বাংলা কবিতায় রাজনীতির প্রবেশ মূলত একটি সভ্যতার দীর্ঘ বিবর্তনের অংশ; যেখানে মানুষের ভাষা, ইতিহাস, দুঃখ, বঞ্চনা, আত্মপরিচয় ও প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা পরস্পর মিশে গ’ড়ে তুলেছে এমন এক কাব্যিক ভূগোল যার ভেতরে সমাজব্যবস্থার প্রতিটি স্তর, রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিটি পরিবর্তন, রাষ্ট্রের প্রতিটি রূপান্তর এবং জনগণের প্রতিটি সংগ্রাম এক অদৃশ্য সুতায় গাঁথা হ’য়ে আছে। তাই বাংলা কবিতায় রাজনীতির আগমন কোনো বহিরাগত ঘটনা নয়, বরং মানবসভ্যতার গভীরে থাকা সেই প্রাচীন সম্পর্কেরই পুনর্বিন্যাস। যেখানে ভাষা শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়, বরং শোষণ ও কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামের সবচেয়ে ধারালো অস্ত্রও। যখন মানুষ গানের ভেতর নিজের কষ্টকে রেখেছিল, তখনই রাজনীতি সেখানে জন্ম নিয়েছিল, কারণ কষ্টের উৎস ছিল ক্ষমতা, শাসন, বৈষম্য, ধর্মীয় দমন এবং সামাজিক শ্রেণিভাগ, আর তাই প্রথম থেকেই বাংলা কবিতার ভেতরে রাজনীতি রূপকের মতো লুকিয়ে থেকেও সর্বদা জেগে উঠেছে। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্য বা পীর-দরবেশদের গানে জীবনের জটিলতা, শোষণের বিরুদ্ধে গোপন অভিযোজন, সামন্ততান্ত্রিক অত্যাচারের প্রতি বিদ্রূপ,এসবই ছিল আদিম রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর, যদিও তা ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক রূপে প্রকাশিত হতো। লৌকিক গানের ভেতর জনমানুষের অসন্তোষ, গ্রামীণ জীবনের দুর্ভোগ, নারী-পুরুষের অসমতা, ধর্মীয় নেতাদের ভণ্ডামি,এসবের মাধ্যমে সমাজের বিশ্লেষণ ছিল, যা রাজনীতির পূর্বানুভূতি বহন ক’রে; কিন্তু আধুনিক যুগে এসে কবিতার ভাষা যখন স্বশিক্ষিত স্বজ্ঞানের দিকে অগ্রসর হলো, তখন রাজনীতি আর আড়ালে থাকলো না; বরং কবিতার কাঠামোই বদলে গেল,এটি হ’য়ে উঠল সময়ের দলিল, বিপ্লবের ভাষা, প্রতিবাদের মশাল, মানবমুক্তির manifesto। নবজাগরণের সময়ে পশ্চিম শিক্ষার সাথে পরিচয় বাংলা কবিতায় রাজনৈতিক চিন্তার আধুনিক কাঠামো সৃষ্টি করে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব ও সামাজিক রূপান্তরের ধারণা উপস্থাপন করেন তাঁর কাব্যের মাধ্যমে; তাঁর পৌরাণিক রূপক আসলে ব্রিটিশ প্রভুত্বের এক প্রতিচ্ছবি; মেঘনাদের বিদ্রোহী মনোভাব, রাবণের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা, এসবই সাম্রাজ্যবাদী নৈতিকতার বিরুদ্ধে এক নন্দনতাত্ত্বিক প্রতিরোধ। যদিও তা পরোক্ষ, তবুও রাজনৈতিক কাঠামোর পরোক্ষ ভাঙনই বাংলা কবিতায় আধুনিক রাজনৈতিক চেতনার বীজ বপন করে; এরপর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘বন্দেমাতরম’ জন্ম দেয় এক অভূতপূর্ব জাতীয়তার ভাষা, যা কবিতাকে সরাসরি রাজনৈতিক সংগ্রামের কেন্দ্রে স্থাপন ক’রে। কবিতা তখন আর শুধু সাহিত্য নয়, বরং স্বাধীনতার শক্তি; এই সময় থেকেই কবিতা হ’য়ে ওঠে আন্দোলনের নান্দনিক কাঠামো। কিন্তু বাংলা কবিতায় রাজনৈতিক দর্শনের সবচেয়ে গভীর পুনর্গঠন ঘটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে। তাঁর বিশাল সৃষ্টিকর্মে রাজনীতি সরাসরি প্রকাশ পায়নি বললে ভুল হবে, কারণ তিনি রাজনীতিকে মানবতার আলো দিয়ে পরিমাপ করেছেন; তাঁর কবিতায় রাজনীতি কোনো দল বা রাষ্ট্রের সীমায় আবদ্ধ নয়, বরং সমস্ত মানবজাতির অস্তিত্বচিন্তা। ‘সভ্যতার সংকট’ লেখায় তিনি বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার অমানবিকতা দেখিয়েছেন। ‘বঙ্গভঙ্গ’ প্রসঙ্গে তিনি জাতীয়তাবাদের অন্ধ উন্মাদনা সমালোচনা করেছেন, কিন্তু মানুষের মুক্তিকেই রাজনৈতিক আদর্শের কেন্দ্র হিসেবে তু’লে ধরেছেন। তাঁর ‘আফ্রিকার কবিতা’ বিশ্বব্যাপী বঞ্চিত মানুষের প্রতি কাব্যিক একাত্মতার মহান দৃষ্টান্ত, যা বাংলা কবিতার রাজনৈতিক চেতনাকে স্থানিক সীমা পেরিয়ে বৈশ্বিক মানবতার স্তরে উন্নীত করে; তিনি দেখিয়েছেন, রাজনীতি যখন বিভেদের নাম হ’য়ে ওঠে তখন কবিতা মনুষ্যত্বকে পুনর্গঠন ক’রে তাকে আলোকিত ক’রে। তবে বাংলা কবিতায় রাজনীতির অগ্নিশিখার বিস্ফোরণ ঘটেছিল নজরুল ইসলামের হাতে। তিনি কবিতাকে সম্পূর্ণ নতুন মাত্রা দেন,এটি হ’য়ে ওঠে দমন, বঞ্চনা, সাম্রাজ্যবাদ, ধর্মীয় কুসংস্কার, সামাজিক শ্রেণিবিভাগ, অর্থনৈতিক বৈষম্য, সবকিছুর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কণ্ঠ। তিনি রাজনীতিকে কবিতার কেন্দ্রে দাঁড় করান, এবং কবিতাকে মানুষের মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতা এক অনন্ত বিদ্রোহের ঘোষণা, যা আজও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সাহিত্য ইতিহাসে অন্যতম উজ্জ্বল দলিল; তাঁর ‘সাম্যবাদী’ কবিতা দেখায় শ্রেণিবৈষম্যহীন পৃথিবীর স্বপ্ন। তাঁর কবিতা একদিকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনুঘটক, অন্যদিকে ধর্মীয় সাম্যের ভাষা; নজরুল প্রমাণ করেন যে কবিতা শুধু সৌন্দর্যের নয়, বিপ্লবেরও ভাষা। দেশভাগের পরপরই বাংলা কবিতায় রাজনীতির প্রকৃতি বদলায়; দেশভাগ ছিল মানবসভ্যতার অন্যতম ভয়ংকর রাজনৈতিক বিপর্যয়, যার আঘাতে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়, পরিচয়হীন হয়, স্মৃতিহীন হয়। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় এই ছিন্নমূলতার শোক অতি গভীর রূপে প্রকাশ পায়; তিনি সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য দেননি, কিন্তু তাঁর চিত্রকল্পের ভেতর বিষণ্ণতা, অস্তিত্বশূন্যতা, বিরহ, নিঃসঙ্গতা, অপরিচিত শহুরে চাপ, এসবই পরোক্ষ রাজনৈতিক সংকটকে বহন ক’রে। তাঁর কবিতা পরবর্তী রাজনৈতিক-সামাজিক অভিঘাতের এক আগাম চিত্র। পূর্ববাংলার রাজনীতিতে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছিল সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বাঁক, এবং সেই বাঁক কবিতাকে রূপান্তর ক’রে আন্দোলনের আত্মায়। ভাষার প্রশ্ন রাজনৈতিক পরিচয়ের কেন্দ্র হ’য়ে ওঠে; ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ শুধু গান নয়, ইতিহাসের মধ্যে ভাষাসত্তার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা; এই সময়ের কবিতায় ভাষা, রক্ত, আত্মত্যাগ, জাতীয় পরিচয়, এসবের অনাড়ম্বর কিন্তু শক্তিশালী প্রকাশ ঘটে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতা তখন শ্রমজীবী মানুষের রাজনীতি গ’ড়ে তোলে, যদিও তিনি আগেই প্রয়াত, কিন্তু তাঁর কবিতা আন্দোলনের ভিত্তি হ’য়ে ওঠে। তাঁর কবিতায় শোষণবিরোধী রাজনৈতিক চেতনা অমরত্ব লাভ ক’রে। ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক বঞ্চনা, সামরিক শাসন, অর্থনৈতিক বৈষম্য বাংলা কবিতাকে নতুন রাজনৈতিক বর্ণমালা শেখায়; শামসুর রাহমানের কবিতায় শহর, নাগরিকতা, ভয়, প্রতিরোধ, স্বপ্ন, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে এক নতুন ভাষায় প্রকাশ করেন। তার ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ’, এসব কবিতা রাজনৈতিক চেতনাকে জনমানসে শক্ত ভিত্তি দেয়। আল মাহমুদ গ্রামীণ বাঙালি পরিচয়, ধর্ম, মাটি ও সংগ্রামকে রাজনৈতিক কবিতায় রূপান্তর করেন। নির্মলেন্দু গুণ সরাসরি রাজনীতিকে কবিতার উন্মেষে নিয়ে আসেন, তাঁর কবিতা প্রতিবাদের আগুনে জ্বলেছে। রফিক আজাদ ক্ষুধা, দুঃখ, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক ব্যর্থতার সরাসরি ভাষা ব্যবহার করেন। ১৯৭১ সালে বাংলা কবিতা নিজের সবচেয়ে সত্য ও মহান রাজনৈতিক রূপে পৌঁছে যায়, যুদ্ধের কবিতা; যুদ্ধকালীন কবিতার শক্তি শুধু আবেগে নয়, আন্দোলনের বাস্তবতায়; লড়াইয়ে থাকা মানুষদের সাহস দেওয়ার জন্য কবিতাই ছিল অস্ত্র। গেরিলা কবিতা, দেশপ্রেম, শপথ, এসব এক নতুন রাজনৈতিক কবিতা-সংগ্রাম জন্ম দেয়। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রগঠনের চ্যালেঞ্জ, দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড, সামরিক শাসন, গণতন্ত্রের ব্যর্থতা, এসব কবিতায় আরও বহুমাত্রিক রাজনৈতিক প্রতিফলন ঘটায়। আশির দশক, নব্বইয়ের দশক, এবং সমকালীন যুগে কবিতার রাজনীতি আরও জটিল হ’য়ে ওঠে। নারীর দমন, শ্রেণিবৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, রাষ্ট্রীয় দমননীতি, বিশ্বায়নের অর্থনীতি, ডিজিটাল নজরতন্ত্র, পরিবেশ বিপর্যয়,এসবই নতুন রাজনৈতিক ভাষা তৈরি করে। একবিংশ শতাব্দীতে কবিতার রাজনীতি আর সরাসরি স্লোগান নয়, বরং গভীর মনস্তাত্ত্বিক, তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত। কবিতার রাজনৈতিকতা এখন আত্মপরিচয়ের রাজনীতি, স্মৃতির রাজনীতি, শরীরের রাজনীতি, ভাষার রাজনীতি, প্রযুক্তির রাজনীতি,সবকিছুর সম্মিলন। কবি এখন শুধুই শিল্পী নন, তিনি ইতিহাসবিদ, নৃবিজ্ঞানী, দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক,সবই। তাঁর কাজ শুধু প্রতিফলন নয়, সত্য উদঘাটন। কবিতার রাজনীতি এখন ব্যঙ্গ, ব্যথা, নীরবতা, ভাষাহীনতা, রূপক, ভাঙা ছন্দ,সবকিছুর মাধ্যমে বহমান; ফলে বাংলা কবিতা আজ যে রাজনৈতিক গভীরতায় দাঁড়িয়ে আছে তা বহুবিধ অভিজ্ঞতা, শতাব্দীর সংগ্রাম, রক্তক্ষয়, ভাষার যুদ্ধ, স্বাধীনতার তৃষ্ণা, মানুষের বঞ্চনা, রাষ্ট্রীয় শক্তির পরিবর্তন,সবকিছুর সম্মিলিত ফল। রাজনীতি আজ কবিতার শ্বাসপ্রশ্বাস, আর কবিতা রাজনীতির মানবিক বিবেক; তাই বলা যায়, বাংলা কবিতায় রাজনীতির প্রবেশ কোনো দিন বিশেষের ঘটনা নয়, এটি সময়ের দীর্ঘ অন্তঃসলিলা নদী, যা যুগে যুগে কবিতাকে রূপান্তরিত করেছে, এবং কবিতাকে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী মানবিক দলিলে পরিণত করেছে, যেখানে প্রতিটি শব্দ একটি আন্দোলন, প্রতিটি চিত্রকল্প একটি প্রতিরোধ, প্রতিটি চিত্র একটি স্বপ্ন, আর প্রতিটি কণ্ঠস্বর একটি জাতির মুক্তির পথরেখা।
বিষ্ণু দে , তিরিশি কবিদের অন্যতম । কবিতা রচনাই যাঁর কাছে এক এবং অদ্বিতীয় হ ’ য়ে দেখা দেয় । কাব্যে সংখ্যার দিক থেকে অতিক্রম করেছেন সতীর্থদের । বিষ্ণু দে , যাঁর কবিতা রচনার সূচনা পর্বটিও শুরু হয় খুব দ্রুততম সময়ে । কবিতা সৃষ্টির পর্বটি অব্যাহত রেখেছেন সর্বদা । পঁচিশটি কবিতা নিয়ে ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এ নিজেকে প্রকাশ করেন স্ব - মহিমায় । যে কবিতাগুলা বিস্ময়বিমুগ্ধ ক ’ রে অন্যেদেরকেও । ওই কবিতা শুধু বিষ্ণু দে ’ কে নয় , বরং নতুনতর হ ’ য়ে দেখা দেয় বাঙলা কবিতা । বিষ্ণু দে ’ র ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’ রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হয়েছিল দু ’ বার । ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এর কবিতাগুলির রচনাকালের ব্যাপ্তি দেওয়া আছে ( ১৯২৮ - ১৯৩৩ ) সময়ের মধ্যে , এবং গ্রন্থকারে প্রকাশ পায় ওই একই বছরে অর্থাৎ , ১৯৩৩ - এ । কিন্তু রচনাকালের ব্যাপ্তি ১৯২৮ দেওয়া থাকলেও প্রকৃত পক্ষে এ সকল কবিতাগুলো রচনা পর্ব শুরু হয় আরো দু ’ বছর পূর্বে অর্থাৎ , ১৯২৬ - এ । যখন কবি হিশেবে বিষ্ণু দে একেবারেই নতুন এবং নবীন । ১৯৩৩ - এ ...
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন