সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের (১৯৩৪-২০১২) সাহিত্যকে মূল্যায়ন করতে গেলে আসলে বাংলা ভাষার এক দীর্ঘ পরিক্রমাকে
মূল্যায়ন করা হয়। কারণ তিনি ছিলেন এমন এক লেখক যাঁর কলম বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন
ভূখণ্ডে ছড়িয়ে যায় নদীর শাখানদীর মতো কবিতা, উপন্যাস,
ইতিহাস, প্রেম, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণ, রোমাঞ্চ, মানবমনস্তত্ত্বের
নিকষ গহ্বর, আবার কখনো নিঃসঙ্গ শহরের নীল-ধূসরতা; তাঁর লেখনী তাই কখনো স্থির হয়নি, বরং ক্রমাগত গতিশীল
থেকেছে, যেন তিনি নিজেই সাহিত্যকে এক চলমান, নিরন্তর বিকাশমান জীবের মতো কল্পনা করেছেন। তাঁর প্রথম আবির্ভাব কবিতার
পৃথিবীতে, এবং সেই আবির্ভাব কোনো নীরব ঘটনা ছিল না,‘কৃত্তিবাস’ প্রজন্মের ঝড়ো আত্মপ্রকাশের ভেতর দাঁড়িয়ে
তিনি হ’য়ে উঠেছিলেন সেই দুর্ধর্ষ তরুণ কবি, যিনি বাংলা
কবিতায় ব্যক্তিমানসের নগ্ন স্বীকারোক্তিকে মর্যাদা দিলেন, যিনি
অলঙ্কারের আড়াল সরিয়ে শব্দের ভেতরে লুকোনো মানবিক কম্পনকে তু’লে আনলেন, যিনি আধুনিকতার টানাপোড়েনকে কাগজে ধরলেন শহরের ধোঁয়ার মতো ঘনভাবে। তাঁর
কবিতার ভাষা কখনো বিদ্রোহী, কখনো বিষণ্ণ, কখনো চিন্তাশীল, কখনো দুর্বোধ্যভাবে ব্যক্তিগত,
কিন্তু সর্বদা জীবন্ত, সর্বদা মানুষের আবেগের
অনুরণনে পূর্ণ। তিনি প্রেমকে দেখেছেন রোমান্টিকতার ফুলেল সাজে নয়, বরং মানুষের গভীর সত্যে, যেখানে রয়েছে আকাঙ্ক্ষা,
ব্যর্থতা, শরীরের স্বীকারোক্তি, মনের অসংলগ্নতা, একাকিত্বের শূন্য দিগন্ত, আবার কখনো অজানা মুক্তির ডাক। তাঁর কবিতায় শহর এক চরিত্র, সময় এক চরিত্র, মন এক চরিত্র; ফলে তাঁর কবিতার পঙ্ক্তি হ’য়ে ওঠে
মানুষের ভাঙন, মানুষের উচ্ছ্বাস, মানুষের
দুঃখী স্বপ্নের এক রূপমাল্য। তিনি আধুনিক কবিদের মতো সঙ্কেত, প্রতীক, অসংলগ্নতা ব্যবহার করলেও তার ভেতর তিনি
রেখেছেন হৃদস্পন্দনের শব্দ, যা তাঁকে তারুণ্যের কবি থেকেও
বেশি করে মানুষের কবি করে তোলে।
কিন্তু কবিতাকে
অতিক্রম ক’রে তাঁর প্রকৃত সত্তা ধরা পড়ে গদ্যে। গদ্য তাঁর কাছে ছিল বিশাল এক খোলা
প্রান্তর, যেখানে
তিনি ইচ্ছামতো দৌড়াতে পারেন, থামতে পারেন, ঘুরতে পারেন, আবার নতুন পথ তৈরি করতে পারেন। তাঁর
ঐতিহাসিক উপন্যাস সেই সময় ও প্রথম আলো বাংলা কথাসাহিত্যে এক বিশাল
উদ্ভাবন, কারণ তিনি ইতিহাসকে তথ্যের শৃঙ্খলাবদ্ধ দৃশ্য নয়,
বরং মানুষের অভিজ্ঞতার মহাকাব্য হিসেবে দেখেছেন। তিনি ১৯শ শতকের
বাংলাকে শুধুই তথ্যের সমষ্টি দিয়ে আঁকেননি; বরং সেই সময়ের
মানুষের দুঃখ, আকাঙ্ক্ষা, আশাভঙ্গ,
রাজনৈতিক উত্তেজনা, ভাষা-আন্দোলন, সামাজিক রূপান্তর, ধর্ম ও শিক্ষার সংঘর্ষ,সবকিছুকে তিনি জীবন্ত মানুষের গল্পে রূপ দিয়েছেন। তাঁর ইতিহাস তথ্যের
ঠাণ্ডা পাথর নয়; বরং আন্দোলিত হৃদয়ের মতো স্পন্দমান, যেখানে মানুষের স্বপ্ন ভেঙে যায়, আবার নতুন স্বপ্ন
জন্ম নেয়। তাই তাঁর ইতিহাস-ভিত্তিক উপন্যাস পড়লে মনে হয় যেন পাঠক কোনো দূর অতীতে
নয়, বরং বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতের হাহাকার শুনছে। তাঁর চরিত্র
যেমন বাস্তব, তেমনি কল্পনার সূক্ষ্ম শিল্পে গড়া; তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও সাহিত্যিক কল্পনার এমন নিখুঁত সেতুবন্ধন রচনা করেছেন
যে পাঠক কখনো বুঝতে পারে না কোনটি কঠিন ইতিহাস আর কোনটি জীবনের গন্ধমাখা গল্প,
এবং এই অদৃশ্য সংমিশ্রণই তাঁকে বাংলা ঔপন্যাসিকদের মধ্যে এক অনন্য
উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
তবে শুধু গুরুগম্ভীর
ঐতিহাসিক সাহিত্যেই তাঁর শক্তি সীমাবদ্ধ ছিল না;
বরং তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় সৃষ্টি ‘কাকাবাবু’
প্রমাণ করে যে তিনি শিশু–কিশোর মনস্তত্ত্বও
সমান দক্ষতায় ধারণ করতে পারতেন। ‘কাকাবাবু’ শুধু একটি চরিত্র নয়, বাংলার পাঠকসমাজের কাছে এটি সাহস, বুদ্ধি, শৃঙ্খলা ও মানবিকতার প্রতীক। শারীরিকভাবে অসম্পূর্ণ হয়েও কাকাবাবুর মানসিক
দৃঢ়তা যে কীভাবে বাধা অতিক্রম ক’রে, তা সুনীল এমনভাবে
লিখেছেন যে পাঠক নিজের মধ্যেও এক অদম্য শক্তির সঞ্চার অনুভব ক’রে। তাঁর রোমাঞ্চ-সাহিত্য শুধুই বিনোদন নয়; তা হলো পৃথিবীকে নতুনভাবে
দেখার এক জানালা। বিদেশভ্রমণ, অচেনা ভূগোল, রহস্য, বিপদ, সাহস,সবকিছুকে তিনি এমনভাবে লিখেছেন যে গল্প একদিকে রোমাঞ্চকর, অন্যদিকে শিক্ষণীয়। তাঁর ভাষা সহজ হলেও তার ভেতরে থাকে শক্তির হাওয়া;
এই ভাষাই তাঁকে কোটি পাঠকের কাছে প্রিয় করেছে।
প্রেম ও সম্পর্ক
তাঁর লেখার কেন্দ্রে যে শক্তিতে উপস্থিত,
তা এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। তিনি প্রেমকে চিরকালীন মায়ার গল্পে পরিণত
করেননি; বরং দেখিয়েছেন প্রেম আসলে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে
ক্রমাগত বদলে যাওয়া এক জটিল অস্তিত্ব। কখনো প্রেম দেহ, কখনো
মন, কখনো শুধুই স্মৃতি, কখনো বেদনা;
তাঁর লেখায় প্রেমকে ঘিরে থাকে শহুরে জীবনের জটিলতা, ব্যস্ততা, বিচ্ছেদের ভয়, একাকিত্বের
দীর্ঘ রাত, বাসনার অপরাধবোধ, আবার কখনো
মুক্তির অন্তহীন স্বপ্ন। মানুষ তাঁর কাছে কোনো নিখুঁত সত্তা নয়; বরং মানুষের মনই সবচেয়ে অসম্পূর্ণ, তবুও সবচেয়ে
সুন্দর। তাঁর প্রেমের লেখায় তাই অতিরিক্ত রোমান্টিকতা নেই; আছে
সত্য, সত্যের গভীরতা, সত্যের জ্বালা।
তিনি মানুষের মনস্তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করেছেন একদম নগ্নভাবে, অলঙ্কারবর্জিত
কিন্তু গভীর দার্শনিকতা দিয়ে, যেন তিনি বলতে চাইছেন,মানুষকে বুঝতে গেলে মানুষকেই খুলে দেখতে হয়, তার
দুর্বলতা, তার দুর্বৃত্তি, তার
আকাঙ্ক্ষা, তার লজ্জা, তার অহং,
তার হাহাকার,সবকিছুকে।
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখার আরেক বিস্ময়কর বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর ভাষা,সহজ অথচ শক্তিশালী, স্বচ্ছ
অথচ বহুবিহ্বল, হালকা অথচ গভীর। তাঁর বাক্য গ’ড়ে ওঠে নদীর
ভঙ্গিতে,প্রবাহমান, কখনো উচ্ছ্বসিত,
কখনো শান্ত, কিন্তু সর্বদাই লক্ষ্যে স্থির।
তিনি বাংলা ভাষাকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে মনে হয় ভাষা তাঁর হাতে কাঁচামাটির
মতো নমনীয়, যে ভাষা দিয়ে তিনি চাইলে মন্দির গড়তে পারেন,
চাইলে ঝড় তু’লে দিতে পারেন পাঠকের মনে। তাঁর ভাষার এই ব্যক্তিত্ব
তার সময়কে অতিক্রম করেছে; আর এই কারণেই তাঁর লেখা আজও পাঠকের
কাছে সমান প্রাসঙ্গিক,যেন তার ভেতরের মানবিকতা কোনো দিন
পুরোনো হয় না।
বাংলা সাহিত্যে তাঁর
অবদান তাই কেবল প্রাচুর্যের কারণে বড় নয়;
বরং তাঁর সৃষ্টির বহুমাত্রিকতার কারণে, তাঁর
চিন্তার বিস্তারের কারণে, তাঁর মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার
ক্ষমতার কারণে। তিনি কবি, তিনি ঔপন্যাসিক, তিনি ইতিহাস লেখক, তিনি শিশুসাহিত্যিক, তিনি ভ্রমণকার, তিনি সম্পাদক, তিনি
পর্যবেক্ষক, তিনি বিশ্লেষক,কিন্তু এই
সব পরিচয়ের ভেতর দিয়ে তিনি আসলে একজনই: একজন সত্যিকারের সাহিত্যকার, যিনি নিজের চারপাশের পৃথিবীকে দেখেছেন মমতায়, ক্রোধে,
প্রেমে, ধ্বংসে, সৃষ্টিতে
এবং গভীর কৌতূহলে; এবং সেই দেখা থেকে যা পেয়েছেন সবকিছুকে
তিনি শব্দে রূপ দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্য আমাদের শেখায় যে লেখক হওয়া মানে শুধু লেখা
নয়, মানুষের দিকে তাকানো, সময়ের দিকে
তাকানো, নিজের অন্তরের দিকে তাকানো, এবং
এই তিন দৃষ্টির সমন্বয়ে এক নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করা। তিনি সেই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন
তাঁর অসংখ্য গ্রন্থে; তিনি ভাষাকে দিয়েছেন মহিমা, সাহিত্যকে দিয়েছেন শক্তি, পাঠককে দিয়েছেন চিন্তার
স্বাধীনতা।
এইসব কারণেই সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য কখনো একক কোনো ধারায় আবদ্ধ থাকে না; তা একটি নদী, একটি আলো,
একটি নক্ষত্রমণ্ডল, যেখানে প্রতিটি পাঠক নিজের
অভিজ্ঞতা, নিজের জীবন, নিজের দুঃখ-আশা-স্বপ্নের প্রতিবিম্ব খুঁজে পায়। তাঁর সাহিত্য
সময়ের সীমানা অতিক্রম করে; তাঁর ভাষা ক্লান্ত হয় না; তাঁর চরিত্রেরা মরে না; তাঁর ভাবনা শুকিয়ে যায় না।
বাংলা সাহিত্য যতদিন থাকবে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাহিত্য
ততদিন আলো হয়ে জ্বলবে, একটি স্থায়ী দীপ্তি, যা প্রজন্মান্তরের অন্ধকার ভেদ ক’রে মানুষের মনকে নতুন ক’রে আলোকিত করবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন