সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঠাকুরবাড়ির রহস্যময় ঘটনা

 

ঠাকুরবাড়ির ভিতরে এমন কিছু জায়গা আছে, যেগুলো আলোয় থেকেও অদ্ভুতভাবে অন্ধকারে ডুবে থাকে। যেন আলো সেখানে গিয়ে নিজের উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে। বাড়ির পূর্বমুখী লম্বা করিডরের মাঝামাঝি এমনই একটি দাগ আছে। দিনের সবচেয়ে উজ্জ্বল রোদেও সে জায়গাটিতে দাঁড়ালে মনে হয়, তোমার ছায়াটা যেন দুটি হয়ে গেছে। একটি তোমার সঙ্গে চলে, আরেকটি একটু পেছনে দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকে। এই ছায়াকে বাড়ির বৃদ্ধ সেবিকা বলতেন,রক্ষক ছায়া। কে বা কাদের রক্ষক, তার উত্তর আজও অনির্বচনীয়।

ঠাকুরবাড়ির সিঁড়িগুলো সাধারণ কাঠের তৈরি, কিন্তু ভোরবেলায় যখন প্রথম কেউ সেগুলো বেয়ে নামে, তখন সিঁড়ির কাঠ থেকে একটা অদ্ভুত, শুকনো শব্দ ওঠে, যেন কেউ নিঃশব্দে অনেকক্ষণ কান পেতে ছিল, আর প্রথম পায়ের শব্দে তাকে ছেড়ে দিল দীর্ঘশ্বাসের মতো। সেই দীর্ঘশ্বাসকারক সত্ত্বা কে? মানুষ বলে,এই বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা হলো তার নীরবতা। নীরবতাই নাকি রাতে ঘরগুলো ঘুরে দেখে, কেউ কোনো গোপন বাক্য ফেলে রেখে গেছে কিনা।

উত্তরের বারান্দায় একটি পুরোনো লণ্ঠন ঝোলে, যা বহুদিন জ্বলে না। তবে কিছু রাতে, বিশেষ করে শরতের শেষ ভাগে, বলা হয় লণ্ঠনের কাচে ক্ষীণ একটি আলো দেখা যায়। যেন ভেতরে কোনো শিখা নয়, বরং কোনো স্মৃতি জেগে উঠেছে। এক বৃদ্ধ পরিচারক বলেছিলেন, বাড়ির যাদের স্বপ্ন অসমাপ্ত থেকে গেছে, সেই সব স্বপ্নের ক্ষুদ্র কম্পন জমে জমে লণ্ঠনের কাচে আলো হয়ে ওঠে। এই আলো মানুষকে ডাকতে চায়, কিন্তু কেউ কাছে এলে মিলিয়ে যায়।

ঠাকুরবাড়ির পশ্চিম দালানের একটি প্রতিকৃতি আছে, যা অনেকেই এড়িয়ে চলে। প্রথম নজরে ছবিটি অন্যদের মতোই, কিন্তু রাতে সেই প্রতিকৃতির চোখে ম্লান একটি আভা দেখা যায় বলে কথিত আছে। যেন ছবিটি কাউকে দেখছে না, বরং কারো অপেক্ষায় আছে। ছবির সামনে দাঁড়ালে বুকের ভেতর এক অদ্ভুত হালকা চাপ লাগতে থাকে, যেন কোনো অদৃশ্য প্রশ্ন তোমার দেহ ছুঁয়ে যাচ্ছিল। বইপত্রে এর কোনো ইতিহাস নেই, কিন্তু বাড়ির কর্মচারীরা বলেন,এ প্রতিকৃতি যে-ঘরে রাখা হয়েছে, সেই ঘরে কেউ কখনো গভীর ঘুমোতে পারে না।

ঠাকুরবাড়ির ভেতরের অদ্ভুততম জায়গা হলো পুরোনো প্রার্থনাকক্ষ। সেখানে এখন কেউ প্রার্থনা করে না, ধূপ জ্বলে না, গানও হয় না। কিন্তু ঘরটিতে ঢুকলে একধরনের অমোঘ ছায়া দেয়ালের গায়ে লেগে থাকে। বিজ্ঞানীরা বলবেন,এটা পুরোনো কাঠের গন্ধ, পুরোনো চুন-সুরকির ছায়া। কিন্তু যারা ভিতরে ঢুকেছেন তাঁরা বলেন,ঘরে ঢুকলে মনে হয়, কেউ যেন নরম স্বরে বলল: ফিরে এসো। কার কাছে ফিরে আসা? কোন অতীতের দিকে? কেউ জানে না।

দোতলার লাইব্রেরিতে রাত নেমে গেলে বইয়ের পাতাগুলো মাঝে মাঝে নিজেরাই উলটে যায়। যদিও জানালা বন্ধ থাকে, বাতাস চলাচল করে না। পাতার এই মৃদু শব্দকে বড়োরা বলতেন,গোপন পাঠ। বলা হতো, যারা জীবদ্দশায় শেষ লেখা শেষ করতে পারেননি, তাঁদের বইগুলো এখনো নিজেদের বাক্য খুঁজতে চায়। তাই কিছু রাত বই নিজেরাই নিজেদের গল্প পড়ে। এই শব্দ শুনলে মনে হয়, দশ, বারোটি ফিসফিসানো কণ্ঠ একসঙ্গে কথা বলছে, অথচ কোনো শব্দই স্পষ্ট হয় না।

ঠাকুরবাড়ির ছাদের ওপরে একটি জানালা আছে যেটা বাইরে থেকে দেখা যায়, কিন্তু ভেতর থেকে কেউ খুঁজে পায় না। এই জানালাকে লোকেরা বলত,অদৃশ্য কক্ষের জানালা। বলা হয়, বাড়ির মূল অংশ নির্মাণের সময় যে কক্ষটি নাকি ভুলে যাওয়া হয়েছিল ,যার কোনো দরজা নেই, কিন্তু জানালা আছে, সেই কক্ষ নাকি চেতনাহীন থেকে আজও ঝুলে আছে বাড়ির কোথাও। মানুষ এটাকে ছায়াময় কল্পনা বলে, কিন্তু রাতের বেলা বাইরে থেকে তাকালে দেখা যায়,জানালার ভেতর একটি হালকা নীলচে আলো ঘুরে বেড়ায়যেন কাউকে খুঁজছে।

বাড়ির কেন্দ্রের সেই ছোট্ট আঙিনায়, যেখানে বৃষ্টির জল জমে থাকে, সেখানে রাতে মাঝে মাঝে হালকা ঢেউ ওঠে,যখন কোনো বাতাস থাকে না, গাছও নড়ে না। বলা হয়,এই জলের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়ায় পদচিহ্নহীন মানুষের স্মৃতি। বাড়ির যাঁরা একসময় এখানে দিন কাটিয়েছেন, তাঁদের না-বলা গল্প, না-কাঁদা কান্না, না-লেখা লাইন,সব মিলেমিশে নাকি অদৃশ্য পদচিহ্ন হয়ে জলে দুলতে থাকে।

সবচেয়ে অদ্ভুত বিষয়, ঠাকুরবাড়িতে কেউ কখনো ঠিক বলতে পারে না, এখানে কয়টি ঘর আছে। যে-গণনা করেই সংখ্যা লেখা হোক, কিছুদিন পর দেখা যায়, নতুন একটি ঘর যেন উদ্ভাসিত হয়েছে এবং পুরোনো একটি ঘর যেন মিলিয়ে গেছে। বাড়ির স্থপতিরাও বলেন,এ অসম্ভব। কিন্তু পুরোনো পরিচারকেরা বলেন,ঠাকুরবাড়ি সংখ্যা মানে না; এটা স্মৃতি অনুযায়ী বড়ো-ছোট হয়।

বাড়ি যেন মানুষের মতোই, কখনো খোলে, কখনো বন্ধ হয়, কখনো স্বপ্ন দেখে। আর রাত হলে, যখন দোতলার সব ঘর অন্ধকারে ঢেকে যায়, ঠাকুরবাড়ি যেন তার বিশাল দেহে অদৃশ্য কোনো অনন্ত গল্প লিখে যেতে থাকে, যেটা কেউ পড়ে না, কেউ বোঝে না, কিন্তু সবাই অজান্তে অনুভব করে।

 জোড়াসাঁকোর ভোরে আলো ধরার আগে যে অদ্ভুত নীল-ধূসর স্তব্ধতা নামে, সে স্তব্ধতার ভেতরে ঠাকুরবাড়ির প্রাচীন বটগাছটি আগে জেগে ওঠে। ঘরের মানুষ তখনো ঘুমিয়ে, কিন্তু সেই বটগাছের পাতার ওপর দিয়ে যে বাতাস প্রথম বয়ে যায়, তাকে বলা হয়,বাড়ির প্রথম শ্রোতা। এই শ্রোতা নাকি প্রতিদিন ভোরে একবার করে বাড়ির অতীতকে শোনে; বহুবছর আগের জমিদারবাড়ির হাসি, কোলাহল, শাড়ির ঘস্ ঘস্ শব্দ, দূর থেকে ভেসে আসা খুদের কান্না,সবকিছু ভোরের ছায়ায় মিশে তার পাতায় ঝরে পড়ে। এই কাহিনি আজ আর কেউ বলে না, শুধু এক বৃদ্ধ পরিচারিকা একসময় বলেছিলেন।

ঠাকুরবাড়ির পশ্চিম দিকের লম্বা করিডর দিয়ে হাঁটতে গেলে পায়ের শব্দে একটি নরম প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। এই প্রতিধ্বনিকে বাড়ির পুরোনো লোকেরা ফিরতি ধ্বনিবলত। ফিরতি ধ্বনি নাকি কখনো নিজের সঙ্গে একই সুরে উত্তর দেয় না; প্রতিটি শব্দকে বদলে দেয়, যেন হাঁটতে হাঁটতে কেউ তোমাকে প্রশ্ন করছে,“তুমি এখন যে, আগে কি সে-ই ছিলে?” শতাব্দী-প্রাচীন ইটের ভাঁজে জমে থাকা সময়ের সুরই হয়তো এই বদলে দেওয়া।

পূর্ব আঙিনার এক কোণে পুরোনো একটি লোহার দরজা আছে। দরজাটি বর্তমানে খোলা হয় না, তবে সে সময়ে বলা হতো,দরজার পেছনে ছিল বাড়ির নিঃশব্দ কক্ষ। কীসের নিঃশব্দ? কেউ জানত না। শুধু কথিত ছিল, বাড়ির অন্তঃপুরে কোনো নববধূ যখন প্রথম ঢুকত, তাকে সেখানে কিছুক্ষণ একা বসিয়ে রাখা হতো, যেন তার মনের সমস্ত ভয় দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। হয়তো এ ছিল পুরোনো সামাজিক আচার; তবে কক্ষে যে অদ্ভুত প্রশান্তি লেগে থাকত, অনেকেই বলত সেটি মানুষের নয়,সময় নামক অদৃশ্য জিনিসের সংগৃহীত শান্তি।

ঠাকুরবাড়ির ছাদের উপরের নকশাগুলো দিনের আলোয় যতটা ধরা পড়ে, তার চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট দেখা যায় সন্ধ্যার পর জোনাকির আলোয়। বহু বছর আগে এক তরুণ শিল্পী, সম্ভবত বিড়লা স্কুলের ছাত্র, বাড়িতে এসে আঁকার অনুশীলন করতেন। তিনি বলেছিলেন, “এই নকশাগুলো দিনের জন্য নয়; রাতের ভিজে নীল আলোতে এদের প্রকৃত মুখ ফুটে ওঠে।কেউ বিশ্বাস করল না, কিন্তু সেই শিল্পী এক অদ্ভুত কথা লিখে গিয়েছিলেন,ঠাকুরবাড়ির ছাদের কারুকাজ নাকি তোমার চোখ নয়, তোমার স্মৃতিকে দেখে নিজের রূপ ঠিক করে নেয়।

মানিকতলা দিকের যে পথ দিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়, সেই পথের বাঁদিকে ছোট্ট একটি কুয়োআজ স্তব্ধ; কিন্তু কথিত ছিল, কুয়োটির জলে বাড়ির উৎসবের প্রতিফলন সবচেয়ে আগে দেখা যেত। কোনো উৎসবের আগে বাড়ির নারীরা কুয়োর পাড়ে এসে বালতি নামিয়ে জল তুলত। তারা নাকি বলত,“পানির মধ্যে উৎসব আগে মাথা তোলে, তারপর মানুষের ঘরে আসে।হয়তো আলো আর ছায়ার খেলা, হয়তো কল্পনা,তবুও সেই জলরাশির গভীরে উৎসবের প্রথম হাসি কেউ কেউ দেখেছে বলে দাবি করেছে।

ঠাকুরবাড়ির পুরোনো লাইব্রেরিতে একটি অদ্ভুত গন্ধ টিকে আছে,কাগজ, কাঠ, ধূপ এবং একফোঁটা বৃষ্টির মিশ্রণ। এই গন্ধ নাকি সবসময় ছিল না; বাড়ির এক বৃদ্ধ দারোয়ান বলতেন, এই গন্ধ এসেছে বহু মানুষের পড়া-লেখার শ্বাস থেকে। বই ছুঁয়ে যে নিশ্বাস বেরিয়েছে, যে চিন্তা অস্থির হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে, ছিঁড়ে যাওয়া খসড়ার যে ছোট্ট শব্দ,সব মিলেই নাকি এই গন্ধ। তাই লাইব্রেরিতে ঢুকলেই মনে হয়,এখানে কেউ নেই, অথচ কেউ আছে।

উত্তর দালানের সিঁড়িতে বিকেলের যে আলো পড়ে, তাকে কখনোই স্থির বলা যায় না। যেন আলো নিজেই দৌড়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। বাড়ির ছেলে মেয়েরা আগে একে বলত আলোর ছুটন্ত পত্র”, কারণ আলো নাকি সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে উঠোনে ছড়িয়ে পড়ে, যেন কোনো অদৃশ্য ডাকপিয়ন বার্তা দিয়ে গেল। কী বার্তা? কেউ জানত না। তবে যারা বাড়ির বাইরে থেকে এসে প্রথম এই আলো দেখত, তারা অকারণেই একটু নরম হয়ে যেত,যেন আলো ভিতরের দরজা হালকা করে খুলে দিচ্ছে।

ঠাকুরবাড়ির রান্নাঘরযা অনেকেই আজ দেখেন না,সেখানে একসময় রাতে হাঁড়িতে ঢাকনা চাপলার শব্দ শোনা যেত, যখন রান্না হতো না তখনও। বলা হতো, আগের দিনের গৃহরন্ধনশিল্পীদের হাতের ছন্দ নাকি একধরনের উত্তাপের স্মৃতিরেখে গেছে। এই স্মৃতিই খালি হাঁড়ি বাজিয়ে যায়, যেন কেউ রান্নার অসমাপ্ত স্বপ্ন পূরণ করতে চায়।

ঠাকুরবাড়িকে তাই শুধু একটি স্থাপনা বলা অন্যায়,এ বাড়ি স্মৃতির মতো, গানের মতো, হঠাৎ ভেসে আসা কোনো দীর্ঘশ্বাসের মতো। অদেখা গল্পেরা এখানে সময়ের মতোই বসবাস করেচুপচাপ, নরম, অথচ দৃঢ়ভাবে।

ঠাকুরবাড়ির দোতলার লালচে কাঠের বারান্দায় দাঁড়ালে বিকেলের আলোটা ঠিক সেভাবে পড়ে, যেন কেউ একজন বহুদিনের পুরোনো একটি চিঠি খুলে পড়ছে। এই আলো বাড়ির বহু বক্তৃতা, বহু বিতর্ক, বহু রাত্রির গদ্যলিখনের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা নিঃশব্দ বাক্যগুলোর ওপর পড়ে। বারান্দার কাঠের রেলিং গুনে গুনে যে ক্ষুদ্র দাগগুলো দেখা যায়,লক্ষ করলে বোঝা যায়, এগুলো একসময়ের কালি-লাগা আঙুলের দাগ। যেন তরুণ কোনো লেখক হাত নামিয়ে বিশ্রাম নিয়েছিলেন, আর সেই ডুবন্ত সূর্যালোক তার কাঁধে নরম একটি চাপ রেখেছিল। কেউ জানে না সেই দাগ কোন প্রজন্মের, কিন্তু রেলিং-এর কাঠ আজও অদ্ভুত মমতায় সেগুলো ধরে রেখেছে।

বাড়ির দক্ষিণ প্রান্তে একটি বন্ধ ঘর আছে,যা আজ বহুকাল খোলা হয় না। বলা হয়, এ ঘরেই একসময় কোনো গোপন সঙ্গীতসন্ধ্যা হতো। কিন্তু সঙ্গীত মানেই কি কেবল সুর? ঘরের দেয়ালে কানের কাছে নিয়ে গেলে faint একটি অদ্ভুত কম্পন শোনা যায়, যেন খুব পুরোনো কোনো তান এখনো মিশে আছে চুন-সুরকিতে। এক বৃদ্ধ গবেষক নাকি একবার বলেছিলেন,ঠাকুরবাড়ির এই ঘরের জড় স্থাপনাগুলোও একধরনের স্মৃতি-তরঙ্গজমিয়ে রাখে। মানুষের আনন্দ, রাগ, প্রেম, হতাশা,সবকিছুই পদার্থ হয়ে জমে থাকে। তাই ঘরে ঢুকলে যে inexplicable শান্তি পাওয়া যায়, তা কোনো দেবীয় রহস্য নয়; মানুষের ছায়া মানুষের মধ্যেই রয়ে যায়।

উত্তর আঙিনায় একটি ছায়া পড়ে সন্ধ্যাবেলায়। আশ্চর্যের বিষয়,গাছ, দেয়াল বা কারো শরীর সেই ছায়া বানায় না; তবু ছায়াটি থাকে। এটাকে বাড়ির পরিচারিকারা ডাকত ঝরা মানুষের ছায়াবলে। বিশ্বাস ছিল, যখন বাড়ির কেউ অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে উঠোনে হেঁটে যেতেন, তার মানসিক ভারের অবয়ব আলাদা হয়ে পড়ত মাটিতে। মাটিতে জমে থাকা সেই ছায়া দিনের শেষে নিজের গতিতে মিলিয়ে যেত। বাস্তবে হয়তো আলো-ছায়ার খেলা, কিন্তু যারা দেখেছে তারা বলেছে,এই ছায়ার মধ্যে এমন একাকিত্ব আছে, যা মানুষের দুঃখকেও লজ্জা দেয়।

ঘরের পরঘর পেরিয়ে যেতে যেতে একটি জায়গায় মেঝেটা খানিকটা ঠান্ডা লাগে। শীতের সময়ও সেখানে একই ঠান্ডা। এটাকে বলা হতো,“অগ্রজদের পথ।কথিত ছিল, বাড়ির প্রবীণ যাঁরা চলে গেছেন, তাঁদের স্বপ্নের চলার পথ নাকি এখনও সেখানে বয়ে যায়। মানুষের এক জীবনের সব অপ্রকাশিত আকাঙ্ক্ষা, অসমাপ্ত গদ্য, অপূর্ণ স্নেহ,সবকিছু মিলেমিশে বাতাসে একটি অদৃশ্য পথ তৈরি করে। যে-কারণে সেখানে দাঁড়ালে মনে হয়, তুমি একা নও,কারো পায়ের অতি-নরম চলার শব্দ ঠিক মনে-মনে শুনে ফেলছো।

ঠাকুরবাড়ির রান্না-বাড়ির পেছনের লম্বা করিডর দিয়ে সন্ধ্যেবেলা গেলে মশলার গন্ধ ভেসে আসে; অথচ রান্নাঘর তখন অন্ধকার ও শীতল। এই গন্ধকে বলা হতো,“রান্নার স্মরণ।অনেকেই বলে, এটা নাকি সেইসব দিনের স্মৃতি যখন বাড়িতে নবদম্পতির জন্য বিশেষ রান্না হতো, কিংবা নিজের সন্তানদের জন্য মায়েরা চুপ করে ভাজছিলেন লুচি। খাবারের গন্ধ যে কেবল খাবারের নয়,এটা সময়ের সুগন্ধও বটে,এ বাড়িটাই যেন এই সত্য ধীরে ধীরে শিখিয়েছে।

আশ্চর্যের একটি জিনিস আছে,রবিবার ভোরে বাড়ির উত্তর জানালাগুলো দিয়ে ঢোকা আলো নাকি অন্যদিনের আলো থেকে বেশি সোনালি হয়। মানুষ বলত,রবিবার ছিল ঠাকুর পরিবারের বিশ্রামের দিন”, তাই আলোও সেদিন একটু ধীর, একটু গাঢ়, একটু নিঃশব্দ। যেন এই আলো জানে,মানুষ সেদিন নিজের গভীরতার দিকে তাকাতে চায়, বাইরে দৌড়ায় না। তাই রবিবার সকালের আলোতে বাড়ির কোনো এক অচেনা অংশ নরম হয়ে যায়। আপনি দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হবে,বাড়িটা যেন নিঃশ্বাস নিচ্ছে।

বাড়ির ছাদের একটি কোণ আছে যেটা খুব কম লোকই দেখেছে,তবে যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বলেন, সেখানে বাতাস ঠিকভাবে বইতে চায় না। যেন বাতাস সেখানে এসে থমকে দাঁড়ায়। এই থেমে যাওয়া বাতাসকে বলা হয়,“অভিমানী বাতাস।কারণ কথিত ছিল, বাড়ির বহুকাল আগের কোনো উৎসবের দিনে কারো মন ভেঙে গিয়েছিল, কারো কথা কেউ শোনেনি, আর সেই না-শোনা কথাটাই হালকা অভিমানে বাতাস হয়ে ছাদের কোণায় আটকে আছে। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হলো,স্থাপত্যের কোণার ঘূর্ণায়মান বায়ুপ্রবাহ। কিন্তু মানুষের স্মৃতি বিজ্ঞান মেনে চলে না,সে চলে ব্যথার ইতিহাস দিয়ে।

এ বাড়ির এক বিশেষ বিষয় আছে, দরজা। এখানে দরজা কখনো পুরোপুরি খোলে না, আবার পুরোপুরি বন্ধও হয় না। দরজার ফাঁকে একটা নরম রেখা থাকে,যেন বাড়ি তোমাকে একদিকে আমন্ত্রণ করছে, আরেকদিকে তোমাকে কিছুটা আটকে দিচ্ছে। দরজার এই দ্বিধাকে বাড়ির নারী-পুরুষেরা বলত,“সময়ের দ্বার।কারণ কারো জীবন কখনো পুরো খোলে না, কখনো পুরো বন্ধ হয় না; মাঝখানের ফাঁক দিয়েই জীবন প্রবাহিত হয়।

শেষত, ঠাকুরবাড়ির রাতের একটি গোপন রঙ আছে,যা দিনের আলোয় দেখা যায় না। রাত গভীর হলে, সব আলো নিভে গেলে, বাড়ির লাল ইটগুলো নাকি অল্প নীল হয়ে ওঠে। এই নীলকে বলা হয়,“নিদ্রার রঙ।মনে হয় বাড়িটা নিজেও ঘুমোয়, তার শত বছরের ক্লান্তি নেমে আসে ইটের ভাঁজে ভাঁজে। যে কেউ গভীর রাতে দাঁড়িয়ে এটি দেখলে বুঝবে,এই বাড়ি শুধু মানুষের স্মৃতি ধরে রাখে না; মানুষের নিদ্রাও ধরে রাখে।

ঠাকুরবাড়ির এইসব অজানা গল্প আসলে কোনো নথির ইতিহাস নয়; মানুষের দেখা, শোনা, বিশ্বাস করা, কল্পনা করা,সব মিলিয়ে তৈরি এক আত্মার চিত্র। একটি বাড়ি যদি এত মানুষের ভালোবাসা, ব্যথা, সংগ্রাম, সৃজন, স্তব্ধতা, স্বপ্ন ধারণ করে রাখে,তবে সে বাড়ি আর স্থাপনা থাকে না। সে হয়ে ওঠে এক জীবন্ত পুরাণ, যার দেয়ালে কান রাখলে আজও শোনা যায়,অদৃশ্য সময়ের ধীর, গভীর, অচেনা হাঁটাচলা।

ঠাকুরবাড়ির ভেতরে ছড়িয়ে থাকা এসব ছোট ছোট অদেখা কাহিনি,যা কেউ লিখে রাখেনিকেউ সংগ্রহ করেনি,আসলে বাড়ির দেয়াল ধরে বেঁচে থাকা মানুষের পদচিহ্নের মতো। ইতিহাস বহন করে নথিকিন্তু একটি বাড়ির আসল আত্মা লুকিয়ে থাকে তার অদৃশ্য গল্পগুলোতে,যা না সত্যিনা মিথ্যেযেন আলো-ছায়ার মাঝামাঝি suspended সত্য।

 


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রবন্ধঃ বিষ্ণু দে : ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ থেকে ‘চোরাবালি’

বিষ্ণু দে , তিরিশি কবিদের অন্যতম । কবিতা রচনাই যাঁর কাছে এক এবং অদ্বিতীয় হ ’ য়ে দেখা দেয় । কাব্যে সংখ্যার দিক থেকে অতিক্রম করেছেন সতীর্থদের । বিষ্ণু দে , যাঁর কবিতা রচনার সূচনা পর্বটিও শুরু হয় খুব দ্রুততম সময়ে । কবিতা সৃষ্টির পর্বটি অব্যাহত রেখেছেন সর্বদা । পঁচিশটি কবিতা নিয়ে ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এ নিজেকে প্রকাশ করেন স্ব - মহিমায় । যে কবিতাগুলা বিস্ময়বিমুগ্ধ ক ’ রে অন্যেদেরকেও । ওই কবিতা শুধু বিষ্ণু দে ’ কে নয় , বরং নতুনতর হ ’ য়ে দেখা দেয় বাঙলা কবিতা । বিষ্ণু দে ’ র ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’ রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হয়েছিল দু ’ বার । ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এর কবিতাগুলির রচনাকালের ব্যাপ্তি দেওয়া আছে ( ১৯২৮ - ১৯৩৩ ) সময়ের মধ্যে , এবং গ্রন্থকারে প্রকাশ পায় ওই একই বছরে অর্থাৎ , ১৯৩৩ - এ । কিন্তু রচনাকালের ব্যাপ্তি ১৯২৮ দেওয়া থাকলেও প্রকৃত পক্ষে এ সকল কবিতাগুলো রচনা পর্ব শুরু হয় আরো দু ’ বছর পূর্বে অর্থাৎ , ১৯২৬ - এ । যখন কবি হিশেবে বিষ্ণু দে একেবারেই নতুন এবং নবীন । ১৯৩৩ - এ ...

প্রবন্ধঃ অমিয় চক্রবর্তী : ‘বৃষ্টি’ নিয়ে তিনটি কবিতা

রবীন্দ্রনাথ, মেঘ-বরষা বৃষ্টি নিয়ে এতো সংখ্যক কবিতা লিখেছেন যে তাঁর সমান বা সমসংখ্যক কবিতা বাঙলায় কেউ লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কবিতায় বার বার এবং বহুবার ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, বরষা, বৃষ্টি। বৃষ্টি নামটি নিলেই মনে পড়ে কৈশোর পেড়িয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটির কথা। ‘দিনের আলো নিবে এল সূর্য্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।’ বৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার কথা মনে পড়লে এটাই চলে আসে আমার মনে। অমিয় চক্রবর্তী বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। বাঙলায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেনি এমন কবির সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় পাই ‘বৃষ্টি’ নামক কিছু সৌন্দর্যময় কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে। ওই কবিদের কারো কারো কবিতা দ্রুত নিঃশ্বাসে পড়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি নামক প্রথম কবিতাটি পাওয়া যাবে অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠোতে’। উন্নিশটি কবিতা নিয়ে গ’ড়ে উঠে ‘একমুঠো’ নামক কাব্য গ্রন্থটি। যেখান থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতায় তুলে নেওয়া হয় চারটি কবিতা। আমার আরো ভালোলাগে ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি ওই তালিকায় উঠে আসে। শ্রেষ্ঠ কবিতায় না আসলে আমার যে খুব খারাপ লাগতে তা-ও নয়। ওই কবিতা...

প্রবন্ধঃ বুদ্ধদেব বসু ও ‘কঙ্কাবতী’

বুদ্ধদেব বসু প্রেমের অজস্র কবিতা রচনা করেছেন । অন্য অনেকের মতো তিনিও বেছে নেন একজন প্রেমিকাকে , যে হ ’ য়ে উঠে বুদ্ধদেবের অতুল্য প্রেমিকা হিশেবে । ‘ কঙ্কাবতী ’ অনিন্দ্য প্রেমিকা হ ’ য়ে বুদ্ধদেবের কাব্যতে বিচরণ ক ’ রে স্বচ্ছন্দে । স্থির হয়ে বসে পড়ে কঙ্কাবতী ’ কাব্যগ্রন্থে । যে কাব্যগ্রন্থে ‘ কঙ্কাবতী ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে ‘ কঙ্কাবতীকে ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে কঙ্কাবতীকে আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো কবিতায় । যেখানে সে প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে কুৎসিত কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু নয় । প্রগাঢ় ভাবে প্রাপ্তির জন্যে সমস্ত কবিতা জুঁড়ে দেখতে পাই কবির অপরিবর্তনীয় আবেদন । কঙ্কাবতী , যাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময়ের জন্যে রক্তের হিমবাহে দেখা দেয় চঞ্চলতা । সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হাঁরিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো , যা বলার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন । প্রেমিকা যখন খুব কাছাকাছি হয়ে এগিয়ে আসেন , ওই ব্যর্থ ...