সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

প্রেমেন্দ্র মিত্রঃ ছোট গল্পের ছোট কথা

 প্রেমেন্দ্র মিত্রের বাংলা কথাসাহিত্যে প্রবেশ যেমন নাটকীয়, তেমনি আকস্মিক ও বলা যায়। প্রেমেন্দ্র মিত্রের জীবনীকার শ্রীমতী সুমিতা চক্রবর্তীর আলোচনা থেকে জানা যায়, তিনি ঢাকায় জগন্নাথ কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স পড়ার সময় কলকাতা এসে ‘২৮নং গোবিন্দ ঘোষাল লেনের’ মেস বাড়িতে থাকেন। সেই সময় সমস্ত বর্ডাররাই ছুটিতে বাড়িতে চলে গেছেন। খালি মেঘের ঘরের জানালায় গোঁজা একটি পোস্টকার্ড লেখকের হাতে আসে। চিঠির বিষয়বস্তু এক নববিবাহিতা নারীর প্রবাসী স্বামীকে লেখা সামান্য কয়েকটি কথা, যা পাথেয় করে রাতারাতি প্রেমেন্দ্র লিখে ফেলেন দু’টি ছোটগল্প ‘শুধু কেরানী’ ও ‘গোপনচারিণী’। এর পরবর্তী অধ্যায় এক প্রসারিত জীবনের। একের পর এক ছোটগল্পের সংকলন যেমন প্রকাশিত হয়েছে; তেমনি কাব্যগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনাতেও তিনি রেখেছেন মৌলিকতার স্বাক্ষর। কল্লোলে’র নতুন ধারায় রচনা শৈলীর তিনি ছিলেন এক অগ্রগণ্য কারিগর। অভিনব বিষয়বস্তু, সুক্ষ্ম ভাবাবেগ, নাটকীয়তা ও স্বাভাবিক সুলভ উপস্থাপনা-এ সবই তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হ’য়ে ধরা পড়ল। প্রবাহিত এক জীবনে বহু রকমের জীবিকার সঙ্গে পরিচিতির সুত্রে কখনও তিনি স্কুল মাস্টার, বিজ্ঞাপন লেখক, পত্রিকা সম্পাদক, চিত্রনাট্যকার, রেডিওর অনুষ্ঠান পরিচালক, সিনেমা শিল্পী ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েছেন তাঁর সমস্ত সাহিত্য জুড়ে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী প্রেমেন্দ্র কিন্তু বারংবার নিজেকে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে এগিয়েছেন। তাই বৈচিত্র্যময় বিষয়ই তাঁর লেখায় জায়গা ক’রে নিতে সক্ষম হয়। ডঃ চক্রবর্তী তাঁর ‘প্রেমেন্দ্র মিত্র’ জীবনী গ্রন্থমালায় লিখেছেন, ‘প্রেমেন্দ্র মিত্র চিরকালই শিশু ও কিশোরদের জন্য রচিত সাহিত্যের এক উৎসাহী নিবেদিত ও স্বাতন্ত্র্যসম্পন্ন লব্ধ প্রতিষ্ঠ লেখক’। সেই উৎসাহই আরও গভীরভাবে অনুভব করলেন যখন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের মৃত্যুর কিছুদিন পরে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধলে প্রেমেন্দ্র জন্মভুমি বারানসীতে আশ্রয় নেন। সেখানেই বিজ্ঞানে আগ্রহ উদ্দীপক বাংলা শিশুসাহিত্যে গ’ড়ে তোলার জন্য দুই যোগ্য সহযোগীকে পেয়ে যান, তাঁরা হলেন মনোরঞ্জন ও ক্ষিতীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, এদের উৎসাহে রচিত হল ‘পিঁপড়ে পুরাণ’, প্রকাশিত হল রামধনুর পাতায়। এর পর প্রেমেন্দ্র অচিরেই হ’য়ে ওঠেন সুধীরচন্দ্র সরকার সম্পাদিত মৌচাক পত্রিকার নিয়মিত লেখক। এই সুত্রেই ১৯৪৫ সালে দেব সাহিত্য কুটিরের পুজা সংখ্যা ‘আলপনায়’ আর্ভিভাব ঘটল ‘ঘনাদা’র। প্রেমেন্দ্র মিত্রের প্রথম গল্প ‘মশা’ মূলত কিশোর-কিশোরীর জন্য লেখা হলেও প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে সব বয়সী পাঠকের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। বুদ্ধি ও আবেগের নিখুঁত সমতা বা সাহিত্যে, বিশেষ ক’রে বলা যায় গল্প বা কথাসাহিত্যে রম্যতা সৃষ্টি করে। সেই জায়গা থেকে বলা যায় প্রেমেন্দ্র তার নিখুঁত শিল্পী। অতিকথন, বর্জিত বর্ণনা, নিবাড়ম্বর শব্দবিন্যাস, গঠিত চরিত্রের গভীর সহানুভূতি ও অন্তর্দৃষ্টি ঘটনা ও সংলাপের মধ্যে বন্ধন তৈরি প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পকে জীবন্ত ও বৈচিত্র্যময় ক’রে তোলে। তাঁর রচিত গল্প ও উপন্যাসে বিষয়বস্তুর নতুনত্ব গঠনধারা ও স্বকীয়তা, সূক্ষ্ম মানসিক অবলোকন বিশেষ ভাবে আমাদের চেতনায় ধরা পড়ে। আর এর জন্যেই তিনি হ’য়ে উঠেন অন্যদের থেকে আলাদা, এক অনন্য লেখক। এই চিত্র আমরা দেখতে পাই তাঁর প্রথম দিকের লেখা ‘পাঁক’ এর মধ্যে দিয়েই। প্রথম জীবনে তার ছোটোগল্পের তিনটি বই বেরোয়- 'পঞ্চশর', 'বেনামী বন্দর' আর 'পুতুল ও প্রতিমা'। মানুষের সম্পর্কের ভাঙ্গা গড়া, মনের জটিলতা, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ব্যথা বেদনার কথা প্রকাশে প্রেমেন্দ্র মিত্র ছিলেন স্বকীয়তায় অনন্য।

 

প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছোটগল্পের মধ্যে রয়েছে কালাপানির অতলে, ‘দুঃস্বপ্নের দ্বীপ, ‘যুদ্ধ কেন থামল, ‘মানুষের প্রতিদ্বন্দ্বী’,  হিমালয়ের চূড়ায়, ‘আকাশের আতঙ্ক, ‘অবিশ্বাস্য, ‘লাইট হাউসে, ‘পৃথিবীর শত্রু, ‘মহাকাশের অতিথি, ‘শমনের রং সাদা। বড়ো গল্প ও উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে,  পিঁপড়ে পুরাণ, পাতালে পাঁচ বছর, ময়দানবের দ্বীপ, শুক্রে যারা গিয়েছিল, মনুদ্বাদশ, সূর্য যেখানে নীল। -ছাড়া আকাশবাণীর উদ্যোগে লিখিত ‘সবুজ মানুষ’ নামে চার অধ্যায়ের বারোয়ারি কল্পবিজ্ঞান কাহিনির প্রথম অধ্যায় রচনা করেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। অবশিষ্ট তিনটি অধ্যায় লিখেছিলেন অদ্রীশ বর্ধন, দিলীপ রায়চৌধুরী ও সত্যজিৎ রায়

 

সাহিত্য-সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য প্রেমেন্দ্র মিত্র শরৎ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৫৪), আকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৬), আনন্দ পুরস্কার (১৯৭৩), নেহেরু পুরস্কার (১৯৭৬)  লাভ করেন। এ ছাড়া শিশু সাহিত্য পরিষদের ভুবনেশ্বরী পদক (১৩৭৮), দেশিকোত্তম উপাধি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের হরনাথ ঘোষ পদক (১৯৮১) প্রভৃতি সম্মাননা ও উপাধিতে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। প্রেমেন্দ্র মিত্র ১৯৮৮ সালের ৩ মে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

 

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রবন্ধঃ বুদ্ধদেব বসু ও ‘কঙ্কাবতী’

বুদ্ধদেব বসু প্রেমের অজস্র কবিতা রচনা করেছেন । অন্য অনেকের মতো তিনিও বেছে নেন একজন প্রেমিকাকে , যে হ ’ য়ে উঠে বুদ্ধদেবের অতুল্য প্রেমিকা হিশেবে । ‘ কঙ্কাবতী ’ অনিন্দ্য প্রেমিকা হ ’ য়ে বুদ্ধদেবের কাব্যতে বিচরণ ক ’ রে স্বচ্ছন্দে । স্থির হয়ে বসে পড়ে কঙ্কাবতী ’ কাব্যগ্রন্থে । যে কাব্যগ্রন্থে ‘ কঙ্কাবতী ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে ‘ কঙ্কাবতীকে ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে কঙ্কাবতীকে আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো কবিতায় । যেখানে সে প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে কুৎসিত কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু নয় । প্রগাঢ় ভাবে প্রাপ্তির জন্যে সমস্ত কবিতা জুঁড়ে দেখতে পাই কবির অপরিবর্তনীয় আবেদন । কঙ্কাবতী , যাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময়ের জন্যে রক্তের হিমবাহে দেখা দেয় চঞ্চলতা । সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হাঁরিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো , যা বলার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন । প্রেমিকা যখন খুব কাছাকাছি হয়ে এগিয়ে আসেন , ওই ব্যর্থ ...

প্রবন্ধঃ অমিয় চক্রবর্তী : ‘বৃষ্টি’ নিয়ে তিনটি কবিতা

রবীন্দ্রনাথ, মেঘ-বরষা বৃষ্টি নিয়ে এতো সংখ্যক কবিতা লিখেছেন যে তাঁর সমান বা সমসংখ্যক কবিতা বাঙলায় কেউ লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কবিতায় বার বার এবং বহুবার ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, বরষা, বৃষ্টি। বৃষ্টি নামটি নিলেই মনে পড়ে কৈশোর পেড়িয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটির কথা। ‘দিনের আলো নিবে এল সূর্য্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।’ বৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার কথা মনে পড়লে এটাই চলে আসে আমার মনে। অমিয় চক্রবর্তী বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। বাঙলায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেনি এমন কবির সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় পাই ‘বৃষ্টি’ নামক কিছু সৌন্দর্যময় কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে। ওই কবিদের কারো কারো কবিতা দ্রুত নিঃশ্বাসে পড়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি নামক প্রথম কবিতাটি পাওয়া যাবে অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠোতে’। উন্নিশটি কবিতা নিয়ে গ’ড়ে উঠে ‘একমুঠো’ নামক কাব্য গ্রন্থটি। যেখান থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতায় তুলে নেওয়া হয় চারটি কবিতা। আমার আরো ভালোলাগে ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি ওই তালিকায় উঠে আসে। শ্রেষ্ঠ কবিতায় না আসলে আমার যে খুব খারাপ লাগতে তা-ও নয়। ওই কবিতা...

প্রবন্ধঃ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধ সংগ্রহ

সুধীন্দ্রনাথ , সাতটি কাব্যগ্রন্থের মতো সাতটি প্রবন্ধের গ্রন্থ লিখলে খারাপ হতো না , বেশ ভালোই হতো । সুধীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো হালকা মানের নয় , যদিও তাঁর কোন রচনাই হালকা নয় । সাহিত্যে বিচারে তা অনেক উঁচুমানের । তার উপর ভাষার ব্যাপারটি তো রয়েছেই । সুধীন্দ্রনাথ মাত্র দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন । গ্রন্থ দুটো ‘ স্বগত ’ ( ১৩৪৫ ঃ ১৯৩৮ ), অপরটি ‘ কুলায় ও কালপুরুষ ’ ( ১৩৬৪ : ১৯৫৭ ) । ‘ স্বগত ’- তে রয়েছে ষোলটি প্রবন্ধ । গ্রন্থ দুটি তিনি রচনা করেছেন দু ’ ভাগে । লরেন্স বা এলিয়ট এর প্রবন্ধ যেমন পাওয়া যাবে না ‘ কুলায় ও কালপুরুষ ’- এ ; তেমনি রবীন্দ্র সম্পর্কিত প্রবন্ধ নেওয়া হয়নি ‘ স্বগত ’- এ । প্রকাশ কাল অনুযায়ী ‘ স্বগত ’- এর প্রবন্ধসমূহ : ‘ কাব্যের মুক্তি ’ ( ১৯৩০ ); ‘ ধ্রুপদ পদ - খেয়াল ’ ( ১৯৩২ ), ‘ ফরাসীর হাদ্য পরিবর্তন ’ ( ১৯৩২ ), ‘ লিটনস্ট্রেচি ’ ( ১৯৩২ ), ‘ লরেন্স ও ভার্জনিয়া উল্ফ্ ’ ( ১৯৩২ ), ‘ উপন্যাস তত্ত্ব ও তথ্য ’ ( ১৯৩৩ ), ‘ উইলিয়ম ফকনর ’ ( ১৯৩৪ ), ‘ ঐতিহ্য ও টি , এস , এলিয়ট ’ ( ১৯৩৪ ), ...