কালান্তর প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ১৩৪০ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ সংখ্যায়। আর গ্রন্থকারে তা প্রকাশিত হয় তার কিছুকাল পরে, ১৩৪৪ সালের বৈশাখ মাসে। রবীন্দ্রনাথ, তাঁর মৃত্যুর কিছু পূর্বে এই লেখাগুলো লিখেছিলেন। এবং এই লেখার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিবোধের ভাবধারার চিহ্ন স্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলা যায়, অনেক লেখাই তাঁর চূড়ান্ত মতামত বলে গণ্য হয়। প্রবন্ধ গ্রন্থটি মূলত, বিশ্বের রাজনৈতিক পটভূমিকায় লিখিত। রবীন্দ্রনাথ কবি হলেও, তাঁর সমকালীন বিশ্বের রাজনৈতিক পটভূমিকা সম্পর্কে তিনি যে সচেতন ছিলেন তার অনেক চিহ্ন আমরা এ-গ্রন্থে দেখতে পাই। প্রবন্ধটি রচনাকালীন সময়ে বিশ্বরাজনীতি এবং ভারতীয় রাজনীতির প্রত্যক্ষ ছাপ এখানে রয়েছে। এখানে স্পষ্ট করে বলা যায় যে, ভারতীয় রাজনীতি তখন এক সন্ধিক্ষণের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। আর রবীন্দ্রনাথ এই সন্ধিক্ষণের নাম দিয়েছেন ‘কালান্তর’। রবীন্দ্রজীবনী, তৃতীয় খণ্ডে, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় আমাদের জানাচ্ছেন, (১৯২৯-১৯৩৪) এই পর্বে, ‘বিরাট পরিবর্তনের সম্মুখে ভারত আজ অত্যন্ত চঞ্চল; রবীন্দ্রনাথ এই অবস্থাকে ‘কালান্তর’ নাম দিয়েছেন।‘ নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘প্রবন্ধটির রচনার পটভূমিকা হল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৯১৮) বেশ কিছুটা পরবর্তীকালের। এই সময়পর্বে, বিশ্বের দু’একটি রাষ্ট্র পরাধীনতা থেকে মুক্ত হল। স্বভাবতই, ভারতবাসীর মধ্যেও এক আশার আলো উদয় হল। নিখিল বিশ্বের এই পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ইংরেজ ভারতবাসীর এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের কোনো চেষ্টাই করলো না। অথচ, বলা যেতে পারে, এই পরিবেশে ইংরেজদের কাছে ভারতবাসীর প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশী। মুসলমান এবং ইংরেজ আমলের শাসনব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা করে রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেখিয়েছেন যে, মুসলমান শাসকগণের তুলনায় ইংরেজ অনেক উদার, শাসিতগণের স্বাধিকার সম্পর্কে সচেতন। ইংরেজরা, ভারতবর্ষে আইনশৃঙ্খলার প্রতিষ্ঠা করেছে ঠিকই, কিন্তু স্বাধীনতা সম্পর্কে তখন অনড় মনোভাবের পরিচয় দিয়ে চলেছে। স্বাধীনতার প্রত্যাশায় ভারতবাসীর মনে যে নতুন যুগের সৃষ্টি হয়েছে, ইংরেজ যদি মনোভাবে সারা না দেয়, তবে তা ইংরেজদের পক্ষেও জূগোচিত কর্ম হবে না। রবীন্দ্রনাথের, এই প্রবন্ধটির সাথে জীবনের শেষের দিকের লেখা প্রবন্ধ ‘সভ্যতার সংকট’-এর ভাবগত মিল রয়েছে। এখানে যাকে বলেছেন ‘কালান্তর’, সেখানেই তাকে আবার রূপ দিয়েছেন ‘সংকট’ আখ্যা দিয়ে। দুই প্রবন্ধের এই যে ভাবগত ঐক্য, যা বিশেষ ভাবে আমাদের চেতনার ধারাকে আরও অনেক বেশী ভাবিত করে তোলে।
রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধসাহিত্য একান্ত ভাবেই তাঁর নিজস্ব ভাব-কল্পনার প্রকাশরীতির মাধ্যম। তাঁর লেখার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা লক্ষ্য করতে পারি যে, প্রবন্ধের গদ্য, রূপক, উপমা, শব্দ নির্বাচন, উপস্থাপনা ইত্যাদি গঠনে আপন কবি সুলভ ভাবধারা প্রস্ফুটিত হয়ে ধরা দেয়। যে দিকটির ধারা আমরা বুদ্ধদেব বসুর লেখায়ও একই ভাবে দেখতে পাই। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে আমরা আরও বলে নিতে পারি, ‘ভারতী’, ‘সাধনা’, ‘প্রবাসী’, ‘নবপর্যায় বঙ্গদর্শন’, ‘ভাণ্ডার’, ‘সবুজপত্র’, ‘বিচিত্রা’ ইত্যাদি পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হতে থাকে। সমসাময়িক নানা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্যিক প্রসঙ্গ নিয়ে এই সব পত্রিকায় জীবনের প্রথম দিক থেকে শেষ দিক পর্যন্ত বৈচিত্র্যময় প্রবন্ধ তিনি লিখে গেছেন। তাঁর প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর কোনো অন্ত নেই। বলা যেতে পারে, এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেননি বললেই চলে। সাহিত্য, সাহিত্যতত্ত্ব, সাহিত্য সমালোচনা, লোকসাহিত্য, ছন্দ, ভাষাতত্ত্ব, বিজ্ঞান, দর্শন, শিক্ষা, অর্থনীতি, রাজনীতি, ভ্রমণকাহিনী, পত্রপ্রবন্ধ, আত্মস্মৃতি ও আত্মজীবনী মুলক ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তাঁর লেখাকে প্রসারিত করেছেন। তাঁর সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, সেই লেখাগুলিতে যেন তাঁর নিজেরই সাহিত্যার্শন ও সাহিত্যের মসৃণ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেই লেখাগুলো কখনও তাঁর নিজস্ব সাহিত্য মূল্য হারায়নি বললেই বলা চলে।
রবীন্দ্রনাথ,
তাঁর কালান্তর গ্রন্থে বলেন,
‘হিন্দু-মুসলমানের
পার্থক্যটিকে আমাদের সমাজে আমরা এতই কুশ্রীভাবে বেআব্রু করিয়া রাখিয়াছি যে, কিছুকাল
পূর্বে স্বদেশী অভিযানের দিকে একজন হিন্দু স্বদেশী-প্রচারক এক গ্লাস জল খাইবেন বলিয়া
তাহাঁর মুসলমান সহযোগীকে দাওয়া হইতে নামিয়া যাইতে বলিতে কিছুমাত্র সংকোচবোধ করেন নাই।
কাজের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার বশে মানুষ মানুষকে ঠেলিয়া রাখে, অপমানও করে-তাহাতে বিশেষ
ক্ষতি হয় না। কুস্তির সময়ে কুস্তিগিরদের গায়ে পরস্পরের পা ঠেকে তাহার হিসাব কেহ জমাইয়া
রাখে না, কিন্তু সামাজিকতার স্থলে কথায় কথায় কাহারও গায়ে পা ঠেকাইতে থাকিলে তাহা ভোলা
শক্ত হয়। আমরা বিদ্যালয়ে ও আপিসে প্রতিযোগিতার ভিড়ে মুসলমানকে জোরের সঙ্গে ঠেলা দিয়াছি।
সেটা সম্পূর্ণ প্রীতিকর নহে তাহা মানি, তবু সেখানকার ঠেলাঠেলিটা গায়ে লাগিতে পারে,
হৃদয়ে লাগে না। কিন্তু সমাজের অপমানটা গায়ে লাগে না, হৃদয়ে লাগে। কারণ, সমাজের উদ্দেশ্যই
এই যে, পরস্পরের পার্থক্যর উপর সুশোভন সামঞ্জসে্র আস্তরণ বিছাইয়া দেওয়া।’
প্রবন্ধগ্রন্থ,
‘কালান্তর’ (১৯৩৭) ও ‘সভ্যতার সংকট” (১৯৪১)-এর মধ্যে কালগত ব্যবধান খুব বেশী নেই, কিন্তু
ভাবগত ব্যবধান রয়েছে অনেক বেশী। বলা যেতে পারে, এই প্রবন্ধের মূলসুর মূলত, উনবিংশ শতাব্দীর
শিক্ষিত ও স্বাধীনতাকামী বাঙালির ইংরেজের প্রতি মনোভাবকে ভিত্তি করে, যদিও ইংরেজের
প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বাঙালি মানসে ফাটল রেখা স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে।
বিশ্বের মানবতাবাদ ও স্বাধীনতার প্রত্যাশা, বিশ্বের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে, যে
এক নব ভাবনার সূচনা করেছে, রবীন্দ্রনাথ তাকেই ‘কালান্তর’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই পরিবর্তন
শুধু যে ভারতবর্ষে ঘটেছে তা কিন্তু নয়, সমগ্র বিশ্বেই সেই হাওয়া বয়ে গেছে। বলা যেতে
পারে, যার চিত্র আমরা প্রবন্ধের বিষয়বস্তুর মধ্যেও দেখতে পাই। এই খানেই প্রবন্ধটির
একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য আমাদের চোখের সামনে ফুটে উঠে। যার পটভূমির বিস্তার সমগ্র পৃথিবীব্যাপী
ছড়িয়ে রয়েছে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্ববোধ ও উদার মানবিকতার বোধ যেন এখানে এসে একই সুত্রে
গেঁথে রয়েছে।
এই বিশ্বব্যাপী ভাবনাটিকে রবীন্দ্রনাথ স্বভাবতই ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে টেনে নিয়ে এসেছেন। অপরিহার্যরূপে এসে পড়েছে শাসক ইংরেজের প্রসঙ্গে ভারতবাসীর সর্বপ্রকার সম্পর্কে উত্থান-পতনের দিক। উত্থান-পতনের দিক বলতে উনবিংশ এবং বিংশশতকের চতুর্থ দশক পর্যন্ত ইংরেজ ভারতবাসীর সম্পর্কের দিককেই বুঝানো হয়েছে। ইংরেজের জ্ঞান পরিপক্ক, স্বাধীনতা, মানবিকতা, ন্যায়-নীতির ধারক বলে একচ্ছ আধিপত্য থাকার কারণে বাঙালিরা খুব কম সময়ে ইংরেজের প্রতি আস্থাশীল হয়ে উঠে। এবং সেই আস্থার জোরেই ভারতবাসীর মধ্যে এই আশ্বাস জাগে যে, স্বাধীনতা, মানবতাবাদী ইংরেজ একদিন আপন উদারতায় ভারত ছেড়ে চলে যাবে। উনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় রাজনীতি, রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য অনুসারে, এই আস্থা আর বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। রাজনীতি বলতে ইংরেজকে তার কর্তব্যটিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। ‘কালান্তর’ প্রবন্ধটিতে, রবীন্দ্রনাথ প্রকারান্তরে সেই মনোভাবেরই জের টেনেছেন। এ-সব দিক বিবেচনা করে যদি বলি, কালান্তরের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপটটা আমাদের চোখের সামনে ধরা পড়ে, তাহলে তাতে কেউ আপত্তি করবেন না বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু কিছু বিশেষজ্ঞ-বিচার উপেক্ষা না করেও তাদের মুখোমুখি আমাদের হতে হয়, এবং তা নিরাসক্ত মন নিয়েই। আরও একটি বিষয় আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় যে, কালান্তরে এসে রবীন্দ্রনাথের ভাব ধারায় যেন নতুন মাত্রার
সন্নিবেশ
ঘটে। এবং সে কারণে এ-বিশেষ মূল্য দাবি করতে পারে এমন ধারণা কতটা যথার্থ, তা কিন্তু
ভেবে দেখা অবান্তর নয়। এখানে একটি কথা স্পষ্ট করে বলে নিতে পারি যে, কালান্তরের
কোন প্রবন্ধ’ই শিল্প-সাহিত্য নির্ভর নয়।
এখানে আমরা স্পষ্ট করে বলে নিতে পারি, কালান্তর রবীন্দ্রমানসের একটি নির্দিষ্ট কালপর্বকে নির্দেশ করে। একজন রবীন্দ্রনাথ এখানে কত ব্যতিক্রমী, সাহসী, যুক্তিপ্রবণ আর তাৎপর্যময় হয়ে উঠেন তা দেখতে পাই এই গ্রন্থের মাধ্যমে। ভাবনার সাথে চিত্ত আর সেখান থেকে যুক্তি যেন দাড়িয়ে তাকে নিয়ে যান আরও অনেক দূরে। রবীন্দ্রনাথ, তাঁর কালের বিস্তার হিসেবে এই প্রবন্ধের রচনাকাল পাওয়া যায় (১৩২১-১৩৪৪) বঙ্গাব্দ পর্যন্ত অর্থাৎ, ১৯১৪ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত। বলে নিতে পারি সুদীর্ঘ এই তেইশ বছর তিনি একাগ্র চিত্তে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন কালান্তরের রচনার সাথে। এখানে সব লেখার উৎসভূমি যে এক তা কিন্তু বলা যাবে না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ছায়া সর্বদা বিদ্যমান। কালান্তরের প্রায় সব প্রবন্ধই সব-সাময়িক কোন না কোন ঘটনার বা নির্দেশনার তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন। কালান্তরের ‘সত্যের আহ্বান’-এ। রবীন্দ্রনাথ বলেন,
‘মানুষের
অন্তঃকরণের ধর্মই হচ্ছে এই, আপনাকে খাটিয়ে কেবল যে তার সফলতা তা নয়, তার আনন্দ; সে
কেবলই উপ্রিতল থেকে গভীরতলে পৌছতে চায়, প্রত্যক্ষ থেকে অপ্রত্যক্ষে, সহজ থেকে কঠিনে,
পরাসক্তি থেকে আত্মকর্তিতে, প্রবৃত্তির তাড়না থেকে বিচারের ব্যবস্থায়। এমনি করে সে
জয়ী হয়েছে। কিন্তু কোনো একদল মানুষ যদি বলে, এই পাথরের ফলা আমাদের বাপ- পিতামহের ফলা,
এ ছাড়া আর যা কিছু করতে যাব তাতে আমাদের জাত নষ্ট হবে, তা হলে একেবারে তাদের মনুয্যত্বের
মূলে ঘা লাগে; তা হলে যাকে তারা জাতরক্ষা বলে তা হতে পারে, কিন্তু তাদের সব চেয়ে যে
বড়ো জাত মনুয্যজাত সেইখানে তাদের কৌলীন্য মারা যায়। আজও যারা সেই পাথরের ফলার বেশী
এগোয়নি মানুষ তাদের জাতে ঠেলেছে, তারা বনে জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়ায়। তারা বহিরবস্থার কাছে
পরাসক্ত, তারা প্রচলিতের জিন-লাগামের টানে চোখে ঠুলি লাগিয়ে চলে, তারা অন্তরের স্বরাজ
পায়নি, বাহিরের স্বরাজের অধিকার থেকে তাই তারা ভ্রষ্ট। এ কথা তারা জানেই না যে, মানুষকে
আপনার শক্তিতে অসাধ্য সাধন করতে হবে। যা হয়েছে তার মধ্যে সে বদ্ধ থাকবে না, যা হয়নি
তার দিকে সে এগোবে, তাল ঠুকে বুক ফুলিয়ে নয়, অন্তঃকরণের সাধনার বলে, আত্মশক্তির উদ্বোধনে।’
কালান্তরের প্রতিধ্বনি শোনা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। সেই পূর্ণাঙ্গ গদ্য রচনা বলে যাকে জানি সেই ‘সভ্যতার সংকট’ পর্যন্ত। বলার ধরন সেই আগের মতোই। এখানেও দেখি, ব্রিটিশ শাসনের শুরুতে তাঁর বিপুল আশার উল্লাস, ও পরে তার আশা ভঙ্গের প্রকারহীন বেদনা। বলা যেতে পারে, রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ইউরোপের অগ্রগতিতে অভিভূত হয়েছেন। তার বাহন হয়ে ইংরেজরা যে এখানে শাসনের অধিকার পেয়েছে, এতে প্রথমজীবনে অনুপ্রাণিতই বোধ করেছেন। কিন্তু এই বোধ তাঁর মধ্যে বেশীক্ষণ স্থায়ী হতে পারেনি। তা আশাভঙ্গের কারণ হয়ে উঠে খুব দ্রুতই। সেই বেদনার কথাও তিনি আমাদের জানান মন খুলে আকুল চিত্তে। আমরা পড়ি, ‘ক্রমে’ ক্রমে দেখা গেল য়ুরোপের বাইরে অনাত্মীয় মণ্ডলে য়ুরোপীয় সভ্যতার মশালটি আলো দেখাবার জন্য নয়, আগুন লাগাবার জন্য।’ ব্যাপারটি কিন্তু আমাদের কাছে আর নতুন হয়ে দেখা দেয় না।
য়ুরোপীয় সভ্যতার বিকাশের প্রতিটি পর্যায়েই এ-ধারা অব্যহত ছিল বলে আমরা ধরে নিতে পারি। কালান্তরের ছ’টি লেখাতে রবীন্দ্রনাথ হিন্দু-মুসলমান নিয়ে তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন। আর নারী ভাবনার চিত্র ফুটে উঠে অন্তত দুটো লেখায়। ‘নারী’ শিরোনামের লেখাতে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘যে সম্বল অনায়াসে পাওয়া যায় তার বিপদ আছে। বিপদের এক কারণ অন্যের পক্ষে ত লোভনীয়। সহজ- ঐশ্বর্যবান দেশকে বলবান নিজের একান্ত প্রয়োজনে আত্মসাৎ করে রাখতে চায়। অনুর্বর
দেশের
পক্ষে স্বাধীন থাকা সহজ। যে পাখির ডানা সুন্দর ও কণ্ঠস্বর মধুর তাকে খাঁচায় বন্দী করে
মানুষ গর্ব অনুভব করে; তার সৌন্দর্য সমস্ত অরণ্যভূমির, এ কথা সম্পত্তিলোলুপরা ভুলে
যায়। মেয়েদের হৃদয়মাধুর্য ও সেবানৈপুণ্য পুরুষ সুদীর্ঘকাল আপন ব্যক্তিগত অধিকারের মধ্যে
কড়া পাহারায় বেড়া দিয়ে রেখেছে। মেয়েদের নিজের স্বভাবেই বাঁধন-মান্য প্রবণতা আছে, সেই
জন্যই এটা সর্বত্রই এত সহজ হয়েছে।’ ভারত ভাবনা বা ভারতচিন্তা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ স্থির
থাকেনি। তার উপর লিখেছেন প্রচুর। জীবনের প্রথমদিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত এ-ভাবনাবোধ রবীন্দ্রনাথকে
তাড়া করে চলেছে। রবীন্দ্রনাথ একই গ্রন্থে ‘বৃহৎ ভারত’ লেখাতে বলেন, ‘তার পর
আর কয়েক বৎসর পরেই পিতা আমাকে সঙ্গে করে হিমালয় পর্বতে নিয়ে যান। আমার পিতাকে এই প্রথম
নিকটে দেখেছি আর হিমালয় পর্বতকে। উভয়ের মধ্যেই ভাবের মিল ছিল। হিমালয় এমন একটি চিরন্তন
রূপ যা সমগ্র ভারতের, যা একদিকে দুর্গম, আর এক দিকে সর্বজনীন। আমার পিতার মধ্যেও ভারতের
সেই বিদ্যা-চিন্তায় পূজায় কর্মে প্রত্যহ প্রাণময় হয়ে দেখা যাচ্ছিল। যা সর্বকালীন, যার
মধ্যে প্রাদেশিকতার কার্পণ্যমাত্র নেই।’ বাতায়নিকের
পত্র -লেখাতে, রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘এক দিকে আমাদের বিশ্বজগৎ, আর-এক দিকে আমাদের
কর্মসংসার। সংসারটিকে নিয়ে আমাদের যত ভাবনা, জগৎটাকে নিয়ে আমাদের কোনো দায় নেই। এইজন্যে
জগতের সঙ্গে আমাদের অহেতুক আত্মীয়তার সম্বন্ধটাকে যতটা পারি আড়াল করে রাখতে হয়, নইলে
সংসারের ভাগে মনোযোগের কমতি প’ড়ে কাজের ক্ষতি হয়। তাই আমাদের আপিস থেকে বিশ্বকে বারোমাস
ঠেকিয়ে রাখতে রাখতে এমনি হয় যে, দরকার পড়লেও আর তার উদ্দেশ্য পাওয়া যায় না।’
কালান্তর গ্রন্থে রবীন্দ্র-দর্পণে সমকালের যে রূপ আমরা দেখতে পাই, তা বিশেষ ভাবে অনুধাবনযোগ্য। সেই রূপকে যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে খুঁজে দেখি যে, ইংরেজদের প্রতি সেই সময়ের শ্রদ্ধা ও আস্থা, এবং ধীরে-ধীরে সেই আশাভঙ্গ। ভারত সমাজের স্বরাজ সাধনার ত্রুটি-বিচ্যুতি। ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সমাজের সমস্যার প্রকৃতি-বিশ্লেষণ ও সমস্যা সমাধানের পথ নির্দেশ। আন্তর্জাতিকতার উৎকর্ষ ও জাতীয়তাবাদের অপকর্ষ-প্রতিবাদন। রবীন্দ্রনাথ, সেই পশ্চিমী জাতীয়তাবাদের সংকীর্নতা ও অনুদারতা দেখিয়ে এর বিরুদ্ধে নিজস্ব অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন সর্বদা। যার চিত্র আমরা শুধু, কালান্তরেই নয়, রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনব্যাপী দেখতে পাই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন