নদীর পাশে, দাঁড়িয়ে থাকি একা-একা অনেকক্ষণ ধ’রে। আমার স্বপ্নের গভীর
থেকে কে যেন আমাকে ডাক দিয়ে যায়, খুব নীরবে শান্ত ভাবে। তার কোনো শব্দই যেন আমার
কানে পৌঁছে না। আমি তার কোনো উত্তর দিতে পারি না। আমি উত্তর দেওয়ার খুব যে চেষ্টা
করি, তা-ও কিন্তু নয়। চুপ করে তাকিয়ে থাকি; বয়ে যাওয়া নদীর ঢেউয়ের দিকে। তার বহমান
ধারার দিকে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে যেন সব কিছু মুছে যাচ্ছে আমার দু’চোখের কোণ
থেকে। আমি কি তাঁকে ধরে রাখবো ? তার সমস্ত সৌন্দর্য কি ধরা দিবে আমার মধ্যে ! আমার
কি কিছুই বলার নেই এই সৌন্দর্য নিয়ে। নাকি শুধুই দেখে যাব, আমার চোখের কোণে, যা
কিছু এসে জড়ো হয় আপন মনে। আমি কিছু বলি না। আসলে সেই মুহূর্তে আমার বলার মতো কিছুই
ছিল না। সব শব্দমালা যেন আমার মধ্যে থেকে স্তব্ধ হ’য়ে মুছে যাচ্ছে। আমি চারিদিকে
কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। কোন মানুষ নেই এখানে। আমি একা-একা দাঁড়িয়ে আছি। আমি কী
আমাকেও দেখতে পাচ্ছি না ? হয়তো পাচ্ছি, হয়তো আবার পাচ্ছি না। কোন একটা তো অবশ্যই
হবে। আমি অনেক টুকরো-টুকরো মেঘ দেখতে পাচ্ছি। তারা যেন সাদা আকাশটাকে তুলি দিয়ে রঙ
করে যাচ্ছে, নিজের মতো করে। আর আমি সেদিকেই তাকিয়ে আছি অনেকক্ষণ ধ’রে। আমার চোখের
সামনেই একটি সাদা আকাশ কেমন ক’রে যেন কালো হ’য়ে উঠলো। কিছুক্ষণ আগেও, এই জায়গাটি
আমার কাছে খুব মনোরম হ’য়ে দেখা দিয়েছিল। আমি নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছি না, প্রিয়
এই জায়গাটি কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমার কাছে কেন এতো অপ্রিয় হ’য়ে দেখা দিবে। সুন্দর এই নদীটি
কি আমার কাছে নষ্ট হ’য়ে দেখা দিচ্ছে ? তাকে সুন্দর ক’রে দেখার চোখ কি আমি হারিয়ে
ফেলেছি ! হয়তো ফেলেছি, তা-না হ’লে আমি কেন সেই আগের মতো সৌন্দর্যগুলো দেখতে পাচ্ছি
না। চারিদিকে আমি আমার মতো ক’রে তাকিয়ে থাকি, সমস্ত সৌন্দর্য ঢেলে, যতদূর চোখ যায়
! নদীর অই পাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকি, কিন্তু কিছুই আমি দেখতে পাই না। নদী আর সাদা
আকাশে কয়েক টুকরো মেঘ ছাড়া। কেউ নেই আমার আশে-পাশে। যদিও কারও থাকার কথা ছিল না। আমি
একা-একা নীল প্রজাপতির মতো ভাসতে থাকি কোমল বাতাসে। মুহূর্তের মধ্যে কোমল বাতাস দল
আমাকে ছুঁয়ে গেল। আমি বুঝতে পারি, আমি উপলব্ধি করতে পারি; সে আমাকে ছুঁয়ে গেছে। তার
সকল সৌন্দর্য যেন ফু’টে উ’ঠে আমার শরীর জুড়ে। আমি কি এই মুহূর্তে ঘাস ফড়িং হ’য়ে উ’ড়ে
যাব হলুদ সরষের ক্ষেতে ! নাকি মাছরাঙা হ’য়ে দাঁড়িয়ে থাকবো আমার মতো ক’রে, নীরব
হ’য়ে। নাকি কিছুই করতে হ’বে না আমাকে।
আমি, আমার মতো ক’রে নিঃসঙ্গ হ’য়ে দাঁড়িয়ে থাকি, দাঁড়িয়ে থাকি, সকল
সৌন্দর্য নিজের ভেতর নিয়ে। যেন অনেকগুলো বিচ্ছিন্ন সৌন্দর্য আমাকে নিয়ে যাচ্ছে তার
আপন পথে। যেখানে আমি দাঁড়িয়ে থাকি; স্তব্ধ হই, ভাবনার দ্বারা নিজেকে নিয়ে যাই দূর
থেকে অনেক দূরে। মেঘগুলো কি আমার পথে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে ? সে কি আমাকে বাঁধা দিবে
অসুন্দরের দিকে না যাওয়ার জন্য। নাকি বলবে, মেঘের ডানায় উ’ঠে পড়, তোমাকে নিয়ে
বেড়িয়ে আসি লাল-নীল আকাশে, মেঘের ভাঁজে-ভাঁজে সাদা সৌন্দর্যে। আমি আরও কিছু সময়
নিশ্চুপ হ’য়ে দাঁড়িয়ে থাকি। ভাবতে থাকি, আমি কি মেঘে ভর করে উড়ে যাব তার সাথে !
নাকি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবো সারাটি দিন ধ’রে; কালো সন্ধ্যা নামা পর্যন্ত। আমি কি
ভুলে যাব আমার সারাদিনের রুটিনের কথা। আমি অনেকক্ষণ ধ’রে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকি।
মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার খুব ভাল লাগে। যদি অনেক বেশি মেঘ জমতে-জমতে বৃষ্টি শুরু
হয় তাহলে আমি কি করবো ? আশে-পাশে তো কোনো গাছপালা নেই। তাহলে কি আমি বৃষ্টিতে
ভিজতে থাকবো ! আমার কি অনেক ভাল লাগবে বৃষ্টিতে ভিজতে। হয়তো অনেক ভাল লাগবে আবার
না-ও লাগতে পারে। বৃষ্টিতে ভিজা থেকে টিনের চালে ঝুমুর-ঝুমুর বৃষ্টির শব্দ শুনতে
আমার অনেক ভাল লাগে। অনেক সুর থেকেও ওই শব্দ আমার কাছে অনেক সুখকর মনে হয়। ওই শব্দ
থেমে যাওয়ার পরও, অনেকক্ষণ ধ’রে আমার কানে বাজতে থাকে। ছন্দের যাদুর মতো, যেন মনে
হয় কোনো যাদুকর তাঁর সমস্ত যাদু ছড়িয়ে দিচ্ছে। এটা আমার মধ্যে, লক্ষ্য করেছি অনেক
দিন থেকে। যেন এক বিশুদ্ধ সংগীতের সুর আমার মধ্যে বেজে উঠছে। আমি আনমনা হ’য়ে শুনতে
থাকি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুর। অন্য কোন সুর হয়তো এতো সহজে আমার মধ্যে প্রবেশ করে না,
বৃষ্টির সুর যত সহজে করে। আমি ওই ঝ’রে পড়া ফোঁটাকে আর শব্দ বলি না। শব্দ বলতে আমার
ভাল লাগে না, সুর বলতে ভাল লাগে। সুর বললে আমার কান বা বুকের মধ্যে যেভাবে কম্পন
জাগায়, শব্দ বললে অতোটা জাগায় না। ‘সুর’ শব্দটি আমার কাছে অনেক শ্রুতিমধুর লাগে। তাই
আমি বলতে থাকি, বৃষ্টির সুর, বৃষ্টির সুর, বৃষ্টির সুর। সুর বলার সাথে সাথে যেন এক
তীব্র কম্পন আমার মধ্যে বেজে উঠে। আমিও যেন তার সাথে বধির হ’য়ে উঠি। আমি মনে মনে
বলি, বৃষ্টি তুমি নিরর্থক নও, শব্দ তুমি নিরর্থক নও, সুর তুমি নিরর্থক নও, মেঘ
তুমি নিরর্থক নও, মাঘের বাতাস তুমি নিরর্থক নও, জলের হাওয়া তুমি নিরর্থক নও, কুয়াশা
তুমি নিরর্থক নও, পালতোলা নৌকা তুমি নিরর্থক নও, গন্ধরাজ তুমি নিরর্থক নও, ঢেউ
তুমি নিরর্থক নও। আমি যেন আমার মধ্যে আবার শুনতে পাই, কোন এক কঠিন শব্দ চারিদিক
থেকে কেঁপে উঠছে। এটা কি গাঢ় মেঘের শব্দ। নাকি অন্য কিছু। জানার চেষ্টা করি না।
আমি কি বাড়ি ফিরে যাব ? আমার কি বাড়ি ফেরার সময় হয়নি। কেউ কি আমাকে
খুঁজবে না, নাকি তারা বুঝতেই পারেনি, আমি অনেকক্ষণ তাঁদের সামনে ছিলাম না। মেঘের
সাথে পায়ে-পায়ে আমি অনেক দূর পর্যন্ত চলে এসেছি। যদি অন্য কাউকে বলি, আমি মেঘের
সাথে অনেক দূর পর্যন্ত চলে এসেছি, তারা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে ? কেউ কি বিশ্বাস
করবে ? আমি যদি তাঁদেরকে গিয়ে বলি, আমি আজ অনেকক্ষণ মেঘের সাথে কথা বলেছি, তাঁরা
কি আমার কথা মেনে নেবে ? আমি কি এ ব্যাপারটি কাউকে বলে বোঝাতে পারবো !
আমি জানি, আমার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। না করুক, তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি জানি, আজ আমি কি করেছি। বাবাকে গিয়ে বলবো, বাবা রাগ করবে না তো ? আম্মুকে গিয়ে বলবো, আম্মু রাগ করবে না তো। রাফিনকে গিয়ে চুপি-চুপি বলবো, আজ আমি মেঘের সাথে কথা বলেছি। ও আমার কথায় বিশ্বাস করবে। কেননা, আমি ওর বড়। ছোটরা, বড়দের সব কথা সহজেই বিশ্বাস ক’রে নেয়। যে কোন জিনিস, অন্যদের তুলনায় তাঁরা খুব সহজেই মেনে নেয়। আমার এটা ভাবতেই খুব ভাল লাগে। ওকে আমি যে খুব বোকা ভাবি তা কিন্তু নয়, অনেক-অনেক ভালোবাসি। আমি এগোতে থাকি বাড়ির দিকে। যেই পথ দিয়ে এসেছি, ঠিক সেই পথ ধরে এগোতে থাকি। আমাদের বাড়ি এখান থেকে কত দূর, আমি স্পষ্ট করে বলতে পারবো না। কিন্তু আমি জানি, বাড়ির পথে এগোতে থাকলে আমি ঠিকই পৌঁছে যাব। সোজা পথ না ধরে, পুকুরের পাড় ধরে আমি এগোতে থাকি, বাড়ির দিকে, আমাদের বাড়ির দিকে। আমাদের সেই বাড়ীর দিকে, যেখানে আমি বড় হয়ে উঠি। যেখানে আমার সাথেও বড় হয়ে উঠে আমার বুকের অনেকগুলো অজানা স্বপ্ন। যে সব স্বপ্নের মাঝে আমি হারিয়ে যাই সকাল-বিকাল আর সন্ধ্যায়। হারিয়ে যাই পৌষ আর মাঘের হিমে বা আষাঢ়ের ঝরে পড়া রাশি-রাশি বৃষ্টির ফোঁটায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন