শামসুর রাহমানের (১৯২৯-২০০৬) কবিতার ভুবনে প্রবেশ করা মানে এমন এক
আলোক-অন্ধকারের জগতে প্রবেশ করা, যেখানে শব্দ শুধু প্রকাশের মাধ্যম নয়, বরং অস্তিত্বের
প্রমাণ। তাঁর কবিতা সেই শহরের মতো—যেখানে একদিকে আছে ধূলিধূসর রাস্তাঘাট, রাজনৈতিক
উত্থান,পতনের গর্জন, মুক্তির জন্য লড়াই করা মানুষের উদ্বেল আবেগ; অন্যদিকে আছে প্রেমের
নরম নিশ্বাস, প্রকৃতির অলৌকিক স্পর্শ, আর নিঃসঙ্গ মানুষের আদিম আতঙ্ক। তাঁর কবিতা এমনই—দ্বৈততার
মধ্যে দাঁড়িয়ে এক অনন্য সাম্য রচনা করে, যেখানে শব্দের ভেতরে লুকিয়ে থাকে মানুষের ইতিহাস,
মানুষের স্বপ্ন, মানুষের পরাজয় ও পুনর্জাগরণ।
শামসুর রাহমানের কাব্যজগতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মানুষ। মানুষের
জীবন, মানুষের সংগ্রাম, মানুষের যন্ত্রণা, মানুষের অপরূপ সৌন্দর্য—সবই তাঁর কাব্যে
বারবার ফিরে আসে। তবে মানুষকে তিনি যেভাবে দেখেন, তা কোনো একমাত্রিক দৃষ্টিতে নয়; মানুষের
ভেতরের আলো, ছায়ার ভীষণ বৈচিত্র্য তাঁকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। মানুষের দুর্বলতা যেমন
তাঁকে ব্যথিত করে, তেমনি মানুষের সম্ভাবনা তাঁকে উদ্বেলিত করে। তাই তাঁর কবিতা কখনো
নিঃস্বতার অন্ধকারে ডুবে যায়, আবার হঠাৎই সমুদ্রের কাছে ফিরে আসে, বিশাল বিস্ময়ের আলোতে
স্নাত হয়ে। তিনি মানবজীবনের নিত্যতা আর অসাধারণতার মধ্যকার লঘু সীমারেখাটি অনুভব করেছেন
সবচেয়ে স্পর্শকাতরভাবে।
শামসুর রাহমানের কবিতার ভাষা অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বজ্ঞাত। তিনি
শব্দকে কখনোই ভারী অলঙ্কারের মতো ব্যবহার করেননি; বরং শব্দকে করেছেন সম্পূর্ণ জীবন্ত,
সংবেদনশীল একটি মাধ্যম। তাঁর শব্দগুলো কখনো ভেসে আসে দূর পাহাড়ি বাতাসের মতো, কখনো
তীক্ষ্ণ অস্ত্রের মতো কেটে দেয় হৃদয়ের নরম স্তর। শব্দের প্রতি এমন তীব্র বিশ্বাস আমাদের
চোখে ধরা দেয় তাঁর কবিতার যাবতীয় লাইনেই। তিনি জানতেন, ভাষা শুধু উচ্চারণ নয়—এটি মানুষের
আত্মা, মানুষের দুঃস্বপ্ন, মানুষের স্বপ্নেরও পথ। তাই তাঁর কবিতার শব্দগুলো কেবল শোনার
জন্য নয়; সেগুলো দেখা যায়, অনুভব করা যায়, এমনকি কোনো কোনো মুহূর্তে শ্বাস হিসেবেও
গ্রহণ করা যায়।
প্রেম তাঁর কবিতায় এক অবিচ্ছিন্ন নদী। তবে এই প্রেম কোনো নাটকীয় বা
অতিরঞ্জিত আবেগের উপর দাঁড়িয়ে নেই। প্রেম তাঁর কাছে মানুষের মতোই—প্রতিদিনের, সহজাত,
কখনো উজ্জ্বল, কখনো নীরব, কখনো বেদনাময়, কখনো দুর্দান্ত আনন্দময়। তাঁর প্রেমকবিতাগুলোতে
যে ধীর সৌন্দর্য দেখা যায়, তা আসে এক ধরনের স্বচেতনার মধ্য দিয়ে। তিনি প্রেমকে কেবল
প্রেমিক,প্রেমিকার সীমানায় বন্দি রাখেননি; প্রেম সেখানে বিস্তৃত হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের
এক অভ্যন্তরীণ যাত্রা হিসেবে। কখনো প্রেম তাঁর কাছে স্মৃতির মতো, কখনো ভবিষ্যতের দিকে
ছুটে যাওয়া এক কল্পনা, কখনো নিঃসঙ্গ রাতের মতোই অনর্থক হলেও পূর্ণ। প্রেমের প্রতিটি
ছায়া, আলো তিনি তুলে এনেছেন নিজের স্বাভাবিক কবিতাসত্তার একটি অংশ হিসেবেই।
তবে প্রেমের বাইরেও তাঁর কবিতার আরেক বিশাল দিগন্ত হলো রাজনীতি। বাংলাদেশ
যখন থেকে ইতিহাসের রক্তাক্ত গলিপথ ধরে হাঁটছে, তখন শামসুর রাহমান, সেই পরিবর্তনের নির্মমতা
ও সৌন্দর্য একসঙ্গে দেখেছেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে শুধু ইতিহাসের ঘটনা হিসেবে দেখেননি;
এটি তাঁর কাছে নৈতিকতার প্রশ্ন, মানুষের অস্তিত্বের প্রশ্ন, মানুষের স্বাধীনতার প্রশ্ন।
তাঁর কবিতায় গণআন্দোলন, অবদমনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণ, গুলিবিদ্ধ রাত, আর পতাকা
উত্তোলনকারী মানুষের বুকে থাকা বেদনা ও উল্লাস- সবকিছুকে তিনি এমনভাবে ধরেছেন যে এগুলো
আমাদের কাছে শুধু ঘটনা নয়, অনুভূতি হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় রাজনীতি কখনো স্লোগান নয়;
এটি মানুষের জীবনকে ব্যথিত করা এক ধারাবাহিক বাস্তবতা।
এই কবির শহর, চেতনা এক আলাদা আলোচনার দাবি রাখে। তিনি ঢাকাকে শুধু
নগর হিসেবে দেখেননি; এক বহুমাত্রিক চরিত্র হিসেবে তুলে ধরেছেন কবিতায়। তাঁর ঢাকা কখনো
নিঃস্ব, কখনো উত্তাল, কখনো নিঃশব্দ, কখনো তীব্র উষ্ণ। শহরের ধুলো, ট্রাফিক, সংকট, প্রেমিকযুগলের
দেখা হওয়া, গলির চায়ের দোকান, রাতের সন্ত্রাস, সকালে পত্রিকার খবর—সবকিছুই তাঁর কবিতায়
এক বর্ণময় উপন্যাসের মতো দ্যুতি ছড়ায়। শামসুর রাহমান; যে শহরকে দেখেছেন, তা হলো মানুষে
ভর্তি এক বিশাল মঞ্চ, যেখানে প্রতিনিয়ত চলতে থাকে জীবনের সবচেয়ে ছোট ও সবচেয়ে বড় নাটক।
তিনি দেখিয়েছেন শহর মানুষের মতোই জটিল, যে এক মুহূর্তে নিষ্ঠুর, আরেক মুহূর্তেই আপন।
সময়ের প্রতি তাঁর অনুভূতি অসাধারণ সূক্ষ্ম। সময়কে তিনি কখনো স্থির
কিছু হিসেবে দেখেননি; বরং সময়কে দেখেছেন ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে নতুনতর হয়ে ওঠা এক জীবন্ত
মহাকাশ হিসেবে। তাঁর কবিতায় সময়ের প্রবাহ কখনো তীব্র জলোচ্ছ্বাসের মতো, কখনো শুকনো
পাতার নরম শব্দের মতো। তিনি বুঝতেন, মানুষের জীবন সময়ের মধ্য দিয়েই তার রূপ নিয়েছে-সময়ই
মানুষকে আঘাত করে, আবার সময়ই মানুষকে মুক্তও করে। তাঁর কবিতায় বারবার উঠে আসে এই চেতনা-সময়
সবকিছু মুছে দেয়, কিন্তু কিছু কিছু স্মৃতি সময়কেও অতিক্রম করে থাকে। যেমন প্রেম, স্বপ্ন,
প্রতিরোধ, যা বারবার ফিরে আসে বেদনারূপে। প্রকৃতি
তাঁর কবিতায় রয়েছে আরেক নরম আলো হয়ে। প্রকৃতি তাঁর কাছে শুধু দৃশ্যমান বাস্তবতা নয়-এটি
মানুষের অন্তর্লোকের প্রতিচ্ছবি। তাঁর কবিতায় বৃষ্টি কখনো শীতল আরাম নয়; কখনো তা অশান্তির
ফোঁটা। হাওয়া কখনো নিঃশ্বাসের মতো স্বস্তি, আবার কখনো অজানা গন্তব্যের ভীতিকর ডাক।
গাছ, নদী, আকাশ, রোদ-এই সবই তাঁর কবিতায় স্পর্শযোগ্য হয়। প্রকৃতির ভেতর দিয়ে তিনি মানুষের
আত্মাকে শনাক্ত করেন; প্রকৃতির রূপান্তরের ভেতর তিনি মানুষের পরিবর্তনও দেখেন। তিনি
জানতেন প্রকৃতি মানুষকে যতটা সান্ত্বনা দিতে পারে, ততটাই পারে প্রশ্নও করতে।
শামসুর রাহমানের কাব্যচেতনায় একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে স্মৃতি।
স্মৃতি তাঁর কাছে জীবনের আরেক প্রবাহ। তিনি স্মৃতির ভেতর হারিয়ে যান না; বরং স্মৃতিকে
তিনি সামনে এনে দাঁড় করান, যেন সেই স্মৃতি থেকেই নতুন আলো বেরিয়ে আসে। তাঁর স্মৃতিগুলো
কখনো সুখের, কখনো বেদনাময়, কখনো শৈশবের নরম বিস্ময়, কখনো পুরোনো প্রেমের অনুচ্চারিত
ব্যথা। কিন্তু স্মৃতির সবকিছুই তিনি এমনভাবে ধরেন যে তা পাঠকের কাছে এক চিরন্তন অভিজ্ঞতায়
পরিণত হয়। এই স্মৃতিচর্চাই তাঁকে আরও মানবিক করে তোলে-একজন কবি হিসেবে, একজন মানুষ
হিসেবে, একজন নাগরিক হিসেবে।
তাঁর কবিতায় নিঃসঙ্গতার উপস্থিতিও গভীর। তিনি জানতেন, মানুষের সবচেয়ে
বড় যন্ত্রণা হলো নিজের সাথে নিজে লড়াই করা। তাঁর কবিতায় বারবার আমরা এমন মানুষের দেখা
পাই, যে ভিড়ের মধ্যেও নিঃসঙ্গ, আলোয় থেকেও অন্ধকারে নিমজ্জিত, কোলাহলের মধ্যেও নীরব।
এই নিঃসঙ্গতাকে তিনি ভয় পাননি; বরং তিনি বুঝেছেন যে জীবনকে বোঝার অন্যতম উপায় হলো একাকীত্বকে
গ্রহণ করা। তাঁর নিঃসঙ্গতার ভেতর লুকিয়ে থাকে অস্তিত্বের এক ভয়াবহ তীব্রতা, আবার সেই
নিঃসঙ্গতার ভেতরই লুকিয়ে থাকে আত্মশুদ্ধির আলো।
তার সৃষ্টিকে বিশ্লেষণ করলে আরও একটি বিষয় সামনে আসে-মানুষের প্রতি
তাঁর নিখাদ বিশ্বাস। মানুষ ভুল করে, দুঃখ দেয়, ধ্বংস করে, আবার প্রেমও করে, সৃষ্টি
করে, পুনর্জন্ম নেয়। শামসুর রাহমান, মানুষের ভেতরের এই বিস্ময় অনুভব করেছিলেন গভীরভাবে।
তাই তাঁর কবিতা মানুষের প্রতি অনন্ত আস্থার ভাষ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন অন্ধকার যতই
ঘন হোক, মানুষের চোখ খুঁজে নেবে আলোর পথ। পাঠকের মনে হয় যেন কবি আমাদের হাত ধরে বলছেন,
তুমি ভেঙে পড়ো না; মানুষের ভেতরেই আছে সবচেয়ে বড় শক্তি।
শামসুর রাহমানের কবিতা তাই শুধু কবিতা নয়; এটি একটি দীর্ঘ জীবনযাত্রা,
যা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের মনের প্রতিটি আঙিনা ঘুরে দেখে। তাঁর শব্দের ভেতর
দিয়ে আমরা নিজেদের দেখি, আমাদের দেশকে দেখি, আমাদের সময়কে দেখি, আমাদের প্রেম, অসহায়তা
ও লড়াইকে দেখি। তাঁর কবিতার ভুবন আমাদের শেখায়, জীবন শুধুই টিকে থাকা নয়; জীবন মানে
প্রশ্ন করা, অনুভব করা, ভুল করা, ভালোবাসা, এবং সবশেষে আবার শুরু করা।
এই কারণেই শামসুর রাহমান বাংলা কবিতার এক স্থায়ী উচ্চতা-এক আলো, যা
নিঃশেষ হয় না। তাঁর কবিতা আমাদের শেখায়, মানুষের ভেতরেই আছে অমোঘ শক্তি, মানুষের মধ্যেই
আছে বিস্ময়, মানুষের সৃষ্টির মধ্যেই লুকিয়ে আছে মুক্তি। তিনি চলে যাওয়ার অনেক পরেও
তাঁর কবিতা আমাদের হৃদয়ে এমনভাবে প্রতিফলিত হবে, যেন আমরা তাঁর শব্দের ভেতর দিয়ে নিজেকেই
আরেকবার ফিরে পাই। তাঁর কবিতা তাই চিরকাল আমাদের সঙ্গী থাকবে-যেমন থাকে শ্বাস, যেমন
থাকে আলো, যেমন থাকে ভালোবাসা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন