর অন্যতম কারণ হিশেবে চিহ্নিত করা হয়, ভাল লেখার অভাব এবং
লেখার মান দ্রুত নেমে যাওয়া। এ-সব কারণ ব্যতীত, আরও একটি কারণ উল্লেখ্য করা যায়, শ্রীশচন্দ্রের
চাকরী উপলক্ষে কলকাতার বাইরে অবস্থান করা। তারপরও থেমে থাকেনি প্রকাশনা, শ্রীশচন্দ্রের কনিষ্ঠভ্রাতা শৈলেশচন্দ্র মজুমদারের তত্ত্বাবধানে ১৩২১ বঙ্গাব্দ
পর্যন্ত প্রকাশিত হতে থাকে বঙ্গদর্শন।
এখানে উল্লেখ্য করা যায় যে, বঙ্কিম যুগের পর বঙ্গদর্শনে উপন্যাসের নতুন
রীতির সূত্রপাত ঘটে। সেই রীতিই প্রচলিত রয়েছে। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়, এর সুচনা
ঘটে রবীন্দ্রনাথের চোখের বালি থেকে। চোখের বালি ১৩০৯ বঙ্গাব্দে গ্রন্থকারে প্রকাশিত হয়। ১৫ মে,
১৯০১-এ, প্রকাশিত নবপর্যায় বঙ্গদর্শন-এর ১ম সংখ্যায় উপন্যাসটির প্রথম চার পরিচ্ছেদ
মুদ্রিত হয়। এর আগে The Bengalee পত্রিকার ১৮ এপ্রিল ও
২৯ এপ্রিল ১৯০১ সংখ্যায় প্রকাশিতব্য বঙ্গদর্শন নবপর্যায় পত্রিকায় গ্রাহক হবার আহ্বান
জানিয়ে যে বিজ্ঞাপন মুদ্রিত হয়, তাতে উল্লেখ্য করা হয়, ‘A highly
interesting novel by Ravindranath Tagore, will appear from the first month.’ ১৩০৮
বঙ্গাব্দের নবপর্যায় বঙ্গদর্শন -এর প্রথম
সংখ্যা থেকে শুরু করে ১৩০৯ বঙ্গাব্দের কার্ত্তিক সংখ্যা পর্যন্ত
ধারাবাহিকভাবে মুদ্রিত হয়ে গ্রন্থাকারে
প্রকাশিত হয় বছর শেষে। মনস্তত্ত্বমূলক উপন্যাস বলতে যা বোঝায় চোখের বালি’তে
উপস্থিত ছিল তার সব কিছুই। বঙ্গদর্শনে ‘চোখের বালি’ ও ‘নৌকাডুবি’ ছাড়া আর কোনো উপন্যাস
প্রকাশিত হয়নি। তাঁর সম্পাদনাকালে ২৮০টি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আরও উল্লেখ্য করা
যায়, নবপর্যায় বঙ্গদর্শনে বিশুদ্ধ সাহিত্যলোচনার একটি উপযুক্ত স্থান তৈরি
করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথই। রবীন্দ্রনাথ, সম্পাদকের পদ ত্যাগ করে শৈলেশচন্দ্রকে
১৩১৩-তে কোন এক পত্রে বলেন, ‘নব পর্যায় বঙ্গদর্শন পাঁচ বৎসরকাল চালন করিয়া বর্তমান
বৎসরে আমি সম্পাদক পদ হইতে নিষ্কৃতি গ্রহণ করিতেছি। এক্ষণে আমি বিশ্রাম প্রার্থী।
আশা করি, পাঠকগণ আমার সম্পাদনকালের সমস্ত ত্রুটি মার্জনা করিয়া আমাকে অবসরদান
করিবেন। ইতি ১লা বৈশাখ, ১৩১৩। শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ এর পরবর্তী সময়ে,
রবীন্দ্রনাথ ভাণ্ডার নামে একটি
পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ভাণ্ডার মূলত
রাজনৈতিক নির্ভর পত্রিকা ছিল। এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ১৩১৪ সালের আষাঢ় পর্যন্ত
সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাশ বছর বয়সে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তত্ত্ববোধিনী
পত্রিকার। রবীন্দ্রনাথের জীবনে দেখা দেয় স্মরণীয় এক মুহূর্তকাল, ও জাতীয় জীবনে
আন্দোলনের বিস্তৃতির ঘটনা। তত্ত্ববোধিনী সম্পাদনাকালেই রবীন্দ্রনাথ ২৪শে মে, ১৯১২ থেকে
একটানা দেড় বছর ইউরোপ ও আমেরিকা সহ নানা
দেশ সফরে যান। ১৯১৩ সালের অক্টোবরে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এই দেড় বছর পত্রিকা
দেখাশুনা করতেন সহ-সম্পাদক অজিতকুমার চক্রবর্তী। তত্ত্ববোধিনী মূলত ছিল
প্রবন্ধ ও বিবিধ আলোচনা নির্ভর পত্রিকা। তত্ত্ববোধিনী’ই রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত শেষ পত্রিকা। এর পর রবীন্দ্রনাথ আর কোন পত্রিকা
সম্পাদনায় হাত দেননি। এমন বহুমুখী প্রতিভাবান মানুষটি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের
অসংখ্য কর্মকাণ্ডের মধ্যেও, নিজের ইচ্ছা এবং একাগ্রতা দিয়ে পাঁচটি পত্রিকাকে যে
সময় দিয়েছিলেন তা আজ ভাবতেই নিজেদের কেমন যেন অবাক আর আশ্চর্য বলেই মনে হয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন