বাঙলা
সাময়িক পত্রের ইতিহাসে; ১৮১৮ সালটি, খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই বছরের এপ্রিলে
প্রকাশিত হয়, বাঙলা ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সাময়িকপত্র, দিগ্দর্শন। প্রথমদিকে, এটি ছিল একটি
মাসিক পত্রিকা; যার সম্পাদক ছিলেন জোশুয়া মার্শম্যানের পুত্র জন ক্লার্ক
মার্শম্যান। এই পত্রিকাটির প্রকাশক হিসেবে নাম পাওয়া যায় শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন প্রেস। দিগ্দর্শন
-এর জীবনকালে মোট প্রকাশিত সংখ্যা ২৬টি। সেগুলো আবার দেখা দেয়, তিনটি বিভিন্ন
সংস্করণে, বিভিন্নরুপে। এর বাঙলা সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১-২৬ সংখ্যা। আবার; ইংরেজি-বাঙলা সংস্করণ দেখা দেয় ১-১৬ সংখ্যাগুলো;
এবং ইংরেজি সংস্করণ হিশেবে দেখা দেয় ১-১৬ সংখ্যাগুলো। দিগ্দর্শন সংবাদপত্র হিসাবে পরিচিত পায়, এটা যেমন সত্য, কিন্তু
সংবাদপত্র বলতে প্রকৃতপক্ষে যা বোঝায়, দিগ্দর্শনে তা ছিল না। এতে সংবাদ
তেমন বেশী খুঁজে পাওয়া যায় না। পত্রিকাটির প্রচার যে খুব বেশী ছিল তা কিন্তু বলা
যাবে না। ২৬টি সংখ্যায় মোট ছাপা হয়েছিল ১০,৬৭৬টি কপি; অর্থাৎ, প্রতিটি সংখ্যা গ’ড়ে
প্রকাশিত হয় চারশো’র কিছু বেশী। দিগ্দর্শনে চিত্র ছিল না বললেই চলে; বেশীর
ভাগ স্থান জু’ড়ে থাকতো বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা। দিগ্দর্শন দীর্ঘস্থায়ী না হলেও প্রথম পত্রিকা হিশেবে পালন
ক’রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দিগ্দর্শন প্রকাশের রয়েছে এক
অজানা ইতিহাস। সে সময়ে প্রশাসকেরা ইংরেজী সংবাদপত্রকে খুব ভাল চোখে দেখত না।
সেজন্য দিগ্দর্শন’কে সংবাদপত্রের পরিবর্তে পরীক্ষামূলকভাবে মাসিকপত্র
হিসাবে প্রকাশ করা হয়েছিল। দিগ্দর্শন প্রকাশের পরেও যখন কোন আপত্তি উঠল না,
তখন মিশনারিরা অন্য নামে একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বের করতে মনস্থ
করেন। ইংল্যাণ্ডের প্রাচীনতম সংবাদপত্র Mirror of News- এর নামানুসারে এর নাম সমাচার দর্পণ রাখা হয়। দিগ্দর্শন-এ
যারা লিখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন, ডঃ কেরী, মিঃ
ওয়ার্ড, ডঃ মার্শম্যান ও তার পুত্র মিঃ মার্শম্যান প্রভৃতি
মিশনারিরা। এছাড়া ছিলেন রামমোহন প্রমুখ এদেশীয় পণ্ডিত ব্যক্তিগণ। রামমোহন রায়ের
লিখিত অনেক প্রবন্ধ প্রথম দিগ্দর্শনে’ই প্রকাশিত হয়েছিল। এ-প্রসঙ্গে
কেদারনাথ মজুমদার বলেন; ‘১৮৫৪ অব্দে জনৈক
মিশনারিসাহেব স্কুল বুক সোসাইটির দ্বারা বঙ্গ-বিদ্যালয়ের ছাত্রদিগের জন্য বঙ্গীয়
পাঠ্যাবলী নামে এক পুস্তক প্রকাশ করেন। আমরা মিলাইয়া দেখিয়াছি সেই প্রবন্ধগুলি
ও দিগ্দর্শনে’র প্রবন্ধগুলি এক। এদেশে প্রথম
পত্রিকা প্রকাশনার ক্ষেত্রে ডাঃ যোশুয়া মার্শম্যান ও তার বড় ছেলে জন ক্লার্ক
মার্শম্যানের অবদান অপরিসীম। ডাঃ মার্শম্যান শ্রীরামপুরে ১৮৩৭ সালের ৫ই ডিসেম্বর
এবং মিঃ মার্শম্যান বিলাতে ১৮৭৭-এর ৮ই জুলাই-এ মারা যান।
বাঙলা
ভাষায় প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র সমাচার দর্পণ ; কিন্তু বাঙলা ভাষায়, বাঙালিদের হাতে পরিচালিত প্রথম
সংবাদপত্রের নাম হিশেবে পাওয়া যায় বাঙ্গাল গেজেটি। শ্রীরামপুরের নিকট বহরা
গ্রাম অধিবাসী গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ছিলেন শ্রীরামপুর মিশন প্রেসের কম্পোজিটর।
ব্যক্তিগত ভাবে, তিনি স্বাধীনভাবে পুস্তক ও পত্রিকা প্রকাশনার ব্যবসা শুরু করার ইচ্ছা
প্রকাশ করেন। যার ফলশ্রুতিতে, ১৮১৮ সালে ‘বাঙ্গাল গেজেটি প্রেস’ নামে একটি
মুদ্রাযন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন কলকাতায়। তার ইচ্ছা এবং একাগ্রতায়; ১৮১৮ সালের জুন মাসে
সাপ্তাহিক আকারে বাঙ্গাল গেজেট প্রকাশিত হয়। এখন স্বাভাবিক ভাবে মনে আসতে
পারে, পত্রিকাটির নাম বেঙ্গল গেজেট হল কেন ? এ সম্পর্কে, সাময়িকপত্র গবেষক কেদারনাথ
মজুমদারের বলেন,
‘এই বাঙ্গালা পত্রিকার নাম
কেন 'বেঙ্গল গেজেট'
রাখা হইয়াছিল তাহার কোন কারণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। বোধহয় সেই সময়
ইংরেজি ভাষা ও ভাবের অত্যধিক প্রভাবহেতু শিক্ষিত ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরাও সে ভাষা ও
ভাবের প্রভাব সহজে অতিক্রম করিতে পারিতেন না। গঙ্গাধর ভট্টাচার্যও বাঙ্গালার প্রথম
সামিয়িক পত্র হিকির বেঙ্গল গেজেট-এর নামের প্রভাব
অতিক্রম করিতে পারেন নাই।’
এ-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে; ১৭৮০ সালে কলকাতা থেকে হিকি সাহেবের
প্রকাশিত প্রথম মুদ্রিত ইংরেজি সংবাদপত্র (James Augustus Hicky) গেজেট নামেই সুপরিচিত ছিল। আর এর থেকেই এর নামকরণ করা হয় বলে অনেকে অনুমান
করেন। পত্রিকাটি দু’বছর বেঁচে ছিল ব’লে অনুমান করা হয়। বেঙ্গল গেজেট পত্রিকাটি
সম্বন্ধে দু’টো তথ্যগত গরমিল চোখে প’ড়ে। প্রথমটি হ’লো, কেদারনাথ
যাকে গঙ্গাধর ভট্টাচার্য বলেছেন তিনি প্রকৃতপক্ষে, শ্রীরামপুরের গঙ্গাকিশোর
ভট্টাচার্য। মুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজে উল্লেখযোগ্য উদ্যমের জন্য গঙ্গাকিশোর একটি
গুরুত্বপূর্ণ নাম, এটা অনেকে অনুমান করেন। অবশ্য, গঙ্গাকিশোর ‘গঙ্গাধর’ নামে
পরিচিত ছিলেন কি-না তা কারও জানা নেই; দ্বিতীয়ত, বেঙ্গল গেজেট প্রকাশনার
সময় নিয়েও কেদারনাথের কিছু অমত রয়েছে। তার মতে; বেঙ্গল গেজেট বাঙলার প্রথম
সাময়িক এবং এটি ১৮১৬ সালে প্রকাশিত হয়। তিনি মনে করেন দিগ্দর্শন প্রকাশিত হয়েছে
বেঙ্গল গেজেটে'র অনেক পরে। এ-সম্পর্কে তিনি মতপ্রকাশ করেন,
‘সেই সময়, ১৮১৬ অব্দে বঙ্গদেশে প্রথম বাঙ্গালা
সাময়িকসাহিত্য ‘বেঙ্গল গেজেট’ পরিচালিত হইতে আরম্ভ করে। সুতরাং বাঙ্গলার
প্রথম সাময়িকসাহিত্য – ‘বেঙ্গল গেজেট’; সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, এই প্রথম বাঙ্গালা পত্রিকাখানা একজন বাঙ্গালি দ্বারা পরিচালিত হইয়াছিল।
ইহার দুই বৎসর পরে ১৮১৮ অব্দে মিশনারিগণ কলিকাতার নিকটবর্ত্তী শ্রীরামপুর হইতে আর
একখানা বাঙ্গালা সাময়িকসাহিত্য পত্র বাহির করিতে আরম্ভ করেন, সে পত্রের নাম ছিল; ‘দিগ্দর্শন’।’ তার আর একটি মত; ‘প্রথম
বাঙ্গালা সাময়িক পত্রিকা ‘বেঙ্গল গেজেট’ জন্মগ্রহণ করিয়া কাল-কবলিত হইলে এক
বৎসর কাল বাঙ্গালা ভাষায় আর কোনো সাময়িক পত্রিকা বাহির হয় নাই। অতঃপর ‘দিগ্দর্শন’
বাহির হয়।’
প্রখ্যাত গবেষক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পত্রিকাটি সম্পর্কে বলেন, বাঙ্গাল
গেজেটি, বাঙালি গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য
পরিচালিত প্রথম বাঙলা সংবাদপত্র। গঙ্গাকিশোর ১৮১৬ সালে; বাঙলা বই ছাপার কাজ
শুরু করেন ঠিকই, কিন্তু 'বাঙ্গাল গেজেটি' ('বেঙ্গল গেজেট') প্রকাশিত হয়েছে ১৮১৮ সালে। সেই সময়ের গেজেট ঘেঁটে তিনি নিশ্চিন্ত হয়েছেন
যে; বাঙ্গাল গেজেটি ১৮১৮ সালের (১৪ই মে/ ৯ই জুলাই) তারিখের মধ্যে কোন একদিন
আত্মপ্রকাশ করে। সমকালে প্রকাশিত ত্রৈমাসিক পত্রিকা ফ্রেণ্ড-অব-ইণ্ডিয়া, ১৮২৯
সালের সেপ্টেম্বর মাসে, দ্বিধাহীনভাবে তাদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে লিখেছেন যে, সমাচার
দর্পণ প্রকাশের, কিছুদিনের মধ্যেই বেঙ্গল গেজেট প্রকাশ পায়। প্রকাশক ও
পত্রিকাটির সম্পাদক হিসাবে গঙ্গাকিশোরের নাম ছাড়াও হরচন্দ্র রায়ের নামও পাওয়া যায়,
যা অনেকে অনুমান করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, হরচন্দ্র রায়-ও ছিলেন শ্রীরামপুরের
অধিবাসী।
কেদারনাথ
মজুমদার; তার বাঙ্গালা সাময়িক সাহিত্য প্রকাশ করেছেন ১৯১৮ সালের কাছাকাছি
কোন এক সময়ে। আলোচ্য পত্রিকাটি বেঙ্গল গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল তারও ১০০ বছর পূর্বে।
বিভিন্ন সূত্রের, সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতেই প্রকাশনার সময় নির্ধারণ করতে হবে।
ব্রজেন্দ্রনাথ যে সব তথ্যসূত্রের উল্লেখ করেছেন; সেগুলি যথেষ্টই নির্ভরযোগ্য।
কিন্তু এ-প্রসঙ্গে মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি রচিত একটি প্রবন্ধের উল্লেখ করা যেতে
পরে। যা প্রকাশিত
হয়েছিল বৈশাখ ১৩০৪ বঙ্গাব্দের নব্যভারত মাসিক পত্রিকায়। সেখানে তিনি বলেন, ‘১২২৫
সালের ১১ই জ্যৈষ্ঠ সমাচারপত্র বিভাগে বঙ্গভাষার দ্বিতীয় পত্রিকাটির জন্ম। এটি সমাচার
দর্পনের ও জ্যেষ্ঠ ছিল। তার নাম বেঙ্গল গেজেট। আরও অনুমান করা হয় যে,
এই পত্রিকাটির বয়স দর্পণ অপেক্ষা
দুই বছরের কিছু বেশী হবে। এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৭ সালে। তবে এখানে
উল্লেখ্য যে, কেদারনাথ মজুমদার সম্ভবত, মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধির প্রবন্ধ থেকেই
তথ্য সংগ্রহ করেছেন। কারণ হিশেবে উল্লেখ্য করা যেতে পারে যে,
বেঙ্গল গেজেট সম্পর্কে, দু’জনই একই
তথ্য উপস্থাপন করেছেন। দু’জনই, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্যের জায়গায় গঙ্গাধর
ভট্টাচার্যের নাম উল্লেখ করেছেন। অনেক তথ্য বিশ্লেষণ ঘেঁটে, গবেষকরা জানিয়েছেন যে,
অনেক অনুসন্ধান করেও বাঙ্গাল গেজেটি'র প্রথম সংখ্যা তো
দূরের কথা, তার কোনো সংখ্যারই উপস্থিতি তাদের দৃষ্টিগোচর হ’য়ে উঠে নি। ১৮১৬ সালে,
গঙ্গাকিশোর কলকাতার Ferris and Company Press-এ, বাঙলা
ভাষার প্রথম পুস্তক অন্নদামঙ্গল প্রকাশ করেন। এ-ছাড়াও তার তত্ত্বাবধানে, গঙ্গাভক্তিতরঙ্গিণী,
লক্ষ্মীচরিত্র, বেতাল পঞ্চবিংশতি,
চাণক্য শ্লোক ইত্যাদি পুস্তকগুলো ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হ’তে থাকে।
এটা আরও লক্ষণীয় যে, দিন-দিন প্রকাশিত ওই গ্রন্থগুলো চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। প্রকাশিত
গ্রন্থ এবং তার চাহিদার সাথে মিল রাখার জন্য গঙ্গাকিশোর কলকাতায় বাঙ্গাল গেজে’টি
প্রেস ও অফিস স্থাপন করেন, এবং বাঙ্গাল গেজেটি'র প্রকাশনা শুরু করেন। এখানে উল্লেখ্য যে, পত্রিকাটির মূল্য ছিল
একটাকা। পত্রিকাটির আয়ুষ্কাল ছিল একবছর।
দুই,
দিগ্দর্শন প্রকাশিত হবার মাসখানেক পরেই, ১৮১৮ সালের ২৩শে মে, প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক সংবাদপত্র সমাচার দর্পণ। দিগ্দর্শন-এর সঙ্গে, এটিরও সম্পাদক হিশেবে নাম পাওয়া যায় জে. সি. মার্শম্যান। পত্রিকাটি, প্রত্যেক শনিবার; শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হ’তে থাকে। জে. সি. মার্শম্যান, নামে মাত্র পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। মূলত, পত্রিকাটি চালাতেন এদেশীয় কিছু পণ্ডিত ব্যক্তি। সমাচার দর্পণ-এর শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৮৪১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর। সমাচার দর্পণ, প্রকাশের সময়েই মিশনারিদের অভ্যন্তরে দেখা দেয় বিভিন্ন মতভেদ। ডঃ কেরি পত্রিকা প্রকাশ ক’রে তাদের রুষ্ট করতে চান নি। পরে স্থির করা হয় যে, প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশিত হবার পরেই, ইংরাজি অনুবাদ সহ, এক কপি গভর্ণমেণ্টকে প্রেরণ করা হবে। এবং–এর ফলশ্রুতিতে, তাদের অনুমতি পেলেই পত্রিকা প্রকাশের কাজ চালিয়ে যাওয়া যাবে। সেই সিদ্ধান্ত অনুসারে, ডঃ মার্শম্যান ভাইস প্রেসিদেন্ত মিঃ এডমনস্টোন, চিফ সেক্রেটারি ও গভর্ণর জেনারেল লর্ড হেস্টিংস সহ, প্রত্যেককে অনুবাদ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা পৌঁছে দেবার জন্য কলকাতার পথে এগিয়ে যান। লর্ড হেস্টিংস, স্বহস্তে চিঠি লিখে মার্শম্যানকে-এদেশে জ্ঞানের বিকাশ প্রসারের জন্য পত্রিকা প্রকাশের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন। তার স্থির বুদ্ধি এবং চিন্তাভাবনার ফলশ্রুতিতে পত্রিকাটির প্রকাশে পরবর্তীতে আর কোন বাধা থাকলো না।
সমাচার দর্পণ, প্রতি শনিবার শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হ’তে থাকে। প্রথম তিন সপ্তাহ, পত্রিকাটি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয় সবার মাঝে। যারা বাঙলা ভাষা জানতেন না, তাদের জন্য একটি ফার্সি সংস্করণও ছাপা হতে থাকে ১৮২৬-এর ৬ই মে থেকে। তবে এটি দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি। ১৮২৯ সালের ১১ই জুলাই থেকে, বাঙলার সঙ্গে সমাচার দর্পণ-এর ইংরেজি সংস্করণও প্রকাশিত হতে থাকে। দিনকে দিন এর চাহিদা বৃদ্ধির জন্য, ১৮৩২ সালের ১১ই জানুয়ারি থেকে, পত্রিকাটি সপ্তাহে দু’বার, অর্থাৎ শনিবার ও বুধবার প্রকাশিত হ’তে থাকে। পূর্বের থেকে কিছুটা বৃদ্ধি করে মূল্য নির্ধারণ করা হয় মাসিক দেড় টাকা। এভাবে বেশী দিন চলতে না পেরে, ১৮৩৪-এর ৮ই নভেম্বর থেকে পত্রিকাটি আবার সাপ্তাহিক রূপে ফিরে আসে।
সমাচার দর্পণে’র পুরানো সংখ্যার দুস্প্রাপ্যতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ের, বিভিন্ন গবেষকদের রয়েছে বিভিন্ন মত । ‘সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা’র ৪র্থ সংখ্যায় (১৩০৫ বঙ্গাব্দ) মহেন্দ্রনাথ বিদ্যানিধি জানিয়েছেন,
‘সমাচার দর্পণে’র
কোন ফাইলই পাইনি। এ-বিষয়ে আমাদের স্নেহাস্পদ সাহিত্যিক
সত্যেন্দ্রনাথ পাইনকে ভার অর্পণ করা হয়। তিনি উত্তরপাড়া লাইব্রেরী ও শ্রীরামপুর
কলেজ-লাইব্রেরীতে বহু অনুসন্ধান করেও কোন সন্ধান পাননি। ওই একই সংখ্যাতে পত্রিকার
আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি আবার বলেন, ১৮৩১-এর ৪ঠা জুন হতে ১৮৩৭-এর ২৮-এ জানুয়ারি পর্যন্ত
যে সংখ্যাগুলির ফাইল, ডাক্তার হেমচন্দ্র চৌধুরীর কাছ থেকে পাওয়া গেল তাতে ইংরেজি ও
বাঙ্গালা দুই ভাষার সমাবেশ রয়েছে। অপরদিকে গবেষক ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন,
‘পুরাতন বাঙলা সংবাদপত্র আজকাল এমনই দুস্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে যে, নানা স্থানে
অনুসন্ধান করেও একমাত্র ‘সমাচার দর্পণে’র প্রায় সকল সংখ্যা এবং ‘সমাচার চন্দ্রিকা’, ‘বঙ্গদূত’ ও
‘সংবাদ পূর্ণচন্দ্রোদয়’ পত্রের কতকগুলি খুচরা সংখ্যা ভিন্ন ১৮৪০ সালের পূর্বের
অন্যকোন সাময়িকপত্র আমি দেখতে পাইনি।’
মূলত,
মিশনারিদের হাতে পরিচালিত সমাচার দর্পণ- এ, বিবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনা হলেও;
অনেক সময়েই তাতে হিন্দু ধর্মের যুক্তিহীনতা এবং খৃষ্টধর্মের মহত্ত্ব প্রতিপন্ন করে,
এ-রকম অনেক লেখা ও চিঠিপত্র প্রকাশিত হতো। এর যথার্থ প্রত্যুত্তর দেবার জন্য বাঙালীদের হাতে
সম্পাদিত একটি পত্রিকার অভাব অনুভব করা হতো। এই উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে, কলুটোলার
দেওয়ান তারাচাঁদ দত্ত ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়; একসঙ্গে মিলে সম্বাদ কৌমুদী
নামে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির প্রথম
সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়, ১৮২১ সালের ৪ঠা ডিসেম্বরে। ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়,
ব্যক্তিগতভাবে লেখক হিসেবে পরিচিত ব্যক্তি ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে কলিকাতা
কমলালয় ও নববাবুবিলাস। রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) প্রকাশ্যে না এলেও,
পত্রিকাটির তত্ত্বাবধানে পালন করেছেন এক অনন্য ভূমিকা। ‘সংস্কৃত প্রেস’ থেকে
পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো; কিন্তু সেই প্রেসের মালিকানা কার হাতে ছিল, তা আজও
অজ্ঞাত। প্রকাশিত লেখার বিষয় হিশেবে পত্রিকাটিতে পাওয়া
যেত বিজ্ঞান, ইতিহাস,
রাজনীতি, সমাজনীতি ইত্যাদি। এ-ছাড়া আরও বিবিধ
বিষয় নিয়ে লেখা প্রকাশিত হতো নিয়মিতভাবে। রামমোহন রায় হিন্দুদের পৌত্তলিকতার
বিরুদ্ধে ‘একেশ্বরবাদ’ সম্পর্কিত প্রবন্ধগুলো প্রকাশিত হতো নিয়মিতভাবে। তার
প্রকাশিত; এ-সমস্ত লেখাগুলো রক্ষণশীল হিন্দুসমাজ ব্যবস্থা ভালভাবে গ্রহণ করেননি।
আট পৃষ্ঠার সম্বাদ কৌমুদী, প্রথমদিকে, সপ্তাহের মঙ্গলবারে প্রকাশিত হতো;
এবং পরে, ১৮২২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারী থেকে মঙ্গলবারের পরিবর্তে প্রকাশিত হতে থাকে শনিবারে।
তারাচাঁদ ও ভবানীচরণ, এ-দু’জন ছাড়াও, তারাচাঁদ দত্তের পুত্র, হরিহর দত্ত ব্যক্তিগতভাবে
পত্রিকাটির সম্পাদনার কাজে যুক্ত হোন।
রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ছিলেন মুক্ত মনের
মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে তিনি সতীদাহ প্রথা সমর্থন করতেন না। প্রচলিত এই নীতির
বিরুদ্ধে প্রবন্ধ প্রকাশের মাধ্যমে মত প্রকাশ করেন তিনি। যার ফলশ্রুতিতে, বন্ধু ও সম্পাদক
ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্বাদ কৌমুদি’র সঙ্গে, তার ব্যক্তিগত
সম্পর্ক ত্যাগ করেন। তখন থেকেই তার মাথায় আসে পৃথক একটি সংবাদপত্র প্রকাশের। কারণ
হিশেবে উল্লেখ করেন, ভবানীচরণ ছিলেন রক্ষণশীল লোক। সহমরণ নিয়ে মতানৈক্যের পরিণামে
ভবানীচরণ আর্থিক দিকটির বিষয়ে হতাশ হ’য়ে পড়েন। হরিহর দত্ত-ও সেই সাথে পত্রিকাটির
পরিচালনার দায়িত্বভার ত্যাগ করেন। এর ফলশ্রুতিতে, মিলিটারি বোর্ড অফিসের কর্মকর্তা
গোবিন্দচন্দ্র কোঙা, পত্রিকাটির দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। কিন্তু ভবানীচরণ সেখানেই
থেমে থাকেননি। তিনি নতুন পত্রিক সমাচার চন্দ্রিকা প্রকাশ করেন। সহমরণ-এর
মতো বিষয়কে কেন্দ্র ক’রে লেখা প্রকাশ এবং রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের বিরোধিতা’র ফলে সম্বাদ
কৌমুদী’র বিক্রি পূর্বের থেকে অনেক কমে আসে। কিন্তু বিক্রি কমে গেলেও পত্রিকাটি একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি। ১৮২৩ সালের
৭ই আগষ্ট থেকে আনন্দচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় সম্বাদ কৌমুদী নতুন ভাবে প্রকাশিত হ’তে থাকে। প্রকাশক
ও মুদ্রাকর হিশেবে নাম পাওয়া যায় গোবিদচন্দ্র কোঙার। ১৮৩০ সালে পত্রিকাটি সপ্তাহে
দু’বার প্রকাশিত হতো। কিছু সময়ের জন্য, হলধর বসু সম্পাদনার কাজ করেছিলেন। পত্রিকাটির
শেষ পর্যায়ের দিকে, সম্পাদক হিশেবে নাম পাওয়া যায়, রামমোহন রায়ের বড় ছেলে
রাধাপ্রসাদ রায়। সম্বাদ কৌমুদী, ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল।
তিন.
সাময়িক বাঙলা পত্রিকার ইতিহাসে, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা একটি উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার ক’রে রয়েছে। ১৮৩৯ সালের ৬ই অক্টোবর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫) তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুররের এই সভার উদ্দেশ্য ছিল: ‘ব্রাহ্ম সমাজ যেন স্থানে-স্থানে স্থাপিত হয়, এবং যে রূপান্তরে সর্বোৎকৃষ্ট পরম ধর্ম বেদান্ত প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার হয়, তার সাধন পরিচালনা করা।’ ১৮৪৩ সালের ১৬ই আগষ্ট, ঐ সভার, অর্থাৎ, ব্রাহ্ম সমাজের মুখপত্র হিশেবে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা প্রকাশিত হ’তে থাকে। হিন্দুধর্মের পৌত্তলিক প্রথা, অবতার তত্ত্ব ও ভাবাবেগকে নিন্দা ক’রে ব্রাহ্মধর্মের মূল আদর্শকে তু’লে ধরা, এই পত্রিকাটির মুখ্য দায়িত্ব দেখা দেয়। সেই সঙ্গে বিজ্ঞান এবং স্ত্রীশিক্ষা বিষয়ক বিবিধ রচনা প্রকাশ পেতে থাকে পত্রিকাটিতে।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ছাড়াও, সে
সময়ে সম্বাদ রসরাজ (১৮৩৯), সংবাদ সুজনরঞ্জন
(১৮৪০) ইত্যাদি যে সব পত্রিকা প্রচলিত ছিল,
সেগুলির বেশীরভাগই, পারস্পরিক বিবাদ ও বিতর্কে লিপ্ত ছিল। এবং এখানে লক্ষণীয় বিষয়
যে, সেই সব পত্রিকায়, প্রায়ই কুরুচিকর ভাষা ব্যবহৃত হতো। ১৮৪২ সালের জুন মাসে
অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০- ১৮৮৬) ও প্রসন্নকুমার ঘোষে’র উদ্যোগে বিদ্যাদর্শন
নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটি ছিল উচ্চ মানের; কিন্তু
মাত্র ছয়টি সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর এটি বন্ধ হ’য়ে যায়। উক্ত পত্রিকাটির
চিত্রভাবনা থেকেই; মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে একটি আদর্শ পত্রিকা প্রকাশ
করার ইচ্ছা জেগে ওঠে। এবং এই ভাবনা থেকেই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র জন্ম। তত্ত্ববোধিনী
পত্রিকা’র ১৮৪৩ সাল থেকে ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত প্রথম সম্পাদক ছিলেন অক্ষয় কুমার
দত্ত (১৮২০-১৮৮৬)। কিন্তু মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্যক্তিগত ভাবে চাইছিলেন,
পত্রিকাটিতে শুধু ধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধই প্রকাশিত হোক; কিন্তু
সম্পাদক অক্ষয় কুমার দত্ত, ওই নির্দিষ্ট লেখা ছাড়াও, বিজ্ঞান বিষয়েও লেখা প্রকাশ
করেন। প্রথমদিকে, এই দায়িত্ব ভার গ্রহণের জন্য তার পারিশ্রমিক ছিল ৩৯ টাকা। তার দক্ষ
পরিচালনার জন্য সেই অর্থ বেড়ে ৪৫ টাকা, এবং আরও পরে, তা পৌঁছে ৬০ টাকা হয়েছিল।
পত্রিকাটির মৌলিক উদ্দেশ্য; অক্ষয়কুমার প্রথম সংখ্যায় বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
তার কয়েকটি এ-রকম,
[ক]. ‘তত্ত্ববোধিনী
সভা’র অনেক সভ্য পরস্পর দূর-দূর স্থায়ী প্রযুক্ত সভার সমুদয় উপস্থিত কার্য
সর্বদা জ্ঞাত হইতে পারেন না, সুতরাং ব্রহ্মজ্ঞানের অনুশীলনা এবং উন্নতি কি প্রকার হইবেক ? অতএব
তাহারদিগের এ সকল বিষয়ের অবগতি জন্য এই পত্রিকাতে সভার প্রচলিত কার্য বিষয়ক
বিবরণ প্রচার হইবেক।’
[খ]. ‘কুকর্ম হইতে
নিবৃত্ত হইবার চেষ্টা না থাকিলে ব্রহ্মজ্ঞানে প্রবৃত্তি হয় না, অতএব যাহাতে লোকের
কুকর্ম হইতে নিবৃত্তি থাকিবার চেষ্টা হয় এবং মন পরিশুদ্ধ হয় এমত সকল উপদেশ
প্রদত্ত হইবেক।’
এ-ছাড়াও মিশনারীদের ক্রমাগত হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে অপপ্রচার রুখতে জনমত গঠন
করা এবং খৃষ্টধর্ম গ্রহণের জন্য মানুষকে প্ররোচিত করার অপচেষ্টাকে প্রতিহত করাও
ছিল উক্ত পত্রিকাটির অপর একটি লক্ষ্য। বলপূর্বক ধর্ম পরিবর্তন এবং সে বিষয়ে তত্ত্ববোধিনী
পত্রিকা’র ভূমিকার একটি সংবাদ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মজীবনী থেকে
জানা যায়। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ লিখেছেন,
‘১৭৬৭-এর
বৈশাখ মাসের একদিন প্রাতঃকালে সংবাদপত্র দেখিতেছি এমন সময় আমাদের হাউসের সরকার
রাজেন্দ্রনাথ সরকার আমার নিকট কাঁদিয়া আসিয়া উপস্থিত হইল। বলিল যে, গত রবিবার
আমার স্ত্রী ও আমার কণিষ্ঠ ভ্রাতা উমেশচন্দ্রের স্ত্রী, দুইজনে
একখানা গাড়িতে চড়িয়া নিমন্ত্রণে যাইতেছিলেন; এমন সময় উমেশচন্দ্র আসিয়া তাহার
স্ত্রীকে গাড়ি হইতে জোর করিয়া নামাইয়া লয়, এবং উভয়ে খ্রীষ্টান হইবার জন্য ডফ
সাহেবের বাড়ীতে চলিয়া যায়। আমার পিতা অনেক চেষ্টা করিয়া তাহাদিগকে সেখান হইতে
ফিরিয়া আনিতে না পারিয়া,
অবশেষে সুপ্রীমে কোর্টে নালিশ করেন। নালিশে সে-বার আমাদের হার হয়। কিন্তু আমি
ডফ সাহেবের নিকটে গিয়া অনুনয় বিনয় করিয়া বলিলাম যে, আমরা আবার
কোর্টে নালিশ আনিব। দ্বিতীয়বার বিচারের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আমার ভ্রাতা ও
ভ্রাতৃবধূকে খ্রীষ্টান করিবেন না। কিন্তু তিনি তাহা না শুনিয়া গত কল্যই সন্ধ্যার
সময় তাহাদিগকে খ্রীষ্টান করিয়া ফেলিয়াছেন।’
এই বলিয়া
রাজেন্দ্রনাথ কাঁদিতে লাগিল। এর পর রাজেন্দ্রনাথের অনুরোধে অক্ষয়কুমার দত্তকে
অনুরোধ করেন একটি জোরালো প্রতিবাদ তুলে ধরার জন্য। দেবেন্দ্রনাথের ভাষায়, আমি
অক্ষয়কুমারের লেখনীকে চালাইলাম এবং একটি তেজস্বী প্রবন্ধ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে
প্রকাশ হইল।’ অত:পর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা সংগঠিত হয় এবং সিদ্ধান্ত
হয় যে মিশনারি স্কুলে ছেলেদের পড়াশোনা বন্ধ করতে বিনা বেতনে পড়বার জন্য একটি
দেশী বিদ্যালয় স্থাপন করা হবে। চল্লিশ হাজার টাকা অনুদান সংগৃহীত হয়। মহর্ষি
জানিয়েছেন আরও জানিয়েছেন-এই অবৈতনিক বিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক শ্রীযুক্ত ভূদেব
মুখোপাধ্যায় নিযুক্ত হন। সেই অবধি খ্রীষ্টান হইবার স্রোত মন্দীভূত হইল। একেবারে
মিশনরিদিগের মস্তকে কুঠারাঘাত পড়িল।
অক্ষয়কুমার দত্তের পর, পর্যায়ক্রমে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮৫৬); নবীনকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৫৭); সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৫৯-৬০); তারকনাথ দত্ত (১৮৬১); আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ (১৮৬২ ); প্রতাপ চন্দ্র মজুমদার (১৮৬৩); অযোধ্যানাথ পাকড়াশী (১৮৬৪-৬৬, ১৮৬৯, ১৮৭২-৭৭); হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১৮৬৭-৬৮, ১৮৭৮-৮৩, ১৯০২); দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭০, ১৮৮৪-১৯০১, ১৯০৬); অযোধ্যানাথ পাকড়াশী ও আনন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৭১) ; দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন (১৯০৩-০৫); দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও চিন্তামনি চট্টোপাধ্যায় (১৯০৯-১০); রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১১-১৪); সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯১৫-২১); ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯২২-২৫), ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বনোয়ারী লালচৌধুরী ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯২৬-২৯); ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বনোয়ারী লালচৌধুরী (১৯৩০), ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৩১), তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র সম্পাদনার কাজ করেছেন।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র সম্পাদক নির্বাচনের জন্য রীতিমত পরীক্ষা নেওয়া হতো। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইচ্ছুক প্রার্থীদের মধ্যে থেকে বেদান্ত ধর্মনুযায়ী সন্ন্যাস ধর্মের এবং সন্ন্যাসীদের প্রশংসা- বিষয়ে একটি প্রবন্ধ রচনার আহ্বান করেন। অক্ষয়কুমার দত্ত, ভবানীচরণ সেন প্রমুখ ব্যক্তিরা রচনা তৈরির গুরুদায়িত্ব পালন করতেন। এদের মধ্যে অক্ষয়কুমারের রচনাই উৎকৃষ্ট বিবেচিত হওয়ায় তিনিই সম্পাদক পদে মনোনীত হন। পরে বহু বিষয়ে মহর্ষির সঙ্গে অক্ষয়কুমারের মতবিরোধ ঘটলে, মহর্ষি অক্ষয়কুমারের মতই গ্রহণ করেন, এবং পরিশেষে অক্ষয়কুমারের গুণগ্রাহী হ’য়ে ওঠেন।
মুলতঃ সাধুভাষায় লিখিত পত্রিকার রচনাগুলি ভাষার প্রেক্ষিতে পরবর্তী অনেকের
কাছেই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়েছিল। তবে সে সময়ে ব্যবহৃত ‘তোমারদিগের’, ‘আমারদিগের’, ‘করিবেক’, ‘যাইবেক’
প্রভৃতি শব্দগুলি অক্ষয়কুমার নিজ দায়িত্বে তার পরিবর্তন আনয়ন
করেন।
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র উৎকর্ষ ও
বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে কেদারনাথ মজুমদারের (১৮৭০-১৯২৬) লেখা থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া
যাক :
‘তত্ত্ববোধিনী’র
প্রচার হইতেই প্রকৃত প্রস্তাবে বাঙ্গালা দেশে প্রকৃত বাঙ্গালা সাহিত্যের আলোচনা
আরম্ভ হয়। তত্ত্ববোধিনী’র পূর্বে যে সমস্ত পত্র-পত্রিকায় সাহিত্যালোচনা
হইত, প্রকৃতপক্ষে
তাহাতে শিক্ষণীয় বিষয় কিছুই থাকিত না। বাদ-প্রতিবাদ, ছড়া-কবিতা
এবং হাসি-ঠাট্টাই সে গুলির আলোচ্য বিষয় ছিল। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা বাঙ্গালা
সাহিত্যের আসরে গুরুগম্ভীর আসন লইয়া উচ্চ দর্শন বিজ্ঞান ও নৈতিক আলোচনার সূত্রপাত
করিলেন। অক্ষয়কুমারের সংগৃহীত ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ ভাবসমূহ তাঁহার তেজস্বিনী ও
হৃদয়গ্রাহিণী ভাষায় প্রচারিত হইতে লাগিল। অক্ষয়কুমারের সহিত বিদ্যাসাগর মিলিত
হইলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের মধুর লেখনী নিঃসৃত মহাভারতের অমৃত সমান কথা তত্ত্ববোধিনী’র
অঙ্গে সোনায় সোহাগার কার্য করিল। তারপর রামমোহন রায়ের অপ্রকাশিত গ্রন্থসমূহ, মহর্ষি
দেবেন্দ্রনাথের উপনিষদের অনুবাদ ও ব্রাহ্মধর্ম্ম সম্বন্ধীয় প্রবন্ধাবলী, রামচন্দ্র
বিদ্যাবাগীশের ব্রাহ্মধর্ম ব্যাখ্যান ও রাজনারায়ন বসুর বক্তৃতা এবং তত্ত্বকথা তত্ত্ববোধিনী’কে
সহজেই সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হইল।’
তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’য় প্রকাশের
উপযুক্ত প্রবন্ধ নির্বাচনের জন্য বিদ্বজ্জনদের নিয়ে একটি নির্বাচক মণ্ডলী তৈরী
হয়েছিল। এতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ন বসু , রামমোহন
রায়ের পুত্র রাধাপ্রসাদ রায়, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর , আনন্দকৃষ্ণ বসু প্রমুখ বিখ্যাত
ব্যক্তিবর্গ। এখানে উল্লেখ্য যে, বিদ্যাসাগর তার মহাভারতের উপক্রমণিকা এই
পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন। অক্ষয়কুমারের সম্পাদনাকালে তত্ত্ববোধিনী’র
গ্রাহক সংখ্যা হয়েছিল ৭০০। অক্ষয়কুমারের পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর তাকে স্কুল সমূহের সহকারী পরিদর্শকের পদ গ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ করেন; কিন্তু
পত্রিকার সম্পাদনায় তিনি তখন এতই নিবেদিত যে; দেড়’শ টাকা পারিশ্রমিকের পদ তিনি
অনায়াসেই প্রত্যাখান করেন। কিন্তু এটা ছিল নিতান্তই সাময়িক। ১৮৫৪ সালে কলকাতায়
নর্ম্যাল স্কুল স্থাপিত হলে শিক্ষাবিভাগের নির্দেশক ইয়াং সাহেবের আবেদনে সাড়া
দিয়ে তিনি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। সম্পাদকের পদ থেকে
অক্ষয়কুমারের বিদায় গ্রহণের পরেই তত্ত্ববোধিনী’র চাহিদা ক্রমশঃ কমতে
থাকে। ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা একটি
উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ পড়ে ব্রজসুন্দর
মিত্র ব্রাহ্মধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ঢাকায় ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে অগ্রণী
ভূমিকা গ্রহণ করেন। ফুলস্কেপ কাগজের আকারে প্রকাশিত তত্ত্ববোধিনী
পত্রিকা’র পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল আট থেকে বার। তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যদের জন্য
মূল্য ছিল বার্ষিক তিন টাকা। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় ছিল তত্ত্ববোধিনী
পত্রিকা প্রকাশের ভূমিকা।
চলার পথে পত্রিকাটির অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। যেমন, বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। পুস্তক
সমালোচনার একটি বিভাগ যুক্ত হয়েছে। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছিল।
ক্ষিতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর এটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ প্রায় ৯০ বছর ধ’রে
চলার একটি কারণ, পত্রিকাটি
ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তির সমর্থন ছিল এটির পিছনে
এবং অর্থের যোগানদাতার তেমন কোন অভাব ঘটে নি।
চার.
পাঠকসমাজকে গ’ড়ে তুলতে এবং সাহিত্য, শিল্প, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ
ব্যবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে নতুন-নতুন তথ্য ও মতামত সম্বন্ধে তাদের অবহিত করতে
সাময়িক পত্রের ভূমিকা অনস্বীকার্য। লেখককে, পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়ে তাকে
গ্রহণযোগ্য করে তুলতেও সাময়িকপত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার
মধ্য দিয়ে রুচিশীল পাঠকশ্রেণী গ’ড়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গে নতুন লেখক গোষ্ঠীও তৈরি
হয়। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রকেও বঙ্গদর্শন প্রকাশ করতে
হয়েছিল ধর্ম, সাহিত্য
প্রভৃতি বিষয়ে তার নিজের মত ও বক্তব্যকে বৃহৎ সংখ্যক পাঠকের কাছে তুলে ধরতে। এর
সুফলও তিনি লাভ করেছিলেন। এখনও বঙ্গদর্শন'কে অনেকে
সর্বকালীন শ্রেষ্ঠ পত্রিকা হিসাবে গণ্য করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১)
ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে নিজের
দৃষ্টিভঙ্গি সামগ্রিকভাবে তুলে ধরতে সাময়িকপত্রের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন
তিনি নিজেও। কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ১৮৯১ সালের ডিসেম্বরে (বঙ্গাব্দঃ
১২৯৮/১৭ই জ্যৈষ্ঠ) প্রকাশিত হয় হিতবাদী পত্রিকা। এই
পত্রিকার সাহিত্য বিভাগের সম্পাদক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। খুবই অল্প সময়ের জন্য, মাত্র তিন
মাস তিনি এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অনেকে মনে করেন, হয়ত তিনি নিজের মতামত
স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করতে পারছিলেন না, তাই নিজেই একটি পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা
প্রকাশ করেন। ১৮৯১-এর ডিসেম্বর মাসে সাধনা প্রকাশের
আগে যে সব পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল, তার মধ্যে রয়েছে-বিবিধার্থ সংগ্রহ
(১৮৫১); সোমপ্রকাশ
(১৮৫৮); রহস্য
সন্দর্ভ (১৮৬৩); অমৃতবাজার
পত্রিকা (১৮৬৮); বঙ্গদর্শন
(১৮৭২); জ্ঞানাঙ্কুর
(১৮৭২); আর্য্যদর্শন
(১৮৭৪); ভারতী
(১৮৭৭); বঙ্গবাণী
(১৮৮১); নব্যভারত
(১৮৮৩); নবজীবন
(১৮৮৪); বালক
(১৮৮৫); সাহিত্য
(১৮৯০) প্রভৃতি। এসব পত্রিকা এবং এতে প্রকাশিত বিবিধ রচনা নিশ্চয়ই রবীন্দ্রনাথ
মনোযোগ আকর্ষণ করে। এ-থেকেই হয়ত তার মনে স্বাধীনভাবে একটি সাময়িকপত্র প্রকাশের
বাসনা জেগে ওঠে। উদ্দেশ্য সাহিত্য দর্শন ধর্ম ইত্যাদি বিষয়ে নিজের বক্তব্য সরাসরি
পাঠকদের কাছে তুলে ধরা। বস্তুত: রবীন্দ্রনাথের বিপুল পরিমাণ সাহিত্য সম্ভারের
অধিকাংশই প্রথম মুদ্রিত হয়ে বেরিয়েছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। তবে, সরাসরি গ্রন্থিত হয়েছে খুব কম লেখাই। অবশ্য সাময়িক পত্রে, প্রকাশিত রচনা
পরে যখন গ্রন্থায়িত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে; রবীন্দ্রনাথ, সেই সব রচনার অনেক পরিমাণ
পরিমার্জন করেছেন। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত দীর্ঘদিন ধরে বিপুল সংখ্যক পাঠক সমাজের
কাছে সাময়িক পত্রের মাধ্যমে যে লেখা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, প্রথমেই
গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হলে সেটা কখনই সম্ভব হত না।
অনেক চিন্তা-ভাবনার পর প্রকাশ করেন সাধনা পত্রিকা। প্রথম সংখ্যার প্রকাশকাল
পাওয়া যায় বঙ্গাব্দ ১২৯৮-অগ্রহায়ণ। এখানে উল্লেখ্য যে, সাধনা'র স্থায়িত্বকালও;
বঙ্গদর্শন-এর
মত চার বছর। প্রথম তিন বছর, সম্পাদক হিসাবে নাম পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ
ভ্রাতা, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের চতুর্থ পুত্র সুধীন্দ্রনাথের। তখন তার বয়স বাইশ
বছর, আর রবীন্দ্রনাথ
ত্রিশ। চতুর্থ বছর থেকে সম্পাদক হিসাবে রবীন্দ্রনাথের নাম প্রথম মুদ্রিত হয়। সম্পাদক
হিসাবে যার নামই থাকুক না কেন, মূলত রবীন্দ্রনাথই শুরু থেকে, সম্পাদনা ও পরিচালনার কাজ
দেখাশোনা করে আসছেন। একটি পত্রে পদ্মিনীমোহন নিয়োগীকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘সাধনা পত্রিকার অধিকাংশ লেখা
আমাকেই লিখিতে হইত এবং অন্য লেখকদের রচনাতেও আমার হাত ভুরি পরিমাণে ছিল।’ সেজন্য
চতুর্থ বছরে, আনুষ্ঠানিকভাবে রবীন্দ্রনাথের নাম সম্পাদক হিসাবে মুদ্রিত হলেও, তার
সম্পাদনাকাল (১২৯৮-১৩০২) দেখানো হয়েছে। ভারতী সম্বন্ধে;
‘অবসরে’র পাতায় আগেই বলা হয়েছে যে, এই পত্রিকার মোট আটজন সম্পাদকের মধ্যে
রবীন্দ্রনাথ সম্পাদনা করেছে এক বছর (১৩০৫)।
রবীন্দ্রনাথ, যে সব পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে রয়েছে সাধনা (১২৯৮-১৩০২), ভারতী (১৩০৫), বঙ্গদর্শন-নবপর্যায় ( ১৩০৮-১৩১২), ভাণ্ডার (১৩১২-১৩১৪), এবং তত্ত্ববোধিনী (১৩১৮-১৩২১)।
রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত প্রথম সাময়িক পত্রিকা সাধনা। অতএব কবির
ভাবাবেগ ও কল্পনা এই পত্রিকাকে কেন্দ্র করে উদ্বেল হয়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক।
রবীন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’তে ‘ভারতী’ ও ‘বালক’-এর উল্লেখ থাকলেও সাধনা’র
কথা সেভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ‘ছিন্নপত্রাবলী’তে সাধনা’র
উল্লেখ রয়েছে একাধিকবার। তার কয়েকটি
উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে,
[ক]. ‘কাল যে ঝড়
সে আর কি বলব। আমার সাধনার নিত্যনৈমিত্তিক লেখা সেরে চা খাবার জন্য উপরে যাচ্ছি, এমন সময়
প্রচণ্ড ঝড় এসে উপস্থিত।’ (শনিবার, ৯ই জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৯) ।
[খ]. ‘আজকাল কবিতা
লেখাটা আমার পক্ষে যেন একটা গোপন নিষিদ্ধ সুখসম্ভোগের মতো হয়ে পড়েছে - এদিকে
আগামী মসের সাধনার জন্যে একটি লাইন লেখা হয় নি, ও দিকে মধ্যে মধ্যে সম্পাদকের তাড়া
আসছে, অনতিদূরে
আশ্বিন কার্তিকের যুগল সাধনা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ভর্ৎসনা করছে, আর আমি আমার
কবিতার অন্তঃপুরে পালিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিচ্ছি।’ (৩০শে আষাঢ়, ১৩০০) ।
[গ]. ‘কাল বিকেলে
সাধনার জন্য একটা গল্প লেখা শেষ করে আজ কতকটা নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছি। দুপুরবেলাটিও
খুব নিস্তব্ধ এবং গরম এবং শান্ত এবং স্থির হয়ে আছে।’ (১৬
ফাল্গুন ,১৩০১)
।
[ঘ]. তারপরে
অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে। আমাকে সে কখনও দেখে নি, কিন্তু আজকাল আমার ‘সাধনা’র মধ্যে সে
আমাকে দেখতে পায়। তাই লিখেছে - তোমার সাধনায় রবিকর পড়িয়াছে, তাই
রবি-উপাসক যত ক্ষুদ্র যত দূরে থাকুক তবু তার জন্যেও রবিকর বিকীর্ণ হইতেছে।’ (২৮
ফেব্রুয়ারি,
১৮৯৫)।
সাধনায়’ রবীন্দ্রনাথের অজস্র ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, গান প্রকাশ
পেয়েছে।সাধনায়’ প্রকাশিত যে সব রচনা, পরবর্তীকালে গ্রন্থাকারে মুদ্রিত
হয় তার মধ্যে রয়েছে, ‘সোনার তরী’, ‘চিত্রা’, ‘কথা ও
কাহিনী’, ‘গল্পগুচ্ছ’
প্রভৃতি। গল্প লিখতে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল সর্বাধিক। পত্রিকার শেষ বর্ষেও তার
দশটি গল্প প্রকাশিত হয়েছে উক্ত পত্রিকায়। ১৮৮৪ সালের ২৭শে জুন, কবি শিলাইদহ থেকে
ইন্দিরা দেবীকে লিখেছেন,
‘আজকাল মনে
হচ্ছে, যদি
আমি আর কিছু না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তা হলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং
কৃতকার্য বলে বোধ হয়। পাঁচজন পাঠকের সুখের কারণ হওয়া যায়। সাধনায় উচ্চ বিষয়ের
প্রবন্ধ লিখে বঙ্গদেশকে উন্নতিপথে লগি ঠেলে নিয়ে যাওয়া খুব মহৎ কাজ সন্দেহ নেই, কিন্তু
সম্প্রতি তাতে আমি তেমন সুখ পাচ্ছিনে এবং পেরেও উঠছিনে। গল্প লেখার একটা সুখ এই, যাদের কথা
লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা
মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার
সময় আমার বদ্ধ ঘরের বিরহ দূর করবে এবং রৌদ্রের মধ্যে পদ্মাতীরের উজ্জ্বল দৃশ্যের
মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াবে।’
সাধনা’র প্রথম সংখ্যায়, কোন-কোন বিষয়ে
এবং কাদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল তার একটি চিত্র দেখা যাক, সাধনার সূর্যালোক(প্রবন্ধ)-দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর; শকুন্তলা
(কবিতা)-ঋতেন্দ্রনাথ ঠাকুর;
প্রাণ ও প্রাণী (প্রবন্ধ)- সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর; সার্গম
স্বরলিপির ‘আকার মাত্রিক’ নূতন পদ্ধতি (প্রবন্ধ)- জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর; সাময়িক
সারসংগ্রহ (নির্দিষ্ট বিভাগের রচনা)-ক. মণিপুরের বর্ণনা-রবীন্দ্রনাথ, খ. আমেরিকার
সমাজচিত্র-রবীন্দ্রনাথ,
গ. পৌরাণিক মহাপ্লাবন-রবীন্দ্রনাথ, ঘ. মুসলমান মহিলা-রবীন্দ্রনাথ, ঙ. প্রাচ্য
সভ্যতার প্রাচীনত্ব-রবীন্দ্রনাথ; সোরাব ও রুস্তম (গল্প)-সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর; স্ত্রী-পুরুষের
ভেদাভেদ (প্রবন্ধ)-জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর; জানালার ধারে (প্রবন্ধ)- বলেন্দ্রনাথ
ঠাকুর; বৈজ্ঞানিক
সংবাদ (নির্দিষ্ট বিভাগের রচনা)-ক. গতি নির্ণয়ের ইন্দ্রিয়-রবীন্দ্রনাথ, খ.
ইচ্ছামৃত্যু-রবীন্দ্রনাথ,
গ. মাকড়শা-সমাজে স্ত্রী জাতির গৌরব-রবীন্দ্রনাথ, ঘ. উটপাখির
লাথি-রবীন্দ্রনাথ; বাগান
(প্রবন্ধ)- রবীন্দ্রনাথ;
যাত্রা আরম্ভ (য়ুরোপযাত্রীর ডায়ারী) (প্রবন্ধ)-রবীন্দ্রনাথ; সাময়িক
সাহিত্য সমালোচনা (নির্দিষ্ট বিভাগের রচনা) : ক. ভারতী-আশ্বিন ও কার্তি ১২৯৮, খ.
নব্যভারত-আশ্বিন ও কার্তিক ১২৯৮, গ. সাহিত্য-আশ্বিন ও কার্তিক ১২৯৮)-রবীন্দ্রনাথ। স্পষ্টত:
অধিকাংশ রচনাই রবীন্দ্রনাথের লেখা।
সাধনা’য় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ছোট
গল্পের সংখ্যা ৩৬টি। প্রকাশের কাল অনুযায়ী সেগুলি হ’ল-‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘সম্পত্তি
সমর্পণ’, ‘দালিয়া’, ‘কঙ্কাল’, ‘মুক্তির
উপায়’, ‘ত্যাগ’, ‘একরাত্রি’, ‘একটা আষাঢ়ে
গল্প’, ‘জীবিত
ও মৃত’, ‘স্বর্ণমৃগ’, ‘রীতিমত
নভেল’, ‘জয়পরাজয়’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘ছুটি’, ‘সুভা’, ‘মহামায়া’, ‘দান
প্রতিদান’, ‘সম্পাদক’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘অসম্ভব কথা’, ‘শাস্তি’, ‘একটি
ক্ষুদ্র পুরাতন গল্প’,
‘সমাপ্তি’, ‘সমস্যাপুরণ’, ‘অনধিকার
প্রবেশ’, ‘মেঘ
ও রৌদ্র’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘বিচারক’, ‘নিশীথে’, ‘আপদ’, ‘দিদি’, ‘মানভঞ্জন’, ‘ঠাকুরদা’, ‘প্রতিহিংসা’, ‘ক্ষুধিত
পাষাণ’ ও ‘অতিথি’।
সাধনা’র মূল লেখক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
স্বয়ং। সুধীন্দ্রনাথের নাম সম্পাদক হিসাবে থাকলেও তিনিই সম্পাদনার কাজ পরিচালনা
করেছেন। রবীন্দ্রনাথ হয় ত পরে বুঝেছিলেন যে, অন্য লেখকের লেখা প্রকাশিত না হলে
পত্রিকাটি নিতান্তই ‘ঠাকুরবাড়ির কাগজ’ হয়ে দাঁড়াবে। ঠাকুরবাড়ির লেখকদের মধ্যে
রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে ছিলেন ইন্দিরা দেবী, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কন্যা
শরৎকুমারী দেবীর জামাতা সুকুমার হালদার, দ্বিজেন্দ্রনাথের জামাতা মোহিনীমোহন
চট্টোপাধ্যায়, ছিলেন
দ্বিজেন্দ্রনাথ স্বয়ং। সবচেয়ে বেশি লিখেছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, বলেন্দ্রনাথ
ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যার নাম প্রথম তিন বছর সম্পাদক হিসাবে ছিল সেই
সুধীন্দ্রনাথ গল্প, কবিতা
ও প্রবন্ধ লিখেছেন ঠিকই তবে সংখ্যায় খুব কম। অন্যান্য লেখকদের মধ্যে ছিলেন
অক্ষয়চন্দ্র চৌধুরী,
অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায়,
ইন্দিরা দেবী, উপেন্দ্রকিশোর
রায়চৌধুরী, উমেশচন্দ্র
, ঋতেন্দ্রনাথ
ঠাকুর, কৃষ্ণবিহারী
সেন, ক্ষীরোদচন্দ্র
রায়চৌধুরী, চুণিলাল
গুপ্ত, জগদানন্দ
রায়, দীনেন্দ্রকুমার
রায়, দেবেন্দ্রনাথ
সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল
রায়, নারায়ণ
দাস বন্দ্যোপাধ্যায়,
নীরদচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়, রজনীকান্ত গুপ্ত, রমেশচন্দ্র
দত্ত, প্রমথনাথ
রায়চৌধুরী, প্রভাতচন্দ্র
মুখোপাধ্যায়, প্রতাপচন্দ্র
মজুমদার, রামেন্দ্রসুন্দর
ত্রিবেদী, শ্রীশচন্দ্র
মজুমদার, রুক্মিণীকান্ত
চক্রবর্তী, শরৎকুমারী
চৌধুরাণী, শৈলেশচন্দ্র
মজুমদার, লোকেন্দ্রনাথ
পালিত, সখারাম
গণেশ দেউস্কর ও হরিসাধন মুখোপাধ্যায়।
পত্রিকার প্রথম সংখ্যা ১২৯৮-এর অগ্রহায়ণে বেরোলেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা কিন্তু
প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১২৯৯ বৈশাখ সংখ্যায়। জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ন’টি
কবিতা জার্মান ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। জার্মান ভাষা জানা থাকায়
অনুবাদে কবির কোন অসুবিধা হয় নি। কবিতার শিরোনামে লেখা ছিল ‘জর্মান হইতে
অনুবাদিত’। মূল জার্মান রচনাও অনুবাদের সঙ্গে মুদ্রিত হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাব্য শিরোনামে সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় সাধনা’র ১২৯৮-এর চৈত্র সংখ্যায়। এখানে কবি কাব্যরস সম্বন্ধে বলেন,
‘কবিতা হইতে
তত্ত্ব বাহির না করিয়া যাহারা সন্তুষ্ট না হয় তাহাদিগকে বলা যাইতে পারে, তত্ত্ব তুমি
দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস প্রভৃতি নানা স্থান হইতে সংগ্রহ করিতে পারো, কিন্তু
কাব্যরসই কবিতার বিশেষত্ব। এই কাব্যরস কি তা বলা শক্ত। কারণ তাহা তত্ত্বের ন্যায়
প্রমাণযোগ্য নহে, অনুভবযোগ্য।
যাহা প্রমাণ করা যায় তাহা প্রতিপন্ন করা সহজ; কিন্তু যাহা অনুভব করা যায় তাহা
অনুভূত করাইবার সহজ পথ নাই,
কেবলমাত্র তাহার সাহায্যে একটা সংবাদ জ্ঞাপন করা যায় মাত্র। কেবল যদি বলা
যায় ‘সুখ হইল’ তবে একটা খবর দেওয়া হয়, সুখ দেওয়া হয় না। ... এমন অনেক
পাঠক দেখা গিয়াছে যাহারা ..কোন বিশেষ কবিতার সৌন্দর্য্য স্বীকার করিয়াও তাহার
উপকারিতার অভাব লইয়া অপ্রসন্নতা প্রকাশ করিয়া থাকে। যেমন ব্যবসায়ী লোক আক্ষেপ
করে পৃথিবীর সমস্ত ফুলবাগান তাহার মূলার ক্ষেত হইল না কেন। সে স্বীকার করিবে ফুল
সুন্দর বটে, কিন্তু
কিছুতে বুঝিতে পারিবে না তাহাতে ফল কি আছে।’
সাধনা’র দ্বিতীয় বর্ষে শিক্ষা বিষয়ক
কিছু প্রবন্ধ পাওয়া যায়। সেগুলি হল, ‘শিক্ষার হেরফের’-রবীন্দ্রনাথ (১২৯৯ পৌষ), ‘শিক্ষাপ্রণালী’-লোকেন্দ্রনাথ
পালিত (১২৯৯ মাঘ), ‘ইংরাজি
বনাম বাঙলা’-বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১২৯৯ চৈত্র), ‘প্রসঙ্গ কথা’-রবীন্দ্রনাথ (১২৯৯
চৈত্র), ‘প্রসঙ্গ
কথা/শিক্ষা সঙ্কট’-রবীন্দ্রনাথ (১৩০০ আষাঢ়)। পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষেই অর্থাৎ
১২৯৯ অগ্রহায়ণ থেকে ১৩০০ কার্ত্তিক অবধি সময়ে একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধমালার নাম
‘ডায়ারি’। কোনো কোনো সংখ্যায় এই প্রবন্ধকে ‘পঞ্চভূতের ডায়ারি’, ‘পাঞ্চভৌতিক
ডায়ারি’ বা ‘পাঞ্চভৌতিক সভা’ নামেও অভিহিত করা হয়েছে। মাঘ ১২৯৯ সংখ্যায় প্রথম
শুরু এই ‘ডায়ারি’। তৃতীয় বর্ষে এই ধারাবাহিকে কোনো প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় নি, কিন্তু
চতুর্থ বা শেষ বছরে আবার কয়েকটি হয়েছে। এই প্রবন্ধগুলি সংকলিত হয়ে গ্রন্থাকারে
প্রকাশিত হয়েছে ১৩০৪ বঙ্গাব্দে। ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’র জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণের
চতুর্দশ খণ্ডে ‘পঞ্চভূত’ শীর্ষক প্রবন্ধগুচ্ছের মধ্যে এই রচনাগুলি প্রাপ্য।
সাধনা’র চার বছরে বহু ধরণের প্রবন্ধ
প্রকাশিত হয়েছে। আলোচিত বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, ধর্ম, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, জীবনী, ভাষাতত্ত্ব প্রভৃতি।
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপক গবেষক ড: অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য তার ‘সাধনা পত্রিকা ও রবীন্দ্রনাথ’ গ্রন্থে যথার্থই মন্তব্য করেছেন, ‘পারিবারিক-স্মৃতিলিপি-পুস্তকখানি বিশ্বভারতী কর্তৃক মুদ্রিত হলে অদ্যাবধি অপ্রকাশিত বিভিন্ন জনের বহু সংখ্যক রচনা আমাদের সকলের হস্তগত হতে পারত।’
বঙ্কিমচন্দ্র তার বঙ্গদর্শনে বেশ কয়েকটি গ্রন্থের সমালোচনা প্রকাশ করেছিলেন। সমালোচনা-প্রবন্ধের নাম ছিল গ্রন্থের নামানুসারেই। রবীন্দ্রনাথও এই ধরণে বঙ্কিমের ‘রাজসিংহ’ গ্রন্থের সমালোচনা প্রকাশ করেছেন একই নামে ১৩০০ চৈত্র সংখ্যায়। তবে বঙ্কিমচন্দ্র তখন মৃত্যু শয্যায়, সমালোচনাটি তিনি সম্ভবত: দেখে যেতে পারেন নি। এ-রকম আরও কয়েকটি সমালোচনা-প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শ্রীশচন্দ্র মজুমদারের ‘ফুলজানি’ (১৩০১ অগ্রহায়ণ), দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘আর্য্যগাথা’ (১৩০১ অগ্রহায়ণ), ‘সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ’ (১৩০১ পৌষ), বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্র’ (১৩০১ মাঘ ও ফাল্গুন), শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘যুগান্তর’ (১৩০১ চৈত্র) ও কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংগৃহীত ‘গুপ্তরত্নোদ্ধার বা প্রাচীন কবি সঙ্গীত সংগ্রহ’ (১৩০২ জ্যৈষ্ঠ)। লেখকের সঙ্গে যথেষ্ট হৃদ্য সম্পর্ক থাকলেও সমালোচনা করার সময়ে কবি ছিলেন নিষ্ঠিত ও অকপট। ভাল মন্দ দুইয়েরই উল্লেখ করেছেন তিনি। যেমন সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ’ সম্বন্ধে লিখেছেন (পৌষ ১৩০১),
‘পালামৌ সঞ্জীবের
একটি রমণীয় ভ্রমণ বৃত্তান্ত। ইহার সৌন্দর্য্য যথেষ্ট আছে, কিন্তু
পড়িতে পড়িতে প্রতিপদে মনে হয় লেখক যথোচিত যত্ন-সহকারে লেখেন নাই। ...তাঁহার
রচনা হইতে অনুভব করা যায় তাঁহার প্রতিভার অভাব ছিল না, কিন্তু সেই
প্রতিভাকে তিনি প্রতিষ্ঠিত করিয়া যাইতে পারেন নাই...তাঁহার মধ্যে যে পরিমাণে
ক্ষমতা ছিল সে পরিমাণে উদ্যম ছিল না। তাঁহার প্রতিভার ঐশ্বর্য ছিল কিন্তু
গৃহিণীপনা ছিল না। ভাল গৃহিণীপনায় স্বল্পকেও যথেষ্ট করিয়া তুলিতে পারে; যতটুকু আছে
তাহার যথাযোগ্য বিধান করিতে পারিলে তাহার দ্বারা প্রচুর ফল পাওয়া গিয়া থাকে।
কিন্তু অনেক থাকিলেও উপযুক্ত গৃহিণীপনার অভাবে সে ঐশ্বর্য ব্যর্থ হইয়া যায়; সে স্থলে
অনেক জিনিস ফেলাছড়া যায়,
অথচ অল্প জিনিসই কাজে আসে। তাঁহার অপেক্ষা অল্প ক্ষমতা লইয়া অনেকে যে পরিমাণ
সাহিত্যের অভাব মোচন করিয়াছেন তিনি প্রচুর ক্ষমতা সত্ত্বেও তাহা পারেন নাই; তাহার কারণ, সঞ্জীবের
প্রতিভা ধনী কিন্তু গৃহিণী নহে।’
সাধনা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ও
উদ্দীপনা সুতীব্র হয়ে উঠেছিল সম্ভবত প্রকাশনার দ্বিতীয় বর্ষে। কটক থেকে ২৫শে
ফেব্রুয়ারি ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের চিঠিতে তিনি লিখেছেন,
‘চৈত্র
মাসের সাধনার জন্যে যে ডায়রিটা লিখতে আরম্ভ করেছিলুম এবং যা ভাঙা রাস্তায় বহু
ভারগ্রস্ত গরুর গাড়ির মতো কিছুতে এগোতে পারছিল না, আজ সেটা নিশ্চয়ই শেষ করে ফেলব। যখন
মন একটু খারাপ থাকে তখনই সাধনাটা অত্যন্ত ভারের মতো বোধ হয়। মন ভালো থাকলে মনে
হয়, সমস্ত
ভার আমি একলা বহন করতে পারি। তখন মনে হয়, আমি দেশের কাজ করব এবং কৃতকার্য হব।
তখন লোকের উৎসাহ এবং অনুকূলতা কিছুই আবশ্যক মনে হয় না, মনে হয়
আমার নিজের কাজের পক্ষে আমি নিজেই যথেষ্ট। তখন এক-এক সময়ে আমি নিজেই খুব দূর
ভবিষ্যতের যেন ছবি দেখতে পাই - আমি দেখতে পাই, আমি বৃদ্ধ পক্বকেশ হয়ে গেছি, একটি বৃহৎ
বিশৃঙ্খল অরণ্যের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছেছি অরণ্যের মাঝখান দিয়ে বরাবর সুদীর্ঘ
একটি পথ কেটে দিয়ে গেছি এবং অরণ্যের অন্য প্রান্তে আমার পরবর্ত্তী পথিকেরা সেই
পথের মুখে কেউ কেউ প্রবেশ করতে আরম্ভ করেছে, গোধূলির আলোকে দুই-এক জনকে মাঝে মাঝে
দেখা যাচ্ছে। আমি নিশ্চযই জানি 'আমার সাধনা কভু না নিষ্ফল হবে'। ক্রমে
ক্রমে অল্পে অল্পে আমি দেশের মন হরণ করে আনব - নিদেন আমার দু-চারটি কথা তার অন্তরে
গিয়ে সঞ্চিত হয়ে থাকবে। এই কথা যখন মনে আসে তখন আবার সাধনার প্রতি আকর্ষণ আমার
বেড়ে ওঠে। তখন মনে হয় সাধনা আমার হাতের কুঠারের মতো, আমাদের
দেশের বৃহৎ সামাজিক অরণ্য ছেদন করবার জন্যে এ'কে আমি ফেলে রেখে মরচে পড়তে দেব না
- এ'কে
আমি বরাবর হাতে রেখে দেব। যদি আমি আরো আমার সাহায্যকারী পাই তো ভালোই, না পাই তো
কাজেই আমাকে একলা খাটতে হবে।’
যে সাধনা’ রবীন্দ্রনাথের এত সাধনার ধন, তার স্থায়িত্ব মাত্র চার বছর কেন ? এ প্রশ্ন স্বভাবতই উঠবে। প্রথম থেকেই সম্পাদনার কাজ মূলত: দেখাশোনা করলেও তৃতীয় বছরের শেষে সুধীন্দ্রনাথের পরিবর্তে অন্য কাউকে সম্পাদক পদে রবীন্দ্রনাথ হয়তো চেয়েছিলেন। সাধনা’র আর্থিক সঙ্গতিও ক্রমশ: হ্রাস পাচ্ছিল। নতুন সম্পাদক হিসাবে ‘সাহিত্য’ সম্পাদক সুরেশচন্দ্র মজুমদারের নাম রবীন্দ্রনাথ ভেবেছিলেন। ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়য়ের নামও চিন্তা করা হয়েছিল। এমন কি ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সঙ্গে ‘সাধনা’র সম্মিলনের কথাও বিবেচনা করা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর কোনটিই ফলপ্রসূ হয় নি।
সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত (কার্তিক ১৩১৩) নিত্যকৃষ্ণ বসুর ‘সাহিত্য-সেবকের ডায়েরী’তে ২৮শে আশ্বিন তারিখের দিনলিপিতে লেখা আছে,
সাহিত্য ও
সাধনার সম্মিলন প্রস্তাবটা কার্য্যে পরিণত হইল না দেখিতেছি। সু-চন্দ্র আজ
রবিবাবুকে স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন, এই ছয় মাস তিনি এ বিষয়ে কিছু করিতে
পারিবেন না। আমাদের বলিলেন,
ছয় মাস কেন, ও
প্রস্তাব আর কখনই বোধ হয় সফল হইবে না। এত পরামর্শ, লোক জানাজানি করিয়া শেষে সব
ভাসাইয়া দেওয়াটা আমার মতে ভাল না হইলেও, সম্মেলন না হওয়াতে যে আমি আনন্দিত, তাহা আর না
বললেও চলে। আর একখানা ‘ঠাকুরবাড়ীর কাগজ’ বাড়াইয়া কোন ফল নাই।
সাধনা’র সমসাময়িক বহু পত্রিকাতে ‘সাধনা’র
সমালোচনা নিয়মিত প্রকাশিত হয়েছে, সব চেয়ে বেশি হয়েছে সাহিত্য’
পত্রিকায়। সুরেশচন্দ্র সম্পাদিত এই পত্রিকাটিতে সাধনা’র সমালোচনা প্রায়
নিয়মিতই বেরিয়েছে। কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত সমালোচনা একটু দেখে নেওয়া যাক। এতে
রবীন্দ্রনাথের সাধনা সম্বন্ধে তখনকার প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য পত্রিকার মনোভাব
কিছুটা অনুমান করা যাবে,
[ক]. ‘আমরা
সাদরে সাধনা’র আবাহন করিতেছি। পত্রিকার আকার প্রকার অতি সুন্দর ও বাঙ্গালা
সাহিত্যে সম্পূর্ণ নূতন বলা যাইতে পারে। সাধনার প্রথম সংখ্যায়, বিলক্ষণ
নূতনত্ব আছে, নানাবিধ
প্রবন্ধের সমাবেশে সুখপাঠ্য হইয়াছে। আমরা সর্বান্তকরণে, সাধনার
উন্নতি ও সম্পূর্ণ সিদ্ধি কামনা করি। আমরা রবীন্দ্রবাবুর ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’
পড়িতে আরম্ভ করিয়া যেমন আমোদ পাইয়াছি; উপসংহারে তেমনই নিরাশ হইয়াছি। এই
গল্পটির আরম্ভভাগ, অতি
মনোরম, বেশ
স্বাভাবিক। ইহার প্রাঞ্জল ভাষা, সরল প্রণালী ও সহজ অলঙ্কার, গল্পটিকে আরও মনোরম করিয়া
তুলিয়াছে। আদুরে খোকার খামখেয়ালী মেজাজ কেমন স্বাভাবিক। কিন্তু যখন রাইচরণ নিজের
বুড়া খোকাটিকে, মুন্সেফ
বাবুর সেই আদুরে খোকা বলিয়া আনিয়া দিতেছে, তখন আমাদের কেমন অস্বাভাবিক বলিয়া
বোধ হয়। মুন্সেফবাবু যেন গল্পটিকে সমাপ্ত করিবার জন্যই, সন্দেহ
সংশয়ে জলাঞ্জলি দিয়া,
পরের ছেলেটিকে নিজের বলিয়া গ্রহণ করিতেছেন। এজন্য গল্পটি কেমন অঙ্গহীন ও
কষ্টকল্পিত বলিয়া বোধ হয়।’
[খ]. ‘উৎকৃষ্ট
কাগজ, উৎকৃষ্ট
ছাপা, এরূপ
পরিপাটি পত্রিকা এদেশে আর প্রকাশিত হয় নাই। আমরা যত ভাবি, ততই বুঝি, মহর্ষির
বাড়ীর সকলই মধুর, সকলই
সুন্দর। বঙ্গের আর কোন পরিবারে এতগুলি বাঙ্গালা ভাষার সাধক দেখিতে পাওয়া যায় না।
মাতৃসেবার জন্য এ বাড়ীর সকলেই অল্পাধিক পরিমাণে লালায়িত। যাঁহার যেরূপ শক্তি, তিনি সেইরূপ
কৃতিত্ব লাভ করিতেছেন। সাধনার লেখার পারিপাট্য দেখিয়া আমরা মোহিত হইয়াছি। আশা
করি পত্রিকাখানির মহর্ষির পরিবারের গৌরব আরো উজ্জ্বল করিতে সমর্থ হইবে।’ (‘নব্যভারত’
১২৯৮ ফাল্গুন)।
[গ]. ‘সাধনা
শ্রীযুক্তবাবু সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত। প্রথম হইতে দু’-চারি-দশ পৃষ্ঠা
পর্যন্ত উলটাইয়াও বুঝিতে পারিলাম না যে, এখানা কি? ওহো, হঠাৎ মনে
পড়িল, বিজ্ঞাপনে
যে দেখিয়াছিলাম, -
‘সাধনা’ – মাসিকপত্র! ভাল! ভাল! বা! বেশ কাগজখানি তো! এক এক সংখ্যা যেন এক
একখানি পুস্তক! কি সুন্দর ছাপা! কি পুরু পুরু পরিষ্কার কাগজ! লেখকগণ আবার দেখি -
সবাই ‘ঠাকুর’! বা! বেশ সারি সারি সাজানো তো! যাই হোক, বাস্তবিকই
‘সাধনা’ কাগজখানি বেশ একখানি ‘সখের জিনিস’ হইয়াছে। ঠাকুরবাড়ির আবালবৃদ্ধ-বনিতা
তারাই সকলে এ কাগজখানিতে লেখেন। তাঁদেরই এটি সখের জিনিস। সুন্দরই হইতেছে। প্রবন্ধও
– ইস্তক বেদালোচনা নাগাদ সা-রি-গা-মা – শেষ রঙ-তামাসা-চুটকি-মজাদার – সবই রকম আছে।
মন্দও আছে, ভালও
আছে -এই পাঁচ ফুলের সাজি আর কি ? ফলত: বাঙ্গালা সাহিত্যে এটিকেও একটি পরিপাটি জিনিস বলিতে
হয়। বাস্তবিকই এটি লাগেও ভাল। আর, তাই আমরা অন্তরের সহিত ইহার
স্থায়িত্ব কামনা করি।’ (‘অনুসন্ধান’ ১২৯৮ চৈত্র)
[ঘ]. ‘সাধনা
শ্রীযুক্তবাবু সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত। ইহার বয়স এক বৎসর পূর্ণ হইয়াছে।
প্রবন্ধের বৈচিত্র্য,
ভাষার মাধুর্য, চিন্তার
গাম্ভীর্য ও মুদ্রাঙ্কনাদির পারিপাট্য সকল বিষয়েই সাধনা প্রশংসার্হ। এরূপ
পত্রিকার দীর্ঘজীবন আমরা প্রার্থনা করি।’
(‘বামাবোধিনী
পত্রিকা’ ১২৯৯ কার্তিক)।
[ঙ]. ‘সাধনা
সম্বন্ধে কিছু লিখিতে আমরা অনুরুদ্ধ হইয়াছি। আমরা সাধনা সম্বন্ধে খুব উচ্চ আশা
হৃদয়ে পোষণ করিয়াছিলাম এবং তাহা নব্যভারতে ব্যক্তও করিয়াছিলাম, কিন্তু
সম্বৎসর পরে, ধীরে
এবং নিরপেক্ষভাবে সাধনার চালচলতি নিরীক্ষণ করিয়া আমাদিগকে কিছু নিরাশ হইতে
হইয়াছে। আমরা একদিন পরম শ্রদ্ধেয়, সাহিত্যক্ষেত্রের সর্ব্বাগ্রজ
তীক্ষ্ণ প্রতিভাশালী শ্রীযুক্ত বঙ্কিম বাবুর সহিত সাক্ষাৎ করিতে গিয়াছিলাম। নানা
কথার প্রসঙ্গে তিনি বলিয়াছিলেন, “বঙ্গদর্শন, প্রচার ও নবজীবন আমাদের বহু যত্নের ফল, কিন্তু
একটানা সুরে সাধা ছিল বলিয়া স্থায়ী হইল না।” সাধনাও একটানা সুরে সাধা। এক
ব্যক্তি যতই প্রতিভাশালী হউন না কেন; প্রতিমাসে বহু প্রবন্ধ লিখিলেই, তাঁহাকে
একটানা ভাবে চলিতে হইবে। মাসিক কাগজে বিভিন্ন মতাবলম্বী যত বহু লোকের লেখা থাকিবে, ততই
সাধারণের আদরের জিনিস হইবে বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। সাধনায় একা রবীন্দ্রনাথ
লিখিবেন, অর্দ্ধেক
কিংবা ততোধিক প্রবন্ধ,
ইহাতে যে সাধনা একটানা সুরে সাধা হইবে, আশ্চর্য কি ? পত্রিকাখানি
মনোযোগ সহকারে পাঠ করিলে বুঝা যায়, এ যেন এক জনেরই কাগজ। “রবীন্দ্র
বাবুর মাসিক প্রবন্ধ ও গল্প” নাম সাধনাকে দিলে যে খুব অন্যায় হয়, আমাদের বোধ
হয় না। সাধনার এ দোষ সংশোধিত হয়, আমরা সর্বান্তকরণে প্রার্থনা করি।’ (‘নব্যভারত’ ১২৯৯ অগ্রহায়ণ)।
[চ]. ‘ইহা
ঠাকুরদের সখের জিনিস। ইহাতে সর্ব্বসাধারণের প্রয়োজন সিদ্ধ কি পরিমাণে হয়, ঠিক বলা
যায় না। সাধনার প্রবর্তক শ্রীমান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ বাবুর
আত্মম্ভরিতার মাত্রার বাড়াবাড়ি না হইলে পত্রিকা সমাজের বিশেষ উপকারিণী হইত। ইহার
আবির্ভাবে উপকার হইয়াছে।’ (‘নব্যভারত’ ১২৯৯ চৈত্র) ।
অবশেষে চতুর্থ বর্ষে সম্পাদক পদে রবীন্দ্রনাথ নিজের নামই প্রকাশ করলেন। এ-প্রসঙ্গে
‘সাধনা’র তৃতীয় বর্ষের শেষে মুদ্রিত ‘বিজ্ঞাপনে’ বিদায়ী সম্পাদক
সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘সাধনার তৃতীয় বর্ষ পূর্ণ হইল’ শিরোনামে লিখেছেন,
[ক]. ‘আমরা
কিয়ৎপরিমাণেও সিদ্ধিলাভ করিয়াছি কি না জানি না। কিন্তু এ কথা গোপন করিবার আবশ্যক
দেখি না, যে, যে পরিমাণ
জনাদর প্রাপ্ত হইলে বহুব্যয়সাধ্য ‘সাধনা’ স্বচ্ছন্দে স্থায়িত্বলাভ করিতে পারিত
তাহা ‘সাধনার’ অদৃষ্টে ঘটে নাই। তাহাতে হয় ত আমাদের অক্ষমতা অথবা দুর্ভাগ্য
উভয়েই প্রকাশ পাইতেছে।’
[খ]. ‘আমাদের একটি
উৎসাহের কারণ এই আছে যে,
আমরা অনেক কৃতবিদ্য পাঠক লাভ করিয়াছি এবং সাধনার প্রতি তাঁহাদের যথেষ্ট
অনুরাগ আছে। তবু যে,
সাধনার আর্থিক অবস্থার অস্বচ্ছলতা ঘটিয়াছে সে কেবল সাধনার অনুষ্ঠাতাগণের
বিবেচনার দোষে তাহাতে সন্দেহ নাই। বাঙ্গালা দেশের কোন সাময়িক পত্রের এতাদৃশ
ব্যয়বাহুল্য করা উচিত হয় না।’
[গ]. ‘পত্রিকার
স্থায়িত্বের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া আগামী বৎসর হইতে সাধনার সাইজ রয়াল করা হইবে -
এবং কাগজের ভার লাঘব করিয়া যাহাতে দুই পয়সা মাশুল যায় তাহার ব্যবস্থা করা
যাইবে। আগামী বৎসর হইতে পত্রিকার মূল্য ডাকমাশুল সমেত তিনটাকা স্থির হইল। এক্ষণে
গ্রাহকগণকে ডাকমাশুল সমেত দুই টাকা বার আনা দিতে হইতেছে তাহার উপর কেবল চারি আনা
মূল্য বৃদ্ধি হইল।’
[ঘ]. ‘যোগ্যতর
হস্তে সম্পাদকীয় কার্য্যভার ন্যস্ত করিয়া আমি অবসর গ্রহন করিলাম, সম্পাদকীয়
কর্তব্য সাধনে যে সকল ত্রুটি ঘটিয়াছে তজ্জন্য পাঠকদের নিকট ক্ষমাপ্রার্থণা করি।’
আনুষ্ঠানিক ভাবে সম্পাদক হবার পর রবীন্দ্রনাথ কি মানসিক ভাবে ক্লান্ত হয়ে
পড়েছিলেন? সাধনার
কাজে তিনি কি আর আনন্দ পাচ্ছিলেন না? একটা সময়ে নানা বৈপরীত্যে তিনি হয়
ত পীড়িত হয়েছিলেন। ১৮৯৫-এর ১৪ই জানুয়ারির চিঠিতে লিখেছেন,
‘অল্প অল্প
করে বসন্ত পড়বার উপক্রম করছে। কাল সমস্ত দিন বেশ গরম পড়েছিল - কাজকর্মে মন
লাগছিল না, সমস্ত
দিনটা একরকম উদভ্রান্তের মধ্যে ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দেওয়া গেছে। এত দিন শীত ছিল, কাজের উৎসাহ
ছিল - মনে করতুম সারা জীবন সাধনার এডিটরি করে কাটিয়ে দেব। এখন একটু গরম হাওয়া
পড়বা মাত্রই মনে হচ্ছে,
এডিটরি করার চেয়ে আমি সেই যে কবি ছিলুম সে ছিলুম ভাল।‘’
১৮৯৫ ৩রা
অগাষ্ট কলকাতা থেকে লেখা কোন এক চিঠিতে বলেন,
‘কিন্তু দিন
দিন যতই আমার খ্যাতি বাড়ছে ততই একদিকে আমি খুশি হচ্ছি অন্য দিকে সব ছেড়েছুড়ে
লোকের ভিড় ঠেলেঠুলে নিজের যথার্থ প্রাইভেট বাসস্থানের নিভৃত কোণে ঢোকবার প্রবল
ইচ্ছা বোধ হচ্ছে। সাধনায় প্রতিমাসে লোকচক্ষে নিজের নামটার পুনরাবৃত্তি করতে
একেবারে বিরক্ত ধরে গেছে। আমি এটা বেশ বুঝতে পারছি খ্যাতি জিনিসটা ভালো নয়-ওতে
অন্তরাত্মার কিছুমাত্র ক্ষুধানিবৃত্তি হয় না, কেবল তৃষ্ণা বেড়ে ওঠে।’
১৩০২ বঙ্গাব্দের ভাদ্র-আশ্বিন-কার্তিক একসঙ্গে প্রকাশিত হয়ে ‘সাধনা’র
প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৯৫-এর ৬ই অক্টোবর কবি লিখেছেন, ‘এখন প্রায়
মাঝে মাঝে মনে করি সাধনা,
ত্রৈমাসিক এবং মাসিক,
এই পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিয়ে যাব।’ এখানে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ
করা প্রয়োজন, সেটি
হ’ল রবীন্দ্রনাথকে জমিদারীর কাজ দেখাশোনায় অত্যন্ত ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। মাঝে
মাঝে এই ব্যস্ততা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায়ই তাকে শান্তিনিকেতন ছেড়ে
বেরিয়ে যেতে হয়েছে। এতে শারীরিক ও মানসিক দু’দিক দিয়েই তিনি ক্লান্ত হ’য়ে
পড়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের
সম্পাদনাকালে কার্যাধ্যক্ষ ছিলেন বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি মাঝে মাঝে নিয়মাবলী
প্রকাশ করেছেন, ‘পত্রিকার মূল্য বার্ষিক
তিন টাকা। ডাকমাশুল লাগে না, প্রতি মসের ১৫
তারিখ সাধনা বাহির হয়, প্রবন্ধ মনোনীত না
হইলে আমরা ফেরত দিতে বাধ্য নহি’ ইত্যাদি। কার্যাধ্যক্ষের ঠিকানা ‘৬নং দ্বারাকানাথ ঠাকুরের গলি, জোড়াসাঁকো, কলিকাতা। কলিকাতা, আদি ব্রাহ্মসমাজ
যন্ত্রে শ্রীকালিদাস চক্রবর্ত্তীর দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত।’ এ-রকম আরও কত কি !
সাধনা’র প্রতি পৃষ্ঠার উপরে কোনো বছর বা
মাসের উল্লেখ থাকত না। এর ফলে, কোন কারণে প্রথম পাতাটি বিনষ্ট হ’য়ে গেলে বাকি পৃষ্ঠাগুলি
যে কোন বছরের কোন সংখ্যার তার মিল রাখাটা বেশ কষ্টকর ছিল। তখন বেশ কিছু পত্রিকায়
এই রীতি দেখা গেলেও; রবীন্দ্রনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকায় এটা কি করে ঘটল
সেটাই বিস্ময়কর।
১৩২৪-এর বৈশাখে ‘ভারতবর্ষ’
পত্রিকায় ‘সাহিত্য-প্রসঙ্গ’ শীর্ষক প্রবন্ধে ঠাকুরদাস মুখোপাধ্যায়কে লেখা
রবীন্দ্রনাথের চিঠির একাংশ,
‘সাধনার সাইজ
ও কাগজ কমানো সম্বন্ধে অনেক হিতৈষী বন্ধু আপত্তি করাতে অবশেষে তাহাদের অনুরোধ পালন
করিতে স্বীকার হইয়াছি। ইহা হইতে বুঝিতে হইবে সাধনার কোষ্ঠীতে ব্যয়ের ঘরে এ
বৎসরেও শনির দৃষ্টি আছে,
আয়ের ঘরে যদি রাহু থাকেন তাহলে মৃত্যু অতি সন্নিকট। যাহা হউক এ বৎসরটা
পরীক্ষা করিয়া দেখিয়া যদি আবশ্যক বোধ করি ত আগামী বৎসরে ব্যয়সংক্ষেপের চেষ্টা
করিব। পূর্ব্বের ন্যায় ব্যয়বাহুল্য রহিল বলিয়া আপনাকে সাধনার সম্পাদক পদে
নিয়মিত নিযুক্ত করিতে সাহস করিলাম না। আপনি প্রবন্ধ-প্রতি কিরূপ মূল্য গ্রহণ
করিতে পারেন আমাকে জানাইবেন অনুগ্রহ
পূর্ব্বক কিছুমাত্র সংকোচ করিবেন না। আগামী বৎসর হইতে সাধনায় কোন লেখকের নাম
থাকিবে না।’
চতুর্থ বছরে রবীন্দ্রনাথ কেন লেখকদের নাম বাদ দিয়েছেন তার কোন উল্লেখ নেই, হতে পারে
ঘুরে ফিরে সেই কয়েক জনের নাম তিনি আর পাঠক সমাজের সামনে আনতে চাইছিলেন না।
সাহিত্য ১৩০২ কার্ত্তিকে সাধনা’র শেষ
সংখ্যা (ভাদ্র-আশ্বিন-কার্ত্তিক সম্মিলিত সংখ্যা) সম্বন্ধে লেখা হয়েছে,
‘পাঠকগণ
বিজ্ঞাপনে দেখিবেন, ‘সাধনা’
অতঃপর আর প্রকাশিত হইবে না। সাহিত্য সংসারে সুপ্রসিদ্ধ শ্রীযুত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মহাশয় সম্পাদক হইয়া সাধনাকে সিদ্ধির পথে আনিয়াছিলেন। তাহার পর ‘সাধনা’
ত্রৈমাসিক হইতেছে শুনিয়া আমরা মনে করিয়াছিলাম যে, বাঙ্গালা সাহিত্যের একটি গুরুতর অভাব
পূর্ণ হইবে। কিন্তু সহসা ‘সাধনা’র বিলোপ হইল দেখিয়া আমরা অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি।
‘সাধনা’ বিলুপ্ত হইল কেন, তাহার কোনো কারণ সাধারণের নিকট প্রকাশ হয় নাই। তথাপি মনে
হয় বাঙ্গালী পাঠকের সম্পূর্ণ সহানুভূতি পাইলে ‘সাধনা’ বিলুপ্ত হইত না। যে দেশে
সাধনার মত উচ্চ শ্রেণীর মাসিকও বিলুপ্ত হইবার অবকাশ পায়, সে দেশ
নিশ্চয়ই অত্যন্ত দুর্ভাগ্য।’
লক্ষণীয় যে, সাহিত্য’
পত্রিকা বহু ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের লেখার বিরূপ সমালোচনা প্রকাশ করেছে, সেই সেটাই সাধনা’কে
একটি উচ্চতর পত্রিকা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং পত্রিকাটির
বিলুপ্তি যে সাহিত্যক্ষেত্রে কাম্য নয় সেটাও দ্বিধাহীন ভাবে উচ্চারিত হয়েছে। স্বল্প
কালের জন্য স্থায়ী হলেও, সাময়িক পত্রের ইতিহাসে সাধনা অবশ্যই একটি উচ্চতর মাসিক পত্রিকা হিসাবে চিহ্নিত হ’য়ে থাকবে।
পাঁচ.
সাময়িক পত্র প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সাহিত্যের আদর্শ অক্ষুণ্ণ রেখে পাঠকের রুচিবোধকে পরিশীলিত ক’রে তুলতে এবং সেই সঙ্গে নতুন লেখক গোষ্ঠি গ’ড়ে তুলে সুস্থ সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে এজাতীয় পত্রিকার একটি অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। সাহিত্যের আদর্শ কি হওয়া উচিত ? এ-নিয়ে বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে কল্লোল যুগে, অনেক বাদানুবাদ ও আলোচনা হয়েছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও এই বিতর্কে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। সময়ের সঙ্গে জীবনধারা, মানসিকতা ও রুচিবোধ সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। সাহিত্যও এ-থেকে বাদ যেতে পারে না। ভাষারীতি, বিষয়বস্তু নির্বাচন, রচনাশৈলী প্রভৃতির পরিবর্তন হলেও, একটা মূললক্ষ্য ও আদর্শবোধের ভিত্তিতে গতিপথ নিয়ন্ত্রিত না হলে সাহিত্য যেখানে গিয়ে পৌঁছতে পারে, সুস্থ সমাজ গ’ড়ে তুলতে সেটা সহায়ক না হ’য়ে পাঠককূলকে বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করতে পারে কি না সেটা এ বিষয়ে বিদগ্ধ জনেরাই বিচার করে দেখবেন।
বর্তমান রচনাটির উদ্দেশ্য সাহিত্যধর্ম আলোচনা নয়, সবুজ পত্র
নামক্ একটি সাময়িকপত্রের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সবুজ পত্র
প্রকাশের কৃতিত্ব প্রমথ চৌধুরীর (১৮৬৮-১৯৪৬) প্রাপ্য। সাহিত্য ক্ষেত্রে এটা তার
জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলেও অনুমান করা হয়।। অবশ্য রবীন্দ্রনাথের শুভেচ্ছা ও
অনুপ্রেরণা তাকে পথ চলতে সাহায্য করেছে, বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হ’তে সাহস
জুগিয়েছে, নির্দিষ্ট
লক্ষ্যে পৌঁছতে প্রতিজ্ঞা করেছে। রবীন্দ্রনাথের মেজদা, সত্যেন্দ্রনাথের কন্যা ইন্দিরা দেবীর (১৮৭৩-১৯৬০)
স্বামী প্রমথ চৌধুরী ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত মুক্ত মনের মানুষ। তার সাহিত্য প্রতিভা
লক্ষ্য করে রবীন্দ্রনাথ তাকে গল্প লিখতে পরামর্শ দেন। সেকালে অধিকাংশ রচনাই রচিত
হয়েছে সাধুভাষায়। সাধুভাষায় গাম্ভীর্য ও উদাত্ত ভাব নিহিত থাকলেও দৈনন্দিন
জীবনের বা পারিপার্শ্বিক ঘটনা বর্ণনায় সেটা যেন একটু অসচ্ছন্দ বেমানান। চলমান
জীবনের বিষয় অকৃত্রিম ভঙ্গীতে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার উপযুক্ত মাধ্যম হিসাবে
কথ্য ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস যে দেখা যায় নি এমন নয়। ১৮৫৪ সালে প্রকাশিত
মাসিক পত্রিকা নামক সাময়িকপত্রে বা প্যারীচাঁদ মিত্র (টেকচাঁদ ঠাকুর) (১৮১৪-১৮৮৩)
রচিত আলালের ঘরের দুলাল ও হুতোম প্যাঁচার নকসা, ‘কালীপ্রসন্ন সিংহ’ নামক গ্রন্থে মৌখিক ভাষাই
ব্যবহৃত হয়েছে। তবে প্রাবন্ধিক প্রমথনাথ বিশী’র (১৯০১-১৯৮৫) কথায়, ‘আলাল ও হুতোম
প্যাঁচার নকশা বিশেষ আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত, তাহাদের ভাষাকে মৌখিক ভাষা বলা উচিত
নয়। সাহিত্যের মৌখিক ভাষা সাহিত্যের লৈখিক ভাষার মতই দেশব্যাপী পটভূমিতে
প্রতিষ্ঠিত হওয়া আবশ্যক। আঞ্চলিক ভাষা সে দাবী করতে পারে না।’
প্রমথ চৌধুরী মৌখিক ভাষাতেই সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। অবশ্য তিনি নিজেই এক সময়ে সাধুভাষায় সাহিত্য রচনা করেছেন। তার লেখা জয়দেব প্রবন্ধটি সাধুভাষায় রচিত। এতে তিনি গীতগোবিন্দ কাব্যের সমালোচনা লিপিবদ্ধ করেছেন। প্রবন্ধটি সম্বন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘এটি আমার প্রথম লেখা। এ প্রবন্ধের পূর্ব্বে আমি বাঙলা ভাষায় গল্প ত দূরের কথা, কখনও দু’ছত্র পদ্যও লিখিনি।’ প্রবন্ধটি পরে সবুজ পত্রে প্রকাশিত হয়েছে (আষাঢ়, ১৩২৭)।
সাহিত্য রচনায় প্রমথ চৌধুরী গতানুগতিকতা বা চিরপ্রচলিত কাঠামোর বাইরে বেরিয়ে যুক্তিবাদ, মুক্তচিন্তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধকে পাথেয় ক’রে এগিয়ে যেতে চেয়েছেন। তার মনে হয়েছে, বহুদিনের অভ্যাসজনিত শৃঙ্খলিত মন যেন অনেক কিছুই উন্মুক্ত করতে চাইছে, কিন্তু যথাযথ প্রকাশের পথ খুঁজে পাচ্ছে না। এই জন্যই হয়তো প্রমথ চৌধুরী কথ্য বা মৌখিক ভাষাকে লেখার মাধ্যম করতে চেয়েছেন। বাস্তবকে আড়ম্বর ও আভিজাত্যের নিগড় থেকে মুক্ত করে অকৃত্রিম ও স্বাভাবিক ভঙ্গীতে প্রকাশের প্রয়োজনে। দীর্ঘকালের অনুসৃত সাহিত্যরূপের পরিবর্তনে যৌবনের বাঁধভাঙা শক্তি ও স্বাতন্ত্র্যবোধকে অন্যতম হাতিয়ার করে এগোতে চেয়েছেন। এ-জন্যই তিনি বলেছেন, ‘যৌবনে মানুষের বাহ্যেন্দ্রিয়, কর্মেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয় সব সজাগ ও সবল হয়ে ওঠে এবং সৃষ্টির মূলে যে প্রেরণা আছে, মানুষ সেই প্রেরণা তার সকল অঙ্গে, সকল মনে অনুভব করে।’ এই পথ নির্দেশের জন্যই সবুজ পত্রে’র প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বঙ্গদর্শন প্রকাশ করেছিলেন; অনেকটা একই ধরণের উদ্দেশ্য নিয়ে সবুজ পত্রে’র প্রকাশ। তবে সময়ের পরিবর্তনে প্রয়োজনের তারতম্য ও ভিন্নতা তো থাকবেই।
সবুজ পত্র প্রকাশিত হয়েছিল বাঙলা ১৩২১-এর
বৈশাখ মাসে। প্রথম সংখ্যায় ‘মুখপত্র’ শিরোনামে প্রমথ চৌধুরী পত্রিকা প্রকাশের যে
উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন তা এ-রকম,
[ক]. ‘একথা শুনে
অনেকে হয়ত বলবেন যে,
যে দেশে এত দিকে এত অভাব, সে দেশে যে লেখা তার একটি অভাবও পূরণ করতে না পারে, সে লেখা
সাহিত্য নয়, -সখ।
ও ত কল্পনার আকাশে রঙীন কাগজের ঘুড়ি ওড়ানো, এবং সে ঘুড়ি যত শীঘ্র কাটা পড়ে’
নিরুদ্দেশ হয়ে যায় ততই ভাল। অবশ্য ঘুড়ি ওড়াবারও একটা সার্থকতা আছে। ঘুড়ি
মানুষকে অন্ততঃ উপরের দিকে চেয়ে দেখতে শেখায়। তবুও একথা সত্য যে মানব-জীবনের
সঙ্গে যার ঘণিষ্ঠ সম্বন্ধ নেই, তা সাহিত্য নয়, তা শুধু বাকছল। জীবন অবলম্বন করেই
সাহিত্য জন্ম ও পুষ্টিলাভ করে, কিন্তু সে জীবন মানুষের দৈনিক জীবন নয়। সাহিত্য হাতে হাতে
মানুষের অন্নবস্ত্রের সংস্থান করে দিতে পারে না। কোনও কথায় চিড়ে ভেজে না, কিন্তু কোনও
কোনও কথায় মন ভেজে,
এবং সেই জাতির কথারই সাধারণ সংজ্ঞা হচ্ছে সাহিত্য।’
[খ]. মানুষ
মাত্রেরই মন কতক সুপ্ত আর কতক জাগ্রত। আমাদের মনের যে অংশটুকু জেগে আছে সেই
অংশটুকুকেই আমরা সাধারণ মন বলে ভুল করি, - নিদ্রিত অংশটুকুর অস্তিত্ব আমরা
মানিনে, কেন
না জানিনে। সাহিত্য মানব-জীবনের প্রধান সহায়, কারণ তার কাজ হচ্ছে মানুষের মনকে
ক্রমান্বয় নিদ্রার অধিকার হতে ছিনিয়ে নিয়ে জাগরূক করে তোলা। আমাদের বাঙলা
সাহিত্যের ভোরের পাখীরা যদি আমাদের প্রতিষ্ঠিত সবুজপত্র-মণ্ডিত সাহিত্যের নব শাখার
উপর এসে অবতীর্ণ হন,
তাহলে আমরা বাঙ্গালীজাতির সব চেয়ে যে বড় অভাব তা কতকট দূর করতে পারব। সে
অভাব হচ্ছে আমাদের মনের ও চরিত্রের অভাব যে কতটা, তারি জ্ঞান।’
[গ]. ‘সাহিত্য
এদেশে অদ্যাবধি ব্যবসা-বাণিজ্যের অঙ্গ হয়ে ওঠেনি; তার জন্য দোষী লেখক কি পাঠক, বলা কঠিন।
ফলে আমরা হচ্ছি সব সাহিত্য-সমাজের সখের কবির দল। অব্যবসায়ীর হাতে পৃথিবীর কোন
কাজই যে সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হয়ে ওঠে না, একথা সর্ব্বলোক স্বীকৃত। লেখা আমাদের
অধিকাংশ লেখকের পক্ষে,
কাজও নয় খেলাও নয়,
শুধু অকাজ; কারণ
খেলার ভিতর যে স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছন্দতা আছে, সে লেখায় তা নেই, - অপর দিকে
কাজের ভিতর যে যত্ন ও মন আছে, তাও তাতে নেই। আমাদের রচনার মধ্যে অন্যমনস্কতার পরিচয় পদে
পদে পাওয়া যায়; কেননা
যে অবসর আমাদের নেই,
সেই অবসরে আমরা সাহিত্য রচনা করি। আমরা অবলীলাক্রমে সাহিত্য গড়তে চাই বলে, আমাদের
নৈসর্গিক প্রতিভার উপর নির্ভর করা ব্যতীত উপায়ন্তর নেই। অথচ এ কথা লেখক মাত্রেরই
স্মরণ রাখা উচিত, যে
যিনি সরস্বতীর প্রতি অনুগ্রহ করে লেখেন, সরস্বতী চাই কি তার প্রতি অনুগ্রহ
নাও করতে পারেন। এই একটি কারণ যার জন্য বঙ্গসাহিত্য পুষ্পিত না হয়ে, পল্লবিত
হয়ে উঠেছে। ফুলের চাষ করতে হয়, জঙ্গল আপনি হয়। অতিকায় মাসিক পত্রগুলি সংখ্যাপূরণের জন্য
এই আগাছার অঙ্গীকার করতে বাধ্য, এবং সেই কারণে আগাছার বৃদ্ধির প্রশ্রয় দিতেও বাধ্য। এই সব
দেখে শুনে, ভয়ে
সঙ্কুচিত হয়ে, আমাদের
কাগজ ক্ষুদ্র আকার ধারণ করেছে। এই আকারের তারতম্যে; প্রকারেরও কিঞ্চিৎ তারতম্য হওয়া
অবশ্যম্ভাবী। আমাদের স্বল্পায়তন পত্রে, অনেক লেখা আমরা অগ্রাহ্য করতে বাধ্য
হব।’
সবুজ পত্রে’র আগেও প্রমথ চৌধুরী সাহিত্য রচনা
করেছেন। তার রচিত ‘জয়দেব’,
‘হালখাতা’, ‘কথার
কথা’, ‘আমরা
ও তোমরা’, ‘বইয়ের
ব্যবসা’, ‘নোবেল
প্রাইজ’ ইত্যাদি রচনা সবুজ পত্র প্রকাশিত হবার আগেই রচিত। সবুজ পত্রে
যখন তিনি লিখেছেন, তখনও
তার লেখার ষ্টাইল মোটামুটি অপরিবর্তিতই থেকেছে। তবে সবুজ পত্র তারই পত্রিকা
হওয়াতে তিনি ইচ্ছামত বিষয় বস্তু নির্বাচন ও প্রকাশের স্বাধীনতা পেয়েছেন। তার
গদ্য রচনার বিশেষ ধরন বীরবলী যুগের সৃষ্টি করেছে। প্রসঙ্গত বীরবল ছিল প্রমথ
চৌধুরীর ছদ্মনাম। তার লেখার ধরনের জন্য সেকালের অনেক সাময়িকপত্র তার লেখা প্রকাশ
করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল। কিন্তু সবুজ পত্রে’ তিনি ইচ্ছামত লেখার সুযোগ
পেয়েছেন। বস্তুত গল্প লেখক হিসাবে তার প্রতিষ্ঠা ‘সবুজ পত্র’কে আশ্রয়
করেই। তার রচিত ‘বড় বাবুর বড়দিন’, ‘আহুতি’ ,‘একটি সাদা
গল্প’ ‘চার-ইয়ারী কথা’ ইত্যাদি গল্পগুলো পাঠকসমাজ আগ্রহের সঙ্গেই গ্রহণ করেছে।
‘সবুজ
পত্রে’র আলোচনা রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে করা সম্ভব নয়।
প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ শুধু উৎসাহ দাতা নন, পত্রিকা প্রকাশের শুরু থেকে পরবর্তী
পর্যায়েও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি ত্রৈমাসিক ‘পরিচয়’ পত্রিকার
১৩৩৮ কার্তিক সংখ্যায় লিখেছেন,
‘বিশিষ্ট
সাহিত্যকে অবলম্বন ক’রে একটি মাসিক পত্র প্রকাশের প্রস্তাব নিয়ে একদিন মণিলাল
আমার কাছে এসেছিল। আমি জানতুম, এটা কঠিন কাজ, আমার অন্য কর্ত্তব্যের উপর এটা চাপলে
বোঝা দুঃসহ ভারী হবে তাই নিজে এ-দায় নিতে রাজী হলুম না। অথচ অত্যন্ত প্রয়োজন আছে
একথা অনেকদিন ভেবেচি তাই সঙ্কল্পটাকে একেবারে নামঞ্জুর ক’রতে পারলুম না। প্রমথকে
সম্পাদক ক’রতে পরামর্শ দিলুম। মণিলালের সঙ্গে প্রথম সর্ত্ত এই হোলো যে, যারা ওজন
দরে বা গজের মাপে সাহিত্য-বিচার ক’রে তাদের জন্যে এ-কাগজ হবে না। সব লেখাই পয়লা
নম্বরের হওয়া অসম্ভব,
দ্বিতীয় শ্রেণীতেও ভিড় হয় না, অতএব আয়তন ছোটো করতেই হবে। ছবি
দেওয়া নিষেধ, বিজ্ঞাপনের
বোঝাও পরিত্যাজ্য, তা’র
মানে মুনাফার লোভ থেকে দৃষ্টি যথাসম্ভব ফিরিয়ে আনা চাই।’
এরপর
কবিগুরুই পত্রিকাটির জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন এবং প্রমথ চৌধুরীকে লিখেন,
‘সেই কাগজটার কথা চিন্তা কোর। যদি সেটা বের করাই ঠিক হয়
তাহলে শুধু চিন্তা করলে হবেনা কিছু লিখতে শুরু কোরো। কাগজটার নাম যদি কণিষ্ঠ হয়
তা কি রকম হয়। আকারে ছোট বয়সেও। শুধু কালের হিসাবে ছোট বয়স নয়, ভারের হিসাবেও।’
বিষয়বস্তু
সম্বন্ধে তার চিন্তার আরও কিছু ছাপ পাওয়া যায় যখন তিনি লেখেন,
‘সবুজ পত্রে
মাঝে মাঝে কাজের কথা আলোচনা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি – বিশেষতঃ যে সব কাজের
মধ্যে নূতন চিন্তা ও নূতন চেষ্টার হাত আছে। অর্থাৎ সবুজ পত্রে কেবল ফুলের সূচনা
মাত্র করে না তাতে ফলেরও আয়োজন আছে এইটে প্রকাশ না হলে জিনিসটা একটু সৌখীন হয়ে
দাঁড়াবে। সৃষ্টির মধ্যে আরো-ভালোর ডাক কোনদিন থামে নি এবং কোনদিন থামবে না।
সবুজ-পত্রের সবুজত্ব এই নিয়ে। যে ডাকঘর দিয়ে এই পত্র আসছে সেই ডাকঘরে তুলট কাগজ
চলে না সেখানে হলদের আমেজ দেখা দিলেই তাকে
খসিয়ে দিয়ে সবুজ আপনার জয়পতাকা ওড়ায়। তাই সবুজের প্রেমিক আমার আবেদন এই যে, কাজের
ক্ষেত্রে পৃথিবীতে যেখানে নূতন চিন্তা ও নূতন চেষ্টা দেখা দিয়েছে, সেইখানকার
বার্ত্তা তোমার কাগজ বহন করে প্রচার করুক।’
সবুজ পত্রে’র কথা ভাবতে গিয়ে
রবীন্দ্রনাথ অন্য লেখার কাজে সময় দিতে পারেন নি। ভাইজি-জামাই প্রমথ চৌধুরীর সবুজ
পত্রে লিখতে গিয়ে তিনি রামানন্দর পত্রিকা ‘প্রবাসী’তে লিখতে পারেন নি।
ক্ষুব্ধ হন ‘প্রবাসী’ সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। ১৯১৪ সালের ১৯শে জুন
তার ক্ষোভ প্রশমনে শান্তিনিকেতন থেকে কবি চিঠি লেখেন রামানন্দকে,
‘প্রবাসীর
প্রতি আমার মমতা কিছুই কমে নাই। আমার মুস্কিল এই যে সবুজ পত্রে ঢাকা পড়িয়াছি।
ওটা আত্মীয়ের কাগজ বলিয়াই যে কেবল উহাতে আটকা পড়িয়াছি তাহা নহে। ওই কাগজটা
আমাদের দেশের বর্তমান কালের একটা উদ্দেশ্য সাধন করিবে বলিয়া আমার ধারনা হইয়াছে।’
সবুজ পত্র’কে একটি সার্থক সাহিত্য পত্রিকা
হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিতে কবিগুরুর চিন্তার অন্ত ছিল না। তিনি চেয়েছিলেন একটা নতুন
লেখক গোষ্ঠি গড়ে তুলতে যেটা পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য সফল করতে প্রয়াসী হবে।
তিনি প্রমথ চৌধুরীকে লিখেন,
‘যত পার নতুন
লেখক টেনে নাও – লিখতে লিখতে তারা তৈরি হয়ে নেবে। কাগজের আদর্শ সম্বন্ধে অত্যন্ত
বেশি কড়া হলে নিষ্ফল হতে হবে। সাময়িক সাহিত্য অত্যন্ত বেশি যদি খুঁৎখুঁতে হয়
তাহলে তাকে বিলেতের Old
maid-এর মত যৌবন ব্যর্থ করে নিঃসন্তান শুকিয়ে মরতে হবে। চির
সাময়িক সাহিত্যই অত্যন্ত সতর্ক হয়ে যাচাই ও বাছাই করে সাময়িক সাহিত্য আমদরবার; খোষদরবার
নয়।’
পত্রিকার শুরুতে লেখা তেমন ছিল না। এটা রবীন্দ্রনাথের পছন্দ হয় নি। ১৩২১-এর
চৈত্র সংখ্যা সবুজ পত্র কেবলমাত্র রবীন্দ্রনাথের লেখা দিয়েই সুশোভিত
হয়েছে। প্রকাশিত সংখ্যাটি সম্বন্ধে মানসী পত্রিকার মন্তব্য,
‘এবারের সবুজ
পত্রের নূতনত্ব আছে লেখক একা রবীন্দ্রনাথ, সম্পাদক মুখপত্রে নামাবশেষ হইয়াই
আছেন। সেদিন একজন বন্ধু বলিতেছিলেন, সবুজ পত্রের এমন সম্পাদক আমিও হইতে
পারি, কিন্তু মুখপত্রে নামটি ছাপিতে রাজী নই।’
অন্যান্য যারা সবুজ পত্রে প্রবন্ধ লিখেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ
চৌধুরী, সুনীতিকুমার
চট্টোপাধ্যায়, অতুলচন্দ্র
গুপ্ত, ব্রজেন্দ্রনাথ
শীল, ধূর্জটিপ্রসাদ
মুখোপাধ্যায়, বরদাচরণ
গুপ্ত, সতীশ
চন্দ্র ঘটক, হৃষিকেশ
সেন, সুরেশ
চন্দ্র চক্রবর্ত্তী,
কিরণশঙ্কর রায়,
সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর,
কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য প্রমুখ। কবিতা রচনায় রয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ
চৌধুরী, সুরেশানন্দ
ভট্টাচার্য, অমিয়
চক্রবর্ত্তী, সুরেশ
চন্দ্র চক্রবর্ত্তী,
কান্তিচন্দ্র ঘোষ ইত্যাদি।
গল্প লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রমথ চৌধুরী, সতীশচন্দ্র
ঘটক, কিরণশঙ্কর
রায়, বীরেশ্বর
মজুমদার প্রভৃতি লেখকেরা। এখানে প্রমথ চৌধুরীর বিদূষী বহুভাষাবিদ স্ত্রী ইন্দিরা
দেবী চৌধুরাণীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রমথ চৌধুরী স্বয়ং উৎসাহিত না করলে বা
রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ না থাকলে ইন্দিরা যে সাহিত্য ক্ষেত্রেও সমান পারদর্শী একথা
অজ্ঞাতই থাকত।
রবীন্দ্রনাথ চাইলেও সবুজ-পত্রে’র লেখক গোষ্ঠি কিন্তু সেভাবে গ’ড়ে ওঠেনি। অনেকে লিখলেও পত্রিকার নিয়মিত ও নিজস্ব লেখক ছিল খুবই কম। রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরীকে বাদ দিলে সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী, কান্তিচন্দ্র ঘোষ, সতীশচন্দ্র ঘটক, অতুলচন্দ্র গুপ্ত প্রভৃতি কয়েকজন এই শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। কিরণশঙ্কর রায়, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন কম কিন্তু গুণগত মান ছিল প্রশংসনীয়।
রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাস ‘সবুজ পত্রে’ই প্রথম প্রকাশিত হয়।
পত্রিকার প্রকাশ কিন্তু মাঝে মাঝেই অনিয়মিত হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের
এটা মনঃপুত ছিল না। তিনি লিখেছেন,
‘ফাগুনের
সবুজ-পত্র বার করতে আর বেশি দেরি কোরোনা – তারপর চৈত্রের প্রথম সপ্তাহেই তোমার
লেখাটি বেরিয়ে যাক। তাহলে বেশি দেরি হবে না। এ মাসের সবুজ-পত্রের কপি কি সব তৈরি
হয় নি ? ঘরে-বাইরে
ত দিয়েছি সেটা ফর্মা চারেক হবে। তোমারও
কিছু কিছু লেখা নিশ্চয়ই আছে যদি প্রফুল্ল
চক্রবর্ত্তির কিছু থাকে দিয়ে দিয়ো। তার পরেই তোমার গল্পটি ছাপা হতে থাক। তাহলে
১লা চৈত্রই বেরোতে পারবে।’
পত্রিকার অনিয়মিত প্রকাশ সম্বন্ধে সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীও যথেষ্ট সচেতন ছিলেন।
১৩২৪ বৈশাখ সংখ্যায় ‘সম্পাদকের কৈফিয়ৎ’-এ তিনি লিখেছেন,
‘কিন্তু সবুজ
পত্র যে শেষ ছ’মাস ঠিক মাসে মাসে বেরোয় নি, এটাই হয়েছে তার মহাত্রুটি।
শ্রীযুক্ত কিরণশঙ্কর রায় তারিখের শাসন না মানবার পক্ষে যে যুক্তি দেখিয়েছেন সে
সব যতই সুযুক্তি হোক না কেন আমরা যে এ ক্ষেত্রে শাসনের নিয়ম লঙ্ঘন করেছি, তার একমাত্র
কারণ সে নিয়ম রক্ষা করা আমাদের পক্ষে সব সময় সম্ভবপর হয় নি।’
সবুজ পত্র যে কতটা রবীন্দ্রনির্ভর ছিল;
সেটা সম্পাদক প্রমথ চৌধুরীর বক্তব্যেই পরিষ্কার ফু’টে উঠেছে,
[ক]. ‘সবুজ পত্রের
বিরুদ্ধে নানারূপ বদনাম থাকা সত্ত্বেও তার একটি বিশেষ সুনাম আছে। জনরব যে এ পত্রের
সম্পাদক রবীন্দ্রনাথের বেনামদার। এ প্রবাদটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হলেও, প্রকৃতপক্ষে
মিথ্যা নয়। সকলেই জানেন যে প্রথম দু বৎসর রবীন্দ্রনাথের লেখাই ছিল – কি ওজনে, কি পরিমাণে
– এ পত্রের প্রধান সম্পদ। সবুজ পত্র বাঙ্গলার পাঠকসমাজে যদি কোনরূপ প্রতিষ্ঠা ও
মর্য্যাদালাভ করে থাকে ত সে মুখ্যতঃ তার লেখার গুণে।’
[খ]. ‘রবীন্দ্রনাথের
সাহায্য ব্যতীত আমি যে এ কাগজ চালাতে পারব, এ ভরসা আমার আদপেই ছিল না। আমার
ক্ষমতার সীমা আমি জানি। সুতরাং মাসের পর মাস একখানি করে গোটা সবুজ পত্র আমার পক্ষে
একহাতে গড়ে তোলা যে অসম্ভব, -এ জ্ঞান আমি কখনই হারাই নি। এ ত গেল লেখার কথা। তারপর আসে
পরের লেখার সম্পাদনের কথা;
সে বিষয়েও আমার কোন অভিজ্ঞতা ছিল না, কেন না সবুজ পত্রের সম্পাদককে ও
কাজের বালাই নিয়ে বড় একটা ভুগতে হয় নি। প্রথমতঃ রবীন্দ্রনাথের লেখার উপর
হস্তক্ষেপ করার অধিকার পৃথিবীর কোন দেশের কোন সম্পাদকেরই নেই – দ্বিতীয়তঃ, আমার নিজের
লেখার উপর হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার চিরদিনই ছিল, - কিন্তু সে লেখক হিসাবে, সম্পাদক
হিসাবে নয়। এই কারণে আমি গত বৎসর সবুজ পত্র বন্ধ করে দেবারি পক্ষপাতী ছিলুম।
শেষটা কিন্তু যাঁর অভিপ্রায়মত সবুজ পত্র প্রকাশ করা হয়, তাঁরই
ইচ্ছামত ও পত্র বাঁচিয়ে রাখতে আমি প্রতিশ্রুত হই।’
এ-সব লক্ষ্য করেই বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘Sabujpatra was Rabindranath’s creation no less than
Pramath Chaudhuri’s.’
এ-সম্বন্ধে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘সবুজ পত্রের রাজা রবীন্দ্রনাথ, সামন্ত
প্রমথ চৌধুরী।’
সবুজ পত্রে’র আর একটি দোষ ছিল এটির ছাপার
ভুল। রবীন্দ্রনাথও মধ্যে মধ্যে এ-নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু প্রমথ
চৌধুরী এটাকে ততটা গুরুত্ব দেননি। তার মতে, ‘ছাপার ভুলকে আমি তেমন মারাত্মক দোষ
বলে মনে করি নে, কেননা
পাঠকমণ্ডলী ও ভুল নিজগুণেই অনায়াসে সংশোধন করে নিতে পারেন।’ পত্রিকাকে
সর্বাঙ্গসুন্দর বা আকর্ষণীয় করে তুলতে প্রমথ চৌধুরী কোন চেষ্টা করেননি, সে ধারণাও
হয়ত তার ছিল না। পত্রিকাতে কোন বিজ্ঞাপন বা চিত্র প্রকাশিত হতো না। তিনি শুধু
সাহিত্য রচনায় মন দিয়েছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘কলম চালানো আমার সখ, কাগজ চালানো
আমার ব্যবসা নয়।’
পরিশেষে, প্রমথ চৌধুরীর গদ্য রচনার ভাষা নিয়ে দু’একটি কথা। তার ব্যবহৃত কথ্য
ভাষা ও গদ্যরীতি বাঙলা সাহিত্যে বীরবলী ঢং
সৃষ্টি করেছে। এমন কি রবীন্দ্রনাথের উপরেও এর প্রভাব কার্যকরী হয়েছে বলে অনেকে
মনে করেন। প্রয়াত অধ্যাপক জীবেন্দ্র সিংহ রায় ‘বীরবল’ তথা প্রমথ চৌধুরীর রচনা ও
সাহিত্যপ্রতিভা নিয়ে প্রশংসনীয় গবেষণা করেছেন। তার মতে, ‘রবীন্দ্র প্রতিভা
বিচিত্র। তার গদ্য-সাহিত্যও সেই বৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত হয় নি। একটু বিশ্লেষণমূলক
দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা করলেই দেখা যায়, তাঁর গদ্যের ভঙ্গির বারে বারে
কম-বেশি বদল হয়েছে। তার মধ্যে সবুজ-পত্রে’র সমকালীন গদ্যরীতির নবরূপ
বিস্ময়কর। এই সময়ের রবীন্দ-গদ্য মৌখিক ভাষায় রচিত; তা
অনাড়ম্বর সৌন্দর্য্যবিশিষ্ট, epigrammatic, সচল,সবল ও মধুর। শিল্পীসুলভ
বৈচিত্র্যপূজারী রবীন্দ্রনাথের এই অভিনব গদ্যরীতির পেছনে আছে সবুজ-পত্রে’র এবং
প্রমথ চৌধুরীর প্রভাব। এর আগে ‘ছিন্নপত্র’, ‘য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র’, ‘য়ুরোপ
যাত্রীর ডায়েরী’ ইত্যাদিতে তিনি মৌখিক ভাষা ব্যবহার করলেও মৌখিক ভাষা তাঁর গদ্য
রচনার একমাত্র বাহন হ’য়ে ওঠেনি। কিন্তু সবুজ-পত্র প্রকাশের প্রায় সঙ্গে
সঙ্গে তিনি যে সমগ্রভাবে মৌখিক ভাষার আশ্রয় গ্রহণ করলেন তা আর কোনদিন পরিত্যাগ
করেন নি। এটা পত্রিকাটির পক্ষে যথার্থই গর্বের কথা।’
তবে সবুজ পত্র রবীন্দ্রনাথের রচনাকে প্রভাবিত করে তার রচনারীতির
পরিবর্তন সাধন করেছে,
না রবীন্দ্রনাথ সবুজপত্রের মাধ্যমে তার গদ্য রচনার ধরনকে স্থায়ী রূপ দিতে
চেয়েছেন সেটা ভেবে দেখার।
১৩২১-এর বৈশাখ থেকে ১৩২৭-এর চৈত্র পর্যন্ত সবুজ পত্র একটানা প্রকাশিত
হয়েছে। অবশ্য
মাঝে মাঝে দু’মাসের যুগ্ম-সংখ্যাও বেরিয়েছে। ১৩২৮-এর বৈশাখ থেকে আষাঢ়, এই তিন
মাস পত্রিকা বেরোয়নি,
পরে ১৩৩৪-এর ভাদ্র সংখ্যা অবধি বেরিয়ে সবুজ পত্র বন্ধ হয়ে যায়। ১৩২১
বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের পর তার লেখার চাহিদা আস্বাভাবিক বেড়ে
যায়। সবুজ পত্র, যে ১৩ বছর সচল ছিল তার পেছনে যে রবীন্দ্রনাথের অবদান
রয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথ হয়তো ভেবেছিলেন সবুজপত্র’কে
কেন্দ্র করে একটা নতুন লেখক গোষ্ঠি তৈরি হয়ে গেলে তিনি খানিকটা ভার মুক্ত হবেন,কিন্তু সেটা
ঘটেনি। তিনি লিখেছেন,
‘যাই হোক ভার
কমল না। সাময়িক কাগজের বাঁধা ফরমাস জুগিয়ে চলা সেকেলে ট্রামগাড়ির ঘোড়ার মত
দুঃখী জীবের কাজ। মন ছুটি চাইল, ক্লান্ত হ’য়ে শেষকালে জবাব দিলুম। বন্ধ হোলো চিত্রিবিহীন
ফর্ম্মাবিরল সবুজ পত্র।’
বঙ্কিমচন্দ্রের
বঙ্গদর্শনে’র মতই, রবীন্দ্রনাথ, সবুজপত্রে’র উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল
বলেই মনে করেন।
পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক পদে পরে সুরেশ চন্দ্র চক্রবর্ত্তী যোগদান করেছেন এবং
প্রকাশিত হয়েছে সবুজপত্র কার্য্যালয়, ৩নং হেস্টিংস হাউস থেকে। বার্ষিক
মূল্য কিন্তু ‘দুই টাকা ছয় আনা’ই ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চার বছর বঙ্গদর্শন
সম্পাদনার পর বলেছিলেন,
যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন, সেটা সফল
হয়েছে; বঙ্গদর্শন-এর
আর প্রয়োজন নেই। সবুজ পত্র সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ওই কাগজটা
আমাদের দেশের বর্তমান কালের একটা উদ্দেশ্য সাধন করিবে বলিয়া আমার ধারনা হইয়াছে’।
অন্যত্র লিখেছেন,
‘ফর্মা গণনা
ক’রে সবুজ পত্রের আয়ু নির্ণয় কোরো না। সবুজ পত্র বাঙলা ভাষার মোড় ফিরিয়ে দিয়ে গেল। এ-জন্যে যে-সাহস
যে-কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েচে তার সম্পূর্ণ গৌরব একা প্রমথনাথের। এর পূর্বে সাহিত্যে
চলতি ভাষার প্রবেশ একেবারে ছিল না তা নয় কিন্তু সে ছিল খিড়কির রাস্তায় অন্দর
মহলে। ফোর্ট উইলিয়মের পন্ডিতেরা সংস্কৃত বেড়া তুলে দখল ঠেকিয়ে রেখেছিলেন।’
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন