সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

বনফুলের কিশোর গল্প

রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ছোটগল্পের যে বিস্তৃত পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগলো, তার উজ্জ্বল সৌন্দর্য যেন আজও আমাদের বিমোহিত ক’রে তোলে। তার পরবর্তীতে; যে কজন সেই আলোর পথে এগিয়েছেন তাঁদের কথামালা নিয়ে, বনফুল তাঁদের মধ্যে অন্যতম। ছোটগল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রে, তিনি নিজস্ব এক জীবন দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। বাক্যের সংক্ষিপ্ততা,  ভাবানুষঙ্গে অনির্বচনীয় রহস্যকরতা, পরিহাস-রসিকতা তাঁর রচিত ছোটগল্পের প্রাণ বলে আমরা মনে করি। এখানে আমরা আরও বলে নিতে পারি, বাক্যের সংক্ষিপ্ততা এবং অনুষঙ্গ জীবনদৃষ্টির কারণে তাঁর রচনাকে হঠাৎ ক’রে অকিঞ্চিৎকর বলে মনে হতে পারে। সাম্প্রতিককালে, বাংলাসাহিত্য সম্পর্কিত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহিত্য সমালোচনায় বনফুলের সাহিত্য কিছুটা ম্লান মনে হ’তে পারে। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো প্রাজ্ঞ সমালোচকও একই ধরনের ভ্রান্তির ভুক্তভোগী হয়ে লিখেছিলেন, ‘তিনি ছোটগল্পের শিল্পরূপ ও ঘটনা বিন্যাসের যথার্থতা লইয়া বিশেষ মাথা ঘামান নাই। স্বল্পতম পরিসরের মধ্যে ইহার অন্তর্নিহিত পরিহাসটুকু ব্যক্ত করিয়া, অতর্কিতের ধাক্কায় পাঠককে খানিকটা চকিত করিয়া, গল্প শেষ করিয়াছেন। কথামালা, হিতোপদেশ প্রভৃতি প্রাচীন গল্প সংগ্রহে যেমন গল্পের নীতিকথাটুকু লেখকের একমাত্র লক্ষ্য ছিল, আধুনিক যুগের বনফুলের গল্পে তদ্রুপ ব্যঙ্গাত্মক অসঙ্গতিটুকু ফুটাইয়া তোলাই যেন গল্প রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য দাঁড়াইয়াছে।’ বনফুল জীবন সত্যের বিচিত্ররূপকে তাঁর ছোটগল্পে তু’লে ধরেছেন। তাঁর চোখে মানুষ স্বর্গের দেবতা নয়, আবার নরকের শয়তানও নয়। মানুষকে তিনি দেখেছেন মানুষেরই রূপে। মানুষ ভুল করে, অন্যয় করে, পাপাচার করে, সেজন্য সে শাস্তি ও পায়, প্রায়শ্চিত্ত করে অনেক মূল্য দিয়ে। এই সব কিছু মিলিয়েই মানবজীবন, আবার এই সবই মানবনিয়তি। মানবজীবনের এই বিমিশ্র রূপকে বনফুল মূল্যায়ন করেছেন যথার্থভাবে। জীবনকে মূল্যায়ন করার এই মানবধারাকে রবীন্দ্রনাথ চমৎকারভাবে চিহ্নিত করেছেন, বনফুলকে লেখা কোনো এক চিঠিতে, ‘যেন তুমি উদ্ভিদবিজ্ঞানী, হাটে যাবার মেঠো রাস্তায় যেতে যেতে এদিক-ওদিকে, আগাছা এবং ঘেসো গাছ গাছড়া যা তোমার চোখে পড়েছে, তোমার নমুনার বইয়ে সেগুলোকে গেঁথে রেখেছ। এগুলো পথিকদের চোখ এড়ায়- কেননা এরা না দেয় পূজার ফুল, না চড়ে চীনে ফুলদানিতে। এরা আদরণীয় নয়, পর্যবেক্ষণীয়। তুলে ধরে দেখিয়ে দিলে মনে হয় কিছু খবর পাওয়া গেল, কিছু কৌতুক লাগে মনে। মেঠো পথটা চৌরঙ্গী রোড নয়, কিন্তু জীবনলোকের নানা আমেজ ওর এখানে ওখানে লুকিয়ে থাকে, ওর ফড়িং টিকটিকিগুলো ময়ূর-হরিণের সঙ্গে তুলনীয় নয়, কিন্তু ঝুঁকে পড়ে যদি দেখা যায় তাহলে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটে-আর ঘেসো জগতের সঙ্গে ওদের মিল দেখে কিছু মজাও লাগে।’ বনফুল সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছেন, তাকে সংক্ষেপ ক’রে বললে বলা যায় যে, বনফুল জীবনকে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যতটুকু জেনেছেন, সেই জানাকে, নিজের গভীর উপলব্ধির দ্বারা স্বমহিমায় যথার্থ প্রকাশ করেছেন। লেখক হিসেবে বনফুলকে আমরা পাই বৈচিত্র্যময় ধারার রচনাকারী হিসেবে। গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ সকল মাধ্যমেই তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল। তবে বিচার বিশ্লেষণে, ছোট গল্পেই তাঁর সর্বাধিক সফলতা রয়েছে। বনফুল ‘কল্লোল’-এর সমসাময়িক ছিলেন। তবে, কল্লোল-কালিকলম-প্রগতি পত্রিকা কেন্দ্রিক লেখক গোষ্ঠী যে জীবন চেতনার রূপকার ছিলেন, তিনি সেই রকম ছিলেন না। তিনি নিজের সাধারণ প্রাজ্ঞ-উপলব্ধি নিয়েই নিজের মত ক’রে সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত থেকেছেন। কল্লোল-এর লেখকেরা ছিলেন চরমভাবে রবীন্দ্রবিরোধী। বনফুল কখনো তাঁদের দলে ভেড়েননি। তাঁর লেখায় বিদ্রোহীর সুর কখনো বেজে উঠেছে কি-না তা আমাদের মনে পড়ে না। বিদ্রোহীর সুর থেকেও মধ্যবিত্ত জীবনের অসঙ্গতি ও গ্লানিময় আত্মসমর্পণের চিত্র তাঁর ছোটগল্পে আমরা বেশী দেখতে পাই। অতীতের ভেসে আসা সুর তাঁর অনেক ছোট গল্পে বেজে উঠেছে। সেই সুরের সাথে গল্পের মৌলিকতা যে ম্লান হয়েছে তা কিন্তু বলা যাবে না। বরং দেখতে পাই গল্পের গাঁথুনি যেন আরও মজবুত হ’য়ে তাঁর হাতে ধরা দেয়। বনফুল তাঁর ছোট গল্পের ভূমিকায় বলেন, ‘খুব ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমার বয়স তখন পাঁচ-ছ বছরের বেশী নয়। আমাদের বাড়িটা ছিল গ্রামের একেবারে এক প্রান্তে। আশে-পাশে বন জঙ্গল। সাপ, বুনোশুয়োর, খরগোস আর নানারকম পাখি, এরাই ছিল প্রতিবেশী, আর ছিল ছোট-বড় নানারকমের গাছ, নানা ধরণের ফুল-ফল লতাপাতা। আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে সরু একটি পায়ে চলা পথ ছিল, পথটি এঁকে-বেঁকে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল ঘন-জঙ্গলের মধ্যে। মা আমাকে কিছুতেই ওপথে নামতে দিতেন না। তাঁর ভয় হতো, কত রকমের জন্ত-জানোয়ার আছে, কি জানি যদি কারও সামনাসামনি পড়ে যাই। সশরীরে সে রাস্তা দিয়ে যেতে পারিনি বটে, কিন্তু মনে মনে সে রাস্তা দিয়ে রোজই চলে যেতুম। চলে যেতুম এমন এক দেশে যেখানে ফুলেরা গান করে, পাখিরা গল্প করে, যেখানে চোখের জলের ফোঁটা মুক্তা হয়ে গড়িয়ে পড়ে, হাসিতে মানিক ঝরে। যেখানে কেউ পর নয়, সবাই আপন-সবাই সুন্দর, যেখানে অসম্ভাব বলে কিছু নেই, সবই সম্ভাব। মনে মনে সেই সরু পথটি ধরে চলে যেতুম স্বপ্নলোকে, যেখানে সত্য আর স্বপ্নে কোন প্রভেদ নেই। বড় হয়ে সেই পথ দিয়ে সশরীরে হেঁটে গেছি, গিয়ে হতাশ হয়েছি। পথ শেষ হয়েছে একটা ফাঁকা মাঠে, উচু-নিচু এবড়ো থেবড়ো মাঠ একটা। কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের আকাশ-পাতাল তফাৎ ! ’   

 বনফুলের গল্প বলার ধরণ আমাদেরকে অনেক অবাক ক’রে তোলে। তাঁর গল্পের নাম বা পরিবেশ বা কাহিনীর বাস্তবতা দেখলে মনে হয়, এগুলো অলৌকিক কোনো গল্প নয়। এ-গল্প যেন আমাদের চারিদিকের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাহিনীর বাস্তবতার চিত্রণ যেন তাঁর হাতে নিপুণভাবে ধরা দেয় আপন সৌন্দর্যে। অনেক সময় এটাও পরিলক্ষিত হয় যে, এ-গল্পের কেন্দ্রে যেন আমি’ই বসে আছি। আমাকে নিয়েই যেন লেখা হয়েছে চির-পরিচিত সেই গল্পের কাহিনী। বনফুলের গল্প কখনও জটিল ধারায় বিচরণ করেনি। বরং বলা যায় যে, সহজকে আরও কত সহজ করে বলা যায় তার যেন নিরন্তর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছেন তিনি সর্বদা। সেই সব গল্প একক কোন কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। বরং সর্বদা তা এগিয়ে গেছে সহজ থেকে সহজের পথে। তাই এটাই হয়ে উঠে তার সফলতার এক অলৌকিক জাদুরকাঠি।

গল্প বলার ক্ষেত্রে, পূর্ব প্রস্তুতি তার গল্পে নেই বললেই চলে। নিজের মনোভাবনার চিত্রকে নিজের মধ্যে সাজিয়ে, নিজের মত করেই লিখেছেন সমস্ত ছোটো গল্পগুলো। তাই সেই সব গল্পে বেজে উঠেছে জীবনের আপন সুর। যে সুরের সাথে আমরা অনেক পূর্ব থেকেই পরিচিত।

                             

 

  

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রবন্ধঃ বুদ্ধদেব বসু ও ‘কঙ্কাবতী’

বুদ্ধদেব বসু প্রেমের অজস্র কবিতা রচনা করেছেন । অন্য অনেকের মতো তিনিও বেছে নেন একজন প্রেমিকাকে , যে হ ’ য়ে উঠে বুদ্ধদেবের অতুল্য প্রেমিকা হিশেবে । ‘ কঙ্কাবতী ’ অনিন্দ্য প্রেমিকা হ ’ য়ে বুদ্ধদেবের কাব্যতে বিচরণ ক ’ রে স্বচ্ছন্দে । স্থির হয়ে বসে পড়ে কঙ্কাবতী ’ কাব্যগ্রন্থে । যে কাব্যগ্রন্থে ‘ কঙ্কাবতী ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে ‘ কঙ্কাবতীকে ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে কঙ্কাবতীকে আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো কবিতায় । যেখানে সে প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে কুৎসিত কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু নয় । প্রগাঢ় ভাবে প্রাপ্তির জন্যে সমস্ত কবিতা জুঁড়ে দেখতে পাই কবির অপরিবর্তনীয় আবেদন । কঙ্কাবতী , যাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময়ের জন্যে রক্তের হিমবাহে দেখা দেয় চঞ্চলতা । সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হাঁরিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো , যা বলার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন । প্রেমিকা যখন খুব কাছাকাছি হয়ে এগিয়ে আসেন , ওই ব্যর্থ ...

প্রবন্ধঃ অমিয় চক্রবর্তী : ‘বৃষ্টি’ নিয়ে তিনটি কবিতা

রবীন্দ্রনাথ, মেঘ-বরষা বৃষ্টি নিয়ে এতো সংখ্যক কবিতা লিখেছেন যে তাঁর সমান বা সমসংখ্যক কবিতা বাঙলায় কেউ লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কবিতায় বার বার এবং বহুবার ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, বরষা, বৃষ্টি। বৃষ্টি নামটি নিলেই মনে পড়ে কৈশোর পেড়িয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটির কথা। ‘দিনের আলো নিবে এল সূর্য্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।’ বৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার কথা মনে পড়লে এটাই চলে আসে আমার মনে। অমিয় চক্রবর্তী বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। বাঙলায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেনি এমন কবির সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় পাই ‘বৃষ্টি’ নামক কিছু সৌন্দর্যময় কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে। ওই কবিদের কারো কারো কবিতা দ্রুত নিঃশ্বাসে পড়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি নামক প্রথম কবিতাটি পাওয়া যাবে অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠোতে’। উন্নিশটি কবিতা নিয়ে গ’ড়ে উঠে ‘একমুঠো’ নামক কাব্য গ্রন্থটি। যেখান থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতায় তুলে নেওয়া হয় চারটি কবিতা। আমার আরো ভালোলাগে ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি ওই তালিকায় উঠে আসে। শ্রেষ্ঠ কবিতায় না আসলে আমার যে খুব খারাপ লাগতে তা-ও নয়। ওই কবিতা...

প্রবন্ধঃ সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রবন্ধ সংগ্রহ

সুধীন্দ্রনাথ , সাতটি কাব্যগ্রন্থের মতো সাতটি প্রবন্ধের গ্রন্থ লিখলে খারাপ হতো না , বেশ ভালোই হতো । সুধীন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলো হালকা মানের নয় , যদিও তাঁর কোন রচনাই হালকা নয় । সাহিত্যে বিচারে তা অনেক উঁচুমানের । তার উপর ভাষার ব্যাপারটি তো রয়েছেই । সুধীন্দ্রনাথ মাত্র দুটি প্রবন্ধ গ্রন্থ রচনা করেছেন । গ্রন্থ দুটো ‘ স্বগত ’ ( ১৩৪৫ ঃ ১৯৩৮ ), অপরটি ‘ কুলায় ও কালপুরুষ ’ ( ১৩৬৪ : ১৯৫৭ ) । ‘ স্বগত ’- তে রয়েছে ষোলটি প্রবন্ধ । গ্রন্থ দুটি তিনি রচনা করেছেন দু ’ ভাগে । লরেন্স বা এলিয়ট এর প্রবন্ধ যেমন পাওয়া যাবে না ‘ কুলায় ও কালপুরুষ ’- এ ; তেমনি রবীন্দ্র সম্পর্কিত প্রবন্ধ নেওয়া হয়নি ‘ স্বগত ’- এ । প্রকাশ কাল অনুযায়ী ‘ স্বগত ’- এর প্রবন্ধসমূহ : ‘ কাব্যের মুক্তি ’ ( ১৯৩০ ); ‘ ধ্রুপদ পদ - খেয়াল ’ ( ১৯৩২ ), ‘ ফরাসীর হাদ্য পরিবর্তন ’ ( ১৯৩২ ), ‘ লিটনস্ট্রেচি ’ ( ১৯৩২ ), ‘ লরেন্স ও ভার্জনিয়া উল্ফ্ ’ ( ১৯৩২ ), ‘ উপন্যাস তত্ত্ব ও তথ্য ’ ( ১৯৩৩ ), ‘ উইলিয়ম ফকনর ’ ( ১৯৩৪ ), ‘ ঐতিহ্য ও টি , এস , এলিয়ট ’ ( ১৯৩৪ ), ...