পুকুর
পাড়েই নিঃসঙ্গ ভাবে দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘ তেতুল গাছটি। জানালার ফাঁক দিয়ে সেই তেতুল
গাছটির দিকে তাকিয়ে থেকেছি অনেক সময় ধরে। সকাল, দুপুর বা তা কখনও পৌঁছে গেছে পড়ন্ত
বিকাল পর্যন্ত। সেই তেতুল গাছের শিকড়টা মাটি ভেদ করে এতো দূর পর্যন্ত চলে গেছে যে
তা ভেবে আর কোন কুল কিনারা পেতাম না। অনেকদিন ভাবতাম গাছটা অনেক দূরে, তার শিকড়টা
এতো দূরে কিভাবে আসলো ? তাহলে শিকড় কি চোখে দেখে দেখে এগিয়ে যায় ! অনেকদিন সেই শিকড় ধরে
এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি তার গোরা পর্যন্ত। কিন্তু কোন বারই সফল হয়নি। বার-বার
যেন হারিয়ে গেছি তার মূল থেকেই। কখনই পৌছতে পারিনি তার শেষ সীমা পর্যন্ত। জানালা দিয়ে
পুকুরের সেই পানির দিকে তাকিয়ে থেকেছি আমি অনেকক্ষন ধরে। সেই পানির উপর যখন রোদ
পড়তো, অদ্ভুত লাগতো আমার। মনে হতো সেই আলো পড়া মাত্রই পানির রঙ যেন ভিন্ন রূপ ধারণ
করছে। কখনও একে-বেকে পানির উপর ছোট-ছোট ঢেউ মিশে যেত এপার থেকে ওপার পর্যন্ত। তাকিতে
থাকতাম, রোদ পড়া সেই পানির দিকে। যেন রোদ পেয়ে পানি চিক-চিক করে উঠছে। কত সময় নিতো
সম্পূর্ণ ঢেউটি পানি থেকে হারিয়ে যাওয়ার জন্য। এক মিনিট, দশ মিনিট না একঘণ্টা। তা
আমি মনে করতে পারি না। জানালার এ পাড় থেকেই ওপারটা চোখ মেললেই দেখা যেত। বৈশাখের
কত দুপুর কেটে যেত সেই নিঃসঙ্গ রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে। আষাঢ়ের প্রচণ্ড
বৃষ্টির মধ্যেও আমি তাকিয়ে থাকতাম সেই রাস্তাটির দিকে। সেই সময় চতুর্দিকে যেন বয়ে
যেত করুণ আর ব্যর্থময় এক গভীর নীরবতা। আমি আর সেই নিঃসঙ্গ তেঁতুল গাছটি যেন তাকিতে
থাকতাম আপন করে তার সমস্ত ডাল পালার দিকে। পুকুরের পানি থেকে তেঁতুল গাছের
পাতাগুলো অল্প কিছু উপরে থাকতো। একই ভাবে তাকিতে থাকতাম সেই কেঁপে-কেঁপে উঠা
তেঁতুল পাতা আর ছুঁয়ে যাওয়া পানির দিকে। মাঝে-মাঝে খুব ভাল ভাবে খেয়াল করতাম, একটু
বাতাস পেলে পাতাগুলো আলতো করে পানিকে ছুঁয়ে যেত। এটাকে কি ছোঁয়া বলবো না স্পর্শ
বলবো, মনে-মনে সেটা ভেবে নিই। যদিও দুটো শব্দই আমার কাছে খুব প্রিয়। আমি মনে মনে
বলতে থাকি, ‘তেঁতুল পাতা, তুমি পানিকে ছুঁয়ে যাও’। আবার বলতে থাকি, ‘তেঁতুল পাতা,
তুমি পানিকে স্পর্শ করে যাও’। আমার ভাল লাগতে থাকে শব্দগুলো বার-বার উচ্চারণ করতে।
আমি বলতে থাকি, কয়েকবার বলি, কয়েকশত বার বলি।
তেঁতুল পাতাগুলো এতোই মসৃণ ছিল যে, অনেক ইচ্ছে করতো তাকে ছুঁয়ে যেতে। বাতাসে সেই পাতাগুলো কখনো শব্দ করতো না। শুধুই কেঁপে উঠতো; বাতাসের সাথে সাথে। কিন্তু তাঁকে ছোঁয়ার ইচ্ছাটা আমার অসম্পূর্ণই থেকে গেল। এই ছোট ইচ্ছাটা আমার আর কখনো পূরণ হয়ে উঠেনি। আজও চোখ বন্ধ করলে, সেই কেঁপে উঠা পাতাকে দেখতে পাই আমার মনের কোণে। তারা তো হারিয়ে যায়নি আমার মন থেকে। তাঁদেরকে আমি মনে রেখেছি; তাঁরা কী আমাকে মনে রেখেছে ? জানি না, হয়তো রেখেছে বা হয়তো রাখেনি। আমার স্বপ্নের সাথে তাঁদের নিয়ে আমি এগিয়ে গেছি অনেক দূর পর্যন্ত। যেমন মানুষ হারিয়ে যায়, তার স্বপ্নের গভীরে। আমিও যেন তাঁদের সাথে হারিয়ে যাই স্বপ্নের গভীর থেকে আরও অনেক গভীরে। যেন হারানো কোনো এক অজানা রাজ্যেয়। যেখানে আমরা সবাই হারিয়ে যাই। হারিয়ে যাই আমাদের মধ্যে থেকে। আমাদের কোলাহলময় চতুর্দিক থেকে। আমাদের চোখের ভিতর জমে থাকা নষ্ট-আবর্জনাময় স্বপ্নগুলোকে ছাড়িয়ে, সেখানে জমিয়ে রাখি কোমল আর শুভ্রতার দিকে এগিয়ে যাওয়া নতুন কিছু স্বপ্নকে। তেঁতুল পাতার ছায়া আমার স্বপ্নটিকে অনেক দীর্ঘ করে তোলে। আমি যেন সেই স্বপ্নের ভিতরে হাঁটতে থাকি, কথা বলতে থাকি। কখনও আবার তাঁকে হাত দিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে যেতে খুব বেশি ইচ্ছে করতো। আমি কি ইচ্ছে করলেই গাছটিকে হাত দিয়ে ধরতে পারতাম ? হয়তো পারতাম, হয়তো পারতাম না। কিন্তু আমার খুব বেশি ইচ্ছে করতো গাছের সম্পূর্ণ পাতাগুলোকে যেন হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখি। এটা কি সম্ভব ? বাস্তবে না হলেও আমি আমার স্বপ্নের গভীরে তাদের ছুঁয়ে যাই। অনেকদিন আমি এভাবে তাদের ছুঁয়ে গেছি। যখন চাঁদের আলো, তেঁতুল পাতাকে ভেদ করে তার ছায়া পুকুরে ফেলতো, মনে হতো অনেকগুলো ছায়া আর আলো যেন লুকোচুরি খেলছে। এর মধ্যে হালকা বাতাসে কেঁপে-কেঁপে উঠতো সেই পাতাগুলো। পুকুরের সেই ছায়া আর আলোকে উদ্ভূত লাগতো আমার কাছে। যেন আমি কোন এক স্বপ্নের গভীরে প্রবেশ করছি। তার থেকে একটু দুরেই, পুকুরের কর্নারেই দাড়িয়ে আছে একটি তাল গাছ। তার চতুর্দিকে পুকুরের পানি। গাছটির গোঁড়াতে কোন মাটি নেই। অনেকগুলো শিকড় তাকে শক্ত করে দাড় করিয়ে রেখেছে। যেন কোন ফুল দানিতে সাজানো সেই তাল গাছটি। যখন প্রচণ্ড বাতাস বয়ে যেত, মনে হতো গাছটি বাতাসের ছোঁয়া পাওয়া মাত্রই কাত হয়ে পড়ে যাবে। এভাবে অনেকদিন তাকিয়ে থেকেছি; অনেক বছর কেটে গেল। গাছটি সেই ভাবেই দাড়িয়ে আছে। তার কিছুই হলো না। গাছটি হয়তো ওইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে, আরো কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত। পুরো পুকুরের দিকে আমি যখন তাকিয়ে থাকতাম, তেঁতুল আর তাল গাছটির দিকে আমার দু’চোখের পাতা গেঁথে থাকতো। যেন আমি কোনো এক আশ্চয সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে আছি। এই সৌন্দর্য দেখার জন্য আমার খুব বেশি কষ্ট করতে হতো না। আমার সেই কাঠের জানালা দিয়েই আমি এই সৌন্দর্য দেখতে পেতাম। কখনোও তার দিকে হাত বাড়াতাম, খুব বেশি ভালোবেসে। আবার ভুলে যেতাম, অনেকদিন না দেখে-দেখে। কিন্তু বুকের কোণ থেকে তাকে কখনও মুছে দেইনি। যেভাবে আমি জাগিয়ে রাখি, আমার বুকের কোণে অনেকগুলো লুকানো স্বপ্নকে। তাদেরকে জমিয়ে রাখি মনের কোণে।
প্রচণ্ড বৃষ্টির পর সাতার কেটে-কেটে অনেকবার পৌঁছে গেছি সেই তেঁতুল গাছের তলায়। থোকায়-থোকায় পাকা তেঁতুল ঝুলে থাকতো গাছের সব ডাল জুড়ে। পানির উপর ডালগুলো বিস্তৃত থাকার কারণে মানুষ থেকে তারা অনেকটা রেহায় পেত। বড় হওয়ার সুযোগও পেত অনেক বেশি। অনেক সময় দেখা গেছে গাছ থেকেই কোনো একদিন তারা ঝরে যেত। আমার, আবার খুব বেশি মনে পড়তো বৃষ্টির পর যখন দলবদ্ধ ভাবে পুকুরে গোসল করতে নামতাম পুকুরের সেই বিশাল জলরাশিতে হিম-হিম একপ্রকার উষ্ণতা শরীরে মিশে থাকতো। শরীরে যেন যাদুকরের কোন এক স্পর্শ ছুঁয়ে যেত মুহূর্তে। এভাবে অনেকটা সময় কেটে যেত। কখন যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে আসতো টেরই পেতাম না। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই বুঝে নিতাম। চারিদিকে যেন কোন এক কালো অন্ধকার নেমে আসতো। সবাই তখন উপরে চলে আসতাম। ছোট-ছোট কিছু ভয়ও কাজ করতো মনের ভিতরে। অনেক সময় দেখা গেছে, বেশি সময় পানিতে থাকলে বলতো, পা টেনে নিয়ে গভীর পানিতে নিয়ে যাবে, পরে ঘাড় মটকে শরীরের সমস্ত রক্ত মুহূর্তে খেয়ে নিবে। একা-একা গোসলে নামলে এভাবে নাকি অনেককে পা টেনে নিয়ে গেছে। বড়রা শুনেছে তাদের মা-বাবার কাছ থেকে। এ-গল্প শুনতে শুনতে আমরা বড় হয়ে উঠ। গল্পের সত্যতা নিয়ে কখনও কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। ভাবতে থাকি, গল্পের জায়গায় গল্প থাক, আমার জায়গায় আমি থাকি। কি সত্য কি মিথ্যা তা কখনও বিচার করি নি। শুধু শুনে গেছি কান পেতে। কোন একদিন প্রচণ্ড ঝরে তেঁতুল গাছটি ভেঙে পড়ে সেই পুকুরের পানিতে। অনেকগুলো ডাল-পালা নিয়ে সে যেন ডুবে যাচ্ছে পানির গভীর থেকে আরো অনেক গভীরে। দেখে মনে হতে থাকে, অভিমান করে কোন চিহ্নই যেন সে রাখতে চায় না যে, সে এখানে একদা দাঁড়িয়ে ছিল। দাঁড়িয়ে ছিল তার সমস্ত শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত করে দিনের উজ্জ্বল আলোর মত। তা যেন মুছে যাচ্ছে আমার চোখের কোণ থেকে। তাকে আড়াল করার মত যেন কোন কিছুই নেই আমার সামনে। আমিও এক অবাক বালকের মত তার দিকে তাকিয়ে থাকি, আমার ভরা চোখ নিয়ে। ব্যাপারটি আমার কাছে কেমন লাগলো তা আমি বলে বুঝাতে পারবো না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন