সাল ১৮৪৬, মাস ১লা আগস্ট। শ্রাবণের দিন শেষে নেমে আসছে কালো সন্ধ্যা। চারিদিকে মেঘের তীব্র গর্জন। কেঁপে-কেঁপে উঠছে সমস্ত আকাশ। ঘড়ির কাটায় ঠিক সন্ধ্যা সোয়া ছ'টা। লণ্ডনের প্রাচুর্যপূর্ণ, মেফেয়ার অঞ্চলের সুপ্রসিদ্ধ একটি হোটেল, নাম সেণ্ট জর্জ হোটেল। বর্তমানে হোটেলটির নাম ব্রাউন হোটেল। কাগজ-কলমে যার ঠিকানা রয়েছে ৩২ নম্বর অ্যালবিমার্ল স্ট্রীট। কিছুক্ষণ পূর্বে, ৫১ বছর বয়সের এক বাঙালী ভদ্রলোক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন এই হোটেলে। মৃত্যুশয্যাতেও তাঁর অগাধ সৌজন্যবোধের এতটুকুও ম্লান ঘটেনি মুখচ্ছবিতে। যেন তাকিয়ে রয়েছেন কোনো এক সৌন্দর্যের দিকে। কে এই বাঙালি? কি তাঁর পরিচয় ? তিনি কার কি হন ? সম্পর্কে অন্যরা বা তাঁর কি হন। তাঁর সদাহাস্য মুখে ছিল একটিই কথা ‘I am content’। ব্রিটিশের দাসত্ব না করে, তাদের সহযোগিতায় নিজ দেশের ভাগ্য উন্নতি সম্ভব, এ-কথা তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাস থেকেই শুরু করেন নিজ দেশের ব্যাপক পরিবর্তন। তাই, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব দেখে তদ্রুপ বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন ভারতবর্ষে। সেই স্বপ্ন তাঁর কতটা সার্থক হয়েছিল ? কতটা সেই স্বপ্নের সাথে নিজকে মিলাতে পেরেছিলেন। ধর্মান্ধতাকে তুচ্ছ ক’রে, সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে পিছে ঠেলে বিশ্ব দরবারে বাঙালির শিল্পোদ্যোগী মনোভাব প্রতিষ্ঠা করতে কালাপানি পেরিয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন বিলেতে। তাঁর সময় থেকে অনেক বেশী এগিয়ে ছিলেন তিনি। মেধা আর প্রাচুর্য যেন ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর চতুর্দিকে। ব্যাঙ্কের সঙ্গে বাঙালির যোগসূত্র গ'ড়ে তোলা থেকে শুরু করে সংবাদপত্রের উন্নতি সাধন বা ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে রেলপথের স্বপ্ন দেখা, এ-সব কিছুর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের সৌভাগ্যের সূচনাও তাঁর হাতে হয়েছিল। অথচ বাঙালি হিসেবে, সেই পরিবারের উত্তরপুরুষেরাও তাঁর সম্পর্কে খুবই উদাসীন ছিলেন। একটু পিছে ফিরে যাই, যদি সত্যি করে সেই ভদ্রলোকের পরিচয় আমাদের জানতে হয়। [1]কাশ্যপগোত্রীয় বীতরাগের চারপুত্র রাঢ় বা পশ্চিমবঙ্গে বাস করে 'রাঢ়ীয়' উপাধিতে পরিচিত হন। দক্ষের চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে 'ধীর' নামক এক ব্যক্তি আদিশূর পুত্র ভুশূরের কাছ থেকে 'গুড়' নামক গ্রাম প্রাপ্ত হন। কথিত রয়েছে, বর্তমানে এই গ্রাম মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত। 'গুড়' নামক গ্রামের অধিবাসী বলে তাঁরা 'ধীরগুড়ি' বা 'ধীরগুড়' নামে পরিচিত। তাঁর সপ্তম পুরুষ রঘুপতি আচার্য পরিণত বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে দণ্ডী হন। জনশ্রুতি রয়েছে, কাশীবাস কালে দণ্ডীসমাজ তাকে কনকদণ্ড উপহার প্রদান করেন। কেহ কেহ বলেন 'কনকদাঁড়' গ্রামে গিয়ে বাস করেন বলে উত্তরকালে রঘুপতির বংশধরেরা 'কনকদণ্ডী গুড়' নামে পরিচিত হতে থাকেন। এই কনকদণ্ডী গুড়ের একটি শাখা যবন সম্পর্কে পীরালি দোষে দুষ্ট হয়ে ব্রাহ্মণসমাজে পতিত হন। সেই রঘুপতি আচার্যের অধস্তন চতুর্থ পুরুষ জয়কৃষ্ণ ব্রহ্মচারী বোধ হয় 'রায়' উপাধি প্রাপ্ত হন। এই জয়কৃষ্ণের দুইপুত্র। নাগর ও দক্ষিণানাথ। সেই দক্ষিণানাথের আবার চারপুত্র। কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব। মুসলমান সম্পর্কে কামদেব প্রথম থেকেই পীরালি হন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ তুর্কী-মুসলিম দ্বারা বিজিত হয়েছে এবং দক্ষিণানাথ রাজদ্বারে প্রতিষ্ঠা লাভ করে 'রায়চৌধুরী' উপাধি দ্বারা ভূষিত হন। কামদেবের চার ভাই বর্তমান যশোহর জেলার চেঙ্গুটিয়া পরগণার জমিদার ছিলেন। তুর্কী-বিজয়ের পর সকল হিন্দুই যে মুসলমানদের 'যবন' আখ্যা দিয়ে দূরে রেখেছিলেন তা নয়। বিজেতাকে অনুকরণ, তার অনুগ্রহভাজন হয়ে অর্থ ও প্রতিপত্তি লাভের লোভ চিরকাল একই ভাবে দেখা দিয়ে আসতেছে। তুর্কী বিজয়ের ফলে হিন্দুদের মধ্যে কেহ ধর্মের আকর্ষণে, কেহ তুর্কী রমণী লাভের মোহে, কেহ বা ঐহিক স্বাচ্ছন্দর জন্য, কেহ বা উৎপীড়নের দায় হতে মুক্তিলাভের জন্য ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এইরূপে যবনদোষে দুষ্ট হয়ে নানা পরিবার হিন্দুসমাজ দেহ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সেরখানী, পীরালি, শ্রীমস্তখানী
প্রভৃতি থাকের উদ্ভব এইভাবেই হয়। বাংলাদেশে
মেল উৎপত্তি সম্বন্ধে বিচিত্র কাহিনী কুলাচার্যগণ সৃষ্টি করেছেন। তবে আচার্যগণের
সততা ও কাহিনী সমুহের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহের বহু কারণ আছে। নানা অজ্ঞাত কারণে
কুলাচার্যগণ যবনদুষ্ট পরিবারসমুহের কাউকে মর্যাদা দান করে সমাজে চালাইয়া
দিয়েছিলেন। কাহাকেও বা পতিত করে সমাজে অচল করে রেখেছিলেন। সে সব পরিবার কুলাচার্যগণের
অনুগ্রহ হতে বঞ্চিত হয়ে সমাজে 'পতিত' থেকে গেল। তাহাদেরই অন্যতম হচ্ছে
'পীরালি' ব্রাহ্মণগণ। 'পীরালি' ব্রাহ্মণদের
উৎপত্তি সম্বন্ধে কুলাচার্যগণ দ্বারা সৃষ্ট যে কিংবদন্তি চালু আছে, তা এখানে
প্রদান করা হলো। দক্ষিণ বাংলার ভূমিতে, উপনিবেশের চেষ্টা শুরু হয় তুর্কী রাজত্বকাল
থেকেই। খান জাহান আলি'র নামের সাথে আমরা সবাই কম বেশী পরিচিত। সেই খান জাহান আলি,
বাংলার দক্ষিণে, বর্তমান খুলনা জেলায় উপনিবেশ স্থাপন করার জন্য সাদরে যশোর জেলায়
উপস্থিত হন। এবং পরবর্তীতে, চেঙ্গুটিয়া পরগণার কর্তৃত্ব লাভ করেন। এখানে শুধু খান
জাহান আলি একাই আসেননি। তাঁর সাথে আরও এক ব্যক্তি আসেন। 'তাহের' নামেই তিনি বেশী
পরিচিত। এই তাহের পূর্বে ব্রাহ্মণ ছিলেন। কোনো এক মুসলিম রমণীর প্রেমে পড়ে তিনি
ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর নিবাস ছিল নবদ্বীপের নিকটে 'পিরলিয়া' বা 'পিরল্যা'
নামক গ্রামে। ইসলাম ধর্মে নিজেকে নিয়োজিত করা, এবং পিরলিয়া গ্রামে বসবাস করায় লোকে
তাকে 'পিরল্যা খা' নামে ডাকতে শুরু করে। তাহের খুব বিচক্ষণ এবং বুদ্ধিমান ব্যক্তি
ছিলেন। যা খান জাহান আলি'র মনে দাগ কেটে যায়। খান জাহান আলি তাঁর প্রতি তীব্র
বিশ্বাস এবং ভালোবেসে 'দেওয়ান' নিযুক্ত করে যশোরে নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য যে,
দক্ষিণানাথের দুই পুত্র, কামদেব ও জয়দেব, সেই পরিচিত 'পিরল্যা খা' বা তাহের-এর
প্রধান কর্মচারী হিসেবে নিযুক্ত হন। কথিত রয়েছে, একদিন রোজার সময়, তাহের বা পীরআলি
একটি লেবুর ঘ্রাণ নিচ্ছিলেন। এমন সময় কামদেব ঠাট্টার সুরে বলেন, 'আমাদের
শাস্ত্রানুসারে ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন হয়। সুতরাং, রোজা নষ্ট হলো। তাহের মুসলমান হলেও
ব্রাহ্মণ সন্তান। তিনি অতি সহজেই কামদেবের বিদ্রূপ বুঝতে পারলেন। বুজেও চুপ করে
থাকলেন, কিছুই বললেন না। কোনো একদিন, তাহের পারিবারিক অনুষ্ঠানে সকল ব্রাহ্মণদেরকে
নিমন্ত্রণ করলেন। এমন সময় অনুষ্ঠানের চারিদিকে মুসলমানদের খাবারের সুঘ্রাণ ছড়িয়ে
পড়লো। হিন্দুদের পক্ষ থেকে সেই খাবারের সুঘ্রাণ সহ্য করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে দেখা দেয়।
অনেকেই সেই ঘ্রাণে, অনুষ্ঠান স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। বিচক্ষন পীরআলি, কামদেব
ও জয়দেবকে বুঝিয়ে বললেন, 'ঘ্রাণে যখন অর্ধেক ভোজন হয়, গোমাংসের ঘ্রাণে অবশ্যই
তোমাদের জাত গেছে'। ভ্রাতৃদ্বয় পালাইবার চেষ্টা করিলেন। পীরআলির লোকজন, তাদের মুখে
জোর করে মাংস তুলে দিল। এইভাবে উভয় ভাই, তাঁদের জাতি হারালেন। পরবর্তীতে,
কামদেব-কামাল খাঁ ও জয়দেব-জামাল খাঁ নামে প্রসিদ্ধ হতে থাকলেন। পীরআলি, খান জাহান
আলিকে অনুরোধ করে দুই ভাইকে সিংগির-এ জায়গীর থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। পীরআলির
সেই অনুষ্ঠানে, কামদেবের অন্যান্য আত্মীয়গণের মধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের
শত্রুপক্ষ, তাদের 'পীরালি' অপবাদ দিলেন। এমনকি অনেককে সমাজচ্যুত করলেন। অর্থের
মহিমায় ও ঘটকের কৃপায় তাঁদের মধ্যে অনেককেই 'জাতে' উঠলেন, কেবল যাঁদের অবস্থা মন্দ
বা ধন থাকা সত্ত্বেও যারা ঘটকের মর্যাদা দান করতে নারাজ ছিলেন, তাঁরা কেবল 'পিরালি' বলে সমাজে অচল রইলেন।
কামদেবের অপর দুই ভাই, রতিদেব ও শুকদেব
রায়চৌধুরী দক্ষিণডিহির বাড়ীতে থাকতেন। সমাজের অত্যাচারে রতিদেব ক্ষুন্ন মনে গ্রাম
ছেড়ে চলে গেলেন। শুকদেবকে ভগ্নীর ও কন্যার বিয়ে নিয়ে খুবই কষ্টভোগ করতে হলো, এবং
বহু ছলচাতুরী ও অর্থব্যয় করে ফুলিয়ার এক মুখুটির সাথে ভগ্নীর বিয়ে দিতে সক্ষম
হলেন। শুকদেবের কন্যার বিয়ে হলো একজন শ্রেষ্ঠ শ্রোত্রিয়ের সাথে। জামাতার নাম
জগন্নাথ কুশারী, তিনি পিঠাভোগের জমিদার। পতিত ব্রাহ্মণের ঘরে বিয়ে করার অপরাধে
জগন্নাথকে তাঁর জ্ঞাতি-কুটুম্বরা 'পতিত' করলেন এবং সেই জন্য তিনি পিঠাভোগ ত্যাগ
করে দক্ষিণডিহিতে শ্বশুরালয়ে বাস করতে আসলেন। শুকদেব, জামাতাকে যথোচিত সম্মান
প্রদর্শন করলেন, খুলনা জেলার বর্তমান বারোপাড়া নরেন্দ্রপুর গ্রামের উত্তরে
'উত্তরপাড়া' নামে গ্রামখানি তাঁকে দান
করেন। এইরূপে, শুকদেবের ভগ্নী ও কন্যার বিয়ের ফলে 'পীরালি' শাখা পল্লবিত হলো বলে
অনুমান করা হয়।
জগন্নাথ কুশারীই ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ।
বিয়ের দ্বারা তিনি পীরালি সমাজে অন্তর্ভুক্ত হলেন। কুশারীরা, ভট্টনারায়ণের পুত্র, দীন কুশারীর বংশজাত। দীন মহারাজ
ক্ষিতিশূরের নিকট 'কুশ' নামক গ্রাম পেয়ে গ্রামীণ হন। এবং 'কুশারী' নামে পরিচিত হতে
থাকেন। দীন কুশারীর অষ্টম কি দশম পুরুষ পরে জগন্নাথ। জগন্নাথের দ্বিতীয় পুত্র,
পুরুষোত্তম হতে ঠাকুরবংশের ধারা চলছে। অপর তিনপুত্রের ধারা লুপ্ত বা প্রায়লুপ্ত
বলা চলে। পুরুষোত্তমের প্রপৌত্র, রামানন্দের দুইপুত্র, মহেশ্বর ও শুকদেব হতে
ঠাকুর পরিবারের কলকাতায় বসবাস আরম্ভ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন