সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

কিশোর গল্পঃ ঘড়ির বোবা কান্না

ঘড়িও যে মানুষের মত কাঁদতে পারে এটা মিতু কখনও লক্ষ্য করেনি। তার মনোযোগ ওদিকে যাইনি বললেই চলে। ঘড়ি আবার কাঁদে? একথা কাউকে বললে, তারা আমাকে পাগল বা মাথা খারাপ ছাড়া আর কিছুই বলবে না। কিন্তু ব্যাপারটি আমারও আগে জানা ছিল না। জানা থেকেও যেটি বেশি দরকার ছিল তা হলো খেয়াল করা। হয়তো আমি এবারের মত, এর আগে সেটি খেয়াল করিনি, তাও হতে পারে। ব্যাপারটি বুঝার পর আমি অন্য কারও সাথে আলাপ করিনি। আমার ভাল লাগে যে, অনেকদিন পর হলেও আমি নতুন একটি জিনিস আবিষ্কার করলাম। ব্যাপারটিকে কী আবিষ্কার বলা যাবে ? অন্যরা যা মনে করুক না কেন, আমার ভাষায়, আমার জন্য এটি একটি নতুন আবিষ্কার। ব্যাপারটি ভাবতেই আমার বেশ ভাল লাগছে। কিন্তু এখনতো অন্যদেরও বলতে হবে। কাকে প্রথম বলবো, তা ভাবতে-ভাবতে অনেকটা সময় আমার কেটে গেল। রাতুলকে বলি, ও আমার সব কথাই বিশ্বাস করে। ও জানে যে, আমি যা বলি বা করি তা কখনও মিথ্যা হয় না। কিন্তু যে ব্যাপারটি নিয়ে এত চিন্তা করছি, সেটা আবার একটু ভাল ভাবে পরীক্ষা করা উচিৎ নয় কী ? তাই, নিজে-নিজে আবার সিদ্ধান্ত নিই, আবার একটু মনোযোগ দিয়ে জিনিসটি লক্ষ্য করি। কিন্তু সমস্যা যে একটি আছে। তা কিভাবে সরাব। যদিও এটি তেমন কোন বড় সমস্যা নয়। বাসার সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়বে, আমার জেগে থাকতে হবে। জেগে না থেকে একটু রাত করে পড়া তৈরি করলে তা ঠিক হয়ে যাবে। যদিও আমার তেমন বেশি রাত জাগা হয় না। কিন্তু আমার এই পরীক্ষাটি করার জন্য রাত যত বেশি হবে, ততই তা ভাল হবে। ততই স্পষ্ট হবে আমার মজার ব্যাপারটি। এই জিনিসটি দিনেও ঘটে, আমরা কেউ তা খেয়াল করি না। ব্যাপারটি ভাবতেই অন্যরকম লাগে আমার কাছে। ঘড়ির বোবা কান্না ! মানুষ কি খুব দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদতে পারে ? একটা সময়তো তাদের কান্না থেমে যায়। কিন্তু, ঘড়ির কান্না ? তার কি থামার কোন বালাই নেই। না জীবন থাকা পর্যন্ত কেঁদেই যাবে। একটু সময়ের জন্য হলেও কি থামবে না ? আমি তা স্পষ্ট করে বলতে পারবো না। তা না থামুক, আমার কি। ও কাঁদতে থাক ওর যতক্ষণ ধরে মন চায়। ও ঘণ্টা ধরে কাঁদুক, সপ্তাহ ধরে কাঁদুক, মাস ধরে কাঁদুক, বছর ধরে কাঁদুক। বছরের পর বছর কাঁদুক। আমার কিচ্ছু আসে যাবে না। কিন্তু একটি ব্যাপার হঠাৎ আমার মনের ভিতর দাগ কেটে গেল। আচ্ছা, মানুষ কাঁদলে তাকে কেউ না কেউ সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু ঘড়ি যদি কাঁদে ? ওকে কে সান্ত্বনা দেয় ? খুব কষ্ট লাগলো জিনিসটি ভেবে যে, সান্ত্বনা দেয়ার মত কেউ বুঝি ওর নেই ! ওকি খুব একা ! নিঃসঙ্গ। ওর মা-বাবা বুঝি নেই। তারা কি খেয়াল করে না, ঘড়িটি কেঁদেই যাচ্ছে। আমি তো খেয়াল করছি। ওর ভাই-বোন কি নেই ? তাঁরা কি তাকে সান্ত্বনা দিতে পারে না? ঘড়ির জন্য আমার বেশ কষ্ট পাচ্ছে। এতো কষ্ট এর পূর্বে কারো জন্য আমার লাগেনি। কিন্তু কষ্টের কথাগুলো আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। এর জন্যও আমার মনটা অনেক খারাপ লাগছে।

 

আমার পড়ার রুমের দেয়াল জুড়ে বড় একটা ঘড়ি রয়েছে, সেই আমার ছেলেবেলা থেকে। ওই ঘড়ির দিকেই তাকিয়ে-তাকিয়ে আমি বড় হয়েছি। আজও সুন্দর ভাবে চলে যাচ্ছে। একটা দিনের জন্যও সে কখনো থেমে থাকেনি। আচ্ছা, সে যদি থেমে থাকতো, তাহলে আমাদের সব কিছুই কি থেমে যেত ! তার সাথে পাল্লা দিয়ে। আমার স্কুলে যাওয়া, খাওয়া, পড়া–লেখা, কিংবা দিনের অন্য সব কাজগুলো, যা আমি প্রত্যহ করে থাকি। আমি বই নিয়ে আমার পড়াগুলো শুরু করতে থাকি। এভাবে হয়তো কয়েক ঘণ্টা কেটে যাবে। আমার জন্য বেশ ভালোই হবে। রাতটা আরও গভীর হোক। পরে আমি নিশ্চূপ ভাবে শুনতে পাবো সেই কান্নার শব্দ। শুধুই কান্নার শব্দ। আমার কি খুব বেশি ভাল লাগবে তার কান্নার শব্দ শুনতে ? কারো কি ভাল লাগে, অন্য কারও কান্নার শব্দ শুনতে। আমার কি আসলে খুব বেশি আনন্দ লাগবে ঘড়ির কান্নার শব্দ শুনতে। কেউ কি কখনো অপেক্ষা করে কান্নার শব্দের জন্য ?

 

কিন্তু আমি অপেক্ষার পর অপেক্ষা করে যাচ্ছি সেই কান্নার শব্দ শোনার জন্য। এভাবে অনেকটা সময় কেটে যায়। আমি চতুর্দিকে তাকিয়ে থাকি। সবকিছু কেমন যেন সুনসান আর নীরব হয়ে আঁচছে। আমি উপলব্ধি করতে থাকি, আমি কান পেতে থাকি, আমি নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকি। হ্যাঁ, আমি শুনতে পাচ্ছি। একটি শব্দ যেন গভীর থেকে আরও বেশি গভীর হয়ে আমার কানে বাজতে থাকে। আমি স্পষ্টভাবে শুনতে থাকি, টিক্‌, টিক, টিক। আমি আমার কানটাকে আরও বেশি সজাগ করে তুলি, যেন কোনো ভাবেই আমার শুনার কোন ভুল না হয়। না, আমার কোন ভুল হচ্ছে না। আমি ঠিকই শুনতে পাচ্ছি ঘড়ির সেই বোবা কান্নার শব্দটি। টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক। এই কান্নার শব্দটি যেন আমার কান পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। আমি স্পষ্ট ভাবে শুনতে পাচ্ছি। আমার শোনার মধ্যে কোন প্রকার ভুল নেই। আবার সেই কান্নার শব্দ। টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক, টিক। আমি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকি। এখন কটা বাজে ? রাত ২টা। অনেক রাত। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমিই জেগে আছি। কারও কষ্টের শব্দ শোনার জন্য। কারও নিঃসঙ্গতার সাথে নিজেকে মিলাবার জন্য। আমার কি খুব বেশি ভাল লাগছে ? সেই শব্দের সাথে নিজেকে মেশাবার জন্য ? আসলে আমি কি খুব বোকা ? তা না হলে এত রাত পর্যন্ত জেগে রয়েছি, কারও কষ্টের শব্দগুলো শোনার জন্য। আমার আর ভাল লাগছে না সেই শব্দগুলো কানের কাছে শুনতে। কিন্তু তারপরও স্পষ্ট হয়ে ভেসে আসছে সেই কান্নার শব্দটি। টিক, টিক, টিক, টিক।

 

পরের দিন সকাল বেলা আমি আম্মুকে বলি।

তুমি একটি কাজ করতে পারবা ?

আম্মু বলল, ‘কি কাজ’।

আমি বলি, ‘আমার রুম থেকে ওই ঘড়িটি অন্য রুমে নিতে পারবা’,

আম্মু বলল, ‘কেন ঘড়ি আবার তোকে কি করলো?’

আমি বলি, ‘আমাকে কিছু করেনি, এমনি আমার ভাল লাগছে না, তার জন্য তোমাকে বললাম’।

আম্মু বলে, ‘ওই ঘড়িটি তোর রুমে রয়েছে অনেকদিন থেকে, কখনো তো কিছু বলিস নি’।

আমি বলি, ‘তখন হয়তো আমার ভাল লাগছিল, এখন হয়তো ভাল লাগছে না’।

আম্মু বলে, ‘ঘড়িটি যদি তোর পছন্দ না হয় তাহলে বল, আমি ঘড়িটি পরিবর্তন করে দিই’।

আমি বলি, ‘না আম্মু, পছন্দ-অপছন্দের কোন ব্যাপার নয়’।

আমি বলি, ‘ঘড়িটি তুমি অন্য রুমে নিয়ে যাও’।

আম্মু বলে, ‘তাহলে তুই সময় দেখবি কিভাবে ?’

আমি বলি, ‘পাশের রুম থেকে দেখে আসবো’।

আম্মু বলে, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, তুই যা বলিস’।

 

আম্মু আমার রুম থেকে আমার প্রিয় ঘড়িটি পাশের রুমে নিয়ে যায়। কারণটি কি, তা আমি আম্মুকে কখনো বলিনি। কিন্তু এতটুকু বলতে পারি, সেই গভীর রাতে কান্নার শব্দ আমার আর শুনতে হয় না। কোন কান্নার শব্দই যেন আমার ভাল লাগে না, তা মানুষ কিংবা ঘড়িরই হোক না কেন। এ-রকম কান্নার শব্দ শুনতে শুনতে আমি যেন বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আমার আর ভাল লাগে না। যাক একটি জিনিস থেকে অন্ততপক্ষে নিজেকে রক্ষা করা গেছে। সেই কান্না নামক শব্দটি আমার কানে আর বেজে উঠবে না। আমাকে আর সেই শব্দ শুনতে হবে না। আমার বেশ ভাল লাগে।                   

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রবন্ধঃ বুদ্ধদেব বসু ও ‘কঙ্কাবতী’

বুদ্ধদেব বসু প্রেমের অজস্র কবিতা রচনা করেছেন । অন্য অনেকের মতো তিনিও বেছে নেন একজন প্রেমিকাকে , যে হ ’ য়ে উঠে বুদ্ধদেবের অতুল্য প্রেমিকা হিশেবে । ‘ কঙ্কাবতী ’ অনিন্দ্য প্রেমিকা হ ’ য়ে বুদ্ধদেবের কাব্যতে বিচরণ ক ’ রে স্বচ্ছন্দে । স্থির হয়ে বসে পড়ে কঙ্কাবতী ’ কাব্যগ্রন্থে । যে কাব্যগ্রন্থে ‘ কঙ্কাবতী ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে ‘ কঙ্কাবতীকে ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে কঙ্কাবতীকে আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো কবিতায় । যেখানে সে প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে কুৎসিত কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু নয় । প্রগাঢ় ভাবে প্রাপ্তির জন্যে সমস্ত কবিতা জুঁড়ে দেখতে পাই কবির অপরিবর্তনীয় আবেদন । কঙ্কাবতী , যাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময়ের জন্যে রক্তের হিমবাহে দেখা দেয় চঞ্চলতা । সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হাঁরিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো , যা বলার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন । প্রেমিকা যখন খুব কাছাকাছি হয়ে এগিয়ে আসেন , ওই ব্যর্থ

প্রবন্ধঃ বিষ্ণু দে : ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ থেকে ‘চোরাবালি’

বিষ্ণু দে , তিরিশি কবিদের অন্যতম । কবিতা রচনাই যাঁর কাছে এক এবং অদ্বিতীয় হ ’ য়ে দেখা দেয় । কাব্যে সংখ্যার দিক থেকে অতিক্রম করেছেন সতীর্থদের । বিষ্ণু দে , যাঁর কবিতা রচনার সূচনা পর্বটিও শুরু হয় খুব দ্রুততম সময়ে । কবিতা সৃষ্টির পর্বটি অব্যাহত রেখেছেন সর্বদা । পঁচিশটি কবিতা নিয়ে ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এ নিজেকে প্রকাশ করেন স্ব - মহিমায় । যে কবিতাগুলা বিস্ময়বিমুগ্ধ ক ’ রে অন্যেদেরকেও । ওই কবিতা শুধু বিষ্ণু দে ’ কে নয় , বরং নতুনতর হ ’ য়ে দেখা দেয় বাঙলা কবিতা । বিষ্ণু দে ’ র ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’ রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হয়েছিল দু ’ বার । ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এর কবিতাগুলির রচনাকালের ব্যাপ্তি দেওয়া আছে ( ১৯২৮ - ১৯৩৩ ) সময়ের মধ্যে , এবং গ্রন্থকারে প্রকাশ পায় ওই একই বছরে অর্থাৎ , ১৯৩৩ - এ । কিন্তু রচনাকালের ব্যাপ্তি ১৯২৮ দেওয়া থাকলেও প্রকৃত পক্ষে এ সকল কবিতাগুলো রচনা পর্ব শুরু হয় আরো দু ’ বছর পূর্বে অর্থাৎ , ১৯২৬ - এ । যখন কবি হিশেবে বিষ্ণু দে একেবারেই নতুন এবং নবীন । ১৯৩৩ - এ

প্রবন্ধঃ অমিয় চক্রবর্তী : ‘বৃষ্টি’ নিয়ে তিনটি কবিতা

রবীন্দ্রনাথ, মেঘ-বরষা বৃষ্টি নিয়ে এতো সংখ্যক কবিতা লিখেছেন যে তাঁর সমান বা সমসংখ্যক কবিতা বাঙলায় কেউ লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কবিতায় বার বার এবং বহুবার ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, বরষা, বৃষ্টি। বৃষ্টি নামটি নিলেই মনে পড়ে কৈশোর পেড়িয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটির কথা। ‘দিনের আলো নিবে এল সূর্য্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।’ বৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার কথা মনে পড়লে এটাই চলে আসে আমার মনে। অমিয় চক্রবর্তী বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। বাঙলায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেনি এমন কবির সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় পাই ‘বৃষ্টি’ নামক কিছু সৌন্দর্যময় কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে। ওই কবিদের কারো কারো কবিতা দ্রুত নিঃশ্বাসে পড়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি নামক প্রথম কবিতাটি পাওয়া যাবে অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠোতে’। উন্নিশটি কবিতা নিয়ে গ’ড়ে উঠে ‘একমুঠো’ নামক কাব্য গ্রন্থটি। যেখান থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতায় তুলে নেওয়া হয় চারটি কবিতা। আমার আরো ভালোলাগে ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি ওই তালিকায় উঠে আসে। শ্রেষ্ঠ কবিতায় না আসলে আমার যে খুব খারাপ লাগতে তা-ও নয়। ওই কবিতা