বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ এক জটিল
অথচ সম্ভাবনাময় ভূদৃশ্য, যেখানে ইতিহাসের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, জনমানসের পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত
রূপান্তর, বৈশ্বিক ভূরাজনীতি, অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও গণতান্ত্রিক চেতনার উত্থান,সবকিছু
মিলে এক বিশাল পরিবর্তনের পূর্বাভাস রচনা করছে। এই ভূখণ্ডের রাজনীতি বরাবরই সংগ্রাম,
অধিকার, স্বপ্ন ও প্রতিরোধের গল্প, কিন্তু ভবিষ্যতের রাজনীতি আরও দ্রুত, আরও গতিশীল,
আরও চ্যালেঞ্জপূর্ণ, আরও বহুমাত্রিক হতে চলেছে, কারণ বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো বদলে যাচ্ছে,
তরুণ জনগোষ্ঠী বিস্তৃত হচ্ছে, ডিজিটাল তথ্যপ্রবাহ সবকিছুকে উন্মুক্ত ক’রে দিচ্ছে। নতুন
মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সক্রিয় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে এবং বৈশ্বিক শক্তির
প্রভাবও ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হ’য়ে উঠছে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশের রাজনীতি তাই শুধুই দলীয়
প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা ক্ষমতার পালাবদলের বিষয় নয়, বরং এটি হবে নীতি, জবাবদিহিতা, প্রযুক্তিগত
স্বচ্ছতা, নাগরিক অংশগ্রহণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যের সমন্বয়ে
গঠিত এক নতুন রাজনৈতিক ধারা। যা সম্পূর্ণভাবে একটি তথ্যনির্ভর বাস্তবতা দ্বারা পরিচালিত
হবে; বাংলাদেশের রাজনীতির এই ভবিষ্যৎকে বোঝার জন্য প্রথমেই জনসংখ্যা পরিবর্তনের প্রভাব
বুঝা জরুরি, কারণ দেশের মোট জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ আজ তরুণ, যারা ইন্টারনেট, সোশ্যাল
মিডিয়া, মোবাইল প্রযুক্তি ও বৈশ্বিক তথ্যপ্রবাহে অভ্যস্ত। তারা আর অন্ধ আনুগত্যে ভোট
দেয় না, তারা বিশ্লেষণ ক’রে, প্রশ্ন তোলে, জবাবদিহিতা দাবি ক’রে; ভবিষ্যতের বাংলাদেশে
এই তরুণ প্রজন্মই নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির দরজা খুলে দেবে, যেখানে মতাদর্শের পাশাপাশি
নীতি, প্রজ্ঞা ও বাস্তবতা হবে প্রধান। একই সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর
করছে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ওপর, কারণ অর্থনীতি যত শক্তিশালী হবে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
তত দীর্ঘমেয়াদি হ’তে পারবে; রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, প্রযুক্তিভিত্তিক
শিল্প, কৃষির রূপান্তর, স্টার্টআপ অর্থনীতি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, এসবই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক
সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করবে; অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একে অপরের
পরিপূরক, তাই ভবিষ্যতের সরকারগুলোকে নীতিনির্ধারণে আরও তথ্যনির্ভর ও দীর্ঘমেয়াদি হতে
হবে। জলবায়ু পরিবর্তনও বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে, কারণ
সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, বন্যা ও খরার চাপ লক্ষ লক্ষ মানুষের
জীবনকে বদলে দিচ্ছে। ভবিষ্যতের সরকারকে তাই
জলবায়ু অভিযোজন, পরিবেশ সুরক্ষা, টেকসই কৃষি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, উপকূলীয় প্রতিরক্ষা
ও পরিবেশবান্ধব নগরায়ণকে রাজনৈতিক অঙ্গীকার হিসেবে নিতে হবে; রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো
পরিবেশগত বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত না হ’লে ভবিষ্যৎ সংকট আরও বড় হ’য়ে উঠবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের
রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনবে ডিজিটাল স্বচ্ছতা, কারণ আগামী দুই দশকে রাষ্ট্রের
প্রশাসন, নির্বাচন, নীতি নির্ধারণ, সরকারি সেবা ও আইনশৃঙ্খলা সবই ডেটা–নির্ভর হ’য়ে
যাবে, ইভিএম থেকে ডিজিটাল ভোটিং, ব্লকচেইন–নির্ভর নির্বাচন, ওপেন ডেটা গভর্ন্যান্স,
রিয়েল–টাইম নীতি বিশ্লেষণ, এসবই রাজনীতিকে আরও স্বচ্ছ করতে পারে। যদি সাইবার সুরক্ষা
শক্তিশালী হয় এবং ডিজিটাল কাঠামো দুর্নীতি কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে, তবে বাংলাদেশের
ভবিষ্যৎ রাজনীতি আরও বিশ্বাসযোগ্য হ’য়ে উঠবে। একইসঙ্গে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
নির্ভর ক’রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তির ওপর, সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা,
গণমাধ্যম, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, এসব যদি স্বায়ত্তশাসিত ও সক্রিয় থাকে তবে রাজনৈতিক
পরিবেশ টেকসই হবে। ভবিষ্যতের নাগরিকেরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শুধু প্রতিশ্রুতি নয়,
কাঠামোগত পরিবর্তন ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা চাইবে; রাজনীতির ভবিষ্যৎ তাই প্রতিষ্ঠান–ভিত্তিক
হবে, ব্যক্তিনির্ভরতা ধীরে ধীরে কমবে। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত কেন্দ্র হওয়ায়
ভারতের, চীনের, যুক্তরাষ্ট্রের, আসিয়ান অঞ্চলের প্রভাব সর্বদাই গুরুত্বপূর্ণ। আগামী
বছরগুলোতে ভূরাজনীতি আরও জটিল হবে, কারণ বৈশ্বিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে;
তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে কৌশলী ভারসাম্য, অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব,
আঞ্চলিক সহযোগিতা, সমুদ্র অর্থনীতি, বন্দরনির্ভর বাণিজ্য ও বহুপাক্ষিক কূটনীতির ওপর;
ভবিষ্যৎ সরকারকে এ বিষয়গুলো অত্যন্ত বাস্তববাদী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কৌশল দিয়ে পরিচালনা
করতে হবে। এছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ আরেকটি বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে,
একদলীয় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে বহুমাত্রিক রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায়। নতুন রাজনৈতিক
দল, নাগরিক আন্দোলন, পরিবেশ–নির্ভর আন্দোলন, প্রযুক্তি–নির্ভর সংগঠন ও বিকেন্দ্রীকরণ–ভিত্তিক
রাজনীতি ক্রমে বিস্তার লাভ করবে। রাজনৈতিক মতাদর্শ শুধু বাম–ডান–মধ্যম নয়, বরং অর্থনৈতিক
দৃষ্টিভঙ্গি, প্রযুক্তি দৃষ্টিভঙ্গি, পরিবেশ দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে
পুনর্গঠিত হবে; ভবিষ্যতের রাজনীতি হবে আরও প্রশ্নমুখর, আরও যুক্তিনিষ্ঠ, আরও গবেষণানির্ভর।
গণমাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর আগের চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে।
ফ্যাক্টচেক, নাগরিক সাংবাদিকতা, ওপেন ডেটা রিপোর্টিং, সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং, সবই
রাজনৈতিক বিতর্কের নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করবে। রাজনৈতিক নেতাদের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি,
নৈতিকতা ও দক্ষতা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আগামী দশকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে চাপ এতটাই
বৃদ্ধি পাবে যে ভবিষ্যতের সরকারগুলোকে সম্পূর্ণ নতুন অ্যান্টি–করাপশন ব্যবস্থায় যেতে
হতে পারে; একইসঙ্গে মানুষের রাজনৈতিক প্রত্যাশাও বদলাবে, তারা শুধু উন্নয়ন নয়, সমতা,
ন্যায়বিচার, পরিবেশ সুরক্ষা, নিরাপত্তা, সুশাসন, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের
স্বাধীনতা চাইবে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ শুধু ভোটকেন্দ্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ
থাকবে না, বরং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নাগরিকেরা নীতি প্রণয়নে মতামত দেবে, নিজেদের অবস্থান
জানাবে, নীতিনির্ধারকদের মূল্যায়ন করবে; ভবিষ্যতের রাজনীতি তাই হবে আরও খোলামেলা, আরও
স্বচ্ছ, আরও তথ্যসমৃদ্ধ। একইসঙ্গে চ্যালেঞ্জও থাকবে,তথ্যবিকৃতি, ডিজিটাল বিভাজন, সাইবার
হুমকি, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও ভুয়া তথ্যের প্রসার; ভবিষ্যতের রাজনীতি এসব মোকাবেলার জন্য
প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়াতে বাধ্য হবে। বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ তাই একদিকে সম্ভাবনার
দিগন্ত, অন্যদিকে জটিলতার বিস্তৃত ক্ষেত্র। তবে এই ভূখণ্ডের ইতিহাস বলে,বাংলাদেশ কখনো
থেমে থাকে না; সে সংগ্রাম ক’রে, শিখে, বদলায়, নতুন পথ তৈরি ক’রে। তাই ভবিষ্যতের বাংলাদেশ
হবে এমন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা যেখানে তরুণদের সৃজনশীলতা, প্রযুক্তির স্বচ্ছতা, অর্থনৈতিক
প্রবৃদ্ধি, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, পরিবেশ সচেতনতা ও আন্তর্জাতিক ভারসাম্য মিলিত হ’য়ে
এক নতুন রাষ্ট্রদর্শন তৈরি করবে। একটি রাষ্ট্রদর্শন যা হবে মানবিক, আধুনিক, জ্ঞাননির্ভর
ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন; এবং এই রাজনৈতিক যাত্রাই বাংলাদেশকে আগামী শতাব্দীর উন্নত, সমৃদ্ধ
ও স্থিতিশীল দেশগুলোর সারিতে স্থান ক’রে দেবে। একটি ভবিষ্যৎ যা সংগ্রামের ভেতর জন্ম
নেবে, সাহসের ভেতর বেড়ে উঠবে এবং স্বপ্নের ভেতর পূর্ণতা পাবে।
বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎকে আরও বিস্তৃতভাবে দেখতে হ’লে প্রথমেই বুঝতে হবে যে দেশের
রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক পর্বে প্রবেশ করছে। অতীতের বিরোধ,
সংঘাত, আন্দোলন, বিপ্লব এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অবশ্যই এই ভূখণ্ডের রাজনীতির ইতিহাসে
গভীর ছাপ রেখে গেছে। কিন্তু ভবিষ্যতের রাজনীতি সেই পুরনো কাঠামো থেকে সরে এসে আরও বৈজ্ঞানিক,
আরও প্রাতিষ্ঠানিক এবং আরও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা–নির্ভর হ’য়ে ওঠার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
এই পরিবর্তনকে কেন্দ্র ক’রে প্রথম যে বিষয়টি সামনে আসে তা হলো, বাংলাদেশের সমাজ দ্রুত
মধ্যবিত্ত–নির্ভর সমাজে পরিণত হচ্ছে, আর মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক চাহিদা সম্পূর্ণ
আলাদা; তারা চায় নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, সমতা, সুশাসন, স্বচ্ছতা ও নীতিগত
ধারাবাহিকতা; ভবিষ্যতের রাজনীতিতে তাই প্রচলিত জনপ্রিয়তাবাদ নয় বরং নীতিনির্ধারণমুখী
বাস্তববাদই প্রধান শক্তিতে পরিণত হতে পারে। বাংলাদেশে তথ্যপ্রবাহ যেভাবে বেড়েছে, বিশেষত
ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ওয়েবমিডিয়া ও ডিজিটাল কন্টেন্টের বিস্তারে। রাজনীতি এখন আগের
মতো কেবল জনসভা-নির্ভর থাকছে না; বরং এটি রূপ নিচ্ছে ডিজিটাল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যেখানে
প্রতিটি নাগরিক তাদের মতামত মুহূর্তে প্রকাশ করতে পারে। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলোর
জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে এই বিশাল তথ্যপ্রবাহকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করা। জনমতের
ধারা বুঝে নীতি তৈরি করা এবং ডিজিটাল ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা;
এর ফলে রাজনীতির ধরণ আরও স্বচ্ছ হলেও আরও জটিলও হবে; কারণ ডিজিটাল পর্যবেক্ষণ ও সাইবার
নিরাপত্তা আগামী দশকে রাজনৈতিক বাস্তবতার অন্যতম বড় অংশ হ’য়ে উঠবে। বাংলাদেশের নির্বাচনী
রাজনীতিও ভবিষ্যতে ব্যাপক পরিবর্তনের মুখোমুখি হবে, কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ,
ভোটারদের মানসিক ও সামাজিক রূপান্তর এবং প্রযুক্তির উন্নতি, সবই নির্বাচনকে আরও প্রযুক্তিনির্ভর
করবে; সম্ভাবনা রয়েছে যে ভবিষ্যতে ভোটার তালিকা, ভোট গণনা, পর্যবেক্ষণ, কেন্দ্র পরিচালনা,
তথ্য সংগ্রহ ও ফল ঘোষণা পুরোপুরি ডিজিটাল সিস্টেমের ওপর নির্ভর করবে। এতে নির্বাচন
হবে দ্রুততর, স্বচ্ছতর এবং তুলনামূলকভাবে কম সংঘাতপূর্ণ। তবে এর জন্য প্রয়োজন উচ্চমানের
সাইবার সুরক্ষা, নিরপেক্ষ প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা এবং সকল রাজনৈতিক দলের আস্থা বৃদ্ধি।
ভবিষ্যতের বাংলাদেশে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করবে জলবায়ু অর্থনীতি, বিশেষত
পরিবেশ, জ্বালানি, পানি ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিজ উৎপাদন; সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি,
উপকূলে লবণাক্ততার বিস্তার, নদীভাঙন, খরা ও অতিবৃষ্টি, এসব পরিবেশগত সংকট আগামী দশকে
কোটি মানুষের জীবনযাত্রা বদলে দেবে। ফলে রাষ্ট্রকে বাধ্য হ’তে হবে নতুন নীতিমালা গ্রহণে;
ভবিষ্যতে পরিবেশ–রাজনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ ধারা হ’য়ে উঠতে পারে; যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো
টেকসই উন্নয়ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, কার্বন হ্রাস, বন সংরক্ষণ ও নীল অর্থনীতি নিয়ে
স্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা দিতে বাধ্য হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের
আরেকটি বড় পরিবর্তন হবে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি। বর্তমানে স্থানীয় সরকার কাঠামো
থাকলেও তার কার্যক্ষমতা সীমিত; ভবিষ্যতে জনগণের প্রত্যাশা হবে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন,
কর ব্যয়, প্রশাসনিক সেবা ও অবকাঠামো নির্মাণ আরও বিকেন্দ্রীকৃত হোক; এর ফলে দেশজুড়ে
স্থানীয় নেতৃত্বের উত্থান ঘটবে, যা জাতীয় রাজনীতিকেও নতুন চরিত্র দেবে। আন্তর্জাতিক
সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ভবিষ্যতে আরও কৌশলগত হ’য়ে উঠবে। ভারত, চীন,
যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, সবই বাংলাদেশের অর্থনীতি,
নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও রাজনৈতিক প্রভাবের ভিত্তি; সমুদ্রবন্দর, বাণিজ্যপথ, আঞ্চলিক সহযোগিতা,
সামরিক কূটনীতি ও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের ওপর ভিত্তি ক’রে বাংলাদেশকে প্রতিটি সিদ্ধান্ত
নিতে হবে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশল দিয়ে; কারণ বৈশ্বিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমশ এশিয়াকে
কেন্দ্র ক’রে বাড়বে, এবং বাংলাদেশ হবে এই ভূরাজনৈতিক খেলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধ।
এই পরিবর্তন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে আরও সংবেদনশীল ও জটিল ক’রে তুলবে। পাশাপাশি
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম, সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ ভবিষ্যতেও বড় ভূমিকা পালন
করবে। তবে তরুণ প্রজন্মের উদারতা, মানবিকতা, বহুত্ববাদ ও বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি, এসব
মিলিয়ে ভবিষ্যতের সমাজ আরও আধুনিক, আরও যুক্তিবাদী ও আরও মানবিক হবে। রাজনীতি তাই বাধ্য
হবে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন, বৈশ্বিক নাগরিকত্ব, গণতান্ত্রিক
পরিসর ও আইনের শাসনকে আরও শক্তিশালী করতে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্বের
রূপও বদলাবে; নেতৃত্ব হবে বেশি শিক্ষিত, প্রাযুক্তিক জ্ঞানসম্পন্ন, বিশ্ববোধসম্পন্ন
এবং গবেষণানির্ভর। জনগণও তখন প্রত্যাশা করবে নেতৃত্বে দক্ষতা, সততা, বুদ্ধিমত্তা ও
দূরদৃষ্টি। ফলে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব রাজনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ একটি বৃহৎ
সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের মিশ্র বাস্তবতা, যেখানে প্রযুক্তি দেবে গতি, তরুণেরা দেবে নতুন
চিন্তা, পরিবেশ দেবে সতর্কতা, অর্থনীতি দেবে দিকনির্দেশনা, আর ইতিহাস দেবে শক্ত ভূমি।
ভবিষ্যতের এই বাংলাদেশ হবে এমন এক রাজনৈতিক ভূখণ্ড, যেখানে সংগ্রাম থাকবে, বিতর্ক থাকবে,
প্রতিযোগিতা থাকবে, কিন্তু থাকবে উন্নয়ন, জ্ঞান, সৃজনশীলতা, মানবিকতা ও নৈতিকতার জয়।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি তাই শেষ পর্যন্ত
এক দীর্ঘ যাত্রা, যার প্রতিটি ধাপে রয়েছে পরিবর্তনের সম্ভাবনা। উত্তরণের জিজ্ঞাসা ও নতুন পথ নির্মাণের সাহস। বাংলাদেশের
রাজনীতির ভবিষ্যৎকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করতে গেলে এই ভূখণ্ডের দীর্ঘ সমাজ–রাজনৈতিক
বিবর্তনকে নতুন আলোকধারায় ব্যাখ্যা করতে হয়। কারণ ভবিষ্যৎ কোনো বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়; এটি বর্তমানের
গতিবিধি, পরিবর্তনের গতি ও জনগণের মনস্তত্ত্বের ধারাবাহিকতার ফল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক
ভবিষ্যৎকে দ্বিগুণ বিস্তৃতভাবে দেখার জন্য তাই আরও কিছু বৃহত্তর ও দীর্ঘমেয়াদি বিষয়কে
সামনে আনতে হয়। ক্ষমতার রূপান্তর, নতুন শ্রেণি–সামাজিক বিন্যাস, উন্নয়ন–রাজনীতি, আধুনিক
রাষ্ট্রের চাপ, প্রবাসী অর্থনীতি, প্রযুক্তি–শাসন, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজার, সামরিক কৌশল,
সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ও পরিচয় রাজনীতির নতুন ধারা; এগুলোর প্রতিটিই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের
রাজনীতিকে গভীরভাবে বদলে দেবে। বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যতে সবচেয়ে মৌলিক পরিবর্তনগুলোর
একটি হবে ক্ষমতার কেন্দ্রীয় কাঠামো থেকে ধীরে ধীরে বিকেন্দ্রীকরণে অগ্রসরতা। তথ্যপ্রযুক্তির
বিস্তার, স্থানীয় সরকারের শক্তিবৃদ্ধি, নাগরিক চাহিদার বৈচিত্র্য ও প্রশাসনের জটিলতা-এসবই
ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর চাপ বাড়াবে। ফলে ক্ষমতা বণ্টন, প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন,
আঞ্চলিক উন্নয়ন ও স্থানীয় বাজেট–নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে রাজনীতির ভূগোল বদলে
যাবে, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, কুমিল্লা, রংপুর,সবই ভবিষ্যতে আরও রাজনৈতিকভাবে
সক্রিয় অঞ্চল হ’য়ে ওঠবে; এই পরিবর্তন জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোকেও তাদের কাঠামো পরিবর্তনে
বাধ্য করবে; কারণ স্থানীয় নেতৃত্বের উত্থান জাতীয় নেতৃত্বকে আরও জবাবদিহিতার মুখোমুখি
দাঁড় করাবে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে অর্থনৈতিক রাজনীতি আরও গভীর হ’য়ে উঠবে। কারণ দেশের
অর্থনীতি ক্রমশ বহুমাত্রিক হবে। কেউ শিল্পায়নকে অগ্রাধিকার দেবে, কেউ কৃষিকে, কেউ সেবা
খাতকে, কেউ প্রযুক্তি অর্থনীতিকে। অর্থনৈতিক নীতির প্রতিযোগিতা তখন রাজনৈতিক মতাদর্শের
নতুন সংজ্ঞা হ’য়ে উঠবে। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পষ্ট পরিকল্পনা দিতে হবে, কত
বছরে কোন খাত কত বৃদ্ধি পাবে, কীভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, কোন প্রযুক্তি যুক্ত
হবে, কীভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ হবে, কীভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি অর্থনীতি গ’ড়ে
তোলা হবে এবং কীভাবে সামাজিক সুরক্ষা জোরদার করা হবে। অর্থনৈতিক দর্শনের এই পরিবর্তন
রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উন্নত করবে, আর জনগণকে আরও সচেতন ক’রে তুলবে। বাংলাদেশের প্রবাসী
মানুষগুলো ভবিষ্যতের রাজনীতিতে নতুন প্রভাব বিস্তার করবে। বর্তমানে প্রবাসীরা দেশের
অর্থনীতিতে বিশাল ভূমিকা রাখলেও ভবিষ্যতে তারা নীতি প্রণয়ন, বিনিয়োগ, প্রযুক্তি স্থানান্তর
ও রাজনৈতিক মত গঠনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। বিশেষত উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ায় বসবাসকারী প্রবাসীরা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অংশ হতে পারে। তাদের চিন্তাধারা
আরও বৈশ্বিক, আরও আধুনিক, আরও মানবিক, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নতুন দিক
দেখাতে পারে। রাজনৈতিক কাঠামোর আরেকটি দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন আসবে নারীর অংশগ্রহণে।
বাংলাদেশের অগ্রগতি ইতোমধ্যেই নারীর নেতৃত্ব, শিক্ষা, অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে নতুন
দিগন্ত খুলেছে। কিন্তু ভবিষ্যতে এই অংশগ্রহণ আরও বিস্তৃত হবে, স্থানীয় সরকার, জাতীয়
সংসদ, নীতিনির্ধারণ, প্রশাসন, কূটনীতি, সব ক্ষেত্রেই নারীর নেতৃত্ব হবে আরও দৃশ্যমান
ও প্রভাবশালী। এর ফলে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি আরও নরম, মানবিক, সমতা–নির্ভর ও বাস্তববাদী
হবে। কারণ গবেষণা বলছে, নারী নেতৃত্ব সামাজিক উন্নয়নে আরও বেশি মনোযোগী, আরও কম দুর্নীতিগ্রস্ত
এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে আরও সমস্যাসমাধানমুখী। বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতির আরেকটি বড়
উপাদান হবে সাংস্কৃতিক পরিবর্তন, বিশেষত বাংলা সাহিত্য, সংগীত, চলচ্চিত্র, নাটক, ডিজিটাল
কন্টেন্ট, ফোক সংস্কৃতি ও আধুনিক শিল্পের সমন্বয়ে নতুন প্রজন্ম যে সংস্কৃতিবোধ তৈরি
করছে তা রাজনৈতিক মূল্যবোধেও প্রভাব ফেলবে। তরুণ সমাজ শুধুই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, সামাজিক
ন্যায়, পরিবেশ, মানবাধিকার, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বৈষম্যহীনতা ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতাকে
গুরুত্ব দেবে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো বাধ্য হবে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা
ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়ে আরও উদার অবস্থান নিতে। এই পরিবর্তন গণতন্ত্রকে আরও
শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা–রাজনীতিও ভবিষ্যতে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হবে।
সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল সন্ত্রাসবাদ, ড্রোন
প্রযুক্তি, সীমান্ত নিরাপত্তা, জলদস্যু প্রতিরোধ, সমুদ্র নিরাপত্তা, ভূরাজনৈতিক চাপ,
এসবই ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করবে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী
ও বিমানবাহিনীকে আরও প্রযুক্তিনির্ভর হতে হবে; সমুদ্র অর্থনীতির বিস্তার, বঙ্গোপসাগরের
ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব, করিডোর–পলিটিকস, এসবই ভবিষ্যতে সামরিক কৌশলের বৃহৎ অংশ হ’য়ে উঠবে।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো তাই আরও বাস্তববাদী ও কৌশলগত হবে। পরিচয় রাজনীতি, ধর্ম, ভাষা,
অঞ্চল, শ্রেণি, সংস্কৃতি, এসবের মধ্যেও ভবিষ্যতে নতুন সম্পর্ক তৈরি হবে। ধর্মীয় মূল্যবোধ
থাকবে, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যও থাকবে, কিন্তু তরুণ প্রজন্মের বৈশ্বিক মনোভাব ও ডিজিটাল
সমাজ তাদের পরিচয়কে আরও বহুমাত্রিক ক’রে তুলবে। ফলে পরিচয়–নির্ভর সংঘাত কমতে পারে,
আর যুক্তিবাদ ও মানবিক মূল্যবোধ বাড়তে পারে। সবশেষে বলা যায়,বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ
এক দীর্ঘ নদীর মতো, যে নদী কখনো শান্ত, কখনো উত্তাল, কখনো ফুলে–ফেঁপে ওঠা, কখনো দিকবদলকারী;
কিন্তু নদী যেমন তার গন্তব্য খুঁজে নেয়, বাংলাদেশের রাজনীতিও তেমনভাবে ধীরে-ধীরে একটি
পরিণত, জ্ঞাননির্ভর, প্রাতিষ্ঠানিক, গণতান্ত্রিক ও মানবিক পথ খুঁজে নেবে। ভবিষ্যতের
বাংলাদেশ হবে এমন একটি রাজনৈতিক ভূখণ্ড যেখানে প্রযুক্তি হবে স্বচ্ছতার আলো, তরুণেরা
হবে পরিবর্তনের আগুন, নারী হবে প্রজ্ঞার শক্তি, সংস্কৃতি হবে চেতনার দিগন্ত, অর্থনীতি
হবে স্থিতিশীলতার মেরুদণ্ড। আর গণতন্ত্র হবে রাষ্ট্রের আত্মা; এই দীর্ঘ যাত্রা, সংগ্রাম,
সাহস, উন্নয়ন, সৃজনশীলতা ও দূরদৃষ্টির অনন্ত সমন্বয়ে, বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে এমন এক
ভবিষ্যতের দিকে, যেখানে সম্ভাবনা হবে সীমাহীন এবং তার যাত্রাপথ হবে এক সৃষ্টিশীল, মানবিক
ও শক্তিশালী রাজনৈতিক ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।
বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎকে আরও গভীর তাত্ত্বিক স্তরে বুঝতে গেলে রাষ্ট্রতত্ত্ব,
ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস, নাগরিক-রাষ্ট্র সম্পর্ক, উন্নয়ন-দমন দ্বৈততা, রাজনৈতিক অর্থনীতি,
জনমতের মনস্তত্ত্ব, এবং বৈশ্বিক শক্তি কাঠামোর পারস্পরিক সংযোগ বিশ্লেষণ অপরিহার্য
হ’য়ে ওঠে; কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ কখনোই একমাত্রিক নয় বরং বহুমাত্রিক। শক্তির
টানাপোড়েনের মধ্যে অবস্থান ক’রে যেখানে রাষ্ট্র একদিকে উন্নয়ন-রাষ্ট্রের চরিত্র ধারণ
করছে, অন্যদিকে কাঠামোগত প্যাট্রোনেজ, আমলাতন্ত্রীয় আধিপত্য, দলীয়করণ, নির্বাচন-বিহীন
ক্ষমতার পুনরুৎপাদন এবং জনগণের নিষ্ক্রিয়করণের প্রবণতা একই সঙ্গে কাজ করছে এবং এই দ্বৈততা
ভবিষ্যৎ রাজনীতিকে ক্রমাগত জটিল ও বহুস্তরীয় ক’রে তুলবে। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে রাজনীতি
কেবল দলীয় ক্ষমতার লড়াইয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং রাষ্ট্রের একচেটিয়া ক্ষমতার প্রকৃতি
কীভাবে রূপান্তরিত হয়, নতুন শ্রেণি-গোত্রের উত্থান ঘটে, রাজনৈতিক অর্থনীতির উৎস কোথায়
বিকেন্দ্রীভূত হয়, এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি নাগরিক নিয়ন্ত্রণের নতুন উপায় সৃষ্টি করে,
এসবই রাজনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হ’য়ে দাঁড়াবে। তাত্ত্বিকভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি ওয়েবারীয় র্যাশনাল-বুরোক্র্যাটিক
রাষ্ট্র থেকে ধীরে ধীরে পূর্ব-ধ্রুপদী প্যাট্রোন-ক্লায়েন্ট নেটওয়ার্ক এবং আধুনিক টেকনোক্র্যাটিক
অ্যালায়েন্সের এক সংমিশ্রণ তৈরি করছে, যেখানে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হলেও তার প্রয়োগ বিস্তৃত
নান্দনিক জটিলতায় পরিবর্তিত হচ্ছে। একদিকে রাষ্ট্র ক্রমেই নির্বাচনী গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক
কাঠামো ধ’রে রাখছে এবং অন্যদিকে বাস্তবে ক্ষমতার প্রয়োগ ক্রমশ অ-নির্বাচনী উৎসে নির্ভরশীল
হ’য়ে উঠছে; যা রাজনৈতিক বিজ্ঞানীরা 'হাইব্রিড রেজিম' হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। এমন এক
ব্যবস্থা যেখানে গণতন্ত্র, আধা-স্বৈরতান্ত্রিকতা এবং উন্নয়নবাদ একসঙ্গে মিলেমিশে থাকে,
ফলে জনগণ একই সঙ্গে উন্নয়নের আকর্ষণ এবং অধিকারের সংকোচনের চাপে বন্দী হ’য়ে পড়ে। ভবিষ্যতের
বাংলাদেশে ডিজিটালাইজেশন রাজনৈতিক তত্ত্বে নতুন মাত্রা যোগ করবে, কারণ তথ্যপ্রবাহ,
জনমত তৈরি, বিরোধী কণ্ঠ দমন, নজরদারি, এবং নাগরিক আচরণের পূর্বানুমানযোগ্যতা প্রযুক্তির
হাতে চলে গেলে রাজনীতি পুরোপুরি এক নতুন মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়ে প্রবেশ করবে যেখানে
ক্ষমতা শুধু দমন নয় বরং 'কনসেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং'–এর মাধ্যমেও পরিচালিত হবে। বাংলাদেশের
রাজনৈতিক অর্থনীতি তাত্ত্বিক দৃষ্টিতে ভবিষ্যতে আরও জটিল হবে; কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈষম্যের দ্বৈততা একই
সঙ্গে মাথা তুলতে থাকবে, এবং এই বৈষম্য রাজনৈতিক শক্তি কাঠামোর ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে,
যেখানে নতুন ব্যবসায়ী শ্রেণি, প্রবাসী মূলধন, কর্পোরেট শক্তি এবং রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র
এক নতুন অ্যালায়েন্স তৈরি করবে, যা ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক দলের উপর নির্ভরশীলতাকে কমিয়ে
এনে রাষ্ট্র-নির্ভর ক্ষমতা উৎপাদনের একটি নতুন ধারা গ’ড়ে তুলবে। একই সঙ্গে ধর্মভিত্তিক
সমাজকাঠামো রাজনীতির গভীরে নতুন ধরনের শক্তি পুনর্বিন্যাস ঘটাবে যা সরাসরি দৃশ্যমান
না হলেও ভবিষ্যতের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, নীতি, এবং ক্ষমতার অনুশীলনে মাইক্রো-স্তরে প্রভাব
ফেলবে; তাছাড়া বাংলাদেশের তরুণ জনগোষ্ঠী, যারা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত নয়, তারাও তাদের
মত বা স্বাধীনতা প্রকাশের জন্য বেঁছে নিবে একক কোন রাজনৈতিক দল বা বৃহৎ রাজনৈতিক দলের
অংশ হ’য়ে নিজের অবস্থান প্রমাণ করবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন