সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

চন্দ্রাবতী, আমার করুণ অশ্রুগাঁথা

 

চন্দ্রাবতী, বাংলা সাহিত্য-ইতিহাসে এক অসাধারণ এবং গভীরতর রহস্যময় উপস্থিতি। যাঁর নাম উচ্চারণ করলেই মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্যভুবনের নীরব অথচ দৃপ্ত এক নারী-কণ্ঠ খুলে যায়। এমন এক সময়ে, যখন নারীর লেখাকে শুধু অবজ্ঞাই নয়, প্রায় অসম্ভব বলেই ধরা হতো, সেই ঘন সামাজিক অন্ধকার ভেদ ক’রে চন্দ্রাবতী তাঁর কলমকে বিশ্বাস করেছিলেন নিজের একমাত্র সত্য আশ্রয় হিসেবে। ময়মনসিংহের শান্ত প্রকৃতি, নদী আর জনপদের সহজ-সরল জীবন যেন তাঁর অনুভূতিতে মিশে ছিল অবিচ্ছিন্নভাবে। সেই প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও একাকিত্ব তাঁর শব্দে, তাঁর উপমায়, তাঁর বেদনায় ক্রমে আকার পেতে থাকে। তাঁর জীবনকথার সঙ্গে প্রেমের ব্যথা এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে মনে হয়, ঠিক সেই ক্ষতই তাঁকে রচনা করেছে, তাঁকে গ’ড়ে তুলেছে ব্যতিক্রমী এক শিল্পীসত্তায়। প্রেমের প্রতারণায় বিধ্বস্ত মন যখন আশ্রয়হীন, তখন তিনি আশ্রয় নিলেন রচনার ভিতরে, এবং সেই রচনা পরিণত হলো বাংলার প্রথম নারী-দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত মহাকাব্যিক আখ্যান, চন্দ্রাবতীর রামায়ণ

এই রামায়ণ অন্য যে কোনো সংস্করণের মতো নয়; এখানে রাম বীরত্বের প্রতীক হলেও তাঁর প্রতি আস্থা অন্ধ নয়, বরং মানবিক দৃষ্টিতে বিচার করা। এখানে সীতা কেবল দেবীসত্ত্বা নন, তিনি এক রক্তমাংসের নারী, যাঁর দুঃখ, অপমান, অবিশ্বাস আর নিঃসঙ্গতা চন্দ্রাবতীর নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে যায়। রামের সিদ্ধান্ত, সমাজের বিচার, নারীর প্রতি অবিরাম সন্দেহ, এসব প্রশ্ন চন্দ্রাবতী, এমন সাহসিকতায় উচ্চারণ করেছেন, যা তাঁর যুগের কোনো নারীর পক্ষে ছিল প্রায় অকল্পনীয়। সমাজের চাপ, ধর্মের প্রভাব, পুরুষ-কেন্দ্রিক মূল্যবোধ, সবকিছু উপেক্ষা করেই তিনি সীতাকে কেন্দ্র ক’রে এক নতুন আলোয় পুরাণকে দেখিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি সীতা যেন এক প্রতীক: সমস্ত অত্যাচারিত, ভুল বোঝা, তবু দৃঢ়চেতা নারীর চিরন্তন রূপ।

চন্দ্রাবতীর ভাষা আধুনিকের মতো জটিল নয়, বরং সহজ-সরল, লোকজ, স্নেহমাখা আর কখনও কখনও হৃদয়ভেদী ব্যথায় রঞ্জিত। তাঁর কবিতায় নদী এসেছে মায়ের মতো, বন এসেছে নিঃসঙ্গতার প্রতীক হ’য়ে, আর রাত্রির অন্ধকার এসেছে নারীর অন্তর্দহনকে প্রতীকী ক’রে। শব্দের সরলতার আড়ালে যে গভীর বোধ, তা পাঠককে সহজেই টেনে নিয়ে যায় তাঁর মানসজগতে, যেখানে নারী শুধু প্রেমের পাত্র নয়, বরং অনুভবের ধারক, সাহসের, প্রতিবাদের, আত্মমর্যাদার। যদিও তাঁর রচনার সংখ্যার তুলনায় তাঁর জীবনের তথ্য অল্প, তবু তাঁর সাহিত্যিক গুরুত্ব দিন দিন আরও দৃশ্যমান হচ্ছে, কারণ তিনি যেন মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের নিভু-নিভু আলোকে এক নতুন আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।

চন্দ্রাবতীকে বোঝা মানে শুধু একজন নারী কবিকে বোঝা নয়, বরং বোঝা এক সম্পূর্ণ যুগকে, সেই যুগে নারীর নিঃশব্দ কান্না, অধিকারহীনতা, এবং আর্তিকার প্রতি সমাজের অনমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি নিজের যন্ত্রণাকে সাহিত্যিক রূপ দিয়ে সেই যুগের নীরবতা ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁর রামায়ণে যখন সীতা প্রশ্ন করেন, তখন আসলে সমগ্র নারীজাতিই প্রশ্ন তোলে; রামকে নয়, বরং সমাজকে, সেই বিচারব্যবস্থাকে, সেই শেকলকে যা নারীর জীবনের উপর কর্তৃত্ব ক’রে। চন্দ্রাবতীর এই উচ্চারণ এতটাই শক্তিশালী যে আজকের সাহিত্যচর্চার প্রেক্ষাপটেও এটি নতুন ক’রে মূল্যায়ন দাবি ক’রে।

তিনি ছিলেন পরিমিত, শান্ত, নীরব এক লেখক; কিন্তু তাঁর নীরবতার ভিতরেই ছিল এক বিশাল বিস্ফোরণ। যা তাঁর রচনার প্রতিটি পংক্তিতে ধ্বনিত হয়। বাংলা সাহিত্যের দীর্ঘ ইতিহাসে বহু কবি, বহু রচনা এলেও চন্দ্রাবতীর মতো গভীরভাবে নারীর আত্মসত্তার বেদনা এবং শক্তি কেউ তু’লে ধরতে পারেননি। তাঁর সাহিত্য শুধু অতীতের স্মারক নয়, বরং আজও প্রাসঙ্গিক, আজও অনুরণিত। কারণ নারীর দুঃখ, অবদমন, প্রেম, বর্জন ও পুনর্জন্মের যে চিরন্তন চক্র, সেটি তিনি এমন সত্যতায় প্রকাশ করেছেন যে, তা শতাব্দী পেরিয়ে আজও অম্লান থাকে।

চন্দ্রাবতী সেই আলো, যা ইতিহাসের ধুলোয় ঢেকে গেলেও নিভে যায়নি; সেই কণ্ঠ, যা সমাজের চাপা অন্ধকারে থেকেও স্পষ্ট প্রতিধ্বনিত; সেই অগ্রগামী নারী, যাঁর রচনার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য প্রথম শোনে নারীর নিজের ভাষা, নিজের স্বর, নিজের যন্ত্রণার অমোঘ আকুতিকে। তাঁর কাব্যধ্বনি আজও নদীর মতো বহমান, চিরন্তন, অবিনশ্বর। তার সৃষ্টি, সৌন্দর্য যেন একক কোন চোখ দিয়ে দেখা নয়, এ-যেন জ্যোতির্ময় আলোয় ছড়ানো এক আদিম অন্ধকারের পথ।


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

প্রবন্ধঃ বিষ্ণু দে : ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ থেকে ‘চোরাবালি’

বিষ্ণু দে , তিরিশি কবিদের অন্যতম । কবিতা রচনাই যাঁর কাছে এক এবং অদ্বিতীয় হ ’ য়ে দেখা দেয় । কাব্যে সংখ্যার দিক থেকে অতিক্রম করেছেন সতীর্থদের । বিষ্ণু দে , যাঁর কবিতা রচনার সূচনা পর্বটিও শুরু হয় খুব দ্রুততম সময়ে । কবিতা সৃষ্টির পর্বটি অব্যাহত রেখেছেন সর্বদা । পঁচিশটি কবিতা নিয়ে ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এ নিজেকে প্রকাশ করেন স্ব - মহিমায় । যে কবিতাগুলা বিস্ময়বিমুগ্ধ ক ’ রে অন্যেদেরকেও । ওই কবিতা শুধু বিষ্ণু দে ’ কে নয় , বরং নতুনতর হ ’ য়ে দেখা দেয় বাঙলা কবিতা । বিষ্ণু দে ’ র ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’ রবীন্দ্রনাথকে পড়তে হয়েছিল দু ’ বার । ‘ উর্বশী ও আর্টেমিস ’- এর কবিতাগুলির রচনাকালের ব্যাপ্তি দেওয়া আছে ( ১৯২৮ - ১৯৩৩ ) সময়ের মধ্যে , এবং গ্রন্থকারে প্রকাশ পায় ওই একই বছরে অর্থাৎ , ১৯৩৩ - এ । কিন্তু রচনাকালের ব্যাপ্তি ১৯২৮ দেওয়া থাকলেও প্রকৃত পক্ষে এ সকল কবিতাগুলো রচনা পর্ব শুরু হয় আরো দু ’ বছর পূর্বে অর্থাৎ , ১৯২৬ - এ । যখন কবি হিশেবে বিষ্ণু দে একেবারেই নতুন এবং নবীন । ১৯৩৩ - এ ...

প্রবন্ধঃ অমিয় চক্রবর্তী : ‘বৃষ্টি’ নিয়ে তিনটি কবিতা

রবীন্দ্রনাথ, মেঘ-বরষা বৃষ্টি নিয়ে এতো সংখ্যক কবিতা লিখেছেন যে তাঁর সমান বা সমসংখ্যক কবিতা বাঙলায় কেউ লিখেনি। রবীন্দ্রনাথ, যাঁর কবিতায় বার বার এবং বহুবার ফিরে ফিরে এসেছে মেঘ, বরষা, বৃষ্টি। বৃষ্টি নামটি নিলেই মনে পড়ে কৈশোর পেড়িয়ে আসা রবীন্দ্রনাথের ওই কবিতাটির কথা। ‘দিনের আলো নিবে এল সূর্য্যি ডোবে ডোবে আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে চাঁদের লোভে লোভে।’ বৃষ্টি নিয়ে কবিতা পড়ার কথা মনে পড়লে এটাই চলে আসে আমার মনে। অমিয় চক্রবর্তী বৃষ্টি নিয়ে লিখেছেন বেশ কিছু কবিতা। বাঙলায় বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লিখেনি এমন কবির সংখ্যা খুব কম বা নেই বললেই চলে। অমিয় চক্রবর্তী, যাঁর কবিতায় পাই ‘বৃষ্টি’ নামক কিছু সৌন্দর্যময় কবিতা। যে কবিতাগুলো আমাকে বিস্ময় বিমুগ্ধ ক’রে। ওই কবিদের কারো কারো কবিতা দ্রুত নিঃশ্বাসে পড়া সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বৃষ্টি নামক প্রথম কবিতাটি পাওয়া যাবে অমিয় চক্রবর্তীর ‘একমুঠোতে’। উন্নিশটি কবিতা নিয়ে গ’ড়ে উঠে ‘একমুঠো’ নামক কাব্য গ্রন্থটি। যেখান থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতায় তুলে নেওয়া হয় চারটি কবিতা। আমার আরো ভালোলাগে ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি ওই তালিকায় উঠে আসে। শ্রেষ্ঠ কবিতায় না আসলে আমার যে খুব খারাপ লাগতে তা-ও নয়। ওই কবিতা...

প্রবন্ধঃ বুদ্ধদেব বসু ও ‘কঙ্কাবতী’

বুদ্ধদেব বসু প্রেমের অজস্র কবিতা রচনা করেছেন । অন্য অনেকের মতো তিনিও বেছে নেন একজন প্রেমিকাকে , যে হ ’ য়ে উঠে বুদ্ধদেবের অতুল্য প্রেমিকা হিশেবে । ‘ কঙ্কাবতী ’ অনিন্দ্য প্রেমিকা হ ’ য়ে বুদ্ধদেবের কাব্যতে বিচরণ ক ’ রে স্বচ্ছন্দে । স্থির হয়ে বসে পড়ে কঙ্কাবতী ’ কাব্যগ্রন্থে । যে কাব্যগ্রন্থে ‘ কঙ্কাবতী ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে ‘ কঙ্কাবতীকে ’ দেখা দেয় অনৈসর্গিক হয়ে । ‘ কঙ্কাবতী ’ কাব্য রচনার পূর্বে কঙ্কাবতীকে আমরা দেখতে পাই অন্য কোনো কবিতায় । যেখানে সে প্রেমিকার কাছে হয়ে ওঠে কুৎসিত কঙ্কাল ব্যতীত অন্য কিছু নয় । প্রগাঢ় ভাবে প্রাপ্তির জন্যে সমস্ত কবিতা জুঁড়ে দেখতে পাই কবির অপরিবর্তনীয় আবেদন । কঙ্কাবতী , যাঁর সাথে কিছু বাক্য বিনিময়ের জন্যে রক্তের হিমবাহে দেখা দেয় চঞ্চলতা । সুপ্রিয়া প্রেমিকা মুখ তোলা মাত্র কবি হাঁরিয়ে ফেলেন ওই সৌন্দর্যময় বাক্যগুলো , যা বলার জন্যে অপেক্ষায় ছিলেন কবি দীর্ঘদিন । প্রেমিকা যখন খুব কাছাকাছি হয়ে এগিয়ে আসেন , ওই ব্যর্থ ...