সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

পোস্টগুলি

বাঙালি একটি জাতিগোষ্ঠী

  ‘বাঙালি একটি জাতিগোষ্ঠী’ এই বাক্যের ভিতর লুকিয়ে আছে এমন এক ইতিহাস, যার সূচনা অনির্দিষ্ট কালের অভ্যন্তরে; এমন এক সমাজজৈব বিবর্তন, যাকে শুধু ভূগোল নয়, ভাষা, সংস্কৃতি, স্বপ্ন, সংগ্রাম, বেদনা, সংগীত, দর্শন, সব মিলেই গ’ড়ে তুলেছে; মানুষের জাতিগত পরিচয়ের ইতিহাস সাধারণত যুদ্ধ, পরিযান, রক্তের মিশ্রণ, খাদ্যাভ্যাস, সামাজিক রীতি, ভূগোল, ঋতুচক্র, নদীর প্রবাহ, বনের বিস্তার, এসবের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়; কিন্তু বাঙালির পরিচয় এতটাই বিস্তৃত যে একে একক কোনো উৎসের সন্তান বলা যায় না; বরং বলা যায় সে বহু ধারার মিলিত সন্তান, পুরোনো সভ্যতার মাটিতে শিকড় গাড়া, বহু জাতির স্পর্শে গঠিত, বহু ভাষার শব্দে নির্মিত, বহু সংস্কৃতির ধ্বনিতে পরিণত এক সম্মিলিত মানবসত্তা। এই অঞ্চলে যে মানুষ প্রথম বসবাস শুরু ক’রে তারা ছিল প্রথম সন্তান, নদীর সন্তান, মাটির সন্তান; তারা বনের ছায়া, পাহাড়ের ঢাল, নদীর দুয়ারে আশ্রয় খুঁজতো; তাদের জীবন ছিল ঋতু ও প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, খাদ্যসংগ্রহ, শিকার, মাছ ধরা, প্রাকৃতিক ফলমূল, এসব ছিল তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা; তাদের সৃষ্ট প্রথম গান ছিল বৃষ্টি নামার শব্দে, প্রথম নৃত্য ছিল নদীর তটে, প্রথ...

সৈয়দ শামসুল হক: ভাষা, জীবন ও সৃজনের উত্তরাধিকার

  বাংলা সাহিত্যের বিস্তীর্ণ অরণ্যে কিছু বৃক্ষ আছে যাদের ছায়া যুগ পেরিয়েও ঝ’রে না; যারা শব্দের শরীরে লুকিয়ে রাখেন মানুষের হৃদয়ের বহু শিকড়, বহু অন্ধকার, বহু জাগরণ। সেই বিরল বৃক্ষদের একজন ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-২০১৬)। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যে এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাকে কেবল কবি, কেবল ঔপন্যাসিক, কেবল নাট্যকার বা প্রাবন্ধিক বলে সীমাবদ্ধ করা যায় না; তিনি ছিলেন ভাষার বহু-মাত্রিক স্থপতি, যিনি শব্দকে মানুষ ক’রে তুলেছিলেন এবং মানুষের বুকে শব্দের সত্যকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সৃষ্টির পরিধি বিস্তৃত,কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, চিত্রনাট্য, গীতিকবিতা, রাজনৈতিক ও মানবতাবাদী বক্তব্য, কোনো ক্ষেত্রেই তিনি অল্প পরিমাণে প্রবেশ করেননি; যা-ই স্পর্শ করেছেন, তা-ই হয়েছে গভীর, প্রগাঢ়, আত্মশক্তিতে দীপ্ত। সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ছিল কৃত্তিবিদ্যার নয়, ভাষার জ্যোতির্বিদ্যার। সেই জ্যোতির্বিদ্যা তাঁকে বুঝিয়েছিল শব্দের নক্ষত্ররা কিভাবে মানুষের ভাগ্যরেখা বদলে দেয়। তাঁর শৈশবের কুড়িগ্রামের আকাশ, তিস্তা নদীর লাবণ্য, শেষ বিকেলের নরম আলো,এসব তাঁর লেখনীতে লুকিয়ে আছে, কখনো ভীষণ স্পষ্টতায়, কখনো স্বপ্নের মত অস্পষ্ট রূপে। ...

কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুরহস্য

  কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনির্বচনীয় অন্ধকার, এমন এক রহস্য যার সূক্ষ্ম পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ঠাকুরবাড়ির অভ্যন্তরীণ সমাজব্যবস্থা, নারীবিদ্বেষী যুগের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি, সম্পর্কের অপ্রকাশ্য জটিল মানসিক বিন্যাস, এবং এক প্রতিভাময় নারীর জীবনের গভীর নিঃসঙ্গতার ছায়া; ১৮৫৯ সালে জন্ম নেওয়া কাদম্বরী খুব অল্প বয়সেই প্রবেশ করেছিলেন জোড়াসাঁকোর অন্দরমহলে, যেখানে রীতি-নীতি, আভিজাত্য, সাহিত্যচর্চা, কৌলীন্য, পারিবারিক রাজনীতি, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব,সব মিলিয়ে চলত এক জটিল সামাজিক দৃশ্যপট, যার মধ্যে কাদম্বরী হয়তো আলো হ’য়ে এসেছিলেন, কিন্তু সময়ের প্রবাহে সেই আলো নিভে যেতে যেতে পরিণত হয়েছিল অসহ্য অন্ধকারে; ঠাকুরবাড়ির ইতিহাসে এমন নারী খুব কমই আছেন যাঁরা কাদম্বরীর মতো একইসঙ্গে প্রভাবশালী, অন্তর্মুখী, বুদ্ধিমতী, সৃজনশীল এবং অগ্নিমেয়; তাঁর স্বামী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন সংস্কৃতিমনস্ক, শিল্পমনস্ক, বহুমুখী প্রতিভাধর, কিন্তু সংসারের কাছে তিনি যেমন অনুপস্থিত থাকতেন, ঠিক তেমনই স্ত্রী কাদম্বরীর জটিল অন্তর্জগত বুঝে ওঠার অবকাশ তার ছিল না; আবার জোড়াসাঁকোর মতো বিশাল পরিবারে, যেখানে অনেকে একই...

রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যকার কথোপকথন

  ১৯৩০ সালের ১৪ জুলাই আইনস্টাইন তাঁর বার্লিনের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ করেন। স্বাভাবিকভাবেই দুজন জ্ঞান নক্ষত্র যখন এক সাথে হয় , তখন গভীর আলোচনা হবেই। তাঁরাও আলোচনা করেছিলেন মানব ইতিহাসের গভীর ও জটিল কিছু বিষয় নিয়ে। আলোচনার বিষয় ছিলো সত্য , সুন্দর ও চেতনা নিয়ে। একজন জগত সেরা বিজ্ঞানী , আরেকজন অন্তর্জগত নিয়ে কাজ করার কবি। নিচে তা তুলে দেওয়া হল: রবীন্দ্রনাথ:   আপনি গণিত দিয়ে স্থাল-কাল ব্যাখ্যা করতে ব্যস্ত আছেন। আর আমি এ দেশে এসে চিরন্তন জগত ও বাস্তবতার জগত সম্বন্ধে লেকচার দিচ্ছি। আইনস্টাইন:   আপনি কি মনে করেন স্বর্গ পৃথিবী থেকে আলাদা কোনো বস্তু ? রবীন্দ্রনাথ:   না , আলাদা নয়। মানুষের আচরণেই মহাবিশ্বের রূপ ধরা পড়ে। এমন কিছু নেই যা মানুষ দিয়ে বোঝা যায় না। এ থেকে বোঝা যায় মানব সত্য মহাবিশ্বের সত্য এক। আমি এ ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার জন্যে বিজ্ঞানের একটা দিক উদাহরণ হিসেবে নিয়েছি। বস্তু ইলেকট্রন-প্রোটন দিয়ে গঠিত। যদিও আপাতদৃষ্টিতে বস্তুকে কঠিন মনে হয় , এর ভেতরটা ফাঁকা। একইভাবে মানবতা এমন অনেক স্বতন্ত্র মানুষ দিয়ে তৈরি। কিন্তু তাদের মাঝে এক ধরণের ভেতরকার যোগসূত্র আছে , যা...

ঠাকুরবাড়ির রহস্যময় ঘটনা

  ঠাকুরবাড়ির ভিতরে এমন কিছু জায়গা আছে , যেগুলো আলোয় থেকেও অদ্ভুতভাবে অন্ধকারে ডুবে থাকে। যেন আলো সেখানে গিয়ে নিজের উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে। বাড়ির পূর্বমুখী লম্বা করিডরের মাঝামাঝি এমনই একটি দাগ আছে। দিনের সবচেয়ে উজ্জ্বল রোদেও সে জায়গাটিতে দাঁড়ালে মনে হয় , তোমার ছায়াটা যেন দুটি হয়ে গেছে। একটি তোমার সঙ্গে চলে , আরেকটি একটু পেছনে দাঁড়িয়ে মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে থাকে। এই ছায়াকে বাড়ির বৃদ্ধ সেবিকা বলতেন , “ রক্ষক ছায়া। ” কে বা কাদের রক্ষক , তার উত্তর আজও অনির্বচনীয়। ঠাকুরবাড়ির সিঁড়িগুলো সাধারণ কাঠের তৈরি , কিন্তু ভোরবেলায় যখন প্রথম কেউ সেগুলো বেয়ে নামে , তখন সিঁড়ির কাঠ থেকে একটা অদ্ভুত , শুকনো শব্দ ওঠে , যেন কেউ নিঃশব্দে অনেকক্ষণ কান পেতে ছিল , আর প্রথম পায়ের শব্দে তাকে ছেড়ে দিল দীর্ঘশ্বাসের মতো। সেই দীর্ঘশ্বাসকারক সত্ত্বা কে ? মানুষ বলে , এই বাড়ির সবচেয়ে পুরোনো বাসিন্দা হলো তার নীরবতা। নীরবতাই নাকি রাতে ঘরগুলো ঘুরে দেখে , কেউ কোনো গোপন বাক্য ফেলে রেখে গেছে কিনা। উত্তরের বারান্দায় একটি পুরোনো লণ্ঠন ঝোলে , যা বহুদিন জ্বলে না। তবে কিছু রাতে , বিশেষ করে শরতের শেষ ভাগে , বলা হয় লণ্ঠনের কাচে...

নীল অন্ধকারের ঢেউ

  নীল অন্ধকারের ঢেউয়ে দুলেছি আজ নিরালায় , চাঁদের ক্ষীণ আলো ভাঙে রাতের নিঃশব্দ গহ্বরজুড়ে ; ভেসেছি স্বপ্নহারা জলের গভীর অচেনা টানে , আমার অনিদ্র দেহে ওঠে অতল স্রোতের অস্থির দোলায় আমার পরাণে আজ দহন শুধু, নোনা জলের ক্ষত , আমার নিঃশ্বাস ডোবে রাতের নিঃসঙ্গ অন্ধকারে ; সমুদ্রের উত্তাল দেহে লুকিয়ে থাকে আমার ছায়া , ঢেউয়ের অভিমানী স্পর্শে মন ভাঙে পুনর্বার অন্তহীন ক্ষত তুমি যে এলে আজ দিগন্তভরা ক্লান্তি নিয়ে , বৃষ্টিভেজা বকুলের মতো কোমল তোমার অবয়ব প্রেম আজ নির্বাসিত , শূন্য নীরব বালুর দেশে , অথচ হৃদয় আমার শোনে সমুদ্রের বলিষ্ঠ , অন্তহীন স্নায়ু-নিঃশেষ গেয়ে।

১৯৭২ সালে জিয়াউর রহমান এর লেখা ''একটি জাতির জন্ম'' :

  'একটি জাতির জন্ম ' শিরোনামে দৈনিক বাংলা পত্রিকার ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ সংখ্যায় সামরিক কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান এর লেখা এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ , ১৯৭৪ তারিখে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় লেখাটি পুনঃপ্রকাশিত হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মিঃ জিন্নাহ যে দিন ঘোষণা করলেন উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা , আমার মতে ঠিক সেদিনই বাঙালী হৃদয়ে অংকুরিত হয়েছিল বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জন্ম হয়েছিল বাঙালী জাতির। পাকিস্তানের স্রষ্টা নিজেই ঠিক সেদিনই অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজটাও বপণ করে গিয়েছিলেন এই ঢাকার ময়দানেই। এই ঐতিহাসিক নগরী ঢাকাতেই মিঃ জিন্নাহ অত্যন্ত নগ্নভাবে পদদলিত করেছিলেন আমাদের জনগণের জন্মগত অধিকার। আর এই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতেই চূড়ান্তভাবে খন্ড বিখন্ড হয়ে গেলো তার সাধের পাকিস্তান। ঢাকা নগরী প্রতিশোধ নিল জিন্নাহ ও তার অনুসারীদের নষ্টামীর। প্রতিশোধ নিল যোগ্যতমভাবেই। মহানগরী ঢাকা চিরদিন ছিল মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মানবিক মুক্তি সাধ...