বাংলা সাহিত্যের বিস্তীর্ণ অরণ্যে কিছু
বৃক্ষ আছে যাদের ছায়া যুগ পেরিয়েও ঝ’রে না; যারা শব্দের শরীরে লুকিয়ে রাখেন মানুষের
হৃদয়ের বহু শিকড়, বহু অন্ধকার, বহু জাগরণ। সেই বিরল বৃক্ষদের একজন ছিলেন সৈয়দ শামসুল
হক (১৯৩৫-২০১৬)। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাকে কেবল কবি, কেবল
ঔপন্যাসিক, কেবল নাট্যকার বা প্রাবন্ধিক বলে সীমাবদ্ধ করা যায় না; তিনি ছিলেন ভাষার
বহু-মাত্রিক স্থপতি, যিনি শব্দকে মানুষ ক’রে তুলেছিলেন এবং মানুষের বুকে শব্দের সত্যকে
ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সৃষ্টির পরিধি বিস্তৃত,কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্য,
গীতিকবিতা, রাজনৈতিক ও মানবতাবাদী বক্তব্য, কোনো ক্ষেত্রেই তিনি অল্প পরিমাণে প্রবেশ
করেননি; যা-ই স্পর্শ করেছেন, তা-ই হয়েছে গভীর, প্রগাঢ়, আত্মশক্তিতে দীপ্ত।
সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ছিল কৃত্তিবিদ্যার
নয়, ভাষার জ্যোতির্বিদ্যার। সেই জ্যোতির্বিদ্যা তাঁকে বুঝিয়েছিল শব্দের নক্ষত্ররা কিভাবে
মানুষের ভাগ্যরেখা বদলে দেয়। তাঁর শৈশবের কুড়িগ্রামের আকাশ, তিস্তা নদীর লাবণ্য, শেষ
বিকেলের নরম আলো,এসব তাঁর লেখনীতে লুকিয়ে আছে, কখনো ভীষণ স্পষ্টতায়, কখনো স্বপ্নের
মত অস্পষ্ট রূপে। প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক তাঁকে সবসময়ই আন্দোলিত করেছে; বিশেষ ক’রে
উত্তরবঙ্গের মানুষের জীবনসংগ্রাম, মাটি, জল, প্রেম, বিচ্ছেদ,এসব তাঁর সাহিত্যকে এক
অনন্য দেশজ আবহে রাঙিয়ে তুলেছে। তাঁর লেখায় গ্রামীণ বাস্তবতার সঙ্গে আধুনিক বোধের যে
মিলন ঘটে, তা বাংলা সাহিত্যে এক বিরল অভিজ্ঞতা।
কবিতায় তিনি ছিলেন সাজিয়ে লেখা নন, বরং
নিজের ভেতরের অগ্নিসদৃশ মর্মযন্ত্রণা থেকে রূপ তৈরি করা এক চিত্রকর। তাঁর কবিতায় আছে
জীবনের সামগ্রিকতা,বেদনা, ক্ষুধা, প্রেম, মূল্যবোধ, দেশ, রাজনীতি, মৃত্যুচেতনা,সব একাকার
হ’য়ে গেছে তাঁর কাব্যভাষায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, কবিতা সমাজের প্রতিচ্ছবি নয়, তার ভেতরের
আলোড়নের ভাষা। সেই আলোড়ন থেকেই এসেছে "পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়", "সে
যে আমার জন্মভূমি", "বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর",এসব উচ্চারণের
ভেতর দিয়ে তাঁর দেশে ও মানুষের প্রতি গভীর মমত্ব প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কাব্যভাষা কখনো
নদীর মতো মসৃণ, কখনো ঝড়ের মতো উত্তাল। তিনি ভাবতেন ভাষাকে, ব্যবহার করতেন যেন সুর,
যেন ছন্দের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কোনো প্রাচীন আহ্বান, যেন মানুষের হৃদয়ের অতল থেকে উঠে
আসা কোনো গোপন উচ্চারণ।
একজন নাট্যকার হিসেবে তিনি ছিলেন বাংলা
সাহিত্যের উর্বর শক্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম। তাঁর নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে মানবসমাজের সংঘাত,
রাজনীতি, প্রতিরোধ, ইতিহাস এবং ব্যক্তি-মনস্তত্ত্বের নির্ভুল নির্মাণ। "নুরুলদীনের
সারাজীবন" গ্রন্থটি কেবল একটি নাটক নয়, এটি জাতির প্রতিবাদী আত্মার দলিল।
এখানে তিনি একদিকে দেখিয়েছেন ক্ষমতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ, অন্যদিকে দেখিয়েছেন
দৃঢ় মানবিক অবস্থান থেকে সত্য উচ্চারণের সাহস। তাঁর নাটকে সংলাপগুলো শুধু কথার মধ্যে
সীমাবদ্ধ ছিল না, তারা ছিল মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস, মানুষের রক্তে লেখা জাগরণ। নাট্যভাষাকে
তিনি এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, যেখানে রাজনীতি ও কাব্য একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে যায়, বিরোধ
আর সৌন্দর্য একে অপরকে আলিঙ্গন করে।
উপন্যাসে তাঁর ভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম।
তিনি মানুষের ভেতরের অন্ধকারকে ভয় পাননি; বরং তিনি তা দেখেছেন, বিশ্লেষণ করেছেন, ভাষায়
রূপ দিয়েছেন তীক্ষ্ণ অথচ কোমল দৃষ্টিতে। মানুষের জীবন শুধু বাহ্যিক নয়, তার ভেতরে যে
জটিলতা, দ্বন্দ্ব, অভাব, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, আত্মসংঘর্ষ,এসবকে তিনি গল্পে এমনভাবে সাজাতেন,
যাতে পাঠক নিজের জীবনকেও চিনে ফেলে। তাঁর উপন্যাসে বাস্তবতা আছে, আছে স্বপ্নের মতো
অস্পষ্টতা, আবার আছে মনস্তাত্ত্বিক অন্বেষার গভীরতা। তিনি কখনো শব্দের অলংকারে আটকাননি;
বরং বোধের ভেতর দিয়ে ভাষার নতুন নির্মাণ করেছেন।
কিন্তু সাহিত্যের বাইরে তিনি ছিলেন এক
সামাজিক বোধের কবি; তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষকে, মানুষে-মানুষে যোগাযোগকে। মুক্তিযুদ্ধ,
ভাষা, স্বাধীনতা, এসব ছিল তাঁর লেখার অনিবার্য প্রেক্ষাপট। তিনি ভাষাকে শুধু সাহিত্যিক
নির্মাণ হিসেবে দেখেননি; দেখেছেন অস্তিত্বের মৌলিক রূপ হিসেবে। তাই ভাষা নিয়ে যে যুদ্ধ,
যে আন্দোলন, সেগুলো তাঁর রচনার ভেতর বারবার ফিরে এসেছে। তিনি মনে করতেন, একটি জাতির
আত্মা তার ভাষায় বেঁচে থাকে। তাঁর শব্দ তাই শুধু শব্দ নয়, তা জাতির চেতনাকে জাগিয়ে
তোলা এক গোপন শক্তি।
সৈয়দ শামসুল হক ছিলেন খ্যাতির ওপর দাঁড়িয়ে
থাকা লেখক নয়, বরং ছিলেন নিজের লেখায় নিজেকে প্রমাণ করার এক অমোঘ যোদ্ধা। তিনি নতুন
কিছু সৃষ্টি না ক’রে থাকতে পারতেন না। তাঁর সৃষ্টিশক্তি ছিল বায়ুর মতো, নদীর মতো, নিরন্তর।
তিনি প্রতিটি রচনায় নিজেকে পুনর্গঠন করেছেন, নিজের ভাষাকে নতুন ক’রে ফুটিয়েছেন। তাঁর
জীবনীপ্রবাহ দেখলে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী, এবং নিজের শিল্পকে নিয়ে
আপসহীন একজন লেখক। সাহিত্য তাঁর কাছে ছিল পূজা, ছিল সাধনা; এবং সেই সাধনা তাঁকে দিয়েছে
এক কালোত্তীর্ণ স্বর, যা বাংলা ভাষার ভুবনে চিরদিন প্রতিধ্বনিত হবে।
মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি লিখেছেন।
ক্যানসারের অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়েও তিনি অন্য সকল লেখকের মতো নীরব হ’য়ে যাননি; বরং শেষ
সময়েও তিনি লিখছিলেন, বলছিলেন, সৃজনের ভেতর দিয়েই মানুষ অমর হয়। তাঁর শেষ কবিতাগুলোতে
আছে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষের অসহায়তা, আবার আছে জীবনের প্রতি গভীর প্রেম।
তাঁর ভাষা তখনও ছিল দ্যুতিময়, তীক্ষ্ণ, অনুভববহ।
বাংলা সাহিত্যকে তিনি দিয়েছেন এক নতুন
বোধ, নতুন দিগন্ত, নতুন ভাষা। তাঁর কলমের নিচে সৃষ্টি হয়েছে দেশ, মানুষ, সংসার, ইতিহাস,
প্রেম, মৃত্যুর বিশাল উপাখ্যান। তিনি দেখিয়েছেন, সাহিত্য কেবল শিল্প নয়, এটি মানুষের
আত্মার গভীরে পৌঁছানোর এক শক্তি, যা সময়কে অতিক্রম ক’রে বেঁচে থাকে। সৈয়দ শামসুল হকের
সাহিত্য তাই কেবল পাঠের বিষয় নয়, এটি অনুভবের, চিন্তার, আত্মবিশ্লেষণের একটি অনন্ত
পথ।
বাংলা সাহিত্যের আকাশে তিনি এমন এক নক্ষত্র,
যার আলো নিভে যায় না। সময় তাঁর শরীরকে শেষ ক’রে দিলেও, তাঁর শব্দ আজও বেঁচে আছে, বেঁচে
থাকবে, তাঁর কণ্ঠ যে কথা বলেছিল দেশের পক্ষে, মানুষের পক্ষে, ভাষার পক্ষে,তা চিরদিন
প্রতিধ্বনিত হবে। তিনি বাংলা ভাষার সেই সৃষ্টিকর্তাদের একজন, যারা নিজের জীবন দিয়ে
সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। সৈয়দ শামসুল হক আমাদের শিখিয়ে গেছেন,সাহিত্য মানে মানুষের
স্পন্দন, মানুষের যন্ত্রণা, মানুষের আনন্দ, মানুষের জয়গাথা,সাহিত্য মানে নিজেকে ভাঙা,
নিজেকে তৈরি করা, এবং নিজের ভেতরের সত্যকে বিশ্বের সামনে উন্মোচন করার সাহস।
তাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা শুধু একজন লেখকের
প্রতি নয়, একজন ভাষা-যোদ্ধার প্রতি, একজন মানুষের প্রতি, যিনি তাঁর শব্দ দিয়ে আমাদের
আত্মাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর সাহিত্য বাংলা ভাষার গর্ব, আমাদের জাতির এক অমূল্য সম্পদ,
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতের মশাল। সৈয়দ শামসুল হক তাই চিরদিন বেঁচে থাকবেন, শব্দে, ছন্দে,
মানুষের অন্তরে। তিনি নিজেই যেমন বলেছিলেন,
“লেখা আমার জীবন, আমি মরলেও শব্দ মরবে না।”
সেই কথাই আজ সত্য হ’য়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁর
শব্দ আজও বেঁচে আছে, জন্ম দিচ্ছে নতুন আলো, নতুন অনুভব, নতুন সাহিত্যের ভবিষ্যৎ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন