পৌষের শেষের দিকে শীতটা কেমন যেন বেড়ে যাচ্ছে দিন-দিন। মাঘ, তখনও আসেনি। জায়গাটা
নীরব হওয়াতে সব দিকেই কেমন যেন এক প্রকার গভীর নীরবতা বজায় থাকে দিনের
বেশীর ভাগ সময়। রাতে এ-দৃশ্যটা চোখে ধরা পড়ে আরও অনেক বেশী। এমনিতেই,
এ-স্থানটিতে মানুষের আনাগোনা খুবই কম, তার উপর শীততো রয়েছে। ঘন বনে আচ্ছাদিত তার চতুর্দিক।
দিনের বেশীর ভাগ সময়ে সূর্যের মুখ দেখা দেখা যায় না বললেই চলে।
বড়-বড় বৃক্ষের মাথায় সূর্যের উকি মারা অভ্যাসটা আমার চোখ এড়াতে পারে না। মনে
হয়; সূর্য তার মুখ দেখাবার জন্য উকি মারছে। কিন্তু বার-বার যেন ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তার চেষ্টা সে যেন ব্যর্থ করতে চায় না। কয়েকটা মাস এখানে আমার একা থাকা লাগবে ভেবে মনটা বেশ অস্থির
লাগছে। আমি যে বাংলোয় একা থাকি, তাতে আমার তেমন কোন কষ্ট
হয় না। আমার কাজগুলো শেষ হয়ে গেলেই; আমি দ্রুত চলে যাব এখান থেকে। এই ডাকবাংলোয় প্রবেশের পথগুলো সোজা নয়; বেশ আকা-বাকা আর উঁচু-নিচু। এক পথ থেকে অন্য পথে যাওয়া খুব সহজ নয়। অনেকটা পথ
ঘুরে-ফিরে সেখানে পৌঁছতে হয়। বেশ ঢালু প্রকৃতির পথ। মাঝে-মাঝে মনে হয়; রাস্তায় নয়,
যেন পাহাড়ে হাঁটছি। আমার কাজগুলো, আমি সময় মত শেষ করতে পারবো বলে আমার বিশ্বাস।
সকালে এক কাপ চা আর হালকা কিছু নাস্তা করে নিয়েছি। আশা করা যায়, এ-দিয়েই আমি আরও
কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দিতে পারবো। বিশাল এই বাংলোর, সীমানা ছেড়ে আমাকে সপ্তাহে যে কোন
একদিন বাইরে যেতে হয়, নিজ প্রয়োজনে, প্রয়োজনীয় কিছু খাদ্য আর আবশ্যক কিছু জিনিসের
জন্য। প্রতিদিন যদি আমাকে এ-ভাবে বাইরে যেতে হতো, তাহলে খুব তাড়াতাড়ি এখান থেকে
পালাতাম। কিন্তু ভাগ্য ভালো যে, সেটা আমি একদিনেই সম্পূর্ণ করে ফেলি। সেটা হতে
পারে সোম বা মঙ্গল বা রবিবার। এ-রকম হয়তো সপ্তাহের কোন একটা
দিন। আমার সময়ও অনেকটা বেঁচে যায়। কাজের জন্য বেশী একটা সময় পাওয়া যায়। আমার
বেশ ভালোই লাগে। কথা বলার জন্য, কেউ নেই বলে যে; মনটা খারাপ থাকে তা
কিন্তু নয়। কাজের প্রতি বেশী একনিষ্ঠ সময় এটাই বলে আমার মনে হয়। কাজের অবসরে,
অনেকটা পথ আমি একা হেঁটে দেখেছি। জায়গাগুলো চেনার জন্য নয়; নিজের কিছুটা নষ্ট সময়
ব্যয় করার জন্য। বাংলোর সম্পূর্ণটা হয়তো আমার দেখা হয়নি; কিন্তু যতটুকু দেখেছি,
তাতে মনে হয়েছে জায়গাটিকে শহর বা গ্রাম কোনো ভাগেই ফেলা যাবে বা। দু’টোর চমৎকার
একটি মিশ্রণ বলা যাবে এ জায়গাটিকে । একে বলা যাবে, আধো শহর
আর আধো গ্রাম। এ-রকম জায়গা আজকাল চোখে পড়ে না বললেই চলে। এ-রকম স্থানের বর্ণনা আমি
কোন একটা বইয়ে পড়েছি, যা এই মুহূর্তে আমি হয়তো নির্দিষ্ট করে বলতে পারবো না; কার
লেখা কোন বইয়ে পড়েছি। আর বাস্তবে যে তার সাক্ষাৎ এতো তাড়াতাড়ি পেয়ে যাবো তা
ভাবিনি। জায়গাটি এ-রকম হওয়াতে, আমার যে খুব বেশী অসুবিধায় পড়তে হয়েছে তা কিন্তু
নয়। আমার দিনগুলো, আমি কাজের সাথে মিলিয়ে ঠিকই অতিবাহিত করছি। কোথাও বাস করতে
হলে, সবাই যে আমাকে চিনবে বা আমি সবাইকে চিনবো, আমি এটা কখনও মনে করি না। অন্যরা, হয়তো
এটাকে আমার বোকামি ছাড়া আর কিছুই বলবে না। আমরা প্রতিটি মানুষই,
আমাদের মতো করে আমরা বাঁচতে শিখেছি। কেউ পাশে থাকলে; আমার যে খুব ভালো লাগতো, তা
কিন্তু আমি কখনও মনে করিনি। অন্যরা হয়তো এর বিপরীতটা ভেবে নেবে। প্রকৃতি আর আমি;
আমি আর প্রকৃতি, বেশ ভালভাবে মিশে আছি। অন্ততপক্ষে, খুব কাছ থেকে প্রকৃতি দেখার এক
চমৎকার সময় আমার জীবনে এটা, তা আমি মেনে নিতে পারি। এটাকে আমি তাই বলে মনে করি। কাজ
এবং ব্যক্তিগত জীবনের এক চমৎকার মিশ্রণ আমি তৈরি করে নিই, আমার মাঝে। নিজের সাথে
নিজের এক গভীর বন্ধন তৈরি করে ফেলি।
কয়েক মাস তো বেশ কেটে গেল। আমার তো এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়নি, এখানে আমি একা
রয়েছি। কাজের মধ্যে ডুবে থাকলে, কখন যে আমার সময়গুলো মেঘের মত উড়ে যাচ্ছে, তা আমি
খেয়াল করিনি। যেহেতু আমি একা রয়েছি, তাই অনেক কিছু থেকে ভাবনাকেও আমার বিরত
রাখতে হয়। সে হয়তো, আমাকে নিয়েই বেশী ব্যস্ত হওয়ার চেষ্টা করে। যে কয়দিন আছি, আমি মনে
করি আমার জন্য নির্ধারিত সময়ের অনেক পূর্বে কাজগুলো আমি শেষ করে
উঠতে পারবো। অতিরিক্ত সময়ের জন্য আমার হয়তো আর চিন্তা করতে হবে না। কারণ, পূর্বেও,
আমি এ-রকম কাজ করেছি। তাই কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে; এ-কাজে যারা
আমাকে পাঠিয়েছে; তারা খুব ভালো ভাবেই জানেন; এ-রকম কাজ আমার দ্বারাই সম্ভব। আমিও
তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনও মতানৈক্য ভাব প্রকাশ করিনি। কিছু-কিছু কাজ, কিছু
মানুষের জন্য। এ-রকম কাজ সকল মানুষের জন্য নয়। যেমন ভাবে এ-কাজ নির্ধারিত রয়েছে
আমার জন্য। এ-কাজে আমাকে বেঁছে নেওয়ার
সবচেয়ে বড় কারণ এটা যে, আমি মনে করি আমার একা থাকার ব্যাপারটি। অনেকে একা থাকতে
পারে না, এমনকি তারা যদি পারেও, তবু থাকতে চায় না। যা হয়তো, অন্যের পক্ষে তেমন
সুবিধাজনক হবে না বলে তারা মনে করে। বিশ্বাস আর আস্থার ব্যাপার যে নেই এ-কাজের
মধ্যে তা কিন্তু আমি বলবো না। এ-রকম কাজের জন্য, তাঁদের অর্থ ব্যয়ের কোন কমতি নেই;
এটা আমি খুব ভালভাবে জানি। যদি প্রাপ্ত ফলাফল আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠে; তাহলে এ-বার
হয়তো আমার অদেখা ভাগ্যের বড় একটা পরিবর্তন দেখা দিবে। যার জন্য, আমি মনে-মনে
অপেক্ষা করে আছি কয়েক বছর। বড় কোন পরিবর্তন আনার জন্য, যে রকম ভাবে পরিবর্তন আনতে
হয় নিজের ভিতর। আমার এই খণ্ডিত জীবনের সমাপ্তি হয়তো এখানেই শেষ হবে। এটা যে
সম্পূর্ণ সত্য হবে; তা কিন্তু নয়। যেহেতু আমি; অনেকগুলো স্বপ্নের উপর দাঁড়িয়ে আছি।
তাই মনে করি, কয়েকটি স্বপ্ন যদি ওখান থেকে সড়ে পড়ে, তাহলে আরও কিছু স্বপ্ন ওখানে
জমা থাকবে। একটি-কী দু’টো যদি স্বপ্ন জমে থাকে, তার সঙ্গে জীবনকে বেঁধে নিতে
পারবো। রাত যখন গভীর হয়ে আসছিল; কোন ভাবেই ঘুম আসছিল না, ঠিক সেই নষ্ট মুহূর্তে
আমার মনে এই ভাবনাগুলো জড় হচ্ছিল শাদা মেঘের টুকরোর সাথে। মেঘ যেমন এক আকাশ থেকে
উড়ে-উড়ে অন্য আকাশে জমা হতে থাকে; আমার স্বপ্নগুলোকে অনেকটা তার সাথে তুলনা করা
যেতে পারে। যেন মেঘের মতোই উড়ে যাচ্ছে আমার হাত ধরে, চোখের উপর একপ্রকার আলোকধারা
বিছিয়ে। আজ কী বার ? আমি কি নির্দিষ্ট করে বলতে পারবো ! আজ তো কিছু সময়ের জন্য, আমার
এই বাংলোর বাইরে যাওয়ার কথা, সেটা কি আমার মনে আছে। না; ভুলে গেছি। আমি এখানে আসার
পর হিশেব করে দেখেছি, আমার আর কতদিন বাকি আছে ? আমি তো জানি ঢের দিন অবশিষ্ট্য রয়েছে। তা যে এতো দ্রুত স্বপ্নের মতো শেষ হয়ে যাবে তাতো
ভাবিনি। আমি কি জানি, আজ মঙ্গলবার। সপ্তাহের শেষের দিকে আমি এগিয়ে যাচ্ছি। এক
প্রকার নিঃসঙ্গতা যেন আমাকে ঘিরে, ঘুরে-ঘুরে আবর্তিত হচ্ছে। সেটা যে বুঝতে আমার
খুব কষ্ট হচ্ছে তা কিন্তু নয়। আমার কাজের অগ্রগতি কতটুকু?
তা-আমি নিজের কাছেই জিজ্ঞাসা করি। এ-সম্পর্কে কোন সঠিক উত্তর কি আমি পেয়েছি ? আমি,
আমার মধ্যে কিছু প্রস্তুতি নিতে থাকি। যার ফলাফল পূর্বের থেকে অনেক ভালো হবে বলে
আমি মনে করি। শীতটা ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে। প্রকৃতি এবং আমার শরীর অনেকটা তা আমাকে
জানিয়ে দেয়। আমি যে প্রকৃতির মধ্যে ডুবে আছি, এই সব ব্যাপারগুলো আমার চোখে সবার
আগে ধরা পড়ে। কিন্তু আমি খুব বেশী আগ্রহ প্রকাশ করি না এ-ব্যাপারে। দিনগুলো কেমন
যেন শেষ হয়ে গেল; আমার বুঝার আগেই। মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিই, কয়েকদিন খুব বেশী
রাত জাগবো। তা-না হলে আমি কাজগুলো শেষ করতে পারবো না; এবং আজ থেকেই এটা কার্যকর
করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তৈরি করি আমার মধ্যে। অনেক রাত জাগবো, একটা-দুটো-তিনটা ;
এমনও হতে পারে হয়তো, সেটা ভোরেও পরিণত হতে পারে। শরীর ভালো বা মন্দ সেটা ভাবনা
থেকে ঝেড়ে ফেলি। আমি খুব বেশী প্রস্তুতি নিতে থাকি আমার মধ্যে। নির্ধারিত সময়ে তা
শেষ হয় আমার চেষ্টা আর একাগ্রতায়। নিজেকে অনেকটা হালকা আর ভারমুক্ত মনে হতে থাকে।
গরম এককাপ কফি তৈরি করে ফেলি। যেখানে অন্য সময়ে চায়ের উপর নির্ভর করে থাকি। নিজ
থেকেই আজ কফির পেয়ালায় ঠোঁট রাখি। কিছুটা গভীর রাত জাগার জন্য।
২,
আমার বিদায়ের প্রস্তুতি আমি শেষ করে উঠি। আমি তাঁদের কে জানিয়েছি, আমার
কাজগুলো আমি সুচারুরুপে সম্পূর্ণ করে
ফেলেছি; যারা আমাকে এখানে পাঠিয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে খুব বেশী প্রস্তুতি নিতে থাকি;
যেন প্রয়োজনীয় কোন কিছু নিজের ভুলে রেখে না যাই। যেহেতু আমি জানি; এখানে আমার আর
ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। তাই মনে করি, যদি কিছু রেখে যাই, তার সাথে আমার আর
দ্বিতীয় সাক্ষাতের সম্ভাবনা নেই। তাই বসবাসের চতুর্দিকে আমার চোখ রাখতে হচ্ছে খুব
সতর্কভাবে। নিজে কোন ভুল করছি কি-না, সেটাও আমি খুব ভালোভাবে লক্ষ্য রাখি। এ-ভাবে সব
কিছু যখন শেষ করে উঠছি, আমার চোখ গেঁথে থাকে দরজার কর্নারে পড়ে থাকা হলুদ একটি
খামের উপর। আমি সেটা তুলে নিই, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকি
তার উপর স্পষ্ট অক্ষরে খোঁদায়ের মতো লেখা আমার নামের অক্ষরগুলোর দিকে। হাতের লেখার
অক্ষরগুলো আমার খুব বেশী পরিচিত মনে হচ্ছে। কিন্তু আমি যা ভাবছি; তা ঠিক বলে আমার
মনে হচ্ছে না। এটা আমি কীভাবে মেলাবো। আমার সাথে তার তো কোন যোগাযোগ নেই বহু বছর
ধরে। এতো বছর পরেও সে আমাকে মনে রাখবে ? আমি তো তার কথা মনে রাখিনি ! রাখার যে খুব
বেশী চেষ্টা করেছি তা কিন্তু নয়। মাঝে-মাঝে ভাবি, রাখিনি বলে, হয়তো আমি অনেক ভালো
আছি। ডান পাশ থেকে হালকা করে খামের মুখটা ছিঁড়ে ফেলি। এটা যে আমার কাছে লেখা হয়েছে,
তা বুঝে নিতে আমার খুব বেশী কষ্ট হয় না। খামটা রেখে, চিঠিটা আমি পড়তে শুরু করি, ‘খুব
স্বল্প সময়ের জন্য দেশে এসেছিলাম, আমার অনেকগুলো কাজের মধ্যে তোমাকে খুঁজে বের করবো,
এটা আমি অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমার অনেক পরিচিত মুখের মধ্যে, তোমার
মুখটা ছিল অনেক বেশী পরিচিত। শুধু যে পরিচিত ছিল তা কিন্তু নয়। অনেক-অনেক বেশী প্রিয়ও
ছিল। সেটা তুমি খুব ভালোভাবে জানো। আমিও জানি, হয়তো কখনও সেটা
প্রকাশ করনি আমার নিকট। আমি যে বুঝতে পারিনি, তা কিন্তু নয়। সে সময় অনেক কিছু বুঝার
পরও না বুঝার এক চিত্র প্রকাশ পেত আমার মধ্যে থেকে। আমি এটাও জানি যে, এ-সব ব্যাপারে
তুমি খুব বেশী জোরালো ভাব প্রকাশ করনি আমার কাছে। যদি ফিরে তাকাই সেই সব দিনের দিকে,
বলতে পারবে আমাদের সম্পর্কের বয়স কত হলো ? তোমার সাথে আমার যে কোন সম্পর্ক নেই; সেটা
আমি মাথা থেকে কখনও সড়াতে পারিনি। এটা হয়তো আমার একপ্রকার ব্যর্থতা! তাই আজও আমি তোমার
সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকে ঠিক আজকে পর্যন্ত সময় হিশেব করে যাচ্ছি। তোমার ভাষায়, আমাকে
বোকা ছাড়া হয়তো আর কিছুই বলতে পারবে না। তা আমি ঠাণ্ডা মাথায় মেনে নিই। কিন্তু ওই হিসাবের
অঙ্কটাই আমার ভালো লাগে। খুব বেশী সময় পাই না, কিন্তু যতটুকু পাই, ফিরে তাকাই অনেক
বছর পিছনের দিকে। চতুর্দিকে, অনেক-অনেক পরিবর্তন দেখতে পাই। কিন্তু আমার মনটা আজও সেই
জায়গায় পড়ে আছে। নোভাস্কটিয়াতে আছি, দেশ থেকে আসার পর। এখানকার নাগরিকত্ব পেয়েছি অনেক
বছর হলো। তোমার সম্পর্কে কোন কিছুই জানতে পারিনি। পরিচিত যারা ছিল; তারা এখন আমার থেকে
অনেক দূরে। কারও সাথে যোগাযোগ নেই। তোমার একটি কথা আজও মর্মে-মর্মে
উপলব্ধি করি। তুমি প্রায়ই জীবনানন্দের একটি উক্তি আমাকে শোনাতে, ‘কে
হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’, আমি আজও ভুলিনি। আরও বেশী আশ্চায হই
এই ভেবে যে, সেই হৃদয় খোঁড়ার গল্পের সূচনা ঘটে যায় তোমার-আমার জীবনে। যেখানে আমরাই
ডুব দিলাম সবার আগে। বেদনা কতটা গভীর হতে পারে তা-তো তুমিই আমাকে শিখিয়েছিলে। সেই
বিষাদের চিহ্ন আমি আজও বয়ে বেড়াই আমার জীবনে। তুমি যেমন মনে করো সব কিছু খুবই
স্বাভাবিক; যে ভাবনা আমার মাঝে অতো সহজে দেখা দেয় না। প্রথম-প্রথম সব কিছুতেই আমি
এ-রকম মনে করতাম; বাস্তবতা তার থেকে অনেক কঠিন। যা আমার জীবনকে নাড়া দিয়েছিল। আমার
রক্ত-মাংস কতটা উদগ্রীব ছিল তোমার জন্য, তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না। সব শুরুর
যেমন সমাপ্তি রয়েছে- সবাই বলে থাকে। তবে তোমার- আমার সম্পর্কের তো শুরু ছিল ! আর
তার সমাপ্তি ? তুমি কি বিশ্বাস করো তোমার-আমার সম্পর্কের কোন সমাপ্তি কোনদিন ঘটবে।
আর সেটাই যদি হবে; এতো বছর পর কেন তোমাকে আমি মনে রাখতে গেলাম। কষ্ট আর বিষাদের
আগুন মনে করো আমার বুকে একটুকুও নেই ! কিছু ভুল আর পারিপার্শ্বিকতা আমাদের
সম্পর্কের গাঁয়ে মরিচা লাগিয়ে দিয়েছিল।
আমি কতটা সুখী হতে পেরেছি, সেই বিচারে কোনদিন আমি যাব না ! তুমি আমার ত্থেকে
অনেক ভালো আছো, অন্ততপক্ষে, এতটুকু বলতে তো পারবো, কারও জীবন নিয়ে টানাটানি করনি।
নিজে সুখী না হলেও, অন্য কাউকে সেই আগুনে পুড়তে দেউনি। শুধু আমিই পুড়লাম সেই
আগুনে; তার তাপ এতো বছর পরও আমি উপলব্ধি করে যাচ্ছি। কে-কোথায়-কেমন আছে তা কিছুই
জিজ্ঞাসা করবো না। আমরাই তো, আমাদের হারিয়ে ফেলেছি। অন্যরা তাঁদের মতোই তারা থাক। তোমার
ঠিকানা কার থেকে পেলাম; সেটা না হয় অজ্ঞাতই থাক। আর কোনদিন দেখা হবে কিনা জানি না
! কিন্তু আমাদের মাঝে আমরা বেঁচে থাকবো। স্মৃতির আড়ালে যেমন অনেকগুলো স্মৃতি বেঁচে
থাকে, আমিও না হয়, সেই ভাবে তোমার মাঝে বেঁচে থাকবো। ভালো থাকো, অনেক-অনেক বেশী
ভালো থাকো। শুভেচ্ছান্তে দীপা।’
চিঠিটা পড়ার পর আমার মনে হচ্ছে, আমি কি বেঁচে আছি। না-স্বপ্ন দেখছি। স্বপ্নও কী এতো স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়। আবার কিচ্ছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। বাংলোটা ছেড়ে আর কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই আমি বেড়িয়ে পড়বো। কখন যে আকাশে এতো মেঘ জমে উঠলো তা খেয়াল করিনি। এখন যদি বেড় না হই; বৃষ্টিতে ভিজতে হবে আমাকে। মেঘ আর অপেক্ষার কোন সময় দিল না আমাকে; চারিদিকে অন্ধকার করে গাঢ় বৃষ্টি নামতে শুরু করলো। আমি, তার একটু স্পর্শ বা ছোঁয়া নেবার জন্য দাঁড়িয়ে পড়ি মেঘের জমানো অন্ধকারের নিচে। এক-একটি ফোঁটা যেন স্পর্শের ছোঁয়ায় গেঁথে যাচ্ছে আমার শরীরে। বৃষ্টির ফোঁটায় আমার চুল ভিজে যায়, নাক ভিজে যায়, গ্রীবা ভিজে যায়, অশ্রুর কোণাও অনেকটা ভেজে উঠে তার কোমল ফোঁটায়-ফোঁটায়। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি বৃষ্টির নিচে। আমার কি খুব ভালো লাগছে, জানি না। আমার কি খুব খারাপ লাগছে, আমি তাও জানি না, আমি কিছুই জানি না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি সেই ঘন বৃষ্টির মধ্যে। যে আমাকে খুব কোমল ভাবে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আমি কী অপেক্ষায় ছিলাম সেই বৃষ্টির জন্য, যে আমাকে ছুঁয়ে যাবে তার ফোঁটা দিয়ে। নাকি কোনো এক অজানা স্বপ্ন আমাকে নিয়ে যাবে তার নিবিড় গভীরে। যেখানে আমি মিশে যাব কোন এক অজানা ভাললাগা বা ভালবাসায়। আমি যেন মিশে যাচ্ছি অপরূপ কোন এক সৌন্দর্যের মধ্যে। যেখানে ডুবে যাওয়াই যেন আমার নিয়তি। আমি ভাবতে থাকি, আবার নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি। এর মধ্যে বৃষ্টিটা আরও অনেক ভারি হয়ে নামতে থাকে। আমি বাংলোর চাবিটা বুঝিয়ে দিয়ে সেই বৃষ্টির মধ্যেই নেমে পড়ি কোনো এক অজানা গন্তব্যেয়, অজানা মানুষ হয়ে। যে শুধু নিজেকেই চিনে নিতে পারে, হয়তো আবার পারে না। তারপরও সে হারিয়ে খোঁজে নিজেকে আবার নতুন রূপে কোন এক অজানাতে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন