‘সোনার তরী' রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১), একটি বিখ্যাত বাংলা কবিতা, এবং এটি তাঁর অন্যতম
শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হিসেবে বিবেচিত। কবিতাটি রবীন্দ্রনাথ রচনা করেন ১৮৯৪ সালে,
যখন তার বয়স ৩৩ বছর। এই কবিতাটি জীবন ও কর্মের ক্ষণস্থায়ীত্বকে
মহাকাল ও আত্মত্যাগের প্রেক্ষাপটে তু’লে ধরে, যেখানে কবি নিজের কাব্য-ফসল মহাকালের হাতে তুলে দিলেও স্থান পাননি,
যা জীবনের নশ্বরতা ও মহাকালকে বোঝায়। সোনার
তরী' কবিতায় কৃষক (সাধারণ মানুষ), সোনার
ধান (মানুষের কর্ম ও সৃষ্টি), মহাকাল ও 'সোনার তরী' (মহাকাল বা ঈশ্বরের নৌকা) এগুলোর মাধ্যমে
জীবন ও কর্মের ক্ষণস্থায়ীত্ব বোঝানো হয়েছে। জীবনের
ভোগ-বিলাস, ব্যক্তিগত অর্জন, সবকিছুই
নশ্বর। মহাকাল সবকিছু গ্রহণ করলেও, মানুষের কর্ম বা
শিল্পকর্মের স্থান শুধু ক্ষণিকের জন্য, শেষে সে রিক্ত হয়ে
যায়, যা জীবনের এক গভীর দার্শনিক সত্যকে প্রকাশ করে।
রবীন্দ্রনাথের সোনার তরি যেন
মানবজীবনের অন্তর্লোক থেকে উঠে আসা এক বিস্ময়মাখা প্রতীক,
যার ভেতরে ভেসে থাকে আমাদের সব সংগ্রাম, আকাঙ্ক্ষা,
প্রত্যাশা আর না-পাওয়ার দীর্ঘ নীরবতা; এই
তরিটি সোনা দিয়ে গড়া বলে নয়, বরং মানুষের গভীর মানসলোকে
সঞ্চিত আশা-স্বপ্নের দীপ্তিতে তা সোনালি হয়ে ওঠে, এবং সেই
দীপ্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি যেন আমাদের সবারই প্রতিরূপ,যে জীবনভর নিজের অর্জন, নিজের শ্রম, নিজের হৃদয়ের সবটুকু দান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কোনো এক অদৃশ্য নিয়তির সামনে,
যার আগমন কখনও আশা জাগায়, কখনও ভীত করে,
কখনও বা এক গভীর রহস্যের ছায়া ফেলে; সোনার তরি কবিতায় এই রহস্যময় আগমনই মানুষের আত্মজিজ্ঞাসার দরজা খুলে দেয়, যেখানে মানুষ বুঝতে পারে যে তার পরিশ্রম জীবনের মাঠে ধানের মতোই বেড়ে ওঠে,
পাকে, ঝরে, আবার নতুন
করে জন্মায়, কিন্তু এই শ্রমের ফল সে কখনো নিশ্চিতভাবে ধরে
রাখতে পারে না, কারণ নিয়তির নিজের একটি প্রবাহ আছে, যার সঙ্গে মানুষের সাধ-আকাঙ্ক্ষা মিলেও কখনও সম্পূর্ণ মেলে না; তবুও মানুষ শ্রম করে, কারণ শ্রমই তাকে অর্থ দেয়,
প্রাণ দেয়, নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে জুড়ে রাখে।
এই তরির আগমন যেন মানুষের সেই
মুহূর্ত,
যখন সে ভাবে যে আজ তার জীবনের স্বীকৃতি মিলবে, আজ তার সঞ্চিত ধন গ্রহণ করবে কেউ, আজ তার পরিশ্রমের
নীরব কাহিনী কারও চোখে ধরা দেবে,কিন্তু সোনার তরি এসে থেমেও
থাকে না, ফিরে যায়; এই ফিরে যাওয়া শুধু
একটি তরি নয়, বরং মানুষের সব প্রত্যাশার আপনার করা দরজার
মতোই, যা খুলতে খুলতে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যায়, আর মানুষ একা দাঁড়িয়ে থাকে জীবনমাঠের মাঝখানে, হাতে
থাকে শুধু শূন্যতার স্পর্শ, অপূর্ণতার কষ্ট, বিসর্জনের দীর্ঘশ্বাস; কিন্তু বিসর্জনের ভেতরেও কবি
দেখান আশ্চর্য এক শান্তির আলো, কারণ মানুষ শূন্য হলে তবেই
বোঝে যে তার অন্তরে যে বিশাল সঞ্চয় লুকিয়ে আছে তা কোনো বাহ্যিক ধন নয়, বরং তারই শ্রম, তারই ভালোবাসা, তারই দানের গভীরতা।
সোনার তরি
মানুষের এই না-পাওয়ার ভেতর থাকা পাওয়া বোঝার সোপান; তরি
চলে গেলেও সে মানুষ হারায় না তার প্রাপ্য, বরং নতুন করে ফিরে
পা শ্রমকে চিনবার শক্তি, নিজের দানের মূল্য বোঝবার ক্ষমতা,
আর এই উপলব্ধিই তাকে গভীর আধ্যাত্মিকতায় পৌঁছে দেয়, যেখানে সে অনুভব করে যে সোনার তরি যদি তার ধন নিয়ে না যায়, তবুও তার অন্তরের সোনা কেউ কেড়ে নিতে পারে না; এই
অন্তরের সোনা হল তার অভিজ্ঞতা, তার ভালোবাসা, তার আত্মসমর্পণের শক্তি, তার দানের আনন্দ, আর এসবের কারণেই মানুষ বাঁচে, এগিয়ে যায়, নতুন ধান ফলায়, নতুন স্বপ্ন বুনে, যদিও জানে যে সামনে থাকা তরি সবসময় তাকে গ্রহণ করবে না।
জীবনে এমন অনিবার্য মুহূর্ত আসে,
যখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সব সুযোগ, সব সম্ভাবনা,
সব স্বপ্নের তরি কোনো অজানা কারণে দূরে সরে যায়,কখনও সময়ের অভাবে, কখনও নিয়তির কোনও কাঠিন্যে,
কখনও নিজের প্রস্তুতির অপূর্ণতায়,আর মানুষ তখন
ভাবতে থাকে সে কি ব্যর্থ হলো; সোনার
তরি এই ব্যর্থতার বোধকে গভীর দার্শনিক আলোয় ভেঙে দেয়,
কারণ কবি দেখান যে সত্যিকার ব্যর্থতা তরি চলে যাওয়ায় নয়, বরং ব্যর্থতা তখনই, যখন মানুষ নিজের শ্রমকে আর মূল্য
দিতে পারে না, নিজের দানের গভীরতা ভুলে যায়, আর নিজের ভেতরের সোনাকে অবহেলা করে বাহিরের সোনায় সব মূল্য খুঁজে; সোনার তরি মানুষকে শেখায় যে বাহ্যিক সব অর্জন ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু যে শ্রম, যে দান, যে
ভালোবাসা আমরা অন্যের প্রতি প্রকাশ করি তা অমলিন, তা-ই আসল
সোনা।
এই কারণে কবিতাটি শুধু একটি তরি ও
কৃষকের গল্প নয়, বরং মানুষের জীবনের প্রতিটি ব্যর্থ
স্বপ্নের, প্রতিটি অপ্রাপ্ত প্রত্যাশার, প্রতিটি হারিয়ে যাওয়া সুযোগের এক চিরন্তন রূপক; মানুষ
যতদিন বাঁচে, ততদিন জীবনের তরিগুলো আসে আর যায়, কিছু গ্রহণ করে, কিছু প্রত্যাখ্যান করে, কিছু স্পর্শ করেও সরে যায়,কিন্তু এইসবের মধ্যেই
মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে শেখে যে তার আসল শক্তি তরি পাওয়া নয়, বরং
তরি না পেলেও আবার উঠে দাঁড়ানো; সেই উঠে দাঁড়ানোর শক্তি আসে
তার শ্রম থেকে, তার অভিজ্ঞতা থেকে, তার
বিশ্বাস থেকে, আর তার অনিবার্য ত্যাগ-বিসর্জন থেকে, যাকে কবি নীরবে সৌন্দর্যের মতো রূপ দেন।
জীবনের যে অমোঘ সত্যটি কবি সোনার তরিতে দেখিয়েছেন,
তা হলো,মানুষের পরিশ্রম কখনও নিঃশেষ হয় না;
তা অন্যের দ্বারা গ্রহণ না হলেও মানুষের ভিতরে তা অনন্ত সঞ্চয়ের মতো
থাকে, আর জীবনে সে যতবার নতুন করে শুরু করে, এই সঞ্চয় তাকে তত গভীরভাবে সঙ্গ দেয়; সোনার তরি
এইভাবে মানুষের অন্তরাত্মার পুনর্জন্মের সম্ভাবনা তুলে ধরে, যেন
বলে,হারানো মানেই পতন নয়, শূন্য হওয়া
মানেই শেষ নয়, বরং শূন্য হয়ে তবেই মানুষ নিজেকে নতুন করে
ভরতে পারে, নতুন করে সৃষ্টির পথে হাঁটতে পারে।
সোনার তরি তাই শুধু চলে যায় না,
বরং এক অমোঘ শিক্ষা দিয়ে যায়, জীবনের যে সোনা
আমাদের ভেতরে আছে, তার আলোই সত্য, তার
দীপ্তিই চিরস্থায়ী; আর সেই আলোকেই মানুষ এগোয়, আবার ধান রোপণ করে, আবার স্বপ্ন গড়ে, আবার কোনো এক অদেখা তরির জন্য অপেক্ষা করে,যেন
জীবনটাই এক দীর্ঘ বিসর্জন আর অর্জনের মিশেল, যেখানে হারানোর
মধ্যেও থাকে পাওয়া, আর না-পাওয়ার ভেতরেও থাকে গভীর উপলব্ধির
আলো; এই উপলব্ধিই সোনার
তরিকে পাঠকের অন্তরে দশ পৃষ্ঠার মতো দীর্ঘ এক চিরন্তন অভিজ্ঞতা হিসেবে
বাঁচিয়ে রাখে, যা শুধু পড়া যায় না, অনুভব
করা যায়, জীবনে নতুন করে উপলব্ধির শক্তি দেয়, আর শেখায়,আমাদের অন্তরের সোনাই আসল, যাকে কোনো তরি কেড়ে নিতে পারে না।
গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।
কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা
ধান কাটা হল সারা,
ভরা নদী ক্ষুরধারা
খরপরশা।
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।
একখানি ছোটো খেত, আমি
একেলা,
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।
পরপারে দেখি আঁকা
তরুছায়ামসীমাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা
প্রভাতবেলা–
এ পারেতে ছোটো খেত, আমি একেলা।
গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা-পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু-ধারে–
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ওগো, তুমি কোথা
যাও কোন্ বিদেশে,
বারেক ভিড়াও তরী কূলেতে এসে।
যেয়ো যেথা যেতে চাও,
যারে খুশি তারে দাও,
শুধু তুমি নিয়ে যাও
ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।
যত চাও তত লও তরণী-‘পরে।
আর আছে?– আর নাই, দিয়েছি
ভরে।
এতকাল নদীকূলে
যাহা লয়ে ছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে
থরে বিথরে–
এখন আমারে লহ করুণা করে।
ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই–
ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।
শ্রাবণগগন ঘিরে
ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে,
শূন্য নদীর তীরে
রহিনু পড়ি–
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন