সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যু-রহস্য

 

উনিশ শতকের বাংলার আধুনিকতা, বাণিজ্যিক উন্মেষ, সামাজিক সংস্কার ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণের যে ইতিহাস নির্মিত হয়েছিল, তার কেন্দ্রে অন্যতম উজ্জ্বল নাম দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬)। ঠাকুর পরিবারের বাণিজ্যিক পুনর্জাগরণ, জমিদারি সংস্কার, ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয়দের আর্থিক স্বাবলম্বনের চিন্তা এবং ইউরোপীয় শিল্প-সভ্যতার সঙ্গে বাঙালির প্রত্যক্ষ সংযোগ এসবের পেছনে তিনি ছিলেন একাধারে উদ্যোক্তা, দূরদর্শী এবং তৎকালীন সমাজবোধে ব্যতিক্রমী এক প্রতিভা। তাঁর শৌখিনতা, উদারতা, সাহসিকতা এবং অতুলনীয় ব্যয়বহুল জীবনযাপন তাঁকে যেমন সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় এনেছিল, তেমনি ব্রিটিশ কোম্পানির প্রশাসনের কাছেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অস্বস্তিকর চরিত্র। এই অসামান্য জীবনের আকস্মিক সমাপ্তি ১৮৪৬ সালের ১ আগস্ট লন্ডনে তাঁর মৃত্যু আজও নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়, কারণ ঘটনাপ্রবাহের অসংগতি, নথির অনুপস্থিতি এবং প্রশাসনিক তৎপরতার অস্বাভাবিক দ্রুততা সন্দেহকে আরও ঘনীভূত করে তুলেছে। তাঁর মৃত্যু-রহস্য তাই শুধু জীবনীমূলক অধ্যায় নয়, বরং ঔপনিবেশিক ভারতের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক খণ্ডচিত্রেও গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক।

দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যু-রহস্য বোঝার জন্য তাঁর ইউরোপযাত্রার কারণ, আর্থিক অবস্থার টানাপোড়েন, ব্রিটিশ প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য-জটিলতা সবই একত্রে বিবেচনা করতে হয়। কারণ তাঁর মৃত্যুকে কোনো একক ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না; বরং বহুস্তরীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা একত্রে তাঁর শেষ পরিণতিকে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর আর্থিক সাম্রাজ্য যেমন তাঁর শক্তি ছিল, তেমনি তা ছিল অসংখ্য ঋণের জালে আটকে থাকা একটি নাজুক কাঠামো। জমিদারি, নীলকর ব্যবসা, কয়লা শিল্প, স্টিমারের বাণিজ্য সব মিলিয়ে তিনি ভারতীয় উদ্যোক্তাদের জন্য পথিকৃৎ হলেও তাঁকে ঘিরে আর্থিক প্রশাসনিক দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঈর্ষাও জন্মেছিল। ফলে তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ে যে আর্থিক সঙ্কট দেখা দেয়, তা তাঁকে বাধ্য করেছিল ইউরোপের দিকে ধাবিত হতে পুঁজিপতিদের সঙ্গে নতুন চুক্তি, পুরোনো ঋণ পুনর্গঠন, এবং নিজস্ব ব্যবসার পুনরুদ্ধার করার আশায়।

ইউরোপে পৌঁছে দ্বারকানাথ ছিলেন অভিজাতদের চোখে এক ধরনের ‘ইস্টার্ন প্রিন্স’, যার বিলাসী জীবনযাপন এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা রাজকীয় সম্মান অর্জন করেছিল। তাকে বিভিন্ন বলরুম পার্টি, সম্মাননাসভা, রাজনৈতিক চা–আসরে আমন্ত্রণ জানানো হতো। ইউরোপীয় সংবাদপত্রে তাঁকে বর্ণনা করা হতো একজন ধনী, অভিজাত, উদার চরিত্র হিসেবে; কেউ কেউ তাঁকে ভারতীয় ঐশ্বর্যের প্রতীক বলেও উল্লেখ করত। কিন্তু এই সামাজিক স্বীকৃতির আড়ালে ছিল এক চাপা আর্থিক সঙ্কট, যা দ্বারকানাথ সম্পূর্ণ গোপন রেখেছিলেন। তাঁর বহু শিল্প উদ্যোগ ক্ষতির মুখে পড়ে, অংশীদারদের সঙ্গে বিরোধ বাড়ে, ঋণদাতারা চাপ সৃষ্টি করে, এবং ব্রিটিশ বাণিজ্যনীতির কারণে ভারতীয় উদ্যোগগুলো বারবার সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে তাঁর ইউরোপযাত্রা বাস্তবে এক মরিয়া চেষ্টার ফল, যা তিনি কখনো পরিবারের কাছে প্রকাশ করেননি।

তাঁর স্বাস্থ্যও ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছিল। সমসাময়িক সূত্রে জানা যায় তিনি লিভার সংক্রান্ত অসুখে ভুগছিলেন, দীর্ঘদিনের অতিরিক্ত কাজের চাপ ও ক্লান্তি সঞ্চিত হয়েছিল, আর ব্যয়বহুল ইউরোপীয় জীবনযাপন তাঁর শরীরকে দ্রুত দুর্বল করে তুলেছিল। তবে তাঁর সঙ্গীরা স্বীকার করেছেন যে মৃত্যুর আগের কয়েক সপ্তাহ তিনি প্রায়ই মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট এবং প্রচণ্ড দুর্বলতার কথা বলতেন। তবুও তিনি সফর কমাননি, কারণ ব্যবসায়িক আলোচনাগুলো তাঁর কাছে ছিল জরুরি। মৃত্যুর তিন দিন আগেও তাঁকে লন্ডনের অভিজাত চক্রে দেখা গেছে, যদিও তিনি তখনও শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন।

তাঁর মৃত্যু নিয়ে সবচেয়ে বিতর্কিত প্রশ্ন হলো ঘটনাটি কতটা ‘স্বাভাবিক’? প্রথমত, তাঁর মৃত্যুর দিন রাতে তাঁর শরীর হঠাৎ খারাপ হয়; কেউ বলেছেন বুকে ব্যথা, কেউ বলেছেন শ্বাসরোধ, কেউ বলেছেন স্ট্রোক। কিন্তু চিকিৎসকদের কোনো নথি আজও পাওয়া যায় না একটি অস্বাভাবিক অনুপস্থিতি, যা অনেক প্রশ্ন তোলে। তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ প্রশাসন ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর দেহদাহের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং পরদিনই তাঁর দেহ হংসলোর সমাধিক্ষেত্রে দাহ করা হয়। উল্লেখ্য, সে সময় ইংল্যান্ডে হিন্দু ধর্মীয় দাহকার্যের জন্য আলাদা ব্যবস্থা ছিল না। ফলে প্রশ্ন ওঠে এত দ্রুত দাহের কারণ কী? তাঁর মৃত্যু যদি স্বাভাবিকই হয়ে থাকে, তবে কেন তাঁর পরিবারের উপস্থিতির জন্য অপেক্ষা করা হলো না? কেন দেহ সংরক্ষণ করা হলো না? কেন কোনো অফিসিয়াল ‘ডেথ সার্টিফিকেট’ সংরক্ষিত নেই? এসব প্রশ্নই তাঁকে ঘিরে রহস্যকে আরো ঘনীভূত করেছে।

সমালোচকরা বলেছেন, দ্বারকানাথের আর্থিক দেনা এত বেশি ছিল যে তাঁর মৃত্যুর পর ঋণদাতাদের মধ্যে বিশাল ধাক্কা লাগতে পারত, এবং ব্রিটিশ প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে বিষয়টিকে রাজনৈতিক-ব্যবসায়িক ঝুঁকি থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিল। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ব্যবসায়িক নথির বড় অংশ হারিয়ে যায়। তাঁর অনেক সম্পদ ঋণের দায়ে বাজেয়াপ্ত হয়, এবং পরে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই দায়ভার দীর্ঘদিন ধরে পরিশোধ করেন। এই আর্থিক নথির বিচ্ছিন্নতা অনেককে সন্দেহ করতে বাধ্য করেছে যে হয়তো তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক গোপন বিষয় যুক্ত ছিল। যদিও এ সম্পর্কে কোনো সরাসরি প্রমাণ নেই, তবে প্রমাণের অনুপস্থিতিই কখনও কখনও সন্দেহকে আরও তীব্র করে তোলে।

আরেকটি বিষয় হলো, দ্বারকানাথ ব্রিটিশ কোম্পানির চোখে অস্বস্তিকর ছিলেন। তিনি ভারতীয়দের জন্য স্বাধীন শিল্পব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছিলেন, ইউরোপীয় ব্যবসায়ীর সঙ্গে সরাসরি চুক্তি করতে চাইছিলেন, এবং ভারতীয়দের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনকে সমর্থন করছিলেন। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জন্য এটি ছিল স্পষ্টতই একটি হুমকি। কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যনীতির সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত ছিল তীব্র। তিনি ছিলেন শিক্ষিত, রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী একজন বাঙালি যার উপস্থিতি ব্রিটিশদের কাছে সবসময়ই খটকা সৃষ্টি করত। ফলে মৃত্যুকে ঘিরে রাজনৈতিক ব্যাখ্যাগুলিও বাতিল করার মতো নয়।

এছাড়া সমসাময়িক ইউরোপীয় কিছু সংবাদপত্রে দ্বারকানাথের মৃত্যুকে ঘিরে বিভ্রান্তিকর বিবরণ প্রকাশিত হয় কেউ তাঁকে ভারতীয় ‘রাজপুত্র’, কেউ তাঁকে ধনী জমিদার, কেউ আবার তাঁর বিলাসী জীবনকে মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখিয়েছিল। কিন্তু কেউই পরিষ্কারভাবে চিকিৎসাগত কারণ উল্লেখ করেনি। তাঁর সঙ্গে থাকা ভারতীয় সহকারী লালবিহারী সেনের বয়ানে অসঙ্গতি আছে; কখনও তিনি বলেছেন মৃত্যু হঠাৎ হয়েছিল, আবার কখনও বলেছেন অসুস্থতা কয়েক সপ্তাহ ধরেই চলছিল। এই ধরনের বিবরণ মৃত্যু-রহস্যকে আরও অস্বচ্ছ করে তোলে।

দ্বারকানাথ ঠাকুরের মৃত্যু শুধুই ব্যক্তিগত বেদনার ঘটনা নয়, তা ঠাকুর পরিবারকেও গভীরভাবে নাড়িয়ে দেয়। তাঁর মৃত্যুর পর পরিবারকে বিপুল ঋণের দায় সামলাতে হয়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের বড় একটি অধ্যায় কেটে যায় এসব দেনা পরিশোধের কাজে, এবং পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর পূর্বপুরুষের এই ইতিহাস সম্পর্কে গভীরভাবে সচেতন ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনায় দাদার মহানুভবতা ও স্বপ্নের কথা উল্লেখ করলেও মৃত্যুর রহস্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করেননি; এটি হয়তো পরিবারের এক ধরনের নীরব সম্মতির ফল।

ঐতিহাসিকেরা আজ দ্বারকানাথের মৃত্যু সম্পর্কে তিনটি মূল ব্যাখ্যা দিয়েছেন। প্রথমত, এটি প্রকৃতই অসুস্থতার কারণে হওয়া একটি স্বাভাবিক মৃত্যু; দ্বিতীয়ত, এটি স্বাভাবিক মৃত্যু হলেও প্রশাসনিক অস্বাভাবিকতা ঘটনাটিকে সন্দেহজনক করে তুলেছে; তৃতীয়ত, এটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফল হতে পারে, যদিও প্রমাণ অনুপস্থিত। তবে তাঁর মৃত্যুর পর ঘটা ঘটনাগুলি দ্রুত দাহ, চিকিৎসা-রিপোর্টের অনুপস্থিতি, নথি হারিয়ে যাওয়া, এবং তৎকালীন ব্রিটিশ প্রশাসনের সক্রিয়তা তৃতীয় ব্যাখাটিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা কঠিন করে তোলে।

যা–ই হোক, দ্বারকানাথের মৃত্যু-রহস্য তাঁর জীবনসংগ্রামের বৈপরীত্যগুলোকে আরও স্পষ্ট করে দেয়। একদিকে তিনি ছিলেন ভারতীয় নবজাগরণের বাতিঘর, উদ্যোক্তা, শিল্পোদ্যোগী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রবর্তক; অন্যদিকে তাঁর জীবন ছিল ঋণ, ঝুঁকি, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সামাজিক চাপের ভারে নত। তাঁর মৃত্যু এই দ্বৈততারই প্রতিফলন—উজ্জ্বল স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তব দুঃখের সংঘাত। তাঁর অন্তর্ধান ইতিহাসে এক ধোঁয়াশা রেখে গেছে, কিন্তু তাঁর প্রচেষ্টা ও দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিকতার পথে বাঙালির অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করেছে।

উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক পরিবর্তন, অর্থনৈতিক শক্তির পুনর্গঠন এবং বাঙালি উদ্যোক্তা-মানসিকতার বিকাশে দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন এক অগ্রগামী চরিত্র। আধুনিক শিল্পবিপ্লবের স্বপ্ন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বিস্তার এবং ভারতীয় ব্যবসায়ী শ্রেণির শক্তি বৃদ্ধির যে ধারণা তিনি প্রচার করছিলেন, তা তাঁকে শুধু জমিদার বা ধনকুবের হিসেবে নয় বরং ঔপনিবেশিক ভারতের অন্যতম চিন্তাশীল উদ্যোক্তা হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু ১৮৪৬ সালে লন্ডনের সেন্ট জর্জেস হোটেলে তাঁর আকস্মিক মৃত্যু ঐতিহাসিকদের কাছে একটি জটিল ধাঁধার জন্ম দেয়। মৃত্যুর ঘটনায় প্রশাসনিক দ্রুততা, চিকিৎসার নথিপত্রের অনুপস্থিতি, তাঁর আর্থিক দায়ের রহস্য, এবং মৃত্যুর পর নথিগুলোর হারিয়ে যাওয়া এ ঘটনাকে ‘অস্বচ্ছ, বহুস্তরীয়, এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক’ করে তুলেছে। এই গবেষণায় দ্বারকানাথের মৃত্যু-রহস্যকে ঘিরে প্রধান উৎস, প্রাপ্ত প্রমাণ, সমসাময়িক মতামত, এবং আধুনিক গবেষকদের ব্যাখ্যা পর্যালোচনা করা হলো।

ঐতিহাসিক নথিতে জানা যায় যে দ্বারকানাথের ইউরোপযাত্রার উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্যিক। তাঁর বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্যোগ কয়লা শিল্প (Raniganj), নীলচাষ, জমিদারি, স্টিমার ব্যবসা—১৮৪০-এর দশকে ধারাবাহিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কড়া নিয়ন্ত্রণনীতি তাঁর উদ্যোগকে সীমাবদ্ধ করে, এবং তাঁর আর্থিক ঘাটতি দ্রুত বাড়তে থাকে। সুকুমার সেন লিখেছেন, “দ্বারকানাথের আর্থিক সাম্রাজ্য প্রকৃতপক্ষে ছিল ঋণ ও সম্পদের দোলাচলে দাঁড়িয়ে থাকা এক ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্য কাঠামো” (Sen, The Tagores of Jorasanko, 1948)। তবে পরিবার এবং সমালোচকদের চোখে তাঁর ‘রাজপ্রসাদসম জীবনযাপন’ এই সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছিল।

ইউরোপে পৌঁছে দ্বারকানাথকে ঘিরে একটি অদ্ভুত দ্বৈত ধারণা তৈরি হয়েছিল। লন্ডনের Illustrated London News তাঁকে বর্ণনা করেছে “The Prince-like Hindu millionaire” একজন দাতা, জ্ঞানপিপাসু, আন্তর্জাতিক আধুনিকতার প্রতিনিধি হিসেবে। আবার অন্যদিকে কিছু সংবাদপত্র তাঁর ব্যয়বহুল জীবনকে সমালোচনা করেছে। হেনরি টেম্পল স্মিথ তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, দ্বারকানাথ “good-hearted but financially over-extended” (Smith, Memoirs on India, 1862)। এই দ্বৈততার মধ্যে তাঁর স্বাস্থ্য ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছিল। চিকিৎসকদের মতে তিনি লিভারের জটিলতায় ভুগছিলেন, যদিও এর কোনো নথি আজ সংরক্ষিত নেই।

মৃত্যুর আগের দিন তাঁর শরীর খারাপ হয়। আধুনিক গবেষক ব্রায়ান হিচিন্স লিখেছেন, “His sudden illness escalated too rapidly to be considered ordinary, and the lack of medical documentation leaves a historical void” (Hitchens, Early Bengal Industrialists, 1997) । তাঁর হোটেল-কক্ষে উপস্থিত ভারতীয় সহকারী লালবিহারী সেন পরবর্তী সাক্ষাৎকারে বলেছেন—শরীর খারাপ ‘অতর্কিতে’ হয়েছিল। কিন্তু অন্য বর্ণনায় দেখা যায় তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই দুর্বল ছিলেন। এই অসঙ্গতি গবেষকদের বিভ্রান্ত করেছে।

সবচেয়ে রহস্যজনক অংশ শুরু হয় তাঁর মৃত্যুর পর। লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশের নির্দেশে তাঁর দেহ দ্রুত দাহ করা হয়। শ্মশান না থাকা সত্ত্বেও, কিছুটা অস্থায়ী ব্যবস্থায় দাহকাজ সম্পন্ন হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দেহদাহের সিদ্ধান্ত অনেককে সন্দেহ করায়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরে লিখেছেন “We could not understand the haste with which the Europeans disposed of my father’s body” (Debendranath Tagore, Autobiography, 1908) । এই বিবৃতি রহস্যকে আরও গভীর করে।

অন্যদিকে তাঁর ব্যবসায়িক নথির একটি বড় অংশ মৃত্যুর পর অদৃশ্য হয়ে যায়। পরবর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, তাঁর দেনার পরিমাণ ছিল বিপুল। রণজিৎ মজুমদার তাঁর বিশ্লেষণে উল্লেখ করেন “A sudden death helped the closure of a large number of unsettled business liabilities, many involving British partners” (Majumdar, Bengal Entrepreneurs and Empire, 1981) । এটি অনেকে ‘পরিস্থিতিগত সুবিধা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।

তবে তাঁর মৃত্যুকে ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে বিবেচনা করার মতো সরাসরি প্রমাণ নেই। বরং ইতিহাসবিদ অনিল দত্ত মনে করেন, “দ্বারকানাথের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু উপনিবেশিক প্রশাসন ঘটনাটি এমনভাবে পরিচালনা করে যে পরে তা রহস্যের জন্ম দেয়” (Dutta, Studies on Bengal Renaissance, 2003) । অর্থাৎ মৃত্যু-ঘটনার পর প্রশাসনিক দ্রুততামূলক ব্যবস্থাপনাই মূল বিভ্রান্তির উৎস।

তবে তাঁর ব্রিটিশ-বিরোধী অর্থনীতিক ধারণা, ভারতীয়দের জন্য পৃথক শিল্পভিত্তিক ক্ষমতা নির্মাণের আহ্বান, এবং ইংরেজ একচেটিয়া পদ্ধতির সরাসরি সমালোচনা এসব দিক বিবেচনা করলে রাজনৈতিক সন্দেহ পুরোপুরি বাতিল করা যায় না। বিশেষত এই কারণেই মৃত্যুর পর সরকারি নথিপত্র অপ্রাপ্য থাকার বিষয়টি প্রশ্নকে আরও ঘনীভূত করেছে। এমনকি তাঁর অবস্থানরত হোটেল-কক্ষের কাগজপত্রও পরিবার পায়নি যা সমসাময়িক সুরক্ষানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

পরবর্তী সময়ে তাঁর মৃত্যুর আর্থিক অভিঘাত ঠাকুর পরিবারকে চরম সংকটে ফেলে। দেবেন্দ্রনাথ বহু বছর ধরে ঋণ পরিশোধে লিপ্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর দাদার জীবন নিয়ে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে লিখেছেন “He dreamt beyond his century, and perhaps beyond the safety of his own life” (Rabindranath Tagore, Selected Essays, 1927) । যদিও তিনি কখনো মৃত্যুর রহস্য নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু লেখেননি—যা হয়তো পরিবারের নীরবতা বা রাজনৈতিক বিবেচনার ফল।

এই আলোচনার ভিত্তিতে দেখা যায় দ্বারকানাথের মৃত্যু-রহস্য তিনটি স্তরে বিশ্লেষণ করা যায়:
(১) চিকিৎসাজনিত ও শারীরিক অবনতি, যা একটি স্বাভাবিক মৃত্যুর ব্যাখ্যা দেয়।
(২) প্রশাসনিক দ্রুততা ও নথির অনুপস্থিতি, যা ঘটনাটিকে অস্পষ্ট করে।
(৩) অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, যা মৃত্যুর পিছনে সম্ভাব্য চাপের ইঙ্গিত দেয়।

তাঁর মৃত্যু তাই কেবল জৈবিক ঘটনা নয় বরং ঔপনিবেশিক ভারত, অর্থনৈতিক দমননীতি, ভারতীয় বণিকশ্রেণির উত্থান-ভয় এবং প্রশাসনিক অস্পষ্টতার সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ঐতিহাসিক ধাঁধা। এর কোনো নিশ্চিত সমাধান নেই, কিন্তু বহু উৎস-প্রমাণ বিশ্লেষণে অনুমান করা যায় যে মৃত্যু স্বাভাবিক হলেও এর পরবর্তী পর্যায়ের অস্বাভাবিকতা রহস্যকে দীর্ঘায়িত করেছে। বাংলার আধুনিক ইতিহাসে দ্বারকানাথ ঠাকুর তাই একদিকে প্রভূত সম্মানের, অন্যদিকে বিতর্কিত এক অধ্যায় একজন স্বপ্নদ্রষ্টা যিনি তাঁর সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

Reference Book:

1.        Debendranath Tagore. Autobiography of Debendranath Tagore. 1908.

2.        S. Sen. The Tagores of Jorasanko. Calcutta: 1948.

3.        Ranjit Majumdar. Bengal Entrepreneurs and Empire. Delhi: 1981.

4.        Brian Hitchens. Early Bengal Industrialists. Oxford University Press, 1997.

5.        Henry Temple Smith. Memoirs on India and the Orient. London: 1862.

6.        Anil Dutta. Studies on Bengal Renaissance. Kolkata: 2003.

7.        Rabindranath Tagore. Selected Essays. Visva-Bharati, 1927.

8.        “Death of Dwarkanath Tagore.” Illustrated London News, 1846 archives.


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রবন্ধঃ বিষ্ণু দে : ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ থেকে ‘চোরাবালি’

বিষ্ণু দে , তিরিশি কবিদের অন্যতম । কবিতা রচনাই যাঁর কাছে এক এবং অদ্বিতীয় হ ’ য়ে দেখা দেয় । কাব্যে সংখ্যার দিক থেকে অতিক্রম করেছেন সতীর্থদের । বিষ্ণু দে , যাঁর কবিতা রচনার সূচনা পর্বটিও শুরু হয় খুব দ্রুততম সময়ে । কবিতা সৃষ্টির পর্বটি অব্যাহত রেখেছেন সর্বদা । পঁচিশটি কবিতা নিয়ে ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এ নিজেকে প্রকাশ করেন স্ব - মহিমায় । যে কবিতাগুলা বিস্ময়বিমুগ্ধ ক ’ রে অন্যেদেরকেও । ওই কবিতা শুধু বিষ্ণু দে ’ কে নয় , বরং নতুনতর হ ’ য়ে দেখা দেয় বাঙলা কবিতা । বিষ্ণু দে ’ র ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’ রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হয়েছিল দু ’ বার । ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এর কবিতাগুলির রচনাকালের ব্যাপ্তি দেওয়া আছে ( ১৯২৮ - ১৯৩৩ ) সময়ের মধ্যে , এবং গ্রন্থকারে প্রকাশ পায় ওই একই বছরে অর্থাৎ , ১৯৩৩ - এ । কিন্তু রচনাকালের ব্যাপ্তি ১৯২৮ দেওয়া থাকলেও প্রকৃত পক্ষে এ সকল কবিতাগুলো রচনা পর্ব শুরু হয় আরো দু ’ বছর পূর্বে অর্থাৎ , ১৯২৬ - এ । যখন কবি হিশেবে বিষ্ণু দে একেবারেই নতুন এবং নবীন । ১৯৩৩ - এ ...

প্রবন্ধঃ অমিয় চক্রবর্তী : ‘বৃষ্টি’ নিয়ে তিনটি কবিতা

রবীন্দ্রনাথ, মেঘ-বরষা বৃষ্টি নিয়ে এতো সংখ্যক কবিতা লিখেছেন যে তাঁর সমান বা সমসংখ্যক কবিতা বাঙলায় কেউ লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কবিতায় বার বার এবং বহুবার ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, বরষা, বৃষ্টি। বৃষ্টি নামটি নিলেই মনে পড়ে কৈশোর পেড়িয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটির কথা। ‘দিনের আলো নিবে এল সূর্য্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।’ বৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার কথা মনে পড়লে এটাই চলে আসে আমার মনে। অমিয় চক্রবর্তী বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। বাঙলায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেনি এমন কবির সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় পাই ‘বৃষ্টি’ নামক কিছু সৌন্দর্যময় কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে। ওই কবিদের কারো কারো কবিতা দ্রুত নিঃশ্বাসে পড়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি নামক প্রথম কবিতাটি পাওয়া যাবে অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠোতে’। উন্নিশটি কবিতা নিয়ে গ’ড়ে উঠে ‘একমুঠো’ নামক কাব্য গ্রন্থটি। যেখান থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতায় তুলে নেওয়া হয় চারটি কবিতা। আমার আরো ভালোলাগে ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি ওই তালিকায় উঠে আসে। শ্রেষ্ঠ কবিতায় না আসলে আমার যে খুব খারাপ লাগতে তা-ও নয়। ওই কবিতা...

প্রবন্ধঃ বুদ্ধদেব বসু ও ‘কঙ্কাবতী’

বুদ্ধদেব বসু প্রেমের অজস্র কবিতা রচনা করেছেন । অন্য অনেকের মতো তিনিও বেছে নেন একজন প্রেমিকাকে , যে হ ’ য়ে উঠে বুদ্ধদেবের অতুল্য প্রেমিকা হিশেবে । ‘ কঙ্কাবতী ’ অনিন্দ্য প্রেমিকা হ ’ য়ে বুদ্ধদেবের কাব্যতে বিচরণ ক ’ রে স্বচ্ছন্দে । স্থির হয়ে বসে পড়ে কঙ্কাবতী ’ কাব্যগ্রন্থে । যে কাব্যগ্রন্থে ‘ কঙ্কাবতী ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে ‘ কঙ্কাবতীকে ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে কঙ্কাবতীকে আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো কবিতায় । যেখানে সে প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে কুৎসিত কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু নয় । প্রগাঢ় ভাবে প্রাপ্তির জন্যে সমস্ত কবিতা জুঁড়ে দেখতে পাই কবির অপরিবর্তনীয় আবেদন । কঙ্কাবতী , যাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময়ের জন্যে রক্তের হিমবাহে দেখা দেয় চঞ্চলতা । সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হাঁরিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো , যা বলার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন । প্রেমিকা যখন খুব কাছাকাছি হয়ে এগিয়ে আসেন , ওই ব্যর্থ ...