সুন্দর ঘরটিতে রাফিন ঘুরাঘুরি করছে।
সে মাঝে মধ্যে অনেক রাত জাগে; আবার কখনও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমোতে যাওয়া না
যাওয়ার ব্যাপারটি তার নিজের উপর নির্ভর ক’রে। এমনও অনেক সময়
গেছে; সে সারারাত জেগে ছিল, পরীক্ষার পড়ার জন্য; পাশ করার জন্য। রাত জেগে শুধুই পড়েছে। যেকোন ভাবে পরীক্ষায় ভাল তার করতেই হবে। বাড়ির
সবাই ঘুমিয়ে পড়ে; রাত বাড়ার সাথে-সাথেই। অনেকে আবার জেগে থাকে। তাদের বাড়িটি
তিনতলার একটি ছোট দালান। এই দালান বাড়িটি রাফিনের অনেক প্রিয়। প্রিয় এই জন্য যে,
সে এই বাড়িতেই জন্মগ্রহণ করেছে। বেশ কিছু গাছপালা রয়েছে বাড়িটির চতুর্দিকে।
নারকেল, আম, সুপারি আরও কত কি। বেশ কিছুটা খালি জায়গাও রয়েছে, বাড়িটির ভিতরে। সময়
পেলেই আমরা ওখানে খেলাধূলা করি। কিন্তু পরীক্ষার কারণে; আপাতত সব ধরনের খেলাধুলা
বন্ধ রয়েছে। অন্য বন্ধুরা খুব বেশী একটা তাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করে না। যেহেতু, তাদের
সাথে প্রতিনিয়তই দেখা হচ্ছে তার। তাই কারও বাড়িতে কেউ না গেলেও চলে। আজ কয়েকদিন
রাফিনের বেশ রাত জাগতে হচ্ছে। ঘুম আসলেও, সে ঘুমকে বাঁধা দিচ্ছে। সে যেন ঘুমকে
বলছে; ‘ঘুম তুমি আমার উপর ভর ক’র না। সামনে আমার পরীক্ষা, আমাকে একটু পড়াশুনা করতে
দাও। তুমি যদি আমার উপর চলে আসো, তাহলে তো আমার আর কোন সকাল-সন্ধ্যা থাকবে না। রাত
আর দিন কাকে বলে, আমি তাও ভুলে যাব। সামনে যে আমার পরীক্ষা। পরীক্ষায় ভাল না করলে
আম্মু-আব্বু আমার উপর রাগ করবে। তখন কি তোমার ভাল লাগবে, আমার এ-রকম অবস্থা দেখে !
তোমার কি একটুও কষ্ট লাগবে না আমার জন্য ? আমার পরীক্ষা শেষ হোক, তারপর না হয় তুমি
এসো। আমি তোমাকে কিছুই বলবো না’। ঘুমের সাথে কথা বলে, তাকে সে বেশ মানিয়ে নেয়।
এ-বার মনে হয় ঘুম তার কথা রাখবে। ঘুম তাকে বলে যায়, ‘যেহেতু তোমার পরীক্ষা, আমি আজ
যাচ্ছি, খুব কম সময়ের জন্য তোমার সাথে আমার দেখা হবে। আমি তোমাকে বেশী বিরক্ত করবো
না। কিন্তু তোমার পরীক্ষা শেষ হলে, আমি তোমার সাথে অনেক সময় জু’ড়ে থাকবো। তুমি
আমার উপর রাগ করতে পারবে না। আজ তাহ’লে আমি যাচ্ছি, তুমি পড়তে থাকো। সামনে তোমার
পরীক্ষা। আমি চাই তুমি পরীক্ষায় অনেক-অনেক ভালো করো। তাহলে আম্মু-আব্বু তোমার উপর অনেক খুশি হ’বে। এই বলে ঘুম
তার কাছ থেকে বিদায় নেয়।
বাড়ির সবাই যখন ঘুমে ব্যস্ত, রাফিন
তার রুমে মৃদু আলোয় পড়া তৈরি করছে। দেখতে-দেখতে পরীক্ষা কত কাছে চলে এসেছে।
মনে-মনে সে দিন আর বার গুনে যাচ্ছে। সোম-মঙ্গল-বুধ; পাঁচদিন-চারদিন-তিনদিন। এভাবে
সময়গুলো যেন তার অনেক কাছে চলে আসে। পরীক্ষার সময় তার অনেক কষ্ট হয়, এই রাত জেগে
পড়াশুনা করতে। পরীক্ষার এই ব্যস্ততা কমানোর জন্য, সে চেষ্টা
করেছে, সাড়া বছর ধ’রে যা পড়বে, তার থেকে দু’ঘণ্টা বেশী পড়ে রাখবে। কিন্তু এই
প্রতিজ্ঞা সে রাখতে পারেনি, কারণ প্রতিজ্ঞাটি যে, সে নিজের সাথেই নিজে করেছে। এ-রকম
অনেক প্রতিজ্ঞা সে নিজের সাথে করেছে, আবার তা ফিরিয়ে নিয়েছে। মাঝে-মাঝে এর জন্য তার
অনেক কষ্ট লাগে।
অনেক রাত। পড়ার টেবিলে রাফিন পড়ে
যাচ্ছে। পিছে ফেরার সময় পর্যন্ত পাচ্ছে না সে। শুধু মনে-মনে বলতে থাকে, পরীক্ষা আর
পরীক্ষা; আমার কিছুই ভাল লাগে না। কবে যে আমি এই পরীক্ষা থেকে মুক্তি পাবো ! তার
পিছে সে একটা ছায়া অনুভব করছে। মনে হচ্ছে, ছায়াটা তার থেকে অনেক দীর্ঘ হবে। সে কি
একবার ফিরে তাকাবে, সেই ছায়ার দিকে। না-সামনের দিকে তাকিয়ে পড়তে থাকবে। ছায়াটি
কতক্ষণ থেকে এখানে আছে, তা-কি বলতে পারবে সে ? এক ঘণ্টা, দুঘণ্টা, তিন ঘণ্টা বা
তার চেয়ে বেশী সময় ধরে! সে কি জানে ? ছায়াটি কি তার ? কিন্তু তার যদি হয়; তাহলে এত
দীর্ঘ হবে কেন ? সে তো এত বড় নয়। সে জানে, ছায়া মানুষের সমান’ই হ’য়ে থাকে। তার কি
ভয় লাগছে ! সে কি কাউকে ডাকবে ? আব্বু বা আম্মুকে ? না-চুপ করে বসে থাকবে। কিন্তু,
সবাই জানে যে, আমি খুব সাহসী। কাউকে যদি ডাকি, তাহলে তারা জেনে যাবে আমি সাহসী নই,
ভীরু। তাই আমি চুপ ক’রে বসে থাকি। ঘুমকে’তো বুঝিয়ে শুনিয়ে পাঠিয়েছি। কিন্তু ছায়া ?
একে আমি কিভাবে পাঠাবো ? যদি বলে উ’ঠে, আমি যাব না। তাহলে আমি কি করবো ? আমার কি
একটু ভয়-ভয় লাগছে ! আমি কি চিৎকার ক’রে উঠবো। আমি ছায়ার সাথে কথা বলতে থাকি। আমি
বলি, ‘ছায়া তুমি কেমন আছ ? খুব ভাল, না কম ভাল।’ আমি তার কাছ থেকে কোন প্রতিত্তর
পাই না। শুধু তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেও খুব স্পষ্ট হ’য়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি
স্পষ্ট হ’য়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি বলি, ‘ছায়া তুমি কার ? আমার না অন্য কার ?
আমার বেশ জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু, তুমি তো কোন উত্তর দিচ্ছ না। যদি আমার হয়ে থাক
তাহলে, তুমি এত দীর্ঘ কেন ? আমার জানার বেশ ইচ্ছে করছে। তুমি কি কিছুই বলবে না ?
তুমি কি রাগ কর’ছ আমার উপর। না, আমাকে ভয় দেওয়ার জন্য এখানে এসেছ ! কিছু একটা বলো।
অনেকক্ষণ পর আমি একটি শব্দ শুনতে পাই। কিন্তু, এ-কণ্ঠটি কার ? আমার বেশ পরিচিত মনে
হচ্ছে ! না-আমি ভুল শুনছি। ছায়াটি আমার বেশ পরিচিত, কিন্তু আমি মনে করতে পারছি না।
ছায়া কি কথা বলতে পারে ? আমি যদি এই কথা কাউকে বলি, তারা আমাকে পাগল ছাড়া আর কিছুই
বলবে না। কিন্তু এটা আমি অন্যদের কিভাবে বিশ্বাস করাব যে, একটি ছায়া আমার সাথে কথা
বলেছে। এবং এও সত্য যে, ছায়াটি আমার নয়। হয়তো আমারও হতে পারে। আমার মনে হচ্ছে। আমি
কোথায় যেন ভুল করছি ! কিন্তু ভুলটি কোথায় হচ্ছে ? কে আমাকে বলে দিবে ! আমি কি
আম্মুকে ডাকবো। আমার কেমন যেন একটু ভয়-ভয় করছে। এত সব ভাবার পর আমি অনেকক্ষণ পর
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি কোন ছায়া’ই নেই। তাকানো মাত্রই আমার গা কেমন যেন কেঁপে
উঠলো। নিজের চোখকেই আমার অবিশ্বাস মনে হচ্ছে। আমি যতক্ষণ পড়ার টেবিলে বসে পড়েছি,
আমার কেবল এটাই বার-বার মনে হয়েছে, সে যেন আমার কাঁধে হাত রাখছে। আমার মনে হচ্ছে,
আমি কিছু একটা অনুভব করছি। কিন্তু দেখার মতো সাহস আমার মধ্যে কাজ করছে না। আমি যে
কাউকে ডাকবো, কিন্তু আমার কণ্ঠস্বর তাদের কান পর্যন্ত পৌঁছবে না। আমি এর মধ্যে
কয়েকবার ডাক দিয়েছি। কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি। আমি চতুর্দিক তাকিয়ে থাকি। সেই একটি
ছায়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কেউকি আমাকে দেখতে পাচ্ছে। আমি তো তাও জানি না।
আমি শুধু এটুকু বলতে পারবো, কয়েকদিন বাদে আমার পরীক্ষা। আম্মু যদি জানে যে, আমি
পড়া বাদ দিয়ে ঘুম আর ছায়ার সাথে কথা বলছি। তাহলে আমার উপর অনেক রাগ করবেন। কিন্তু
আমি যে ছায়াটি দেখতে পাচ্ছি। এটা আমি মাথা থেকে সরাব কিভাবে ? এখন কত রাত ? আমার
কি ঘুম পাচ্ছে। আমি কি একটু ঘুমিয়ে পড়বো। ঘুমে কি আমার দু’চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ! আমি
গভীর ঘুমের মধ্যে ডুবে যাই। আমার মনে হচ্ছে, আমি যেন কয়েকবছর ঘুমাইনি। আমি তো
সারারাত পড়েছি। কেউ এখন আর আমার উপর রাগ করতে পারবে না।
পরের দিন অনেক বেলা করে আমার ঘুম ভাঙে। আমার মাথার কাছে আম্মু-আব্বু ও আমার ছোট বোন রিতিকে দেখতে পাই। তারা, চতুর্দিক দিক দিয়ে আমাকে ঘিরে রেখেছে। আম্মু, আমার মাথায় পানি ঢালছে। আমার গায়ে নাকি অনেক জ্বর। গতকাল রাতে নাকি জ্বর আরও অনেক বেশী ছিল। আম্মু যখন আমার রুমে যায়, তখন দেখতে পায় আমি নাকি জ্বরের ঘোরে কি বলছি। পরে আমার দিকে এগিয়ে যায়। দেখতে পায় আমার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। পরীক্ষার চিন্তায় আমি নাকি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। আম্মু, ওই সময় আমার রুমে যদি না যেত তাহলে অনেক বড় রকমের দুর্ঘটনা ঘটে যেত। আমি যেন পরীক্ষার আগে সুস্থ হয়ে উঠি, তার জন্য যা কিছু দরকার তারা তাই নিয়েই ব্যস্ত রয়েছে। সবাই আমার ভালোর জন্যই এ-কাজগুলো করছে। আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠি।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন