পঞ্চানন ঠাকুরের জয়রাম ও রামসন্তোষ নামে দুইপুত্র ও শুকদেবের কৃষ্ণচন্দ্র নামে একপুত্র হয়। তিনজনেই ইংরেজ বণিক থেকে কিছু ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন। তা ছাড়া ফার্সি ভাষা তখনকার দিনের মানুষ কম-বেশী সবাই জানত। ১৭৪২ সালে কলিকাতার জরিপকার্য আরম্ভ হলে জয়রাম ও রামসন্তোষ আমিন পদে নিযুক্ত হন। সেই জন্য খুলনায় অবস্থিত তাঁদের পৈত্রিক ভিটা আমিনের ভিটা নামে পরিচিত। তাঁরা কোম্পানির কাজ করে প্রচুর ধনসম্পত্তি উপার্জন করেন। এবং সেই উপার্জিত অর্থ থেকে (ধর্মতলা ও গড়ের মাঠ) বাড়ি, জমিজমা ও যেখানে বর্তমানে ফোর্ট উইলিয়াম আছে, সেখানে গঙ্গাতীরে বাগানবাড়ীটি নির্মাণ করেছিলেন। ১৭৫৬ সালে জয়রামের মৃত্যু হয়। তখন তাঁর স্ত্রী গঙ্গাদেবী, তিনপুত্র (নীলমণি, দর্পনারায়ণ, গোবিন্দরাম), দুই পৌত্র (আনন্দীরামের দুই পুত্র) ও এক কন্যা বিদ্যমান ছিলেন। আনন্দীরামকে, জয়রাম বেঁচে থাকা অবস্থায় ত্যাজ্য করে গিয়েছিলেন। সিরাজদ্দল্লা কলিকাতা আক্রমণ করলে জয়রাম তাঁর অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি, নগরের অন্য সকলের মত ফোর্ট উইলিয়ামে এনে জমা করেন। জয়রামের মৃত্যুর পর, কিছুকাল পরেই নীলমণি প্রমুখ তাঁর ওয়ারিশগণের ধনসায়রের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে নগদে পাঁচহাজার টাকা পান। পলাশী যুদ্ধের পর, মীরজাফর আলি খাঁ বাংলা সুবার নবাব হলে, 'নগর ধ্বংসের ক্ষতিপূরণ' বাবদ মোটা অংকের টাকা ইংরেজ কোম্পানির হাতে সমর্পণ করতে হয়। সেই তহবিল হতে ড্রেক সাহেব জয়রাম আমিনের পুত্রদের হাজার ছয় টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করে দেন। তার মধ্যে জয়রামের নিজস্ব দুইহাজার টাকা ছিল। সর্বসাকুল্য, তের হাজার টাকার মত জয়রামের পুত্রদের হাতে দেওয়া হয়। ১৭৬৪ সালে, জয়রামের পুত্রগণ কলিকাতা গ্রামে পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলে জমি ক্রয় করে বাড়ি নির্মাণ করেন এবং পিতার নির্দেশে, সেই তের হাজার টাকা কোম্পানির কাগজ কিনে গৃহদেবতা শ্রীশ্রীরাধাকান্ত জীউ-এর নামে 'দেবত্র' করে দেন। পরবর্তীতে, সেই টাকার সুদ থেকে পূজাপার্বণের সমস্ত খরচ করা হত।
পাথুরিয়াঘাটায় বাড়ি নির্মাণের পূর্ব হতেই নীলমণি ও দর্পনারায়ণ, সাহেবদের 'দেওয়ানী' বা আজকালকার ভাষায় সেক্রেটারির কাজ করে আরও বেশী অর্থ অর্জন করতে সক্ষম হন। সেকালে ধন হলেই মান হত না। ধনীদের কলিকাতার লোকে বলতো 'বাবু'। জমিদারী ক্রয় করে 'জমিদার' হলেই লোকের আভিজাত্য প্রতিষ্ঠিত হত। নীলমণি তাঁর সুত্রপাত করে যান। অতঃপর তাঁর বংশধরদের মধ্যে রামমণি ওড়িশায় সামান্য রকম জমিদারী ক্রয় করেন। পরবর্তী সময়ে, তাঁর ভ্রাতা রামবল্লভ সেই সম্পত্তির সাথে আরও কিছু সম্পত্তি যোগ করেন। আসলেই ঠাকুর বাড়ি থেকে দ্বারকানাথই জমিদার হন।
পাথুরিয়াঘাটার একান্নবর্তী পরিবারে একদিন ভাঙন ধরে। এখানে অর্থই অনর্থের মুল। নীলমণি ও দর্পনারায়ণের মধ্যে মনোমালিন্য দেখা দিল। পরবর্তী সময়ে, উভয়েই আবার সেই বিরোধ নিস্পত্তি করলেন। নীলমণি, নগদ একলক্ষ টাকা নিয়ে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ও দেবত্র সম্পত্তি কনিষ্ঠ ভাইকে ছেড়ে দিলেন।
আলোচনা মতে জানা যায়, জয়রাম ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র, নীলমণি ঠাকুর হতে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের উদ্ভব। নীলমণি জোড়াবাগানের বৈষ্ণবচরণ শেঠের কাছ থেকে বর্তমান জোড়াসাঁকোর বাড়ির একবিঘা জমি ব্রক্ষ্মত্র প্রাপ্ত হন। ১৭৮৪ সালের জুন মাসের দিকে জোড়াসাঁকোতে ঠাকুর পরিবারের বসবাসের সূত্রপাত হয়। যখন ঠাকুর পরিবার এ পল্লীতে বসবাস শুরু করেন, তখন কিন্তু এ স্থানের নাম জোড়াসাঁকো ছিল না। মেছুয়াবাজার পল্লীর খুব নিকটে হওয়ায় এই স্থানটি ওই নামেই পরিচিতি পেতে থাকে। নীলমণি পরিবার নিয়ে থাকবার জন্য সামান্য কাঁচা-পাকা ঘর গলির মধ্যে নির্মাণ করলেন। নীলমণির তিনপুত্র (রামলোচন, রামমণি ও রামবল্লভ) এবং এককন্যা কমলমণি। সুতরাং, জোড়াসাঁকোতে বসবাস যখন শুরু হয় (১৭৮৪ সালে) নীলমণির সকল পুত্রই তখন বয়স্ক। নীলমণি, তাঁর কন্যার বিয়ে পীরালি সমাজে দেননি। তাঁর সদাচারখ্যাতি ও ততোধিক অর্থখ্যাতি নিষ্ঠাবান হিন্দুপরিবার হতে জামাতা লাভের সহায়তা করেছিল। কিন্ত পুত্রদের বিয়ে পীরালি সমাজেই করতে হত। ১৭৯১ সালে নীলমণির মৃত্যুর পর পরিবারের অভিভাবকত্ব পেলেন রামলোচন। তাঁর চেষ্টায় পরিবারের বিষয়সম্পত্তি আরও অনেক বেশী বৃ্দ্ধি পায়। রামলোচনের কোন পুত্রসন্তান ছিল না। তাই তিনি ভাই রামমণির পুত্র, দ্বারকানাথ ঠাকুরকে দত্তক হিসেবে গ্রহণ করেন। রামমণি দুই বিয়ে করেন। মেনকা দেবীর গর্ভে রাধানাথ, জাহ্নবী দেবী, রাসবিলাসী ও দ্বারকানাথ। এবং দুর্গামণির গর্ভে রমানাথ ও সরস্বতী দেবীর জন্ম হয়।
'২.
[1]'শুকদেব জানতেন সময়ের সাথে অনেক কিছুর বদল ঘটে। তাই তিনি সেই সময়ের জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। দক্ষিণডিহিতে, কন্যার জামাতা পুরুষোত্তমকে আর ঘরজামাই হয়ে থাকতে হবে না। এমন বিশ্বাস তাঁর মনে গেঁথে ছিল পূর্ব থেকেই। তাই তো তিনি জামাতাকে যৌতুক হিসেবে দিলেন 'নরেন্দ্রপুরের উত্তর-পশ্চিম কোণে উত্তরপাড়া গ্রামের সঙ্গে সংলগ্ন বারোপাড়া গ্রাম। সেখানেই নিজস্ব বসতি স্থাপন করলেন পুরুষোত্তম। ঠাকুরবাড়ির কুলপঞ্জিকার হিসাবে সময়টা হচ্ছে ১৪৩২ সাল, এমনটাই জানা যায় চিত্রাদেবের 'ঠাকুরবাড়ির বাহিরমহল' গ্রন্থ থেকে। ভট্টনারায়ণ এই বংশের আদিপুরুষ ছিলেন এবং এই পুরুষোত্তম বিদ্যাবাগীশ মতান্তরে, জগন্নাথ ন্যায়পঞ্চানন ছিলেন কলকাতার ঠাকুর বংশের আদিপুরুষ।' নগেন্দ্রনাথ বসু ও ব্যোমকেশ মুস্তফী প্রণীত 'বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস' শিরোনামের গ্রন্থ থেকে জানা যায়, 'ব্রাহ্মণ কাণ্ড পিরালী ব্রাহ্মণ-বিবরণে' বলা হয়েছে, 'এই অংশ হইতে হঠাৎ মনে হয় বিবাহকারীর নাম পুরুষোত্তম, কিন্তু তাহা নহে, পুরুষোত্তম শব্দটি জগন্নাথের বিশেষণ। কয়েক পুরুষ বারোপাড়া গ্রামে অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন করার পর পুরুষোত্তমের পরিবার স্বাভাবিক নিয়মে বড় হচ্ছিল ঠিকই কিন্তু দিনে-দিনে বাড়ছিল স্থানাভাব এবং অর্থাভাব। তাঁরা ব্রাহ্মণ, কিন্তু 'পতিত' তাঁদের শিষ্য বা যজমান নেই। ব্রহ্মত্র ভূমি লাভের উপায় নেই। টোল খুলে শিক্ষকতা করার উপায় নেই। কেউ-কেউ বলেন, পিরালি ব্রাহ্মণরা উপবীত ধারণের অধিকার হারিয়েছিলেন। এভাবে জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে থাকা নিদারুণ কষ্টের ব্যাপার। পুরুষোত্তমের পঞ্চম উত্তরপুরুষ, মহেশের পুত্র, পঞ্চাননের মনে উচ্চাশা ছিল। গতানুগতিক জীবন যাপনে তাঁর ছিল প্রবল অনীহা। একদিন তিনি, তাঁর সমবয়সী কাকা শুকদেবের সঙ্গে পরামর্শ করে দু'জনে বারোপাড়া গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন অজানার সন্ধানে। লোকমুখে, তাঁরা অবশ্যই শুনেছিলেন ভাগীরথী-তীরবর্তী কোনও গ্রামে একবার পৌঁছোতে পারলে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের আর কোনো কষ্ট হবে না। গৃহত্যাগের সময় পঞ্চানন সঙ্গে নিয়েছিলেন তাঁর গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দন শিলাটিকে। এ ছাড়া নিশ্চয় তাঁদের গলায় ছিল তুলসীকাঠির কণ্ঠি এবং উপবীত। অঙ্গে ছিল ধুতি ও দোবজা বা উড়ুনি। সঙ্গে তাঁদের পরিবার ছিল কি ? মনে হয়, দুজনেই সপরিবারে বেড়িয়েছিলেন। না হলে গৃহদেবতাকে সঙ্গে নিয়ে জাবেন কেন ? যদিও বিদেশে পরিবার নিয়ে যাওয়ার প্রথা এ দেশে ছিল না। পুরুষেরা একাই কর্মস্থলে যেতেন। তবুও সন্দেহ থেকে যায়, শুকদেব ও পঞ্চানন কুশারী, সুভো ঠাকুরের শোনা কথা 'জয়রাম ঠাকুরের পিতা পঞ্চাননও এই কুশারী পদবীধারী হিসাবেই পরিচিত ছিলেন, স পরিবারেই দেশ ত্যাগ করেছিলেন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন